ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশ বিতর্ক by হাসান ফেরদৌস
কথায়
বলে, নেই কাজ তো খই ভাজ। অনেকটা সেই রকম এক বিতর্ক হয়ে গেল ওয়াল স্ট্রিট
জার্নাল–এ। বিষয় বাংলাদেশ। দুই বিজ্ঞ লেখক—একজন ভারতীয়, অন্যজন ইংরেজ—বেজায়
তর্ক জুড়ে দিলেন আজকের বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তার কতটা ঠিক, কতটা ক্ষতিকর,
এই নিয়ে। মূল তর্ক জঙ্গিবাদ প্রশ্নে বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে, তবে সেই সূত্র
ধরে তাঁরা দুজনই ব্যাপকতর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রতি আমাদের দৃষ্টি
আকর্ষণ করেছেন। আপনারা অনেকে সেই বিতর্কে হয়তো পড়েননি, তাই তার সারসংক্ষেপ
জানাই।
আলোচনার শুরু সদানন্দ ধুমের প্রশস্তিমূলক উপসম্পাদকীয় থেকে (http://on.wsj.com/1FeLhXJ)। ভদ্রলোক আমেরিকার দক্ষিণপন্থী থিংক ট্যাংক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। সদানন্দ মনে করেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তার কারণ, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগতভাবে এক ভিন্ন অবস্থান তিনি নিয়েছেন। কামারুজ্জামানের মতো একাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিজের অঙ্গীকার পূরণ করেছেন তিনি। তাঁর বিবেচনায়, ইসলামিক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের এই শক্ত অবস্থানের জন্য হাসিনা বিশ্ববাসীর সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। অথচ এই ভূমিকার জন্য সাধুবাদ দেওয়ার বদলে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ বিচারব্যবস্থার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এসব সমালোচনার ফলে বাংলাদেশের ভেতরে কেবল তারাই লাভবান হয়, যারা জঙ্গিবাদের পক্ষে। সদানন্দ মনে করেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এখনো শেষ হয়নি, সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ব্লগারের হত্যাকাণ্ড থেকেই প্রমাণিত হয় বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা এক ভঙ্গুর ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে। এ অবস্থায় সমালোচনার বদলে পশ্চিমের দেশগুলোর উচিত হবে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়ানো।
লন্ডন থেকে তাঁর সে কথার বিরুদ্ধে পাল্টা শেল ছুড়লেন টবি ক্যাডম্যান (http://on.wsj.com/1FpnCWk)। ভদ্রলোক পেশায় ব্যারিস্টার, ঘাতক–দালালদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে বিচারের প্রক্রিয়া চলছে, তিনি তার একজন প্রবল সমালোচক। অবশ্য তার কারণও রয়েছে, তিনি বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর একজন উপদেষ্টা। অন্য কথায়, জামায়াতকে আত্মরক্ষায় সহায়তা করা তাঁর রুটি-রুজির ধান্দা। সদানন্দ ধুমের সমালোচনা করে তিনি লিখলেন, ঘাতক-দালালের বিচারের নামে বাংলাদেশ সরকার যা করছে, তা আসলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশ গঠন করেছে, তার লক্ষ্য আইন ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা নয়, বাংলাদেশ সরকারের বিরোধিতা করে, এমন সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা। সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে শুধু তার অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে। ক্যাডম্যান ‘মুক্তমনা’ ব্লগারদের হত্যার বিরোধী, কিন্তু তিনি মনে করেন না যে এসব ব্লগার হত্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা হুমকির মুখ। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বাড়ছে তার কারণ, মাঝামাঝি ক্ষেত্র, তাঁর ভাষায় ‘মিডল গ্রাউন্ড’ আর থাকছে না। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বা অন্য ঘাতক-দালালদের ফাঁসির ফলে জঙ্গিবাদের মোকাবিলার বদলে বরং তাদের উসকে দেওয়া হচ্ছে। ক্যাডম্যানের সবচেয়ে বেশি আপত্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের জন্য সমালোচনার বদলে তাঁর হাত শক্ত করার যে প্রস্তাব সদানন্দ করেছেন, তা নিয়ে। তাহলে তো মিসরে জেনারেল সিসি বা সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদ যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন, আমাদের তারও সমর্থন জানাতে হয়। তাঁরাও তো জঙ্গিবাদের বিরোধিতার নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মেরে লাশ বানাচ্ছেন! টবি মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য যা দরকার তা হলো গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। ‘মধ্যভূমি’ ধ্বংসের যে কাজে হাসিনা নেমেছেন, তাতে সে কাজটি অর্জিত হবে না।
সদানন্দ ধুমের লেখা পড়ে এমন ভ্রম হতে পারে যে ভদ্রলোক বুঝি হাসিনা সরকারের ‘পেইড এজেন্ট’। বাংলাদেশ সরকারের বাকপটু তথ্যমন্ত্রীকেও বিন্দুমাত্র চোখের পাতা না কাঁপিয়ে এমন ভাষায় তাঁর সরকারের প্রশস্তি গাইতে শুনিনি। আমি অবশ্য খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এই ভদ্রলোক আগাগোড়াই বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের পক্ষে নানা সময়ে প্রশস্তিমূলক উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছ থেকে দু-চার সবক নিতে পারে, বছর দুয়েক আগে এমন কথা লিখে তিনি আমাদের পাকিস্তানি মিত্রদের গাত্রদাহের কারণ হয়েছিলেন। বাংলাদেশ এখন আর ‘বাস্কেট কেস নয়’, এ কথাও তাঁরই। এসব লেখার জন্য ঢাকা থেকে কোনো উপঢৌকন গেছে, এমন শুনিনি। বস্তুত, সদানন্দ ধুমের সব লেখাই এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের আদর্শগত অবস্থান থেকে লেখা। ফিলিস্তিন থেকে জঙ্গিবাদ, ইরানের সঙ্গে আণবিক চুক্তি থেকে কিউবার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন, এমন প্রতিটি প্রশ্নে এই সংস্থা তাদের অতি কট্টর ডানপন্থী অবস্থানের জন্য সুপরিচিত। ফলে সদানন্দ যে হাসিনা সরকারের জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছেন, তা নিজের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে বিচার-বিবেচনা করেই লেখা।
অন্যদিকে টবি ক্যাডম্যান তাঁর ইসলামি ক্লায়েন্টদের নির্ভরশীল উকিল হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর প্রধান উষ্মা, যে ঘাতক-দালাল বিচারের প্রক্রিয়া বাংলাদেশে চলছে, তার মান আন্তর্জাতিক বিধিসম্মত নয়। সে কারণে তিনি কামারুজ্জামান গংদের ফাঁসির বিপক্ষে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মান বলতে তিনি কী বোঝান, তা খুব খোলাসা করে বলেননি। নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হলেও ঘাতক-দালালদের চলতি বিচার অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে বাংলাদেশের আইন পরিষদে গৃহীত আইনের ভিত্তিতে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ ফাঁসির রায়ের সমালোচনা করেছে, কারণ তাদের চোখে ফাঁসি অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমেরিকাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সে ব্যবস্থা চালু রয়েছে। জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘না’ বলল বলেই সেই ব্যবস্থা বেআইনি হয়ে গেল, তা নয়। গত বছরও আমেরিকায় ৩৫ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, সেসব নিয়ে কেউ টুঁ-শব্দটিও করেনি।
টবি উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন, ঘাতক-দালালদের বিচার কেবল হাসিনা সরকারের সিদ্ধান্ত নয়, এর পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের জনগণের দাবি। সেখানে এই বিচারের পক্ষে জনসমর্থন প্রায় নিরঙ্কুশ। প্রায় বলছি, কারণ দেশে এখনো ২ থেকে ৫ শতাংশ জামায়াতপন্থী আছে, যাদের যদি ঘাতকপন্থী বলা হয়, তাতে খুব অন্যায় হবে না। কাগজে-কলমে নিয়মনীতি মেনে চলার পাশাপাশি নাগরিক সম্মতি ও সমর্থনের একটি ওজন রয়েছে, তা যেকোনো আইনি প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে বাধ্য।
টবি মনে করেন, ঘাতক-দালালদের বিচারের নামে হাসিনা সরকার আসলে একটি রাজনৈতিক খেলায় নেমেছে, যার লক্ষ্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা নয়, জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করা। এ কথা থেকে বোঝা যায় টবির আসল আপত্তি কোথায়। তাঁর মক্কেলকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে ফাঁসি দিলে তিনি হয়তো আপত্তির কারণ দেখতেন না। স্পষ্টতই, তিনি যে কথাটা বোঝেন না বা মানেন না, তা হলো কাদের মোল্লা বা কামারুজ্জামানের মতো লোকগুলো রাজনীতিক নন, তাঁরা খুনি, মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধে দোষী। চিহ্নিত ও প্রমাণিত এসব অপরাধীকে শাস্তি দিলে বাংলাদেশের ‘মিডল গ্রাউন্ড’ কেন নিশ্চিহ্ন হবে, তা স্পষ্ট নয়। আর এই জামায়াতিদের যদি ‘মিডল গ্রাউন্ড’ বলা হয়, তাহলে সে কথা শুনে বাংলাদেশের লোক সমস্বরে এমন অট্টহাসি দিয়ে উঠবে, যা তিনি হয়তো আটলান্টিকের ওপার থেকেও শুনতে পাবেন।
ইসলামি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের অবস্থানের একটি ভূ-রাজনৈতিক চরিত্র রয়েছে, সদানন্দ বা টবি কেউই সেদিকে নজর দেননি। পাকিস্তান এই জঙ্গিবাদের একটি প্রধান ঘাঁটি। আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতনের পর হাজার হাজার আন্তর্জাতিক জঙ্গি সে দেশের সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। পরে তাদের অনেকে বাংলাদেশ হয়ে ইউরোপ ও আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে এই পরিচিতি লাভের পর জঙ্গিবাদের লড়াইয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা ভিন্ন মাত্রা গ্রহণ করে। বাংলাদেশের নিজস্ব ‘ঘরে বোনা’ সন্ত্রাসীও রয়েছে, যাদের অনেকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব কারণে আমেরিকা ও ভারতের কাছে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব বেড়ে যায়। বিএনপি আমলে দেশি-বিদেশি জঙ্গিরা নিরাপদ আশ্রয় পায়। অন্যদিকে হাসিনা সরকার তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। হাসিনা সরকার নিজেরাও জঙ্গিবাদের শিকার, সেই অভিজ্ঞতা থেকে তারা সাগ্রহে আমেরিকা ও ভারত উভয়ের সঙ্গেই জঙ্গিবাদবিরোধী আঁতাতে যুক্ত হয়েছে।
হাসিনা সরকারের আমলে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র পিছু হটেছে, টবির এই উপসংহার সম্পূর্ণ ভ্রান্ত নয়। কিন্তু আমেরিকা বা ভারত কেউই সে ব্যাপারে তেমন উদ্বিগ্ন নয় বলেই মনে হয়। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতার চেয়ে তাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে নিজেদের পাশে রাখা। হাসিনা এ ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝে ফেলেছেন। মাস তিনেক আগে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের আমেরিকাকে যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি আমেরিকার প্রয়োজন বাংলাদেশকে। জঙ্গিবাদের সমস্যা যদি মাথায় রাখি, তাহলে তাঁর এ কথা মোটেই বাচালতা মনে হয় না।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
আলোচনার শুরু সদানন্দ ধুমের প্রশস্তিমূলক উপসম্পাদকীয় থেকে (http://on.wsj.com/1FeLhXJ)। ভদ্রলোক আমেরিকার দক্ষিণপন্থী থিংক ট্যাংক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। সদানন্দ মনে করেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তার কারণ, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগতভাবে এক ভিন্ন অবস্থান তিনি নিয়েছেন। কামারুজ্জামানের মতো একাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিজের অঙ্গীকার পূরণ করেছেন তিনি। তাঁর বিবেচনায়, ইসলামিক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের এই শক্ত অবস্থানের জন্য হাসিনা বিশ্ববাসীর সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। অথচ এই ভূমিকার জন্য সাধুবাদ দেওয়ার বদলে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ বিচারব্যবস্থার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এসব সমালোচনার ফলে বাংলাদেশের ভেতরে কেবল তারাই লাভবান হয়, যারা জঙ্গিবাদের পক্ষে। সদানন্দ মনে করেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এখনো শেষ হয়নি, সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ব্লগারের হত্যাকাণ্ড থেকেই প্রমাণিত হয় বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা এক ভঙ্গুর ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে। এ অবস্থায় সমালোচনার বদলে পশ্চিমের দেশগুলোর উচিত হবে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়ানো।
লন্ডন থেকে তাঁর সে কথার বিরুদ্ধে পাল্টা শেল ছুড়লেন টবি ক্যাডম্যান (http://on.wsj.com/1FpnCWk)। ভদ্রলোক পেশায় ব্যারিস্টার, ঘাতক–দালালদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে বিচারের প্রক্রিয়া চলছে, তিনি তার একজন প্রবল সমালোচক। অবশ্য তার কারণও রয়েছে, তিনি বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর একজন উপদেষ্টা। অন্য কথায়, জামায়াতকে আত্মরক্ষায় সহায়তা করা তাঁর রুটি-রুজির ধান্দা। সদানন্দ ধুমের সমালোচনা করে তিনি লিখলেন, ঘাতক-দালালের বিচারের নামে বাংলাদেশ সরকার যা করছে, তা আসলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশ গঠন করেছে, তার লক্ষ্য আইন ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা নয়, বাংলাদেশ সরকারের বিরোধিতা করে, এমন সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা। সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে শুধু তার অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে। ক্যাডম্যান ‘মুক্তমনা’ ব্লগারদের হত্যার বিরোধী, কিন্তু তিনি মনে করেন না যে এসব ব্লগার হত্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা হুমকির মুখ। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বাড়ছে তার কারণ, মাঝামাঝি ক্ষেত্র, তাঁর ভাষায় ‘মিডল গ্রাউন্ড’ আর থাকছে না। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বা অন্য ঘাতক-দালালদের ফাঁসির ফলে জঙ্গিবাদের মোকাবিলার বদলে বরং তাদের উসকে দেওয়া হচ্ছে। ক্যাডম্যানের সবচেয়ে বেশি আপত্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের জন্য সমালোচনার বদলে তাঁর হাত শক্ত করার যে প্রস্তাব সদানন্দ করেছেন, তা নিয়ে। তাহলে তো মিসরে জেনারেল সিসি বা সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদ যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন, আমাদের তারও সমর্থন জানাতে হয়। তাঁরাও তো জঙ্গিবাদের বিরোধিতার নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মেরে লাশ বানাচ্ছেন! টবি মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য যা দরকার তা হলো গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। ‘মধ্যভূমি’ ধ্বংসের যে কাজে হাসিনা নেমেছেন, তাতে সে কাজটি অর্জিত হবে না।
সদানন্দ ধুমের লেখা পড়ে এমন ভ্রম হতে পারে যে ভদ্রলোক বুঝি হাসিনা সরকারের ‘পেইড এজেন্ট’। বাংলাদেশ সরকারের বাকপটু তথ্যমন্ত্রীকেও বিন্দুমাত্র চোখের পাতা না কাঁপিয়ে এমন ভাষায় তাঁর সরকারের প্রশস্তি গাইতে শুনিনি। আমি অবশ্য খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এই ভদ্রলোক আগাগোড়াই বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের পক্ষে নানা সময়ে প্রশস্তিমূলক উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছ থেকে দু-চার সবক নিতে পারে, বছর দুয়েক আগে এমন কথা লিখে তিনি আমাদের পাকিস্তানি মিত্রদের গাত্রদাহের কারণ হয়েছিলেন। বাংলাদেশ এখন আর ‘বাস্কেট কেস নয়’, এ কথাও তাঁরই। এসব লেখার জন্য ঢাকা থেকে কোনো উপঢৌকন গেছে, এমন শুনিনি। বস্তুত, সদানন্দ ধুমের সব লেখাই এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের আদর্শগত অবস্থান থেকে লেখা। ফিলিস্তিন থেকে জঙ্গিবাদ, ইরানের সঙ্গে আণবিক চুক্তি থেকে কিউবার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন, এমন প্রতিটি প্রশ্নে এই সংস্থা তাদের অতি কট্টর ডানপন্থী অবস্থানের জন্য সুপরিচিত। ফলে সদানন্দ যে হাসিনা সরকারের জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছেন, তা নিজের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে বিচার-বিবেচনা করেই লেখা।
অন্যদিকে টবি ক্যাডম্যান তাঁর ইসলামি ক্লায়েন্টদের নির্ভরশীল উকিল হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর প্রধান উষ্মা, যে ঘাতক-দালাল বিচারের প্রক্রিয়া বাংলাদেশে চলছে, তার মান আন্তর্জাতিক বিধিসম্মত নয়। সে কারণে তিনি কামারুজ্জামান গংদের ফাঁসির বিপক্ষে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মান বলতে তিনি কী বোঝান, তা খুব খোলাসা করে বলেননি। নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হলেও ঘাতক-দালালদের চলতি বিচার অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে বাংলাদেশের আইন পরিষদে গৃহীত আইনের ভিত্তিতে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ ফাঁসির রায়ের সমালোচনা করেছে, কারণ তাদের চোখে ফাঁসি অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমেরিকাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সে ব্যবস্থা চালু রয়েছে। জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘না’ বলল বলেই সেই ব্যবস্থা বেআইনি হয়ে গেল, তা নয়। গত বছরও আমেরিকায় ৩৫ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, সেসব নিয়ে কেউ টুঁ-শব্দটিও করেনি।
টবি উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন, ঘাতক-দালালদের বিচার কেবল হাসিনা সরকারের সিদ্ধান্ত নয়, এর পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের জনগণের দাবি। সেখানে এই বিচারের পক্ষে জনসমর্থন প্রায় নিরঙ্কুশ। প্রায় বলছি, কারণ দেশে এখনো ২ থেকে ৫ শতাংশ জামায়াতপন্থী আছে, যাদের যদি ঘাতকপন্থী বলা হয়, তাতে খুব অন্যায় হবে না। কাগজে-কলমে নিয়মনীতি মেনে চলার পাশাপাশি নাগরিক সম্মতি ও সমর্থনের একটি ওজন রয়েছে, তা যেকোনো আইনি প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে বাধ্য।
টবি মনে করেন, ঘাতক-দালালদের বিচারের নামে হাসিনা সরকার আসলে একটি রাজনৈতিক খেলায় নেমেছে, যার লক্ষ্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা নয়, জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করা। এ কথা থেকে বোঝা যায় টবির আসল আপত্তি কোথায়। তাঁর মক্কেলকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে ফাঁসি দিলে তিনি হয়তো আপত্তির কারণ দেখতেন না। স্পষ্টতই, তিনি যে কথাটা বোঝেন না বা মানেন না, তা হলো কাদের মোল্লা বা কামারুজ্জামানের মতো লোকগুলো রাজনীতিক নন, তাঁরা খুনি, মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধে দোষী। চিহ্নিত ও প্রমাণিত এসব অপরাধীকে শাস্তি দিলে বাংলাদেশের ‘মিডল গ্রাউন্ড’ কেন নিশ্চিহ্ন হবে, তা স্পষ্ট নয়। আর এই জামায়াতিদের যদি ‘মিডল গ্রাউন্ড’ বলা হয়, তাহলে সে কথা শুনে বাংলাদেশের লোক সমস্বরে এমন অট্টহাসি দিয়ে উঠবে, যা তিনি হয়তো আটলান্টিকের ওপার থেকেও শুনতে পাবেন।
ইসলামি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের অবস্থানের একটি ভূ-রাজনৈতিক চরিত্র রয়েছে, সদানন্দ বা টবি কেউই সেদিকে নজর দেননি। পাকিস্তান এই জঙ্গিবাদের একটি প্রধান ঘাঁটি। আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতনের পর হাজার হাজার আন্তর্জাতিক জঙ্গি সে দেশের সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। পরে তাদের অনেকে বাংলাদেশ হয়ে ইউরোপ ও আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে এই পরিচিতি লাভের পর জঙ্গিবাদের লড়াইয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা ভিন্ন মাত্রা গ্রহণ করে। বাংলাদেশের নিজস্ব ‘ঘরে বোনা’ সন্ত্রাসীও রয়েছে, যাদের অনেকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব কারণে আমেরিকা ও ভারতের কাছে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব বেড়ে যায়। বিএনপি আমলে দেশি-বিদেশি জঙ্গিরা নিরাপদ আশ্রয় পায়। অন্যদিকে হাসিনা সরকার তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। হাসিনা সরকার নিজেরাও জঙ্গিবাদের শিকার, সেই অভিজ্ঞতা থেকে তারা সাগ্রহে আমেরিকা ও ভারত উভয়ের সঙ্গেই জঙ্গিবাদবিরোধী আঁতাতে যুক্ত হয়েছে।
হাসিনা সরকারের আমলে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র পিছু হটেছে, টবির এই উপসংহার সম্পূর্ণ ভ্রান্ত নয়। কিন্তু আমেরিকা বা ভারত কেউই সে ব্যাপারে তেমন উদ্বিগ্ন নয় বলেই মনে হয়। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতার চেয়ে তাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে নিজেদের পাশে রাখা। হাসিনা এ ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝে ফেলেছেন। মাস তিনেক আগে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের আমেরিকাকে যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি আমেরিকার প্রয়োজন বাংলাদেশকে। জঙ্গিবাদের সমস্যা যদি মাথায় রাখি, তাহলে তাঁর এ কথা মোটেই বাচালতা মনে হয় না।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments