নিধন ভয়ে আসে না অতিথি পাখি
প্রতি
বছর পৃথিবীর নানা দেশ থেকে লাখো অতিথি পাখি আসে টাংগুয়ার হাওরে। তবে এবার
পাখি এসেছে অন্য বছরের চেয়ে অনেক কম। স্থানীয়ভাবে হাওরের নিরাপত্তার
দায়িত্ব থাকা প্রশাসন শীতের শুরুতেই পাখি নিধন বন্ধ করতে না পারায় পাখি
ধরার হিড়িক পড়েছে এ হাওরে। অন্যদিকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত এই হাওরে
পাখির নিরাপদ আবাসস্থল তৈরিতে কোন উদ্যোগ নেই। ফলে বিশাল এই টাংগুয়ার হাওর
থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে অতিথি পাখিরা। এলাকাবাসীরা জানায়, এক সময়
টাংগুয়ার হাওরের পার্শ্ববর্তী মাটিয়ান ও শনির হাওরে শীত মওসুমে কৃষকরা
পাখির কবল থেকে ধান রক্ষা করতে রাত জেগে পাহারা দিতেন। তারপরও সুদূর
সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা অতিথি পাখির কবল থেকে
ফসলি জমির ধান রক্ষা করা কঠিন ছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্দিয়াতা
গ্রামের এক কৃষক জানান, এই বিশাল টাংগুয়ার হাওর জেলা প্রশাসনের তদারকিতে
আসার পর হাওরে অবাধে শুরু হয় পাখি নিধন। তাই আর রাত জেগে পাখিদের কবল থেকে
ফসল রক্ষা করতে হয় না হাওরপাড়ের কৃষকদের। শিকারিদের জ্বালায় উল্টো পাখিরাই
এখন অতিষ্ঠ। সূত্র মতে, শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া,
নেপালসহ প্রথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে লেনজা
হাস, পিং হাস, বালি হাঁস, সরালি কাইম, গঙ্গা কবুতর, কালাকুড়া, পিয়ারিসহ
হাজারও অতিথি পাখি আসে। এবার কিন্তু তার উল্টো। এখন পর্যন্ত অতিথি পাখি
চোখে পড়েনি। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, টাংগুয়া হাওরের নিরাপত্তার
জন্য উপজেলার রামসিংপুর গ্রামে ১টি আনসার ক্যাম্প, গোলাবাড়ী গ্রামে ১টি
ক্যাম্প, মন্দিয়াতা গ্রামে ১টি ক্যাম্প, ধর্মপাশা উপজেলার রংসি গ্রামে ১টি
ক্যাম্পসহ মোট চারটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। আর প্রতিটি ক্যাম্পে ৮ জন করে
মোট ৩২ জন আনসার দায়িত্ব পালন করেন। তাদের পাশাপাশি কমিউনিটিগার্ড পুলিশও
দায়িত্ব পালন করেন। আর তাদের তদারকি করেন জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী
ম্যাজিস্ট্রেট। পাখি শিকারি দলের সঙ্গে আঁতাত রয়েছে হাওর রক্ষার দায়িত্বে
থাকা আইশৃঙ্খলা বাহিনী, আইইউসিএন, সিএনআর ও কমিউনিটিগার্ড পুলিশদের। অভিযোগ
উঠেছে, আনসার, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইসিইউএন, সিএনআরএস, কমিউনিটি গার্ড
ও ম্যাজিস্ট্রেটের নৌকার মাঝিদের ম্যানেজ করে অসাধু পাখি শিকারিরা ফাঁদ
পেতে পাখি শিকার করছে। আর এসব অতিথি পাখি বিক্রি হচ্ছে উপজেলার বিভিন্ন
বাজারসহ জেলা শহরে চড়া দামে। তবে পাখি শিকারিরা অপরিচিত কারও কাছে বিক্রি
করে না। শুধু পরিচিতদের মাধ্যমেই চলে পাখি বেচাকেনা। গ্রামের চায়ের দোকানে
অতি গোপনে দু-একটি পাখি রাখা হয়। দরদাম ঠিক হলে পরে বাড়ি থেকে চাহিদামতো
সরবরাহ করা হয় পাখি। অথবা মোবাইলের মাধ্যমে দরদাম ঠিক করে রাতের আঁধারে অতি
গোপনে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয় অতিথি পাখি। বর্তমানে ১২০০ টাকা দামে একজোড়া
পাখি বিক্রি হচ্ছে। সম্পতি তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের রবিন মিয়া নামে এক পাখি বিক্রেতাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। সোলেমানপুর
গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, হাওরে দায়িত্বে থাকা আনসার কমিউনিটি গার্ড ও
নৌকার মাঝিদের প্রতি রাতে টাকা দিলেই জাল, বিষ টোপ ও ফাঁদ দিয়ে পাখি শিখার
করা যায়। ম্যাজিস্ট্রেটের চোখ ফাঁকি দিয়ে অসৎ একটি চক্র পাখি শিকার অব্যাহত
রেখেছে। টাংগুয়ার হাওরে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের নৌকার মাঝি উত্তর
শ্রীপুর ইউনিয়নের রূপনগর গ্রামের উজ্জ্বল মিয়া, রামসিংপুর গ্রামের মনির
হোসেন,কামালপুর গ্রামের শফিক মিয়া ও গোলাবাড়ী গ্রামের হোসেন মোটা অঙ্কের
টাকার বিনিময়ে প্রতি রাতে পাখি শিকারিদের পাখি ধরার করার সুযোগ করে দেয় বলে
হাওরে গিয়ে জানা গেছে। তাহিরপুর সিএনআরএসের প্রকল্প সমন্বয়কারী ইয়াহিয়া
সাজ্জাদ তাদের নৌকার মাঝিদের টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘পাখি
আগের তুলনায় অনেক কম শিকার করা হয়। তবে হাওর পাড়ের কিছু অসাধু পাখি
শিকারিরা রাতে পাখি শিকার করে বলে শোনা যাচ্ছে।’ টাংগুয়ার হাওরের
দায়িত্বরত জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ জোবায়ের আহমেদ বলেন,
‘রাতের আঁধারে কিছু অসাধু পাখি শিকারি ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করার কথা শোনা
যাচ্ছে। হাওরে যাতে কেউ অতিথি পাখি শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা
যথেষ্ট তৎপর রয়েছি।’
No comments