শালবনের কফিনে শেষ পেরেক by মোকারম হোসেন
গাছকাটা ও পাচারসহ বনভূমি দখলবাজির কারণে শালবন ধ্বংস |
কিছুদিন
আগে শালবন সম্পর্কে একজন প্রকৃতি গবেষকের মন্তব্য ছিল এ রকম—সংকটাপন্ন
কোনো রোগীকে যেমন আইসিইউতে রেখে তার স্বজনেরা বাইরে উদ্বিগ্ন সময় কাটায়
এবং কিছুক্ষণ পরপরই চিকিৎসকের কাছে তার পরিস্থিতি জানতে চায়, শালবনের
অবস্থা এখন অনেকটা সে রকমই। বাস্তবেও আমাদের একসময়ের রাজসিক শালবন এখন
আইসিইউতে। আর গাছপালার কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী চিন্তিত ভঙ্গিতে বাইরে পায়চারি
করছেন। বন বিভাগ হয়তো যেকোনো সময় এমন একটি ঘোষণাও দিতে পারে যে দেশে এখন
আর শালবন বলতে কিছু নেই। যদি এমন কিছু ঘটেও তাহলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
কারণ, শালবন এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে ঠেকেছে। ১৯৮৭ সালের দিকে বন
বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বনের ভেতর বিদেশি গাছ লাগানো আরেকটি আত্মঘাতী কাজ।
শালবনকে নতুনভাবে জেগে ওঠার সুযোগ না দিয়ে কৃত্রিমভাবে বন তৈরির চেষ্টা
খুবই হাস্যকর ও হঠকারী উদ্যোগ। একসময় আয়তনের দিক থেকে দেশের সমতল অঞ্চলে
সম্ভবত শালবনই সবচেয়ে বড় ছিল। এমনকি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারত পর্যন্ত
ছিল এর বিস্তৃতি। নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা গ্রন্থে অধ্যাপক দ্বিজেন
শর্মা জানিয়েছেন, ‘ভারতের ডুয়ার্স থেকে মেঘালয়ের গারো পাহাড় পর্যন্ত
বিস্তৃত শালবন গোটা বরেন্দ্র অঞ্চল হয়ে ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও
কুমিল্লা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।... প্লিয়োস্টিন যুগের ২ লক্ষ বছর আগে
শেষ ভূমিকম্পে সৃষ্ট লালমাটির আত্মজ এই শালবন খুবই প্রাচীন।’
জীবনে প্রথম কয়েকটি শালগাছ দেখি কুমিল্লার ময়নামতির শালবন বিহারে। সেখান থেকে ফেরার পর অনেকবার ভেবেছি, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি শালগাছ এখানে কোথা থেকে এল। পরে অবশ্য এই প্রশ্নের জবাব পেয়েছি। ময়নামতির গাছগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ভৌগোলিক বিবর্তন, বেদখল প্রক্রিয়া এবং অপরিকল্পিত বসতি সারা দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শালবনকে নিশ্চিহ্ন করেছে। ময়নামতির পর অসংখ্যবার গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও দিনাজপুরের শালবনগুলো দেখেছি। যতবারই দেখেছি ততবারই কোনো না কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছি। প্রায় নিঃশেষ, ক্ষয়িষ্ণু বন নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বনের ভেতর কোথাও আরণ্যক নিবিড়তা নেই। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা অল্পবয়সী গাছগুলোর গোড়া একেবারেই সাফসুতরো। মানুষের পদপিষ্ট লতাগুল্মগুলো মৃত্যুর প্রহর গুনছে। বনে আশ্রিত প্রাণিকুল ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়েছে।
মাস খানেক আগে গাজীপুরের হাতিয়াবিবি এলাকায় আরণ্যকে বেড়াতে গিয়ে নিজের চোখে যে দৃশ্য দেখেছি, তা বর্বরোচিত ও জঘন্য। আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় শালগাছগুলো আগুনে দগ্ধ। বনের ভেতরে এই দৃশ্য আরও বীভৎস। যতই হাঁটতে থাকি ততই হতাশায় আচ্ছন্ন হই। শালবনের এমন ঝলসানো চেহারা দেখলে যে কারোরই মন খারাপ হবে। আগুনে শুধু শালগাছই নয়, বনের যাবতীয় প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। শালবনে কেন আগুন লাগানো হয়েছে, স্থানীয় সূত্র থেকে এই প্রশ্নের একাধিক উত্তর পাওয়া যায়। যার অন্যতম হলো জ্যান্ত গাছ পুড়িয়ে লাকড়ি বানিয়ে সংগ্রহ করা। এই প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় সুবিধা শালবন দখল করা। গাছ পুড়ে যতই বনের আয়তন সংকুচিত হবে, ততই দখল করতে সুবিধা। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও নতুন নতুন কৌশল। স্থানীয় বাসিন্দারা বনের কিনারায় অগভীর অংশে পালিত বৃক্ষ রোপণ করে পরবর্তী সময়ে জায়গাটি নিজেদের বলে দাবি করে। তাদের যুক্তি, শিল্পপতিরা যদি বন দখল করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না!
শালবন নিয়ে নৈরাজ্যের যেন আর শেষ নেই। এসব দেখারও যেন কেউ নেই। কাগজ-কলমে বন বিভাগ শালবনের অভিভাবক হলেও তারা যে বন রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ, সে কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। অথচ আমরা কেউ কি একবারও ভেবেছি, শালবন ধ্বংস হওয়া মানে দেশের একটি অন্যতম প্রাণভান্ডারের বিলুপ্তি ঘটা। কারণ, শালবন আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেম। শালবন মানে শুধু শালগাছই নয়, অসংখ্য লতাগুল্ম, অন্যান্য বৃক্ষ ও বিচিত্র প্রাণীদের আবাসও এখানে। গবেষকদের মতে, এই বনে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্মের বসবাস। আমাদের একমাত্র বুনো রঙ্গন, বুনো কুল, কুম্ভি, উলটচণ্ডাল, গোয়ালিয়া লতাসহ আরও অনেক কন্দজ ও পরজীবী এখানে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। একজন বৃক্ষপ্রেমী বা গবেষক যদি প্রতি মাসে একবার শালবনে যান, তাহলে প্রতিবারই তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে কোনো না কোনো নতুন কিছু। বছরজুড়ে থাকে বিচিত্র ফুল, ফল, লতাগুল্ম, কন্দজ আর তৃণ নিয়ে অফুরন্ত প্রাণবৈচিত্র্যের সমাহার। টিকে থাকা যৎসামান্য এই শালবনকে এখন তৃতীয় প্রজন্মের বন মনে করা হয়।
শালবন বিলুপ্ত হলে শুধু যে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হবে তা নয়, বনের ওপর নির্ভরশীল অনেকগুলো নৃ-গোষ্ঠীও বিপন্ন হবে। বর্তমানে যদিও তারা বনের ওপর নির্ভরশীল নয়, তবু বহিরাগতদের চাপে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়ার আশঙ্কা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রায় বিশ বছর আগে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা গ্রন্থে শালবনের যে চিত্র তুলে ধরেছেন, সেখানেও নিঃশেষিত বনের কথা আছে। আছে বনজীবী মানুষের হাহাকারের কথা। বিশ বছর পর এই চিত্র আরও চূড়ান্ত হয়েছে মাত্র।
২০১০ সালের ৪ মার্চ প্রথম আলোয় ‘জাতীয় বৃক্ষ, পুষ্প উৎসব ও অন্যান্য’ শিরোনামে একটি লেখা লিখি। তাতে শালগাছকে আমাদের জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করার প্রস্তাব করি। কারণ, দারু মূল্য, পাতার আকৃতি, বংশবৃদ্ধির কৌশল—সবকিছুতেই এরা অনন্য। শালকে জাতীয় বৃক্ষ করা হলে দুটি কাজ হতো। প্রথমত, শাল সম্পর্কে মানুষ নতুন করে জানতে আগ্রহী হতো; দ্বিতীয়ত, গাছটি কিছুটা হলেও রক্ষা পেত। আমরা কি পারি না দেশের অবশিষ্ট বনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে? আমার বিশ্বাস, দেশের অধিকাংশ মানুষই বন দখল করতে চায় না। আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে মুষ্টিমেয় দখলকারীরা দাঁড়তেই সাহস পাবে না।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক: তরুপল্লব
tarupallab@gmail.com
জীবনে প্রথম কয়েকটি শালগাছ দেখি কুমিল্লার ময়নামতির শালবন বিহারে। সেখান থেকে ফেরার পর অনেকবার ভেবেছি, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি শালগাছ এখানে কোথা থেকে এল। পরে অবশ্য এই প্রশ্নের জবাব পেয়েছি। ময়নামতির গাছগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ভৌগোলিক বিবর্তন, বেদখল প্রক্রিয়া এবং অপরিকল্পিত বসতি সারা দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শালবনকে নিশ্চিহ্ন করেছে। ময়নামতির পর অসংখ্যবার গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও দিনাজপুরের শালবনগুলো দেখেছি। যতবারই দেখেছি ততবারই কোনো না কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছি। প্রায় নিঃশেষ, ক্ষয়িষ্ণু বন নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বনের ভেতর কোথাও আরণ্যক নিবিড়তা নেই। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা অল্পবয়সী গাছগুলোর গোড়া একেবারেই সাফসুতরো। মানুষের পদপিষ্ট লতাগুল্মগুলো মৃত্যুর প্রহর গুনছে। বনে আশ্রিত প্রাণিকুল ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়েছে।
মাস খানেক আগে গাজীপুরের হাতিয়াবিবি এলাকায় আরণ্যকে বেড়াতে গিয়ে নিজের চোখে যে দৃশ্য দেখেছি, তা বর্বরোচিত ও জঘন্য। আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় শালগাছগুলো আগুনে দগ্ধ। বনের ভেতরে এই দৃশ্য আরও বীভৎস। যতই হাঁটতে থাকি ততই হতাশায় আচ্ছন্ন হই। শালবনের এমন ঝলসানো চেহারা দেখলে যে কারোরই মন খারাপ হবে। আগুনে শুধু শালগাছই নয়, বনের যাবতীয় প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। শালবনে কেন আগুন লাগানো হয়েছে, স্থানীয় সূত্র থেকে এই প্রশ্নের একাধিক উত্তর পাওয়া যায়। যার অন্যতম হলো জ্যান্ত গাছ পুড়িয়ে লাকড়ি বানিয়ে সংগ্রহ করা। এই প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় সুবিধা শালবন দখল করা। গাছ পুড়ে যতই বনের আয়তন সংকুচিত হবে, ততই দখল করতে সুবিধা। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও নতুন নতুন কৌশল। স্থানীয় বাসিন্দারা বনের কিনারায় অগভীর অংশে পালিত বৃক্ষ রোপণ করে পরবর্তী সময়ে জায়গাটি নিজেদের বলে দাবি করে। তাদের যুক্তি, শিল্পপতিরা যদি বন দখল করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না!
শালবন নিয়ে নৈরাজ্যের যেন আর শেষ নেই। এসব দেখারও যেন কেউ নেই। কাগজ-কলমে বন বিভাগ শালবনের অভিভাবক হলেও তারা যে বন রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ, সে কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। অথচ আমরা কেউ কি একবারও ভেবেছি, শালবন ধ্বংস হওয়া মানে দেশের একটি অন্যতম প্রাণভান্ডারের বিলুপ্তি ঘটা। কারণ, শালবন আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেম। শালবন মানে শুধু শালগাছই নয়, অসংখ্য লতাগুল্ম, অন্যান্য বৃক্ষ ও বিচিত্র প্রাণীদের আবাসও এখানে। গবেষকদের মতে, এই বনে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্মের বসবাস। আমাদের একমাত্র বুনো রঙ্গন, বুনো কুল, কুম্ভি, উলটচণ্ডাল, গোয়ালিয়া লতাসহ আরও অনেক কন্দজ ও পরজীবী এখানে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। একজন বৃক্ষপ্রেমী বা গবেষক যদি প্রতি মাসে একবার শালবনে যান, তাহলে প্রতিবারই তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে কোনো না কোনো নতুন কিছু। বছরজুড়ে থাকে বিচিত্র ফুল, ফল, লতাগুল্ম, কন্দজ আর তৃণ নিয়ে অফুরন্ত প্রাণবৈচিত্র্যের সমাহার। টিকে থাকা যৎসামান্য এই শালবনকে এখন তৃতীয় প্রজন্মের বন মনে করা হয়।
শালবন বিলুপ্ত হলে শুধু যে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হবে তা নয়, বনের ওপর নির্ভরশীল অনেকগুলো নৃ-গোষ্ঠীও বিপন্ন হবে। বর্তমানে যদিও তারা বনের ওপর নির্ভরশীল নয়, তবু বহিরাগতদের চাপে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়ার আশঙ্কা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রায় বিশ বছর আগে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা গ্রন্থে শালবনের যে চিত্র তুলে ধরেছেন, সেখানেও নিঃশেষিত বনের কথা আছে। আছে বনজীবী মানুষের হাহাকারের কথা। বিশ বছর পর এই চিত্র আরও চূড়ান্ত হয়েছে মাত্র।
২০১০ সালের ৪ মার্চ প্রথম আলোয় ‘জাতীয় বৃক্ষ, পুষ্প উৎসব ও অন্যান্য’ শিরোনামে একটি লেখা লিখি। তাতে শালগাছকে আমাদের জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করার প্রস্তাব করি। কারণ, দারু মূল্য, পাতার আকৃতি, বংশবৃদ্ধির কৌশল—সবকিছুতেই এরা অনন্য। শালকে জাতীয় বৃক্ষ করা হলে দুটি কাজ হতো। প্রথমত, শাল সম্পর্কে মানুষ নতুন করে জানতে আগ্রহী হতো; দ্বিতীয়ত, গাছটি কিছুটা হলেও রক্ষা পেত। আমরা কি পারি না দেশের অবশিষ্ট বনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে? আমার বিশ্বাস, দেশের অধিকাংশ মানুষই বন দখল করতে চায় না। আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে মুষ্টিমেয় দখলকারীরা দাঁড়তেই সাহস পাবে না।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক: তরুপল্লব
tarupallab@gmail.com
No comments