‘ভুল’ by আবুল হায়াত
ভুল কার না হয়!
অবশ্যি অনেকে বলে থাকেন, আমি কখনো ভুল করি না। সেটাও ভুল। কারণ, মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়। সেটা জেনেবুঝেই হোক বা না জেনেই হোক।
ভুল করে অনেকে পার পেয়ে যান, আবার অনেককে গুনতে হয় ভারী মাশুল। আবার কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা অন্যের ভুলের ফসল অনায়াসে নিজের ঘরে তুলতে ওস্তাদ। প্রকৃতির প্রতিশোধের কারণে আবার কখনো তাঁদের এই অন্যায়ের ফলও ভোগ করতে হয়।
আচ্ছা শুনুন, ছোটবেলায় স্কুলে একটা ভুল করেছিলাম এবং হাতে হাতে তার শাস্তি পেয়েছিলাম কীভাবে।
পণ্ডিত স্যারের ক্লাসে ‘ভুল’ বানান লিখেছিলাম ‘ভূল’। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তখন আমি। অবশ্য এ ভুলটা তখন আমি একা করিনি। সাথি ছিল আরও কয়েকজন। হাতে হাতে শাস্তি। স্যার বোর্ডে একটা বাক্য লিখে দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন ওই বাক্যটা দশবার লিখে দেখাতে হবে তাঁকে। বাক্যটা ছিল এমন-
‘ভুল বানান লিখিতে জীবনে কোনো দিন ভুল করিয়াও ভুল করিব না।’
তারপর মনে হয় না আর কোনো দিন এ ভুল করেছি আমি।
তবে নানান ভুল তো হরদম হয়েই থাকে। ইদানীং একই ভুল আমার নিয়মিত হচ্ছে। সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর মনে পড়ে হয় মোবাইল ফেলে এসেছি, না হয় হাতঘড়ি, না হয় নাটকের স্ক্রিপ্ট।
এগুলো নাকি বুড়ো হওয়ার লক্ষণ। তা বুড়ো তো হয়েছিই। একাত্তর চলছে না? কিন্তু ভুল জওয়ানকালেও হয়।
শুনুন তাহলে—তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। আমার এক বন্ধু খুলনায় থাকত। তাকে চিঠি লিখে জিপিওতে গিয়ে খাম কিনে ঠিকানা লিখে পোস্ট করে রাস্তায় বেরিয়ে এসে পকেট হাতড়ে দেখি, বাবার সদ্য পাঠানো এক শ টাকার নোটটা চিঠির সঙ্গে বন্ধুর কাছে পোস্ট করে দিয়েছি।
তারপরের ঘটনা আর কী বলব! পোস্ট অফিসে ফিরে গিয়ে তাদের হাতে-পায়ে ধরে মেলা রকম প্রমাণ দিয়ে বের করতে পেরেছিলাম টাকাটি। আসলে নিরুপায় ছিলাম আমি, কারণ ওই এক শটি টাকা ছিল সারা মাসের খরচ।
এ ধরনের ভুলের আরেক ঘটনা শুনেছি অবশ্য আমি। ভদ্রলোক দুটো চিঠি লিখেছেন—একটি বাবাকে, অন্যটি প্রেমিকাকে। তারপর পোস্ট করার সময় হয়ে গেছে উল্টোপাল্টা। বাবা পেলেন প্রেমিকার চিঠি আর প্রেমিকা বাবারটা।
ভুল নিয়ে কিন্তু বেশ চমৎকার কটা গানও আছে, শুনেছেন নিশ্চয়। যেমন ধরেন একটা আছে-উৎপলা সেনের কণ্ঠে, ‘আমি ভুল তো করিনি ভালোবেসে’ একেবারে খাঁটি কথা। তারপর ধরেন বিখ্যাত আর একটা গান, ‘ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল।’
ফল কী হয়েছিল আমার অবশ্য জানা নেই তা।
ভুল নিয়ে কিন্তু বেশ চমৎকার কটা গানও আছে, শুনেছেন নিশ্চয়। যেমন ধরেন একটা আছে—উৎপলা সেনের কণ্ঠে, ‘আমি ভুল তো করিনি ভালোবেসে’ একেবারে খাঁটি কথা। তারপর ধরেন বিখ্যাত আর একটা গান, ‘ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল।’ সুজাতা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অতল জলের আহ্বান চলচ্চিত্রের বিখ্যাত গান এটা। আর সেই গানটা নিশ্চয় মনে আছে। অগ্নিপরীক্ষা সিনেমায় আমাদের হৃদয়ে মোচড়মারা নায়িকা সুচিত্রা সেনের ঠেঁাটে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, ‘যদি ভুল করে ভুল মধুর হলো—মন কেন মানে না, কেন একটু চাওয়া দোলায় আমায়, কেউ তা জানে না!’
অসাধারণ গান! আমাদের মতো বুড়োদের হাড়কে এখনো দুলিয়ে যায় এ গানটা। তা দোলাক, তাতে কার কী! একটা চুটকি শোনেন এবার।
এক ভদ্রলোক ইংল্যান্ড থেকে নিউইয়র্ক গিয়েছেন একটা সেমিনারে যোগ দিতে। চার দিন পর সেমিনার শেষ হলে স্ত্রীও সেখানে যোগ দেবেন, এমনই কথা ছিল। তারপর বেড়াবেন তাঁরা।
সেমিনার শেষে স্ত্রীকে ই-মেইল পাঠালেন, ‘এখানে তোমার জন্য সবকিছু প্রস্তুত। আমি দেখেশুনে নিয়েছি। সব ঠিক আছে ডার্লিং। চলে এসো।’ ই-মেইল পাঠানোর সময় ঠিকানাটা ভুল করে ফেললেন, আর সেটা গিয়ে পৌঁছাল অন্য এক নারীর কাছে, যাঁর স্বামী মারা গেছেন মাত্র দুদিন আগে।
স্বর্গ থেকে এমন বার্তা পেয়ে তিনি হার্টফেল করেন।
আর একটি শুনুন।
এক ভদ্রলোক তাঁর পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের কাছ থেকে মুঠোফোনে একটি খুদে বার্তা পেলেন, ‘স্যার, আমি কিছুদিন ধরে আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার ওয়াইফকে ভোগ করছি। যখন খুশি তখন। যেমন খুশি তেমন করে ভোগ করছি। হঠাৎ করে আমার মধ্যে একটা অপরাধবোধ জেগে ওঠায় ক্ষমা চাইতেই এই বার্তা পাঠালাম। আমি অত্যন্ত দুঃখিত।’
বুঝতেই পারছেন- এরপর ভদ্রলোকের স্ট্রোক হয়। তিনি ভর্তি হন হাসপাতালে।
পরদিন একটু সুস্থ হলে মুঠোফোন খুলে দেখেন সেই ভদ্রলোক আরেকটি খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন।
‘স্যার, আমি অতীব দুঃখিত। কালকের খুদে বার্তায় একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। শব্দটা ওয়াইফ হবে না স্যার, ওটা হবে ওয়াইফাই।’
মাননীয় অর্থমন্ত্রীও বাজেট বক্তৃতায় এমন একটা ভুল করলেন। ‘কতিপয় পণ্যের উৎসে করের পরিধি বৃদ্ধি ও করহার বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে...এখানে উৎসে শব্দটা ভুল হয়েছে। আমি উৎসে কর শব্দটি বাদ দেওয়ার অনুরোধ করছি।’
তাঁর এ ভুলে কারও স্ট্রোক করেনি বটে, তবে হৃদয়ে নাড়া পড়েছিল অনেকেরই, তাতে সন্দেহ নেই।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
অবশ্যি অনেকে বলে থাকেন, আমি কখনো ভুল করি না। সেটাও ভুল। কারণ, মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়। সেটা জেনেবুঝেই হোক বা না জেনেই হোক।
ভুল করে অনেকে পার পেয়ে যান, আবার অনেককে গুনতে হয় ভারী মাশুল। আবার কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা অন্যের ভুলের ফসল অনায়াসে নিজের ঘরে তুলতে ওস্তাদ। প্রকৃতির প্রতিশোধের কারণে আবার কখনো তাঁদের এই অন্যায়ের ফলও ভোগ করতে হয়।
আচ্ছা শুনুন, ছোটবেলায় স্কুলে একটা ভুল করেছিলাম এবং হাতে হাতে তার শাস্তি পেয়েছিলাম কীভাবে।
পণ্ডিত স্যারের ক্লাসে ‘ভুল’ বানান লিখেছিলাম ‘ভূল’। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তখন আমি। অবশ্য এ ভুলটা তখন আমি একা করিনি। সাথি ছিল আরও কয়েকজন। হাতে হাতে শাস্তি। স্যার বোর্ডে একটা বাক্য লিখে দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন ওই বাক্যটা দশবার লিখে দেখাতে হবে তাঁকে। বাক্যটা ছিল এমন-
‘ভুল বানান লিখিতে জীবনে কোনো দিন ভুল করিয়াও ভুল করিব না।’
তারপর মনে হয় না আর কোনো দিন এ ভুল করেছি আমি।
তবে নানান ভুল তো হরদম হয়েই থাকে। ইদানীং একই ভুল আমার নিয়মিত হচ্ছে। সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর মনে পড়ে হয় মোবাইল ফেলে এসেছি, না হয় হাতঘড়ি, না হয় নাটকের স্ক্রিপ্ট।
এগুলো নাকি বুড়ো হওয়ার লক্ষণ। তা বুড়ো তো হয়েছিই। একাত্তর চলছে না? কিন্তু ভুল জওয়ানকালেও হয়।
শুনুন তাহলে—তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। আমার এক বন্ধু খুলনায় থাকত। তাকে চিঠি লিখে জিপিওতে গিয়ে খাম কিনে ঠিকানা লিখে পোস্ট করে রাস্তায় বেরিয়ে এসে পকেট হাতড়ে দেখি, বাবার সদ্য পাঠানো এক শ টাকার নোটটা চিঠির সঙ্গে বন্ধুর কাছে পোস্ট করে দিয়েছি।
তারপরের ঘটনা আর কী বলব! পোস্ট অফিসে ফিরে গিয়ে তাদের হাতে-পায়ে ধরে মেলা রকম প্রমাণ দিয়ে বের করতে পেরেছিলাম টাকাটি। আসলে নিরুপায় ছিলাম আমি, কারণ ওই এক শটি টাকা ছিল সারা মাসের খরচ।
এ ধরনের ভুলের আরেক ঘটনা শুনেছি অবশ্য আমি। ভদ্রলোক দুটো চিঠি লিখেছেন—একটি বাবাকে, অন্যটি প্রেমিকাকে। তারপর পোস্ট করার সময় হয়ে গেছে উল্টোপাল্টা। বাবা পেলেন প্রেমিকার চিঠি আর প্রেমিকা বাবারটা।
ভুল নিয়ে কিন্তু বেশ চমৎকার কটা গানও আছে, শুনেছেন নিশ্চয়। যেমন ধরেন একটা আছে-উৎপলা সেনের কণ্ঠে, ‘আমি ভুল তো করিনি ভালোবেসে’ একেবারে খাঁটি কথা। তারপর ধরেন বিখ্যাত আর একটা গান, ‘ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল।’
ফল কী হয়েছিল আমার অবশ্য জানা নেই তা।
ভুল নিয়ে কিন্তু বেশ চমৎকার কটা গানও আছে, শুনেছেন নিশ্চয়। যেমন ধরেন একটা আছে—উৎপলা সেনের কণ্ঠে, ‘আমি ভুল তো করিনি ভালোবেসে’ একেবারে খাঁটি কথা। তারপর ধরেন বিখ্যাত আর একটা গান, ‘ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল।’ সুজাতা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অতল জলের আহ্বান চলচ্চিত্রের বিখ্যাত গান এটা। আর সেই গানটা নিশ্চয় মনে আছে। অগ্নিপরীক্ষা সিনেমায় আমাদের হৃদয়ে মোচড়মারা নায়িকা সুচিত্রা সেনের ঠেঁাটে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, ‘যদি ভুল করে ভুল মধুর হলো—মন কেন মানে না, কেন একটু চাওয়া দোলায় আমায়, কেউ তা জানে না!’
অসাধারণ গান! আমাদের মতো বুড়োদের হাড়কে এখনো দুলিয়ে যায় এ গানটা। তা দোলাক, তাতে কার কী! একটা চুটকি শোনেন এবার।
এক ভদ্রলোক ইংল্যান্ড থেকে নিউইয়র্ক গিয়েছেন একটা সেমিনারে যোগ দিতে। চার দিন পর সেমিনার শেষ হলে স্ত্রীও সেখানে যোগ দেবেন, এমনই কথা ছিল। তারপর বেড়াবেন তাঁরা।
সেমিনার শেষে স্ত্রীকে ই-মেইল পাঠালেন, ‘এখানে তোমার জন্য সবকিছু প্রস্তুত। আমি দেখেশুনে নিয়েছি। সব ঠিক আছে ডার্লিং। চলে এসো।’ ই-মেইল পাঠানোর সময় ঠিকানাটা ভুল করে ফেললেন, আর সেটা গিয়ে পৌঁছাল অন্য এক নারীর কাছে, যাঁর স্বামী মারা গেছেন মাত্র দুদিন আগে।
স্বর্গ থেকে এমন বার্তা পেয়ে তিনি হার্টফেল করেন।
আর একটি শুনুন।
এক ভদ্রলোক তাঁর পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের কাছ থেকে মুঠোফোনে একটি খুদে বার্তা পেলেন, ‘স্যার, আমি কিছুদিন ধরে আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার ওয়াইফকে ভোগ করছি। যখন খুশি তখন। যেমন খুশি তেমন করে ভোগ করছি। হঠাৎ করে আমার মধ্যে একটা অপরাধবোধ জেগে ওঠায় ক্ষমা চাইতেই এই বার্তা পাঠালাম। আমি অত্যন্ত দুঃখিত।’
বুঝতেই পারছেন- এরপর ভদ্রলোকের স্ট্রোক হয়। তিনি ভর্তি হন হাসপাতালে।
পরদিন একটু সুস্থ হলে মুঠোফোন খুলে দেখেন সেই ভদ্রলোক আরেকটি খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন।
‘স্যার, আমি অতীব দুঃখিত। কালকের খুদে বার্তায় একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। শব্দটা ওয়াইফ হবে না স্যার, ওটা হবে ওয়াইফাই।’
মাননীয় অর্থমন্ত্রীও বাজেট বক্তৃতায় এমন একটা ভুল করলেন। ‘কতিপয় পণ্যের উৎসে করের পরিধি বৃদ্ধি ও করহার বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে...এখানে উৎসে শব্দটা ভুল হয়েছে। আমি উৎসে কর শব্দটি বাদ দেওয়ার অনুরোধ করছি।’
তাঁর এ ভুলে কারও স্ট্রোক করেনি বটে, তবে হৃদয়ে নাড়া পড়েছিল অনেকেরই, তাতে সন্দেহ নেই।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
No comments