নবায়নযোগ্য জ্বালানি- বিদ্যুতের উৎপাদন সীমাবদ্ধতা by মুশফিকুর রহমান

দুবাইয়ের গালফ নিউজ পত্রিকার খবর অনুযায়ী, আবুধাবির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ১২০ কিলোমিটার দূরে শাম্স-১ নামে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে নির্মিত প্রথম এই গুরুত্বপূর্ণ নবায়নযোগ্য জ্বালানির বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেখানে মোট ৭৪১ একর জায়গার ওপর ৭৬৮টি অর্ধবৃত্তাকার সৌর আলো ঘনীভূত করার সংগ্রাহক বসিয়ে সিএসপি সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এ প্ল্যান্টে মরুভূমির তীব্র সৌরতাপকে কাজে লাগিয়ে পানিকে বাষ্পীভূত করে তা দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। শাম্স-১ প্ল্যান্টে উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য ডিজেল পুড়িয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম। দুবাইয়ে নির্মাণাধীন এ সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আশা করা হচ্ছে বাংলাদেশি চার টাকা ইউনিট দরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে।
দুবাইয়ের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্যে সংগত কারণেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা উৎসাহিত হয়েছেন। এবং ৫ মে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ‘ফিড ইন ট্যারিফ’ নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে প্রস্তাবিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ‘ফিড ইন ট্যারিফ’ চার টাকা হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে তিনি মত দিয়েছেন। অবশ্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন চেয়ারম্যান বলেছেন, দুবাইয়ের বাস্তবতা বাংলাদেশে অনুপস্থিত এবং সে কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য ইউনিটপ্রতি চার টাকা নির্ধারণ বাস্তবানুগ হবে না।
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সৌরবিদ্যুৎ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, গ্রিড বিদ্যুৎ যেখানে নেই সেখানে। তবে প্রধানত সোলার হোম সিস্টেমস সৌরবিদ্যুৎ সম্ভাবনারও সীমা রয়েছে। আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাণিজ্যিক ব্যবহারের সম্ভাবনাও সে কারণে সীমাবদ্ধ অস্ট্রেলিয়া সরকারের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি ইনস্টিটিউট ও এশিয়া ফাউন্ডেশন যৌথভাবে ‘বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ও ফিড ইন ট্যারিফ’ শীর্ষক সেমিনারটি আয়োজন করেছিল। সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে ব্যক্তি খাতকে উৎসাহিত করতে দীর্ঘ মেয়াদে প্রচলিত উৎসের বিদ্যুতের চেয়ে বেশি মূল্যে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ক্রয়ের নিশ্চয়তা দিতে ফিড ইন ট্যারিফ নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তর কথা হলেও বাংলাদেশে এখনো কেবল সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পেয়েছে; তাও মূলত গ্রিড বিদ্যুতের আওতাবহির্ভূত এলাকায়। প্রায় ৩৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেমস ইতিমধ্যে দেশে স্থাপিত হয়েছে এবং প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার নতুন সোলার হোম সিস্টেমস বসানো হচ্ছে। কিন্তু এখনো সোলার হোম সিস্টেমস থেকে উৎপাদিত অতি সামান্য পরিমাণের বিদ্যুৎ কেবল সীমিতসংখ্যক বাতি জ্বালানো, টিভি চালানো এবং মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়ার কাজে সীমাবদ্ধ।
সম্প্রতি কয়েকটি সৌরবিদ্যুৎ-চালিত সেচপাম্প দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসানো হয়েছে এবং আগামী বছরের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ-চালিত প্রায় ৫০ হাজার সেচপাম্প স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সৌরবিদ্যুৎকে গ্রিডে সংযুক্ত করার বিভিন্ন উদ্যোগের কথা হলেও এখন অবধি তেমনটি ঘটেনি। দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের (সব কটি স্থাপিত সোলার হোম সিস্টেমসের সম্মিলিত উৎপাদন) ২০০ মেগাওয়াটেরও কম। সৌরবিদ্যুৎ এবং গত শতাব্দীর ষাটের দশকে স্থাপিত এবং দেশের একমাত্র ২৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা মিলিয়ে এখন আমাদের দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট।
সরকারের ঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ বছরের মধ্যে ৬০০ মেগাওয়াট (মোট উৎপাদনক্ষমতার ৫ শতাংশ) বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের কথা। সরকারের প্রতিষ্ঠিত ‘সাসটেইনেবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অব বাংলাদেশ’-এর মূল্যায়ন অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ বিদ্যুতের উৎপাদন সামর্থ্য এ বছর অনর্জিতই থাকবে। তবে প্রতিষ্ঠানপ্রধান আশা করেন, ২০২১ সালের মধ্যে সৌরবিদ্যুতের উৎস থেকে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট, বাতাসের শক্তি থেকে ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট, বায়োমাস থেকে ৪৭ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস থেকে ৭ মেগাওয়াট এবং মিনি হাইড্রো বা ÿখুদে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আরও ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে।
দেশে ১৩টি স্থানে বাতাসের শক্তি সম্ভাবনা নিয়ে জরিপ করা হচ্ছে; তবে বিশেষজ্ঞদের অনুমান যথেষ্ট উঁচু স্তরে না গেলে বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের দেশে দুরূহ। সেই সঙ্গে বাতাসের ক্রমপরিবর্তনশীল ও অনির্ভরযোগ্য গতি ও দিক পরিবর্তনের ধরন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাতাসের শক্তি ব্যবহার অনিশ্চিত করে তুলেছে। সৌররশ্মির তীব্রতাও আমাদের দেশে সারা বছর একই রকম জোরালো নয়। ফলে সিএসপি-প্রযুক্তির সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি।
সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রযুক্তি সাধারণভাবে বর্তমানে জনপ্রিয়। কিন্তু বড় পরিসরে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে—প্রধানত দেশে জমির স্বল্পতার কারণে। বিদ্যমান প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সূর্যের আলো থেকে ১৬০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোটামুটি এক বিঘা জমি দরকার হয়। ১০ থেকে ২০টি ঘরে সামান্য আলো আর টিভি চালানোর বিদ্যুতের জোগান দিতে বেশ কয়েকটি সোলার হোম সিস্টেমস, (ব্যাটারি, সংযোগ ব্যবস্থাসহ) মিলিয়ে একটি ‘ন্যানো গ্রিড’ তৈরি করা যায়। এ জন্য চার-পাঁচ লাখ টাকার বিনিয়োগ দরকার।
এর চেয়ে আর একটু বড় বা ‘মিনি গ্রিড’ তৈরি করে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। সে ক্ষেত্রে মিনি গ্রিড তৈরিতে পাঁচ-ছয় কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সৌরবিদ্যুৎ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, গ্রিড বিদ্যুৎ যেখানে নেই সেখানে। তবে প্রধানত সোলার হোম সিস্টেমস সৌরবিদ্যুৎ সম্ভাবনারও সীমা রয়েছে। আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাণিজ্যিক ব্যবহারের সম্ভাবনাও সে কারণে সীমাবদ্ধ।
ড. মুশফিকুর রহমান: জ্বালানি ও পরিবেশ-বিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.