লুপাস-প্রায় অজানা এক রোগ by ফারহানা ফেরদৌস
বেশ
কয়েক মাস ধরেই সেতু খুব অসহায় বোধ করছে। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন
দিয়েছে। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য গ্রুপ ডিসকাশন, আর সাজেশন তৈরিতে ব্যস্ত
সবাই। কিন্তু ইদানীং সব কিছুতেই খুব ক্লান্তি অনুভব করছে সেতু। কোথায় যেন
হারিয়ে গেছে তার স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা, বিলুপ্ত হয়েছে তার চিরাচরিত
প্রফুল্লতা। ক্যাম্পাসে সিঁড়ি বেয়ে ক্লাসে ঢুকতে যেয়ে সেতু টের পেল তার
হাঁটুর তীব্র ব্যথা। অনেক কষ্ট করে বেঞ্চে বসলেও যখন ওঠার সময় হলো, তখন
উঠতে পারছিল না সে। প্রিয় বান্ধবী লিমার সাহায্যে সে যাত্রা যদিও রেহাই
পেলো, তবে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো লেখার সময় তার আঙ্গুলগুলো কেমন যেন অচল
হয়ে যাচ্ছে। হাতের আঙ্গুল কাজ করছে না। কিছুতেই ক্লাসের লেকচার তুলতে পারলো
না সে। একই সঙ্গে টানা জ্বর আর মাথার তীব্র ব্যথা, আসলে কেমন যেন অচেনা
লাগছে নিজের এই চিরচেনা শরীরটাকে। বেশ ক’মাস ধরেই শরীরটা তার বিরুদ্ধে টানা
হরতাল কর্মসূচিতে লিপ্ত হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, দুপুরের যেই প্রখর
সূর্য্যালোক যখনই গায়ে লাগছে, সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখের চামড়া গোলাপি র্যাশে
ভরে যাচ্ছে। শুধু মুখই নয় বরং বাহু, হাত, পায়ের থাই, উন্মুক্ত সব জায়গায়
গোলাপি র্যাশের আঁচড়। দেখে মনে হয় বুঝি এইমাত্র সুন্দরবন থেকে নেকড়ে বাঘের
সঙ্গে যুদ্ধ করে বের হয়েছে সে। আঘাতে আঘাতে তার শরীরে নেকড়ের আঁচড় আর
প্রচণ্ড ব্যথা সব জায়গায়। তাহলে কি কোন ভয়াবহ রোগের আক্রমণে পড়তে যাচ্ছে
সে? আতঙ্কিত হলো সেতু। হিমশীতল একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল রক্তের মাঝে।
বস্তুুত, সেতু যে রোগটির আক্রমণে পড়েছে এর নাম ঝুংঃবসরপ খঁঢ়ঁং
ঊৎুঃযড়সধঃঁংঁং। ঝখঊ বা লুপাস নামেই পরিচিত। এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যা
প্রধানত নারীদের মাঝেই (১৫-৫৫ বছর) দেখা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লুপাস
রোগের সঙ্গে জনসাধারণের খুব বেশি পরিচয় নেই। কিন্তু পৃথিবীর উন্নত
দেশগুলোর জনগণ ইতিমধ্যে লুপাস সম্পর্কে সচেতন। তারা জানে এ রোগের লক্ষণ, আর
প্রতিকারের নানাদিক সম্বন্ধে। লুপাস- ভয়ের কিছু নেই ‘লুপাস’ একটি গ্রীক
শব্দ, যার অর্থ হলো ‘নেকড়ে’। এ রোগে শরীরের ইমিউন সিস্টেম অতিরিক্ত কার্যকর
হয়ে যায়। শরীর তার নিজের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। মানব শরীরের যে কোন
অঙ্গে লুপাস আক্রমণ করতে পারে। সাধারণত মহিলাদের মাঝেই লুপাস-এর প্রকোপ
বেশি দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী লুপাস সম্পর্কে গণসচেতনতা বাড়াতে ২০০৪ সাল থেকে
প্রতিবছর ১০ই মে বিশ্ব লুপাস দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ২০১২ সাল থেকে
বাংলাদেশে প্রতিবছর লুপাস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ (খঋই)-এর উদ্যোগে বাংলাদেশ
রিউম্যাটোলজি সোসাইটি (ইজঝ) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল
বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউম্যাটোলজি বিভাগের যৌথ সহযোগিতায় বিশ্ব লুপাস দিবস
পালিত হয়ে আসছে। লুপাসের উপসর্গ অন্যান্য সাধারণ রোগের সঙ্গে
সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় চিকিৎসকদের পক্ষে এ রোগ নিরূপণ বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এই রোগের কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষণ রয়েছে। অনেকদিন ধরে জ্বর, নাকের দুই পাশে
লাল চাকা হওয়া, শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাল রংয়ের অথবা গোল গোল চাকা হওয়া,
অতিরিক্ত চুল পড়া, গিরায় ব্যথা, রক্ত শূন্যতা, মুখের তালুতে ঘা হওয়া, কিছু
ক্ষেত্রে ঠাণ্ডা পানিতে হাত রাখলে হাতের রংয়ের পরিবর্তন হওয়া প্রথমে সাদা,
তারপর নীল, তারপর লাল, ক্লান্তি বা অবসাদ লাগা। এই রোগ যখন খারাপের দিকে
যায়, তখন বেশকিছু উপসর্গ দেখা যায়। শ্বাসকষ্ট হওয়া, মুখে, শরীরে বা পেটে
পানি আসা, ডায়রিয়া, বমি অথবা পেটব্যথা হওয়া, বার বার বাচ্চা নষ্ট হওয়া, কোন
একটি পা ফুলে গিয়ে ব্যথা হওয়া, রক্ত শূন্যতা হওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
ইত্যাদি। নিজেকে সতেজ, সবল, কর্মক্ষম ও প্রফুল্ল রাখতে লুপাস রোগীদের কিছু
কাজ অবশ্যই করা দরকার। সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিন ৩০ মিনিট সহনীয় পর্যায়ের
হাঁটা, অথবা ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে কোন অ্যারোবিক ব্যায়াম করা অবশ্য
প্রয়োজনীয়। যেহেতু লুপাস রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, সেহেতু ইনফেকশনে
আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই লুপাস ডাক্তারের পরামর্শে
প্রয়োজনীয় টিকাগুলো নিয়ে নিতে হবে। নিয়ম করে রক্তের-প্রস্রাবের পরীক্ষাগুলো
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে। প্রয়োজনে রক্তচাপ মাপতে হবে। লুপাস
রোগীর ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা উচিত। প্রতিদিন দাঁত ও মাড়ি ব্রাশ ও
ফ্লস করতে হবে। ধূমপান থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। ঠাণ্ডা ও ধুলা-বালি
এড়িয়ে চলতে হবে। খাদ্য তালিকায় কম লবণ, কম ফ্যাটযুক্ত খাবার, পর্যাপ্ত দুধ,
ডিম, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস খেতে হবে। ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার যেমন-
দুধ, দুগ্ধজাত পনির, ছানা, বাটার, ভিটামিন ই, কলিজা, এবং আমিষ খাবার বেশি
রাখতে হবে। মাছের তেল রোগীদের জন্য খুব কার্যকর। প্রতি রাতে এক গ্লাস দুধ
পান করা অবশ্যই প্রয়োজন। লুপাস রোগীদের অবশ্যই সূর্যের আলো ও অত্যধিক তাপ
থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করতে হবে।
লেখক: সেক্রেটারি জেনারেল, লুপাস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ
লেখক: সেক্রেটারি জেনারেল, লুপাস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ
No comments