কৌতুককর আচরণ করবেন না by প্রণব মুখার্জি
সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জির বই ‘দি ড্রামেটিক ডিকেড দি ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স প্রকাশ করেছে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স। এ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধ: দি মেকিং অব বাংলাদেশ’-এর অবিকল তরজমা...
(দ্বিতীয় কিস্তি)
১৯৪৬
সালের ১৬ই আগস্ট মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে ডাইরেক্ট অ্যাকশন
কর্মসূচি ঘোষণা করলো। যখন আশা করা হয়েছিল যে, তাদের আন্দোলন ব্রিটিশদের
বিরুদ্ধেই কিন্তু কলকাতায় এ নিয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে একটি
সাম্প্রদায়িক বিরোধ ঘটল। হিন্দু ও শিখদের টার্গেট করা হলো এই বিবেচনায় যে,
তারা হয়তো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে পারে। এই সময়ের ওপর অনেক
বিবরণ নথিবদ্ধ রয়েছে কিন্তু এর মধ্যে দুটি অভিজ্ঞতা অন্য সবার থেকে ভিন্ন।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং তৎকালীন মুসলিম লীগের ছাত্র শাখার নেতা শেখ
মুজিবুর রহমান সেই সময়ের অযৌক্তিক অনুভূতির একটা চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর
অসমাপ্ত স্মৃতিকথায়, (শেখ মুজিবুর রহমান, দি আনফিনিশড মেময়ার্স, নিউ
দিল্লি, ২০১২), যেমনটা তপন রায় চৌধুরী করেছেন তার বঙ্গনামায় (তপন রায়
চৌধুরী, বেঙ্গলনামা, কলকাতা, ২০০৭)।
ওই সাম্প্রদায়িক বিরোধটা কেবল কলকাতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। পূর্ব বাংলার নোয়াখালীতে ও পরে বিহার ও পাঞ্জাবে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বাতাসে মিলিয়ে গেল এবং বিচারবুদ্ধির সুস্থতা কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে গেল। ১৯৪৫ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে হিন্দু-মুসলিম সুবর্ণ ঐক্য দেখা গিয়েছিল, এই দাঙ্গা ছিল তার দারুণ বিপরীত। ওই সময়ে হিন্দু-মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশদের ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ (ডিভাইড অ্যান্ড রুল) নীতির বিরুদ্ধে কলকাতার রাস্তায় প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল। ১৬ আগস্টের আগে যেমনটা দেখা গিয়েছিল, তা থেকে নিরাপত্তাগত দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত পাল্টে গিয়েছিল, কলকাতার রাস্তা ছিল হিন্দু-মুসলমানের জন্য নিরাপদ কিনু্ত ওই তারিখের পরে হয়ে পড়লো অনিরাপদ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়টায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গেল ভারতে। ভারতীয়দের জনমত যাচাই না করে জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে এবং ব্রিটেনের নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনীর অংশ হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের একতরফা প্রতিবাদে কংগ্রেসের নেতৃত্ব ওধ ও আগ্রার ইউনাইটেড প্রভিন্স, সেন্ট্রাল প্রভিন্সেস, বিহার, উড়িষ্যা, এনডব্লিউএফপি, বোম্বে ও মাদ্রাজ সরকার থেকে পদত্যাগ করলো।
সংকটের সমাধান এবং একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা লাভের লক্ষ্যে দশজন ভারতীয় নেতার সঙ্গে আলোচনা করতে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে মন্ত্রী পর্যায়ের একটি শক্তিশালী মিশন ভারতে প্রেরণ করা হল। কিন্তু সেটি ব্যর্থ হলো, কারণ ব্রিটিশ সরকারের নেওয়া অবস্থানের সঙ্গে কংগ্রেস নেতারা একমত হতে পারেননি। ১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ভারত খেদাও আন্দোলন শুরু করলো।
এর ফল হিসেবে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হলেন এবং দলকে নিষিদ্ধ করা হলো। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর বার্তা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেল। মুহূর্তের উত্তেজনায় বিপুলসংখ্যক মানুষ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। সুভাষ চন্দ্র বোস দেশত্যাগ করলেন। তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (আইএনএ) নেতৃত্ব নিতে জার্মানি হয়ে জাপান গেলেন। ১৯৪৪ সালে নেতাজি জাপানিদের সহায়তায় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপ স্বাধীন করলেন। জার্মানি, ইতালি ও জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো। তখন রাজনৈতিক তৎপরতা মধ্য গগনে। কংগ্রেসের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলো। দলীয় নেতাদের জেল থেকে মুক্তি দেয়া হলো এবং ব্রিটিশ সরকার ও তাদের মধ্যে একটি সংলাপ শুরু হলো।
১৯৪৬ সালের ২রা সেপ্টেম্বর ভারতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করলো। একটি এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড অর্চিবাল্ড ওয়াভেল, জওহর লাল নেহরু হলেন এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন স্যার ক্লদ অচিনলেক, সরদার বল্লবভাই প্যাটেল, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, আসফ আলী, সি. রাজাগোপালচারি, শরত চন্দ্র বোস, ড. জন মাথাই, সরদার বলদেব সিং, স্যার শাফাত আহমাদ খান, জগজীবন রাম, সৈয়দ আলী জহীর এবং সি. এইচ. ভাবা। মুসলিম লীগকে ৫টি আসন নিতে আমন্ত্রণ জানানো হলো, যা তারা প্রথমে নিতে চাননি। কিন্তু ১৯৪৬ সালের ১৫ই অক্টোবর তারা প্রস্তাবটি মেনে নিলেন। লিয়াকত আলী খান, ইবরাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগড় (উভয়ে পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন) আবদুর রব নিশতার, রাজা গজনফর আলী এবং যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল সরকারে যোগ দিলেন। (জিন্নাহ কর্তৃক মুসলিম লীগের মনোনীত সদস্য হিসেবে যোগেন মণ্ডলকে বেছে নেয়ার পেছনের কারণ হলো তিনি কংগ্রেসের মুসলিম কার্ডকে টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন। এটা লক্ষণীয় যে, মুসলিম লীগের আর কোন সদস্যই পূর্র্ববঙ্গ থেকে নেয়া হয়নি।
১৯৪৭ সালের ৩রা জুন ব্রিটিশ সরকারের ঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, পাঞ্জাব ও বেঙ্গলের জন্য ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের পরিকল্পনা ছিল। যাতে দেশভাগের পরে তারা দুটি অঞ্চলেরই সব রকম স্বার্থ দেখতে পারেন। পূর্ব পাঞ্জাবের ছায়া মন্ত্রিসভার প্রধান হলেন ড. গোপি চাঁদ ভার্গব। পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রধান হলেন মামদতের নওয়াব ইফতিখার হোসাইন। পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে এলেন ড. পিসি ঘোষ। তিনি ছিলেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। এরপরের সিদ্ধান্ত হলো মুসলিম ও অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোর বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যরা আলাদাভাবে মিলিত হবেন এবং তারা সিদ্ধান্ত নেবেন তারা কে কান এলাকা- ভারত না পাকিস্তান কোনটি বেছে নেবেন।
ইতিমধ্যে পাঞ্জাব ও বেঙ্গলের জন্য বাউন্ডারি কমিশন গঠন করা হলো। উভয়ের নেতৃত্বে থাকলেন স্যার সিরিল রেডক্লিফ।
‘১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট যখন ১৬ পৃষ্ঠাব্যাপী রেডক্লিফ রিপোর্ট প্রকাশিত হলো, যার মধ্যে ১৬ পৃষ্ঠা ছিল বেঙ্গলের জন্য, তখন তাতে অনেক বিস্ময় লুকিয়ে ছিল। দুদিন অগেই খুলনা এবং চট্টগ্রামের পার্বত্য জেলাগুলোতে ভারতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছিল, তা পাকিস্তানের অংশে পরিণত হলো। মুর্শিদাবাদ ও মালদায় যেখানে পাকিস্তানি পতাকা উড়েছিল, সেসব এলাকা ভারতের অংশে পরিণত হলো। জলপাইগুড়ি, মালদা ও নদিয়ার জেলাগুলো ভারতের অংশ হয়ে থাকলো। কিন্তু এসব জেলাগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ পাকিস্তানে চলে গেল। অন্যদিকে যশোর ও দিনাজপুর পাকিস্তানকে দেয়া হলো। কিন্তু উভয় জেলার একটি করে সাব ডিভিশন (যশোরের বনগাঁও সাবভিভিশন ও দিনাজপুরের বালুরঘাট সাবডিভিশন) ভারতকে দেয়া হলো। পশ্চিমবঙ্গ যা কি না রেডক্লিফের কাঁচি থেকে টিকে গেলো, তাও দেখা গেলো পোকায়-খাওয়া। দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির জেলাগুলোকে পশ্চিমবঙ্গের মূল ভূখণ্ড থেকে বাস্তবে বিচ্ছিন্ন করা হলো। মুসলিমরা এটা দেখে ব্যথিত হলেন যে, কলকতা পশ্চিমবঙ্গে চলে গেল। আবার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদও পশ্চিমবঙ্গে পড়লো। রেডক্লিফ কি কারণে মুর্শিদাবাদকে ভারতে দিলেন, তার কারণ তিনি খুলনা পাকিস্তানকে দেয়ার ক্ষতি পূরণ করলেন। গঙ্গার যেখান থেকে হুগলি নদীর শুরু সেখান থেকে পুরো এলাকাটিই ভারতের মধ্যে থাকা দরকার ছিল আর সেটা কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখার স্বার্থেই। হিন্দুরা দুঃখিত হলেন এই ভেবে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধানত বৌদ্ধ অধ্যুষিত জেলা পড়লো চট্টগ্রাম জেলায়। এর কারণ এই জেলার সব ধরনের যোগাযোগই হলো চট্টগ্রাম জেলা সংশ্লিষ্ট এবং দৃশ্যত সেটাই রেডক্লিফকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু তাড়াহুড়োর কারণে যা তার চোখ এড়িয়ে গেছে তা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তের একটি বড় অংশ ভারতের আসাম প্রদেশের লুসি পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত। যেহেতু সকল পক্ষ নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, কোন প্রশ্ন ছাড়াই তারা রেডক্লিফ রোয়েদাদ মেনে নেবে, তাই তাদের শান্ত থাকতে হয়েছিল এবং তিনি যাই করেছেন, তাই তাদেরকে মানতে হয়েছিল। অথচ তা ছিল দুই দেশের মধ্যকার সীমান্ত রেখা তৈরির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অদ্ভুত, একতরফা ও অযৌক্তিক।’’ (নিতীশ কে. সেনগুপ্ত, হিস্ট্রি অব দ্য বেঙ্গলি স্পিকিং পিপল, নিউ দিল্লি, ২০০১, পৃ. ৫২৪)
মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিশেষ করে জিন্নাহ এবং কংগ্রেস উপলব্ধিতে নিয়েছিল যে, কোন একটি দেশের পক্ষে পাঞ্জাব, বেঙ্গল, আসামকে পুরোপুরি নেয়া যাবে না, তাই তারা দেশভাগ থেকে যেখানে যেটুকু পাওয়া যায়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট হতে আগ্রহী ছিলেন। তদুপরি বেঙ্গলের কতিপয় নেতা একটি অবিভক্ত বাংলার ধারণা দিলেন। মাওলনা আকরাম খান এবং এইচ এস সোহরাওয়ার্দী প্রদেশ ভাগের সম্পূর্ণরূপে বিরোধী ছিলেন। এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ একটি ফর্মুলায় পৌঁছাতে বেশ কয়েকবার বৈঠক করেছিলেন, যাতে বাংলা ভাগ এড়ানো যায়। মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত স্মৃতিকথায় দেশভাগ পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি ষড়যন্ত্রের কথা লিখেছেন। তার দাবি বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে বাংলা ভাগ সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। অবিভক্ত বাংলার বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর দ্ব্যর্থহীন অবস্থান ও সমর্থনের বিবেচনায় এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বাংলায় আন্তঃদলীয় আলোচনায় একটি ফর্মুলা বের হয়েছিল, এতে বলা হয়েছিল একটি গণপরিষদ বাংলার জনগণ নির্বাচিত করবেন আর তখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নেবেন যে, তারা ভারত না পাকিস্তানে যোগ দেবেন কিংবা স্বাধীন থাকবেন। এই ফর্মুলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিল অনুমোদন দিয়েছিল। যখন শরত চন্দ্র বোস (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে ছিটকে পড়ার পরে তিনি সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন), কিরণ শংকর রায়, সোহরাওয়ার্দী এবং অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতা এই ফর্মুলা প্রণয়ন করেন, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তা প্রত্যাখ্যান করলেন। শরত চন্দ্র বোসের বিবৃতি অনুযায়ী, মহাত্মা গান্ধী ও জওহর লাল নেহরু বোসকে সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আর বল্লভভাই তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘কৌতুককর আচরণ করবেন না। আমাদেরকে অবশ্যই কলকাতাকে ভারতে রাখতে হবে।’ এভাবে তারা হতাশাগ্রস্ত হলেন এবং তারা বাড়ি ফিরে গেলেন।
(সম্প্রতি ভারতের প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জির বই ‘দি ড্রামেটিক ডিকেড দি ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স’ প্রকাশ করেছে দিল্লির রুপা পাবলিকেসন্স। এ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধ: দি মেকিং অব বাংলাদেশ’ এর অবিকল তরজমা)
ওই সাম্প্রদায়িক বিরোধটা কেবল কলকাতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। পূর্ব বাংলার নোয়াখালীতে ও পরে বিহার ও পাঞ্জাবে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বাতাসে মিলিয়ে গেল এবং বিচারবুদ্ধির সুস্থতা কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে গেল। ১৯৪৫ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে হিন্দু-মুসলিম সুবর্ণ ঐক্য দেখা গিয়েছিল, এই দাঙ্গা ছিল তার দারুণ বিপরীত। ওই সময়ে হিন্দু-মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশদের ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ (ডিভাইড অ্যান্ড রুল) নীতির বিরুদ্ধে কলকাতার রাস্তায় প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল। ১৬ আগস্টের আগে যেমনটা দেখা গিয়েছিল, তা থেকে নিরাপত্তাগত দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত পাল্টে গিয়েছিল, কলকাতার রাস্তা ছিল হিন্দু-মুসলমানের জন্য নিরাপদ কিনু্ত ওই তারিখের পরে হয়ে পড়লো অনিরাপদ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়টায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গেল ভারতে। ভারতীয়দের জনমত যাচাই না করে জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে এবং ব্রিটেনের নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনীর অংশ হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের একতরফা প্রতিবাদে কংগ্রেসের নেতৃত্ব ওধ ও আগ্রার ইউনাইটেড প্রভিন্স, সেন্ট্রাল প্রভিন্সেস, বিহার, উড়িষ্যা, এনডব্লিউএফপি, বোম্বে ও মাদ্রাজ সরকার থেকে পদত্যাগ করলো।
সংকটের সমাধান এবং একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা লাভের লক্ষ্যে দশজন ভারতীয় নেতার সঙ্গে আলোচনা করতে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে মন্ত্রী পর্যায়ের একটি শক্তিশালী মিশন ভারতে প্রেরণ করা হল। কিন্তু সেটি ব্যর্থ হলো, কারণ ব্রিটিশ সরকারের নেওয়া অবস্থানের সঙ্গে কংগ্রেস নেতারা একমত হতে পারেননি। ১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ভারত খেদাও আন্দোলন শুরু করলো।
এর ফল হিসেবে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হলেন এবং দলকে নিষিদ্ধ করা হলো। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর বার্তা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেল। মুহূর্তের উত্তেজনায় বিপুলসংখ্যক মানুষ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। সুভাষ চন্দ্র বোস দেশত্যাগ করলেন। তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (আইএনএ) নেতৃত্ব নিতে জার্মানি হয়ে জাপান গেলেন। ১৯৪৪ সালে নেতাজি জাপানিদের সহায়তায় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপ স্বাধীন করলেন। জার্মানি, ইতালি ও জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো। তখন রাজনৈতিক তৎপরতা মধ্য গগনে। কংগ্রেসের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলো। দলীয় নেতাদের জেল থেকে মুক্তি দেয়া হলো এবং ব্রিটিশ সরকার ও তাদের মধ্যে একটি সংলাপ শুরু হলো।
১৯৪৬ সালের ২রা সেপ্টেম্বর ভারতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করলো। একটি এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড অর্চিবাল্ড ওয়াভেল, জওহর লাল নেহরু হলেন এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন স্যার ক্লদ অচিনলেক, সরদার বল্লবভাই প্যাটেল, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, আসফ আলী, সি. রাজাগোপালচারি, শরত চন্দ্র বোস, ড. জন মাথাই, সরদার বলদেব সিং, স্যার শাফাত আহমাদ খান, জগজীবন রাম, সৈয়দ আলী জহীর এবং সি. এইচ. ভাবা। মুসলিম লীগকে ৫টি আসন নিতে আমন্ত্রণ জানানো হলো, যা তারা প্রথমে নিতে চাননি। কিন্তু ১৯৪৬ সালের ১৫ই অক্টোবর তারা প্রস্তাবটি মেনে নিলেন। লিয়াকত আলী খান, ইবরাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগড় (উভয়ে পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন) আবদুর রব নিশতার, রাজা গজনফর আলী এবং যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল সরকারে যোগ দিলেন। (জিন্নাহ কর্তৃক মুসলিম লীগের মনোনীত সদস্য হিসেবে যোগেন মণ্ডলকে বেছে নেয়ার পেছনের কারণ হলো তিনি কংগ্রেসের মুসলিম কার্ডকে টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন। এটা লক্ষণীয় যে, মুসলিম লীগের আর কোন সদস্যই পূর্র্ববঙ্গ থেকে নেয়া হয়নি।
১৯৪৭ সালের ৩রা জুন ব্রিটিশ সরকারের ঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, পাঞ্জাব ও বেঙ্গলের জন্য ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের পরিকল্পনা ছিল। যাতে দেশভাগের পরে তারা দুটি অঞ্চলেরই সব রকম স্বার্থ দেখতে পারেন। পূর্ব পাঞ্জাবের ছায়া মন্ত্রিসভার প্রধান হলেন ড. গোপি চাঁদ ভার্গব। পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রধান হলেন মামদতের নওয়াব ইফতিখার হোসাইন। পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে এলেন ড. পিসি ঘোষ। তিনি ছিলেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। এরপরের সিদ্ধান্ত হলো মুসলিম ও অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোর বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যরা আলাদাভাবে মিলিত হবেন এবং তারা সিদ্ধান্ত নেবেন তারা কে কান এলাকা- ভারত না পাকিস্তান কোনটি বেছে নেবেন।
ইতিমধ্যে পাঞ্জাব ও বেঙ্গলের জন্য বাউন্ডারি কমিশন গঠন করা হলো। উভয়ের নেতৃত্বে থাকলেন স্যার সিরিল রেডক্লিফ।
‘১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট যখন ১৬ পৃষ্ঠাব্যাপী রেডক্লিফ রিপোর্ট প্রকাশিত হলো, যার মধ্যে ১৬ পৃষ্ঠা ছিল বেঙ্গলের জন্য, তখন তাতে অনেক বিস্ময় লুকিয়ে ছিল। দুদিন অগেই খুলনা এবং চট্টগ্রামের পার্বত্য জেলাগুলোতে ভারতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছিল, তা পাকিস্তানের অংশে পরিণত হলো। মুর্শিদাবাদ ও মালদায় যেখানে পাকিস্তানি পতাকা উড়েছিল, সেসব এলাকা ভারতের অংশে পরিণত হলো। জলপাইগুড়ি, মালদা ও নদিয়ার জেলাগুলো ভারতের অংশ হয়ে থাকলো। কিন্তু এসব জেলাগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ পাকিস্তানে চলে গেল। অন্যদিকে যশোর ও দিনাজপুর পাকিস্তানকে দেয়া হলো। কিন্তু উভয় জেলার একটি করে সাব ডিভিশন (যশোরের বনগাঁও সাবভিভিশন ও দিনাজপুরের বালুরঘাট সাবডিভিশন) ভারতকে দেয়া হলো। পশ্চিমবঙ্গ যা কি না রেডক্লিফের কাঁচি থেকে টিকে গেলো, তাও দেখা গেলো পোকায়-খাওয়া। দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির জেলাগুলোকে পশ্চিমবঙ্গের মূল ভূখণ্ড থেকে বাস্তবে বিচ্ছিন্ন করা হলো। মুসলিমরা এটা দেখে ব্যথিত হলেন যে, কলকতা পশ্চিমবঙ্গে চলে গেল। আবার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদও পশ্চিমবঙ্গে পড়লো। রেডক্লিফ কি কারণে মুর্শিদাবাদকে ভারতে দিলেন, তার কারণ তিনি খুলনা পাকিস্তানকে দেয়ার ক্ষতি পূরণ করলেন। গঙ্গার যেখান থেকে হুগলি নদীর শুরু সেখান থেকে পুরো এলাকাটিই ভারতের মধ্যে থাকা দরকার ছিল আর সেটা কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখার স্বার্থেই। হিন্দুরা দুঃখিত হলেন এই ভেবে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধানত বৌদ্ধ অধ্যুষিত জেলা পড়লো চট্টগ্রাম জেলায়। এর কারণ এই জেলার সব ধরনের যোগাযোগই হলো চট্টগ্রাম জেলা সংশ্লিষ্ট এবং দৃশ্যত সেটাই রেডক্লিফকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু তাড়াহুড়োর কারণে যা তার চোখ এড়িয়ে গেছে তা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তের একটি বড় অংশ ভারতের আসাম প্রদেশের লুসি পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত। যেহেতু সকল পক্ষ নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, কোন প্রশ্ন ছাড়াই তারা রেডক্লিফ রোয়েদাদ মেনে নেবে, তাই তাদের শান্ত থাকতে হয়েছিল এবং তিনি যাই করেছেন, তাই তাদেরকে মানতে হয়েছিল। অথচ তা ছিল দুই দেশের মধ্যকার সীমান্ত রেখা তৈরির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অদ্ভুত, একতরফা ও অযৌক্তিক।’’ (নিতীশ কে. সেনগুপ্ত, হিস্ট্রি অব দ্য বেঙ্গলি স্পিকিং পিপল, নিউ দিল্লি, ২০০১, পৃ. ৫২৪)
মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিশেষ করে জিন্নাহ এবং কংগ্রেস উপলব্ধিতে নিয়েছিল যে, কোন একটি দেশের পক্ষে পাঞ্জাব, বেঙ্গল, আসামকে পুরোপুরি নেয়া যাবে না, তাই তারা দেশভাগ থেকে যেখানে যেটুকু পাওয়া যায়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট হতে আগ্রহী ছিলেন। তদুপরি বেঙ্গলের কতিপয় নেতা একটি অবিভক্ত বাংলার ধারণা দিলেন। মাওলনা আকরাম খান এবং এইচ এস সোহরাওয়ার্দী প্রদেশ ভাগের সম্পূর্ণরূপে বিরোধী ছিলেন। এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ একটি ফর্মুলায় পৌঁছাতে বেশ কয়েকবার বৈঠক করেছিলেন, যাতে বাংলা ভাগ এড়ানো যায়। মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত স্মৃতিকথায় দেশভাগ পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি ষড়যন্ত্রের কথা লিখেছেন। তার দাবি বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে বাংলা ভাগ সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। অবিভক্ত বাংলার বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর দ্ব্যর্থহীন অবস্থান ও সমর্থনের বিবেচনায় এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বাংলায় আন্তঃদলীয় আলোচনায় একটি ফর্মুলা বের হয়েছিল, এতে বলা হয়েছিল একটি গণপরিষদ বাংলার জনগণ নির্বাচিত করবেন আর তখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নেবেন যে, তারা ভারত না পাকিস্তানে যোগ দেবেন কিংবা স্বাধীন থাকবেন। এই ফর্মুলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিল অনুমোদন দিয়েছিল। যখন শরত চন্দ্র বোস (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে ছিটকে পড়ার পরে তিনি সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন), কিরণ শংকর রায়, সোহরাওয়ার্দী এবং অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতা এই ফর্মুলা প্রণয়ন করেন, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তা প্রত্যাখ্যান করলেন। শরত চন্দ্র বোসের বিবৃতি অনুযায়ী, মহাত্মা গান্ধী ও জওহর লাল নেহরু বোসকে সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আর বল্লভভাই তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘কৌতুককর আচরণ করবেন না। আমাদেরকে অবশ্যই কলকাতাকে ভারতে রাখতে হবে।’ এভাবে তারা হতাশাগ্রস্ত হলেন এবং তারা বাড়ি ফিরে গেলেন।
(সম্প্রতি ভারতের প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জির বই ‘দি ড্রামেটিক ডিকেড দি ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স’ প্রকাশ করেছে দিল্লির রুপা পাবলিকেসন্স। এ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধ: দি মেকিং অব বাংলাদেশ’ এর অবিকল তরজমা)
No comments