দক্ষিণের মতো আমি দেউলিয়া নই -বিশেষ সাক্ষাৎকারে : আনিসুলহক by মিজানুর রহমান খান
ঢাকার নতুন দুই মেয়র পদে
দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস পূর্ণ হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে জনবান্ধব, পরিচ্ছন্ন ও
গতিশীল নগর গড়ে তোলার অঙ্গীকারের পথে তাঁরা কতটা এগোলেন, নগরবাসী কী পেল,
তা জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁদের মুখোমুখি হন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো : মেয়র হয়ে কোনো স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে কি না?
আনিসুল হক : না। গত ৪২
দিনে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে কখনো রাত ১১টা পর্যন্ত অফিস করেছি। এই সময়ে যত
বেশি ফাইলে সই করেছি, তত সই সারা জীবনে করিনি। আমি বিশ্বাস করি, একজন
প্রধান নির্বাহীর হাতে এ ধরনের কাজ থাকা উচিত নয়। যদিও বলা হয়ে থাকে ৫৬ রকম
সংস্থা আছে, কিন্তু এখন আমি মনে করি মেয়রের পক্ষে কিছু কাজ করা সম্ভব।
দেখার মতো করে পরিবর্তনটা আসতে তিন-চার বছর লাগবে।
প্রথম আলো : অগ্রাধিকারগুলো কী?
আনিসুল হক : পরিচ্ছন্ন
নগর সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে অনেক কিছু পড়ে। বেশির ভাগ পার্ক ও
হ্রদ আমাদের নয়। গুলশানের সব লেক রাজউক দেখে। অথচ গঠনতান্ত্রিকভাবে তার কাজ
এটা বানিয়ে হস্তান্তর করা। সুতরাং বাস্তবতা ও জনধারণার সঙ্গে বৈপরীত্য
আছে। খাল, বিল, নর্দমা, পানি, বিলবোর্ড—সব ডিসিসির, আসলে তা নয়।
এক-তৃতীয়াংশ বিলবোর্ড করপোরেশনের নয়, আর্মি, নেভি, রাওয়া ক্লাব, সড়ক ও
সেতু মন্ত্রণালয়ও বিলবোর্ড বসায়।
প্রথম আলো : তাহলে কীভাবে অবৈধ বিলবোর্ড সরবে?
আনিসুল হক : আমি মনে
করি, এটা সম্ভব। ইতিমধ্যে আড়াই শ বিলবোর্ডের ওপরের ছাল তোলা হয়েছে। ক্রেন
দিয়েও দিনে তিনটির বেশি তোলা যায় না। দু-এক জায়গায় বাধা এসেছে, কিন্তু
বিস্ময়করভাবে ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতা-কর্মীর বাধা পাইনি, খুব নিচের
পর্যায়ে এক-আধটু আপত্তি তুলেছে। বিলবোর্ড সমিতি, যার ৫০০ সদস্য, তাদের
বলেছি, আপনাদের সব অবৈধ বিলবোর্ড তুলে নিতে হবে। ১ জুলাই তাদের সম্মেলন
হবে। বিজ্ঞাপনদাতাদের চিঠি দিয়েছি।
প্রথম আলো : প্রথম ১০০ দিনে কী করে দেখাবেন বলে আশা করেন? জবাবদিহির স্বার্থে নির্দিষ্ট করে বলুন।
আনিসুল হক : ১.
তেজগাঁও, গাবতলী ও মহাখালীর যন্ত্রণাদায়ক ট্রাক পার্কিং অপসারণ করব। ২.
ডিএনসিসির আওতাধীন যেকোনো স্থান থেকে বাসযাত্রী ওঠানামায় শৃঙ্খলা আনব। ৩.
বাসমালিকদের সঙ্গে আলাপ করে নতুন বাস নামাব। ৪. কারওয়ান বাজারের পাইকারি
বাজারকে মহাখালী নিতে শক্তিশালী উদ্যোগ নেব।
প্রথম আলো : এটাই কি যথেষ্ট?
আনিসুল হক : আগামী ৩১
ডিসেম্বরের মধ্যে ১. কারওয়ান বাজার অপসারণ চূড়ান্ত করব। ২. রাস্তাঘাটের
বিশাল আবর্জনার স্তূপ (তিন-চার বছরের মধ্যে বর্জ্য হবে বড় সম্পদ) ৭০ শতাংশ
পর্যন্ত হ্রাস করব। ৩. নগর হবে বেশ পরিচ্ছন্ন। ৪. মহাখালীর
বাসস্ট্যান্ডের জট অনেকটা কমাব। ৫. আগামী শীতের মধ্যে নগর সবুজ হয়ে ওঠা
আপনার চোখে পড়বে (৬০ শতাংশ শেষ হবে ২০১৮ সালে), বিশেষজ্ঞরা উদয়স্ত
পরিশ্রম করছেন। ৬. নগর হবে অবৈধ বিলবোর্ডমুক্ত। ৭. হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল
শিশুদের জন্য ১৫টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করব। ৮. ডিএনসিসির জন্য সুষ্ঠু প্রশাসন
গড়ব।
প্রথম আলো : কিন্তু মানুষের বড় ভোগান্তি ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, যানজট ও জলাবদ্ধতায়। সে বিষয়ে আপনি কবে কী করবেন, সেটা বলুন?
আনিসুল হক : ওয়াসাসহ
অনেক সংস্থা রাস্তা কাটে। বর্ষায় বেশি রাস্তা কাটার অভিযোগ অনেকটা
কল্পকাহিনি। কারণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্থ জোগাতে সরকার ও দাতা সংস্থাসহ
বহু ধরনের সংস্থা একসঙ্গে জড়িত থাকে। তাই টাকা ছাড়ে হেরফের ঘটার প্রভাব
সড়ক নির্মাণ বা মেরামতে পড়ে। তদুপরি ১৫ মের পরে রাস্তা না কাটার যে
নির্দেশনা আছে, ওয়াসা তা মানে না। তারাও ২০ শতাংশের বেশি রাস্তা খোঁড়ে
না, কিন্তু সেটাই বেশি চোখে পড়ে। এ মুহূর্তে তারা নাখালপাড়াসহ দু-চারটি
স্থানে কাটছে। চাপের মুখে তারা নাখালপাড়ায় এক মাসের কাজ ১০ দিনে শেষ করছে।
প্রথম আলো : অলিগলির খানাখন্দ দূর হবে, নাকি এটা ঢাকাবাসীর নিয়তি?
আনিসুল হক : কিছু বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। দু-চার বছরের মধ্যে সুফল মিলবে।
প্রথম আলো : আপনি জলাবদ্ধতা পরিদর্শনে যাচ্ছেন। এটা কি লোক দেখানো?
আনিসুল হক : না, এটা
শৌখিন পরিদর্শন নয়, মূলত আমি যেখানেই যাচ্ছি সেখানে একটি স্থানীয়ভাবে
সমাধান দিয়ে আসছি। আমার সঙ্গে রাজউক ও ওয়াসার কর্মকর্তারা থাকছেন। কিন্তু
জলাবদ্ধতা কবে যাবে, তার উত্তর আমার জানা নেই, এটা কমবেই, তা জানি। একটি
নামকরা হাউসিং কোম্পানি একটি খালের মাথা আটকে দিয়েছে, তাদের খাল কেটে দিতে
বলেছি, অন্যথায় চাপ দেব। মিরপুর ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৬২টি ছোট বাড়ি ভাঙা
হচ্ছে, এর মধ্যে ২১টি ভাঙার কাজ শেষ। হ্যাঁ, এটা দুরূহ কাজ। আমি শুধু
কমিশনারকে বলেছি, ভাই, কখনো যেন না শুনি যে আপনার গায়ে লেগেছে বলে আপনি
কারও স্থাপনা ভেঙে দিয়েছেন।
প্রথম আলো : টাকা পাবেন কোথায়? তহবিল নাকি শূন্য—
আনিসুল হক : অল্প কিছু ছিল।
প্রথম আলো : টাকার অঙ্কটা প্রকাশ করুন।
আনিসুল হক : না, সেটা
গোপনীয়। ভাগ হওয়ার সময় উত্তরের কোনো টাকা ছিল না। গত তিন বছরে কিছু
জমেছে, দক্ষিণের কাছে আমরা এখনো প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাই।
প্রথম আলো : টাকার অঙ্কে কে শক্তিশালী?
আনিসুল হক : দুজনেই
গরিব তবে দক্ষিণের চেয়ে উত্তর খেয়ে-পরে ভালো আছে। দক্ষিণের প্রশাসকেরা খুব
অপরিকল্পিত কাজ করেছেন, তাঁরা ৫০০ কোটি টাকার কার্যাদেশ দিয়েছেন,
ইচ্ছেমতো দোকান, ভবন তৈরি করেছেন। উত্তরেরও দেনা আছে, তবে তা হয়তো সোয়া শ
কোটি টাকার। আরেকটি দুঃখ হলো, ডিসিসি সম্পর্কে সুনাম শুনিনি। মানুষ বলে
দুর্নীতির আখড়া, আমি বলি দুর্নীতির সংক্রমণ ঘটেছে। কানে এসেছে, নেই
প্রকল্প পাস হয়েছে, বিলও শোধ হয়েছে।
প্রথম আলো : দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি চান কি না?
আনিসুল হক : অবশ্যই চাই। দক্ষিণের মতো আমরা দেউলিয়া নই। তবে আমরাও সরকারের অর্থের ওপর বিরাটভাবে নির্ভরশীল।
প্রথম আলো : বাজেট কেমন হবে, কর বাড়াবেন?
আনিসুল হক : না। দুই হাজার কোটি টাকার বাজেটে নিজস্ব জোগান আট শ কোটির মতো থাকবে।
প্রথম আলো : প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভোটের পরে কী কথা হলো?
আনিসুল হক : আমি
প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন, আমার প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন আছে। আমার পক্ষে
সম্ভব সবকিছুই করব, নিজেকে যাতে তাঁর বিশ্বাসের যোগ্য রাখতে পারি। আমার
সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে ঢাকার রূপান্তরকরণের চেষ্টা চালাব। দুবার তাঁর সঙ্গে
কথা হয়েছে। অন্যদের সঙ্গে অল্প সময়ের, দ্বিতীয়বার একান্তে এক ঘণ্টারও বেশি,
সেখানে তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আর তহবিলের বিষয়ে দক্ষিণের মতো নাজুক
অবস্থায় কিন্তু আমরা নেই।
প্রথম আলো : সিটি করপোরেশনে অনেক অনেক বদনাম। কীভাবে ঘোচাবেন?
আনিসুল হক : ইতিমধ্যে
দুজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী প্রকৌশলী বরখাস্ত ও আরও দুজন প্রভাবশালী কর্মীর
পদাবনতি ঘটেছে। ডিএনসিসি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা হিসেবে জনমনে ছাপ আছে।
সুতরাং ডিএনসিসির পুনর্গঠন আমার অগ্রাধিকার। যথাসময়ে অফিসে আসতে ও মানুষকে
উত্তম সেবা দিতে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে।
প্রথম আলো : পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছাড়াই গুলশান, বনানী গড়ে উঠল। কী করবেন?
আনিসুল হক : রাজউক এটা
পরিকল্পনা করেনি। ওয়াসা এখন একটি মহাপরিকল্পনা করেছে। এখন আমরা ২৪০ কোটি
টাকার একটি বড় তহবিল পেয়েছি। এটা কুয়েত ফান্ড হিসেবে পরিচিত।
প্রথম আলো : শহরের যত্রতত্র অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এ সময়ের মধ্যে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
আনিসুল হক : সম্প্রতি
আমি মার্কিন দূতাবাসের সামনের অবৈধ কাঠামো, দপ্তর ভেঙে দিয়েছে। ঢাকা শহর
তো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাস। তাঁদের চাপ আসা এখনো শুরু হয়নি, সেটা এলে
বুঝব, কত দূর কী পারব। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য এখনো আমার ভালো
প্রস্তুতি নেওয়া বাকি। তবে এটা না বললেই নয় যে নগর গড়তে নাগরিকের অংশগ্রহণ
লাগবেই, এর ঘাটতি থাকলে যত কিছুই করি, তা টেকসই হবে না।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
আনিসুল হক : ধন্যবাদ।
No comments