সমস্যা জটিল—স্থায়ী সমাধান কাম্য by সৈয়দ আবুল মকসুদ
আমাদের
অনেক প্রবীণ নেতার রাজনৈতিক জ্ঞান অসামান্য ও প্রজ্ঞা প্রচুর,
দূরদর্শিতারও শেষ নেই। কিন্তু মালয়েশিয়া সম্পর্কে তাঁদের যে ধারণা, তা
অগভীর। শুধু তাঁরাই নন, অনেক বাম তাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদ পর্যন্ত
মালয়েশিয়াকে উন্নয়নের রোল মডেল বা আদর্শ মনে করেন, তা তাঁদের রচিত
উপসম্পাদকীয় রচনা থেকে জানা যায়। তত্ত্বগত ও বৈপ্লবিক বিদ্যায় তাঁরা
প্লেখানভ বা ট্রটস্কির চেয়ে কিঞ্চিৎ কম হতে পারেন, কিন্তু মালয়
দ্বীপপুঞ্জের মূল জায়গাটা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা খুব স্পষ্ট, তা মনে হয় না।
কোনো দেশের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস সামগ্রিকভাবে
পর্যালোচনা না করে সেই দেশের একটি মস্ত বড় উঁচু দালান দেখে তার তারিফ করা ও
তাকে রোল মডেল বানানো স্রেফ বোকামি। আমাদের অনেক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও
উপসম্পাদকীয় রচনা লেখকেরা সারল্যবশত তা করছেন। যেমন, দুই দিন আগে এক মাননীয়
মন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন,
ন্যায়বিচার কোন ছাই, মাহাথির আমাদের আদর্শ, তাঁর পথই আমাদের পথ, তাঁর
দেখিয়ে দেওয়া পথেই আমরা এগিয়ে যাব, আমাদের এই দুর্বার গতিতে যাত্রা কে
রুধিবে দিয়ে বালির বাঁধ। তাঁর এই বার্তা টিভির পর্দা থেকে ধ্বনিত হওয়ার পর
আমার মনে পড়ল একদা গুলিস্তান-তোপখানা রোড থেকেই ঘোষিত হতে শুনেছি:
চেয়ারম্যান মাও আমাদের চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যান মাওয়ের পথই আমাদের পথ।
মাননীয় মন্ত্রী সেই সময় মালয় নেতা মাহাথিরের জয়ধ্বনি দিলেন, যখন
মালয়েশিয়ামুখী বাঙালি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা মালয় উপকূলে নৌকায়
দানাপানি না পেয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। তাদের উপকূল থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে
দূর দূর করে।
মাহাথিরীয় পথ বাঙালির একাত্তরে গৃহীত পথের সম্পূর্ণ বিপরীত পথ। একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া-টিক্কা-ফরমান যে অর্থ ব্যয় করেছেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ না করলে ওই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে বড় বড় দালানকোঠা বানানো যেত। দালানকোঠা এক বস্তু আর গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আর এক জিনিস। আমরা গণহত্যা চাইনি, গণতন্ত্র চেয়েছি। মাহাথিরের যে পথ, ওই পথে রাস্তাঘাট-দালানকোঠা হয়, সেখানে কোনো দিনও একজন বিশ্বমানের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা বা সত্যসাধক হতে পারবেন না।
মালয়েশিয়ার আজকের যে আর্থসামাজিক উন্নতি, তার পেছনে বাঙালি অভিবাসী শ্রমিকদের অবদান যে কতটা, তা মালয়ের শাসকেরাই ভালো জানেন, বাংলাদেশের শাসকেরা নন। আজ বাঙালি ও রোহিঙ্গা শ্রমিকবোঝাই নৌকা তাঁরা তীরে ভিড়তে দিচ্ছেন না। অথচ আজকের তাঁদের ঐশ্বর্যের পেছনে লাখ লাখ বাঙালি শ্রমিকের ঘাম অপরিমেয়। এখনকার মতো অতীতেও বাংলাদেশিরা সেখানে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করতে গেছে, ভিক্ষা করতে যায়নি। ওরা সেখানে গিয়ে উঁচু উঁচু দালান বানিয়েছে, রাস্তায় বসে ইট ভেঙে খোয়া বানিয়েছে, রাস্তাঘাট বানিয়েছে, পামের বাগানে কাজ করেছে বলে অত পাম অয়েল তারা আমাদের দেশে রপ্তানি করতে পেরেছে, রাবার বাগানে কাজ করেছে বলে রাবার ও রাবারজাত দ্রব্য রপ্তানি করে বস্তা বস্তা রিংগিত রোজগার করতে পেরেছে, নারকেলের বাগান ও গভীর অরণ্যে কাজ করেছে বলে টিম্বার রপ্তানি করতে পারছে। হতভাগ্য বাংলাদেশি, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও ভারতীয় শ্রমিকেরা মালয়কে দিয়েছে অনেক সমৃদ্ধি।
পৃথিবীর অভিবাসনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বৈধ ও অবৈধ দুভাবেই অভিবাসন হয়ে থাকে। বরং অবৈধভাবেই বেশি অভিবাসন হয়। যে দেশে জনসংখ্যা বেশি এবং রয়েছে বেকারত্ব, সেখান থেকেই প্রধানত অদক্ষ যুবকেরা গিয়ে থাকে এমন কোনো দেশে, যেখানে শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে অথবা যেখানকার অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত ভালো। তা ছাড়া, কোনো দেশে কোনো জাতিসত্তার মানুষ অবিচারের শিকার হলে তাদের অনেকে অন্য দেশে পালিয়ে যায়। তুরস্ক থেকে যেমন কুর্দিরা গেছে জার্মানিতে। সেভাবেই রোহিঙ্গারা হয় বাংলাদেশে অথবা মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে যাতায়াত করে। তারা গিয়ে বসে থাকে না, শ্রম বিক্রি করে জীবিকার জন্য রোজগার করে অর্থ। তাদের শ্রম ওই সব দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে।
আশির দশকের শুরুতে আমি যে অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকতাম, সেখানে ছিল আটটি ফ্ল্যাট। তার পাঁচটিতে থাকতেন কয়েকজন মালয়েশীয় ছাত্রছাত্রী। তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে পড়তে এসেছিলেন। অনগ্রসর মালয়েশিয়ায় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি ছিল না। তাই মালয় সরকার বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে বৃত্তি দিয়ে ছেলেমেয়েদের পাঠাত। ওদের আমন্ত্রণে আমি কয়েক দিনের জন্য মালয়েশিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেই মালয়েশিয়া আর আজকের মালয়েশিয়া এক নয়। কিছুদিন আগেই নির্বাচনের মাধ্যমে মাহাথির বিন মোহাম্মদের দল কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় এসেছে। পাহাড় কেটে রাস্তাঘাট ও বড় মসজিদ নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। আমার থাকা অবস্থায় কোরবানির ঈদ আসে। আমার সুযোগ হয়েছিল মাহাথিরের সঙ্গে নির্মীয়মাণ মসজিদে নামাজ আদায় করার। তবে সারা দিন ঘুরেও কোরবানি দেওয়ার দৃশ্য আমি কুয়ালালামপুরের কোথাও দেখিনি।
প্রথম প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমান মালয়েশিয়ার ভিত্তি স্থাপন করে যান। দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুল রাজাক ভালো শাসক ছিলেন। তাঁর ছেলেই এখন প্রধানমন্ত্রী। তারপর কয়েক বছর ছিলেন দাতুক হোসেন ওন্। তাঁর উত্তরাধিকারী মাহাথির। তিনি মালয়েশিয়াকে একটি উচ্চতায় নিয়ে যান। তাঁর অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, সাহস ও সততা বিশ্ববাসীর প্রশংসা (ও নিন্দাও) অর্জন করে। তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁরই উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে যে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করেন, তা ঘৃণার্হ। শুধু বামপন্থীদের নয়, তাঁর বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার ক্ষেত্রে তাঁর কর্মকাণ্ড খুবই অন্যায়।
তিনি কঠোর হাতে মাদক নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সেটা প্রশংসনীয়। তাঁর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষের ওপর যে নির্যাতন করেছে, তার সব খবর পৃথিবীর মানুষ কোনো দিনই জানবে না। বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের অনেকে তাঁর কারাগারে নির্মমতার শিকার হয়েছেন। তাঁর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার একটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার চুক্তি ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি মালয়েশিয়া সরকারের আমন্ত্রণে কুয়ালালামপুর যান। গভীর রাত। তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁর হোটেলের কক্ষে। হঠাৎ দুমদাম শব্দে তাঁর ঘুম যে শুধু ভাঙে তা-ই নয়, ভয়ে তিনি কাঁপতে থাকেন। টোকা দিলে দরজা তিনি নিজেই খুলে দিতেন। কিন্তু মালয়েশীয় নিরাপত্তাকর্মীরা হাতুড়ি-শাবল দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলেন। ঘরে ঢুকে তারা তৌহিদ আনোয়ারকে লাথি মারাসহ নির্মমভাবে পিটিয়ে থানায় নিয়ে যায়। কিছুই বুঝতে পারেননি তিনি। কয়েক ঘণ্টা পরে তাঁকে জানানো হয় ভুল হয়ে গেছে, তারা অন্য এক অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিল। তৌহিদ যখন হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন তখন কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের চাপে মালয়েশীয় সরকার ক্ষমা চায়। নিউ স্ট্রেইট টাইমস–এ বিরাট খবর হয়েছিল ঘটনাটি। আমিও কড়া প্রতিবাদ করে লিখেছিলাম।
আমার মালয়েশীয় বন্ধুদের সঙ্গে আমি সেলাঙগোর, জোহর, পাহান, কেলাস্তান প্রভৃতি রাজ্য ঘুরেছি। পাহাড় ও বনভূমির আদিম সৌন্দর্য। বহু জায়গায় গিয়ে দেখেছি বাংলাদেশি শ্রমিকেরা পাম ও রাবার বাগানে কাজ করছেন। এক নারকেল বাগানে গিয়ে দেখি আমাদের দেশের কয়েকজন যুবক বুকে চামড়ার একটা বর্মের মতো সেঁটে তরতর করে নারকেলগাছে উঠে নারকেল পাড়ছে। নারকেলগাছগুলো যে খুব উঁচু তা নয়। কিন্তু নারকেল পাড়া খুবই কষ্টকর। তা দেখে কষ্ট পাই। যা হোক, অভিবাসী শ্রমিকেরাই আধুনিক মালয়েশিয়াকে গড়ে তুলেছেন, দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন মাহাথির। তাঁর অনেক নীতিই মানবতাবিরোধী।
অবৈধভাবে মানব পাচারের আমরা ঘোর বিরোধী এবং তার তীব্র নিন্দা জানাই। কিন্তু ওপেন সিক্রেট হলো, অবৈধ অভিবাসীদের অনেক দেশই পছন্দ করে। কারণ, তাদের কম বেতন দিয়ে দাস হিসেবে খাটানো যায় ইচ্ছামতো।
কিছু কিছু স্থায়ী সমস্যা হঠাৎ তীব্র আকার ধারণ করে। তখনই তা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। কোনোরকমে সমস্যাটির সাময়িক সমাধান দিলেও তা থেকেই যায়। সে জন্য দরকার বিচক্ষণতার সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করা। বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সমস্যাটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এর সমাধান তাৎক্ষণিকভাবে হবে না। এই মুহূর্তে জরুরি মাঝদরিয়ায় যারা রয়েছে এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছে, তাদের বাঁচানোর ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার রোধে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, কোস্টগার্ড ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যদের কড়া নজর রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে আমার ধারণা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যদি এ ব্যাপারে শক্ত ভূমিকা না রাখেন, তাহলে মানব পাচার বন্ধ করা যাবে না।
থাইল্যান্ডের গহন অরণ্যে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর সন্দেহভাজন মানব পাচারকারীদের ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়া হয়েছে। ক্রসফায়ার সমাধান নয়। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ‘সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির আত্মীয়স্বজন, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা এবং পুলিশ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ কাজে লাগিয়ে কক্সবাজার থেকে প্রায় প্রতি রাতেই মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশ্যে ট্রলারে তোলা হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ।...জলপথে মানব পাচার খাতে এ পর্যন্ত অন্তত ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মুক্তিপণ লেনদেন হয়েছে।...তবে বরাবরই কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কৌশলের কারণে আড়ালেই থাকছে গডফাদাররা। মানব পাচারের পেছনের মূল হোতা ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের নাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানলেও তা গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোয় আসছে না।...পুলিশের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ১৫ থেকে ২০ হাজার লোক অবৈধভাবে সমুদ্রপথে পাচার হয়েছে।’ [কালের কণ্ঠ, ১৭ মে]
অবৈধ মানব পাচার একটি অতি জটিল মানবিক সমস্যা। এটি আন্তরাষ্ট্রীয় সমস্যা। একসময় এই বিষয়টি কূটনৈতিক জটিলতার জন্ম দিতে পারে। সুতরাং অবিলম্বে স্থায়ীভাবে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়াই হবে সুবুদ্ধির কাজ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
মাহাথিরীয় পথ বাঙালির একাত্তরে গৃহীত পথের সম্পূর্ণ বিপরীত পথ। একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া-টিক্কা-ফরমান যে অর্থ ব্যয় করেছেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ না করলে ওই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে বড় বড় দালানকোঠা বানানো যেত। দালানকোঠা এক বস্তু আর গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আর এক জিনিস। আমরা গণহত্যা চাইনি, গণতন্ত্র চেয়েছি। মাহাথিরের যে পথ, ওই পথে রাস্তাঘাট-দালানকোঠা হয়, সেখানে কোনো দিনও একজন বিশ্বমানের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা বা সত্যসাধক হতে পারবেন না।
মালয়েশিয়ার আজকের যে আর্থসামাজিক উন্নতি, তার পেছনে বাঙালি অভিবাসী শ্রমিকদের অবদান যে কতটা, তা মালয়ের শাসকেরাই ভালো জানেন, বাংলাদেশের শাসকেরা নন। আজ বাঙালি ও রোহিঙ্গা শ্রমিকবোঝাই নৌকা তাঁরা তীরে ভিড়তে দিচ্ছেন না। অথচ আজকের তাঁদের ঐশ্বর্যের পেছনে লাখ লাখ বাঙালি শ্রমিকের ঘাম অপরিমেয়। এখনকার মতো অতীতেও বাংলাদেশিরা সেখানে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করতে গেছে, ভিক্ষা করতে যায়নি। ওরা সেখানে গিয়ে উঁচু উঁচু দালান বানিয়েছে, রাস্তায় বসে ইট ভেঙে খোয়া বানিয়েছে, রাস্তাঘাট বানিয়েছে, পামের বাগানে কাজ করেছে বলে অত পাম অয়েল তারা আমাদের দেশে রপ্তানি করতে পেরেছে, রাবার বাগানে কাজ করেছে বলে রাবার ও রাবারজাত দ্রব্য রপ্তানি করে বস্তা বস্তা রিংগিত রোজগার করতে পেরেছে, নারকেলের বাগান ও গভীর অরণ্যে কাজ করেছে বলে টিম্বার রপ্তানি করতে পারছে। হতভাগ্য বাংলাদেশি, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও ভারতীয় শ্রমিকেরা মালয়কে দিয়েছে অনেক সমৃদ্ধি।
পৃথিবীর অভিবাসনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বৈধ ও অবৈধ দুভাবেই অভিবাসন হয়ে থাকে। বরং অবৈধভাবেই বেশি অভিবাসন হয়। যে দেশে জনসংখ্যা বেশি এবং রয়েছে বেকারত্ব, সেখান থেকেই প্রধানত অদক্ষ যুবকেরা গিয়ে থাকে এমন কোনো দেশে, যেখানে শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে অথবা যেখানকার অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত ভালো। তা ছাড়া, কোনো দেশে কোনো জাতিসত্তার মানুষ অবিচারের শিকার হলে তাদের অনেকে অন্য দেশে পালিয়ে যায়। তুরস্ক থেকে যেমন কুর্দিরা গেছে জার্মানিতে। সেভাবেই রোহিঙ্গারা হয় বাংলাদেশে অথবা মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে যাতায়াত করে। তারা গিয়ে বসে থাকে না, শ্রম বিক্রি করে জীবিকার জন্য রোজগার করে অর্থ। তাদের শ্রম ওই সব দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে।
আশির দশকের শুরুতে আমি যে অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকতাম, সেখানে ছিল আটটি ফ্ল্যাট। তার পাঁচটিতে থাকতেন কয়েকজন মালয়েশীয় ছাত্রছাত্রী। তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে পড়তে এসেছিলেন। অনগ্রসর মালয়েশিয়ায় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি ছিল না। তাই মালয় সরকার বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে বৃত্তি দিয়ে ছেলেমেয়েদের পাঠাত। ওদের আমন্ত্রণে আমি কয়েক দিনের জন্য মালয়েশিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেই মালয়েশিয়া আর আজকের মালয়েশিয়া এক নয়। কিছুদিন আগেই নির্বাচনের মাধ্যমে মাহাথির বিন মোহাম্মদের দল কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় এসেছে। পাহাড় কেটে রাস্তাঘাট ও বড় মসজিদ নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। আমার থাকা অবস্থায় কোরবানির ঈদ আসে। আমার সুযোগ হয়েছিল মাহাথিরের সঙ্গে নির্মীয়মাণ মসজিদে নামাজ আদায় করার। তবে সারা দিন ঘুরেও কোরবানি দেওয়ার দৃশ্য আমি কুয়ালালামপুরের কোথাও দেখিনি।
প্রথম প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমান মালয়েশিয়ার ভিত্তি স্থাপন করে যান। দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুল রাজাক ভালো শাসক ছিলেন। তাঁর ছেলেই এখন প্রধানমন্ত্রী। তারপর কয়েক বছর ছিলেন দাতুক হোসেন ওন্। তাঁর উত্তরাধিকারী মাহাথির। তিনি মালয়েশিয়াকে একটি উচ্চতায় নিয়ে যান। তাঁর অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, সাহস ও সততা বিশ্ববাসীর প্রশংসা (ও নিন্দাও) অর্জন করে। তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁরই উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে যে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করেন, তা ঘৃণার্হ। শুধু বামপন্থীদের নয়, তাঁর বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার ক্ষেত্রে তাঁর কর্মকাণ্ড খুবই অন্যায়।
তিনি কঠোর হাতে মাদক নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সেটা প্রশংসনীয়। তাঁর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষের ওপর যে নির্যাতন করেছে, তার সব খবর পৃথিবীর মানুষ কোনো দিনই জানবে না। বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের অনেকে তাঁর কারাগারে নির্মমতার শিকার হয়েছেন। তাঁর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার একটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার চুক্তি ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি মালয়েশিয়া সরকারের আমন্ত্রণে কুয়ালালামপুর যান। গভীর রাত। তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁর হোটেলের কক্ষে। হঠাৎ দুমদাম শব্দে তাঁর ঘুম যে শুধু ভাঙে তা-ই নয়, ভয়ে তিনি কাঁপতে থাকেন। টোকা দিলে দরজা তিনি নিজেই খুলে দিতেন। কিন্তু মালয়েশীয় নিরাপত্তাকর্মীরা হাতুড়ি-শাবল দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলেন। ঘরে ঢুকে তারা তৌহিদ আনোয়ারকে লাথি মারাসহ নির্মমভাবে পিটিয়ে থানায় নিয়ে যায়। কিছুই বুঝতে পারেননি তিনি। কয়েক ঘণ্টা পরে তাঁকে জানানো হয় ভুল হয়ে গেছে, তারা অন্য এক অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিল। তৌহিদ যখন হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন তখন কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের চাপে মালয়েশীয় সরকার ক্ষমা চায়। নিউ স্ট্রেইট টাইমস–এ বিরাট খবর হয়েছিল ঘটনাটি। আমিও কড়া প্রতিবাদ করে লিখেছিলাম।
আমার মালয়েশীয় বন্ধুদের সঙ্গে আমি সেলাঙগোর, জোহর, পাহান, কেলাস্তান প্রভৃতি রাজ্য ঘুরেছি। পাহাড় ও বনভূমির আদিম সৌন্দর্য। বহু জায়গায় গিয়ে দেখেছি বাংলাদেশি শ্রমিকেরা পাম ও রাবার বাগানে কাজ করছেন। এক নারকেল বাগানে গিয়ে দেখি আমাদের দেশের কয়েকজন যুবক বুকে চামড়ার একটা বর্মের মতো সেঁটে তরতর করে নারকেলগাছে উঠে নারকেল পাড়ছে। নারকেলগাছগুলো যে খুব উঁচু তা নয়। কিন্তু নারকেল পাড়া খুবই কষ্টকর। তা দেখে কষ্ট পাই। যা হোক, অভিবাসী শ্রমিকেরাই আধুনিক মালয়েশিয়াকে গড়ে তুলেছেন, দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন মাহাথির। তাঁর অনেক নীতিই মানবতাবিরোধী।
অবৈধভাবে মানব পাচারের আমরা ঘোর বিরোধী এবং তার তীব্র নিন্দা জানাই। কিন্তু ওপেন সিক্রেট হলো, অবৈধ অভিবাসীদের অনেক দেশই পছন্দ করে। কারণ, তাদের কম বেতন দিয়ে দাস হিসেবে খাটানো যায় ইচ্ছামতো।
কিছু কিছু স্থায়ী সমস্যা হঠাৎ তীব্র আকার ধারণ করে। তখনই তা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। কোনোরকমে সমস্যাটির সাময়িক সমাধান দিলেও তা থেকেই যায়। সে জন্য দরকার বিচক্ষণতার সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করা। বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সমস্যাটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এর সমাধান তাৎক্ষণিকভাবে হবে না। এই মুহূর্তে জরুরি মাঝদরিয়ায় যারা রয়েছে এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছে, তাদের বাঁচানোর ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার রোধে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, কোস্টগার্ড ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যদের কড়া নজর রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে আমার ধারণা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যদি এ ব্যাপারে শক্ত ভূমিকা না রাখেন, তাহলে মানব পাচার বন্ধ করা যাবে না।
থাইল্যান্ডের গহন অরণ্যে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর সন্দেহভাজন মানব পাচারকারীদের ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়া হয়েছে। ক্রসফায়ার সমাধান নয়। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ‘সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির আত্মীয়স্বজন, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা এবং পুলিশ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ কাজে লাগিয়ে কক্সবাজার থেকে প্রায় প্রতি রাতেই মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশ্যে ট্রলারে তোলা হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ।...জলপথে মানব পাচার খাতে এ পর্যন্ত অন্তত ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মুক্তিপণ লেনদেন হয়েছে।...তবে বরাবরই কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কৌশলের কারণে আড়ালেই থাকছে গডফাদাররা। মানব পাচারের পেছনের মূল হোতা ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের নাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানলেও তা গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোয় আসছে না।...পুলিশের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ১৫ থেকে ২০ হাজার লোক অবৈধভাবে সমুদ্রপথে পাচার হয়েছে।’ [কালের কণ্ঠ, ১৭ মে]
অবৈধ মানব পাচার একটি অতি জটিল মানবিক সমস্যা। এটি আন্তরাষ্ট্রীয় সমস্যা। একসময় এই বিষয়টি কূটনৈতিক জটিলতার জন্ম দিতে পারে। সুতরাং অবিলম্বে স্থায়ীভাবে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়াই হবে সুবুদ্ধির কাজ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments