জাতীয় রাজনীতি পরিশুদ্ধ না হলে ছাত্র রাজনীতিতে শৃংখলা আসবে না by বিমল সরকার
ছাত্রলীগ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং
দেশবাসীর জন্য এখন অনেক অশান্তি, দুর্গতি, দুর্নাম ও বিড়ম্বনার কারণ।
পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের প্রথমদিককার অর্জিত গৌরব-গরিমাকে বর্তমান
ছাত্রলীগ ধরে রাখতে পারেনি। নানা ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকারের
অর্জিত সাফল্য অনেকটাই ম্লান করে দিচ্ছেন ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতাকর্মী।
তাই কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয়, খোদ আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যেও অনেকে
তাদের ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোও সরব
ও সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
ইদানীং আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতি এবং চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দখল, আতংক- এ ধরনের শব্দগুলো অনেকটা একাকার হয়ে পড়েছে। যখন যেখানেই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নৈরাজ্য, দখল ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মতো কোনো ঘটনা সংঘটিত হয়, সেখানেই কোনো না কোনোভাবে ছাত্র রাজনীতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের একটি গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহ্য রয়েছে ছাত্র রাজনীতিরও। প্রতিটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দেশের ছাত্র-যুবসমাজের আত্মত্যাগ ও গৌরবদীপ্ত ভূমিকা গোটা জাতির জন্যই উৎসাহ-অনুপ্রেরণার উৎস। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে গত দুই যুগ ধরে উচ্চশিক্ষা দানকারী নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে মফস্বল এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বলতে গেলে দেশের সর্বত্র যা ঘটে চলেছে, তা সহজে ব্যক্ত করার নয়। এমন কোনো দুষ্কর্ম বাদ নেই যা আজকাল ছাত্ররাজনীতির নামে সংঘটিত হচ্ছে না। গুণধর ছাত্রনেতা বা কর্মীদের কীর্তিকলাপের যেসব বর্ণনা সময় সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তা উল্লেখ করতে যে কারোরই রুচিতে বাধে। এক্ষেত্রে নেতা ও কর্মীতে খুব একটা ব্যবধান নেই। সবার লক্ষ্যই যেন এক- আনো, লুটেপুটে খাও, ফুর্তি কর আর আখের গোছাও। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যাওয়াটা স্বাধীনতা লাভের পর বিরাজমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও, এমনকি আশির দশকেও সহজে কল্পনা করা যেত না। বিশ্বের ছোট-বড়, উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত বোধকরি একটি রাষ্ট্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে চাকরি বা দৃশ্যমান কোনো পেশায় জড়িত না হয়ে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সে বাড়ি-গাড়িসহ কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
আশির দশক থেকে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে হয়ে ওঠে অশান্ত। সরকারি নির্দেশে কেবল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অনেক সময় সারা দেশের স্কুল-কলেজগুলোও সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি মাসের পর মাস ধরে বন্ধ রাখতে হয়েছে। এ সময় ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে একতাবদ্ধ হয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করে। অবশেষে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি পায় গণতন্ত্র।
১৯৯১ সালে দেশে নতুন করে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। বিএনপি সরকার গঠন করে। নব্বইয়ের ছাত্র ও গণআন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকা পালন, ক্ষমতাসীনদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা কিংবা ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথা বিবেচনায় রেখে বিএনপি (১৯৯১-১৯৯৬) তার ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর (১৯৯৬-২০০১) ছাত্রলীগ নেতারাও একই কারণে দলের কাছে অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। এভাবে উভয় দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ক্রমে বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকেন। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে প্রায় সবখানেই বিস্তৃত হতে থাকলেও ছাত্র সংগঠনগুলোর গুণধর নেতাকর্মীদের দমনে বা এসব প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই গত দুই যুগ ধরে নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা ও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কোনো সংগঠনেরই বেপরোয়া ছাত্রনেতারা বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেননি। এ দুবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত। দেশবাসীও ছিলেন এদিক থেকে অনেকটা নিরুপদ্রব; নিরীহ মানুষ বলতে গেলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাহীন জীবন কাটান। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে (২০০৯-২০১৩) ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়ে যায়। এ সময়ে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, দেশজুড়ে অনেক অশান্তি, দুর্গতি ও দুর্ভাবনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ তথা ছাত্র রাজনীতি, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ পরিণাম নিয়ে সুশীল সমাজের অনেকেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে (১৯৯৬-২০০১) অনেকবার প্রদত্ত ভাষণে বর্তমান ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সাময়িকভাবে হলেও ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বারবার আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারে তার গুরুত্বপূর্ণ অভিমত, মন্তব্য ও আহ্বান সে সময় সচেতন মহলে ব্যাপক উৎসাহ ও আশার সঞ্চার করলেও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইতিবাচক সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। প্রসঙ্গত, মিতভাষী এ সাবেক রাষ্ট্রপতি ছাত্র রাজনীতির মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে যতগুলো অনুষ্ঠানে যতবার নির্দ্বিধায় কথা বলেছেন, গত ৪৪ বছরে আর কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের মুখ থেকে এরূপ কথা উচ্চারিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ক্ষমতাপিয়াসী বড় দুটি দলেরই একটি ক্ষেত্রে দেউলিয়াপনা ও দীনতার বিষয়টি দেশবাসীর কাছে বোধকরি আজ অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নানাভাবে নষ্ট-ভ্রষ্ট ছাত্র রাজনীতির ওপর ভর না করে কখনও যে সহজে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া যাবে না কিংবা কোনো না কোনোভাবে অধিষ্ঠিত হলেও বেশিদিন অবস্থান করা যাবে না, তা তাদের হিসাবে রয়েছে। আর এ দুর্বলতার সুযোগটিই বরাবর লুফে নিচ্ছে স্বার্থান্বেষী ও সুযোগসন্ধানী মতলববাজ ছাত্রনেতারা।
সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি থাকলে কোনো সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যেই এ ধরনের বেপরোয়াপনা সহজে জন্মাতে পারত না। আর রাজনীতি কলুষমুক্ত থাকলে ছাত্র রাজনীতি নিয়েও এমন বিতর্ক সৃষ্টির অবকাশ থাকত না। মনে রাখা দরকার, পঙ্কিলতার আবর্তে ঘূর্ণায়মান বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি আশা করা অনেকটা দুরাশারই নামান্তর। আর অসুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতিতে সংগঠন বিশেষে কিংবা সংগঠনে সংগঠনে সময় সময় এমন হানাহানি-রক্তপাত ঘটতেই থাকবে; ঘটাটাই স্বাভাবিক। আদর্শ-উদ্দেশ্য পরে, এসব কিছুর মূলে রয়েছে সংকীর্ণ স্বার্থ উদ্ধার ও আখের গুছিয়ে নেয়ার নেশা বা প্রতিযোগিতা। বিএনপি আমলে (২০০১-২০০৬) যা করেছে ছাত্রদল, আওয়ামী লীগের আগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) ছাত্রলীগও বলতে গেলে তা-ই করেছিল। গত ২৪ বছরে পৌনঃপুনিকভাবে ক্ষমতায় থাকা বড় দুই দলের ছত্রছায়ায় থেকে মতলববাজ ও স্বার্থপর ছাত্রনেতারা দিন দিন তাল বুঝে এর মাত্রা বাড়িয়েছেন মাত্র, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
অতএব কেবল সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ নয়, বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি সমর্থক ছাত্রদলও নয়; জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্র রাজনীতি নিয়েই ভাবতে হবে। ছাত্র রাজনীতি যে অশান্তি, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির অন্যতম প্রধান কারণ, তা সেতু ও পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ বর্তমান সরকারের আরও অনেকেই বলেছেন। রাজনীতিকে সন্ত্রাসমুক্ত করা গেলে আশি ভাগ এবং শিক্ষাঙ্গন ও ছাত্র রাজনীতিকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে পারলে শতভাগ দুর্নীতি কমে যাবে বলে অনেকবার মন্তব্য করেছেন এ মন্ত্রী। কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের বেপরোয়া নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শেখ হাসিনা নিজে। দুর্ভাগ্যজনক হল এরপরও শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য কমেনি। পবিত্র শিক্ষাঙ্গন রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। তাহলে দেশবাসীর ভরসা রাখার জায়গাটি কোথায়?
তাই আবারও বলতে চাই, ভাবতে হবে গোটা ছাত্র রাজনীতি নিয়েই। তারও আগে ভাবতে হবে আমাদের জাতীয় রাজনীতি নিয়ে। রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করতে না পারলে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ভাবাভাবি কোনো কাজে আসবে না। তবে আপাতত এসব কিছুর শুরুটা করতে হবে ছাত্রলীগকে দিয়েই।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
ইদানীং আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতি এবং চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দখল, আতংক- এ ধরনের শব্দগুলো অনেকটা একাকার হয়ে পড়েছে। যখন যেখানেই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নৈরাজ্য, দখল ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মতো কোনো ঘটনা সংঘটিত হয়, সেখানেই কোনো না কোনোভাবে ছাত্র রাজনীতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের একটি গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহ্য রয়েছে ছাত্র রাজনীতিরও। প্রতিটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দেশের ছাত্র-যুবসমাজের আত্মত্যাগ ও গৌরবদীপ্ত ভূমিকা গোটা জাতির জন্যই উৎসাহ-অনুপ্রেরণার উৎস। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে গত দুই যুগ ধরে উচ্চশিক্ষা দানকারী নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে মফস্বল এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বলতে গেলে দেশের সর্বত্র যা ঘটে চলেছে, তা সহজে ব্যক্ত করার নয়। এমন কোনো দুষ্কর্ম বাদ নেই যা আজকাল ছাত্ররাজনীতির নামে সংঘটিত হচ্ছে না। গুণধর ছাত্রনেতা বা কর্মীদের কীর্তিকলাপের যেসব বর্ণনা সময় সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তা উল্লেখ করতে যে কারোরই রুচিতে বাধে। এক্ষেত্রে নেতা ও কর্মীতে খুব একটা ব্যবধান নেই। সবার লক্ষ্যই যেন এক- আনো, লুটেপুটে খাও, ফুর্তি কর আর আখের গোছাও। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যাওয়াটা স্বাধীনতা লাভের পর বিরাজমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও, এমনকি আশির দশকেও সহজে কল্পনা করা যেত না। বিশ্বের ছোট-বড়, উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত বোধকরি একটি রাষ্ট্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে চাকরি বা দৃশ্যমান কোনো পেশায় জড়িত না হয়ে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সে বাড়ি-গাড়িসহ কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
আশির দশক থেকে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে হয়ে ওঠে অশান্ত। সরকারি নির্দেশে কেবল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অনেক সময় সারা দেশের স্কুল-কলেজগুলোও সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি মাসের পর মাস ধরে বন্ধ রাখতে হয়েছে। এ সময় ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে একতাবদ্ধ হয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করে। অবশেষে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি পায় গণতন্ত্র।
১৯৯১ সালে দেশে নতুন করে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। বিএনপি সরকার গঠন করে। নব্বইয়ের ছাত্র ও গণআন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকা পালন, ক্ষমতাসীনদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা কিংবা ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথা বিবেচনায় রেখে বিএনপি (১৯৯১-১৯৯৬) তার ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর (১৯৯৬-২০০১) ছাত্রলীগ নেতারাও একই কারণে দলের কাছে অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। এভাবে উভয় দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ক্রমে বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকেন। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে প্রায় সবখানেই বিস্তৃত হতে থাকলেও ছাত্র সংগঠনগুলোর গুণধর নেতাকর্মীদের দমনে বা এসব প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই গত দুই যুগ ধরে নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা ও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কোনো সংগঠনেরই বেপরোয়া ছাত্রনেতারা বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেননি। এ দুবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত। দেশবাসীও ছিলেন এদিক থেকে অনেকটা নিরুপদ্রব; নিরীহ মানুষ বলতে গেলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাহীন জীবন কাটান। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে (২০০৯-২০১৩) ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়ে যায়। এ সময়ে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, দেশজুড়ে অনেক অশান্তি, দুর্গতি ও দুর্ভাবনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ তথা ছাত্র রাজনীতি, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ পরিণাম নিয়ে সুশীল সমাজের অনেকেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে (১৯৯৬-২০০১) অনেকবার প্রদত্ত ভাষণে বর্তমান ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সাময়িকভাবে হলেও ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বারবার আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারে তার গুরুত্বপূর্ণ অভিমত, মন্তব্য ও আহ্বান সে সময় সচেতন মহলে ব্যাপক উৎসাহ ও আশার সঞ্চার করলেও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইতিবাচক সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। প্রসঙ্গত, মিতভাষী এ সাবেক রাষ্ট্রপতি ছাত্র রাজনীতির মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে যতগুলো অনুষ্ঠানে যতবার নির্দ্বিধায় কথা বলেছেন, গত ৪৪ বছরে আর কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের মুখ থেকে এরূপ কথা উচ্চারিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ক্ষমতাপিয়াসী বড় দুটি দলেরই একটি ক্ষেত্রে দেউলিয়াপনা ও দীনতার বিষয়টি দেশবাসীর কাছে বোধকরি আজ অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নানাভাবে নষ্ট-ভ্রষ্ট ছাত্র রাজনীতির ওপর ভর না করে কখনও যে সহজে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া যাবে না কিংবা কোনো না কোনোভাবে অধিষ্ঠিত হলেও বেশিদিন অবস্থান করা যাবে না, তা তাদের হিসাবে রয়েছে। আর এ দুর্বলতার সুযোগটিই বরাবর লুফে নিচ্ছে স্বার্থান্বেষী ও সুযোগসন্ধানী মতলববাজ ছাত্রনেতারা।
সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি থাকলে কোনো সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যেই এ ধরনের বেপরোয়াপনা সহজে জন্মাতে পারত না। আর রাজনীতি কলুষমুক্ত থাকলে ছাত্র রাজনীতি নিয়েও এমন বিতর্ক সৃষ্টির অবকাশ থাকত না। মনে রাখা দরকার, পঙ্কিলতার আবর্তে ঘূর্ণায়মান বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি আশা করা অনেকটা দুরাশারই নামান্তর। আর অসুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতিতে সংগঠন বিশেষে কিংবা সংগঠনে সংগঠনে সময় সময় এমন হানাহানি-রক্তপাত ঘটতেই থাকবে; ঘটাটাই স্বাভাবিক। আদর্শ-উদ্দেশ্য পরে, এসব কিছুর মূলে রয়েছে সংকীর্ণ স্বার্থ উদ্ধার ও আখের গুছিয়ে নেয়ার নেশা বা প্রতিযোগিতা। বিএনপি আমলে (২০০১-২০০৬) যা করেছে ছাত্রদল, আওয়ামী লীগের আগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) ছাত্রলীগও বলতে গেলে তা-ই করেছিল। গত ২৪ বছরে পৌনঃপুনিকভাবে ক্ষমতায় থাকা বড় দুই দলের ছত্রছায়ায় থেকে মতলববাজ ও স্বার্থপর ছাত্রনেতারা দিন দিন তাল বুঝে এর মাত্রা বাড়িয়েছেন মাত্র, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
অতএব কেবল সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ নয়, বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি সমর্থক ছাত্রদলও নয়; জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্র রাজনীতি নিয়েই ভাবতে হবে। ছাত্র রাজনীতি যে অশান্তি, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির অন্যতম প্রধান কারণ, তা সেতু ও পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ বর্তমান সরকারের আরও অনেকেই বলেছেন। রাজনীতিকে সন্ত্রাসমুক্ত করা গেলে আশি ভাগ এবং শিক্ষাঙ্গন ও ছাত্র রাজনীতিকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে পারলে শতভাগ দুর্নীতি কমে যাবে বলে অনেকবার মন্তব্য করেছেন এ মন্ত্রী। কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের বেপরোয়া নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শেখ হাসিনা নিজে। দুর্ভাগ্যজনক হল এরপরও শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য কমেনি। পবিত্র শিক্ষাঙ্গন রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। তাহলে দেশবাসীর ভরসা রাখার জায়গাটি কোথায়?
তাই আবারও বলতে চাই, ভাবতে হবে গোটা ছাত্র রাজনীতি নিয়েই। তারও আগে ভাবতে হবে আমাদের জাতীয় রাজনীতি নিয়ে। রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করতে না পারলে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ভাবাভাবি কোনো কাজে আসবে না। তবে আপাতত এসব কিছুর শুরুটা করতে হবে ছাত্রলীগকে দিয়েই।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
No comments