বাংলাদেশে সংসদীয় রাজনীতির করুণ পরিণতি by বদরুদ্দীন উমর
৫ জানুয়ারি ২০১৩, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক
কলংকজনক দিন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে যে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হয়েছিল,
ওই দিন তা এক করুণ পরিণতি লাভ করে ধ্বংসের দোরগোড়ায় এ দেশকে এনে দাঁড়
করিয়েছিল। একটি ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে যে অনির্বাচিত বেসামরিক সরকার
ক্ষমতায় এসেছিল তার সঙ্গে অনির্বাচিত সামরিক সরকারের যে কোনো পার্থক্য
কার্যত নেই এটা এ সরকার তার এক বছরের শাসনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে। শুধু
তাই নয়, অনির্বাচিত ১৫৩ জন সংসদ সদস্য নিয়ে যেভাবে এ সরকার গঠিত হয়েছিল
সেটা এক রাজনৈতিক ভেল্কিবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু এর সব থেকে বিপজ্জনক
দিক হল, সংসদীয় রাজনীতি ধসে গিয়ে এর মাধ্যমে বাংলাদেশে এমন এক সরকার গঠিত
হয়েছে যার ফ্যাসিস্ট চরিত্র নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। এর প্রমাণ জনগণ এবং এ
দেশের গণতান্ত্রিক ও সেই সঙ্গে সংসদীয় বিরোধী সব শক্তি ও দল বিগত ৩৬৫ দিনই
পেয়েছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে যে ব্যবস্থা জারি আছে, একে পুলিশি রাজত্ব ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। দেশের সংবিধান থেকে নিয়ে সাধারণ নিয়ম-কানুনকে পর্যন্ত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এরা যেভাবে নিজেদের বেপরোয়া শাসন চালিয়ে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের ৪৩ বছরের গণতন্ত্রশূন্য শাসনের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণ, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো, এমনকি শাসকশ্রেণীর নিজের ক্ষমতাবহির্ভূত অংশ পর্যন্ত আজ সভা-সমিতি, মিছিল করার অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ দিক দিয়ে সরকারের শাসন নীতি অনুযায়ী জনগণ এখন পুলিশের হাতে জিম্মি। কারণ সভা-সমিতি, মিছিল করার জন্য নির্বাচনের আগে থেকেই পুলিশ ঢাকার মুক্তাঙ্গনকে পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং তা এখনও বলবৎ আছে। এভাবে তারা সভা-সমিতির জায়গা কমিয়ে দিয়েছে। ভিন্নমত প্রকাশের যে কোনো উদ্যোগকে কঠোরভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এরা আইন-শৃংখলা রক্ষার নামে পুলিশের হাতে সব ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। সরকারের নির্দেশে পুলিশ জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছে। একে পুলিশি শাসনব্যবস্থা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? বর্তমান সরকারের এ কার্যকলাপ বিগত নির্বাচনপূর্ব পাঁচ বছরব্যাপী দেখা গেলেও ৫ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের পর এটা এক ভয়াবহ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
ফ্যাসিবাদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, যারা এ ব্যবস্থা পরিচালনা করে তাদের বেপরোয়া কার্যকলাপ। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার মধ্যে সরকারি ও সরকারি দলের লোকদের জবাবদিহিতার কোনো ব্যাপার আজ নেই। যে যেভাবে পারছে চুরি-দুর্নীতি, জনগণের কণ্ঠরোধ, পুলিশি হেফাজতে হত্যা-নির্যাতন, অপহরণ, পুলিশি হেফাজতের বাইরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ নামে সরকারি ঠেঙ্গাড়ে বাহিনী এবং খোদ আওয়ামী লীগের লাগামছাড়া লোকজন জনগণের ওপর যে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, তার সব কিছুই সরকারি নির্দেশে ও তাদের ছাতার তলে থাকার কারণে এর কোনো জবাবদিহিতা নেই। আদালতের কোনো নিয়ন্ত্রণও এ ক্ষেত্রে দৃষ্টিগোচর নয়।
এ সরকারের অধীনে দুষ্কৃতকারী এবং নানা ধরনের অপরাধীর বিচার ও শাস্তির কোনো ব্যবস্থা এ দেশে নেই বললেই সবটুকু বলা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যারা এসব অপকর্ম ও ক্রিমিনাল কাজ করে তাদের শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা আছে। রেলের কর্মচারী ও রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ কেলেংকারিতে ধরা পড়লেও কারও শাস্তি হয়নি। গাড়িতে আটক ৭০ লাখ টাকা গাড়ির মালিককে ব্যাংকে নিজের হিসাবে জমা দিতে দেয়া হয়েছিল, যা এক বড় মাপের দুর্নীতি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সে টাকা কীভাবে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছিল, তা জানার কোনো উপায় নেই। এ কেলেংকারির জন্য রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে তার পদ থেকে অপসারণ করলেও তার দুর্নীতির পুরস্কারস্বরূপ তাকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দফতরবিহীনমন্ত্রী করা হয়েছিল।
বর্তমান সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের লোকজন এবং তাদের সমর্থক ছাড়া কারও কোনো সামান্য চাকরি থেকে নিয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও চাকরি হওয়ার উপায় নেই। এ নীতি তারা প্রথম থেকেই ব্যতিক্রমহীনভাবে কার্যকর করে এসেছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচটি ইমাম একেবারে উলঙ্গভাবে যা বলেছিলেন তা উল্লেখযোগ্য। ছাত্রলীগের এক সভায় তিনি বলেছিলেন, কোনো রকমে
(অর্থাৎ দুর্নীতির মাধ্যমে হলেও) লিখিত পরীক্ষায় পাস করতে পারলে মৌখিক পরীক্ষার জন্য তাদের ভাবনার কারণ নেই। তাদের সবারই চাকরি হবে! তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি যখনই কারও চাকরির তদবিরে যান, তখন তিনি জিজ্ঞেস করেন প্রার্থী আওয়ামী লীগের লোক কি-না। আওয়ামী লীগের লোক হলে তার চাকরি হতে কোনো অসুবিধা নেই!! তার এ বক্তব্যের
পর সরকারি মহলেও কিছু কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও ইমামের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের এ ধরনের কার্যকলাপের কোনো শেষ নেই। প্রতিদিনই তারা এসব কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন কোনো বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই।
এ আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরের শাসনকাল এবং তারপর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে এ দেশের শাসনব্যবস্থায় যা ঘটে চলেছে তার ফিরিস্তি দেয়া ও পর্যালোচনা কোনো কোনো মহল থেকে হচ্ছে। এ নিয়ে কোনো বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। কাজেই খণ্ড খণ্ড উদাহরণ ছাড়া উপায় নেই। এ রকম এক অতি সাম্প্রতিক ঘটনা হল, একটি চার বছরের শিশু ওয়াসার একটি খোলা পাইপের মধ্যে পড়ে নিহত হওয়ার ঘটনা। কাজ শেষ হওয়ার পর ওয়াসা কর্তৃক পাইপের মুখ খোলা রাখার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই তুচ্ছ অবহেলা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং অপরাধের তদন্ত করে ওয়াসার কোনো কর্মকর্তাকে শাস্তি দেয়ার প্রশ্নই বর্তমান সরকারের আমলে ওঠে না! এটা তো গেল এর একটা দিক। এর অন্যদিক হল, দুদিন ধরে নানা ধরনের অকেজো যন্ত্রপাতি নিয়ে ফায়ার ব্রিগেড এবং ওয়াসা ছেলেটিকে উদ্ধার করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এ ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য ছেলেটির অসহায় ও শোকার্ত বাবাকে পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়ে তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়, তাকে ক্রসফায়ারে দেয়ার উদ্দেশ্যে র্যাবের হাতে সমর্পণের হুমকি দেয়। তাদের কথা হল, ছেলেটি নাকি পাইপের মধ্যে পড়েনি! তাকে নাকি তার বাবা অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়েছে, এজন্যই তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!! থানার ওসির এ অপরাধের জন্য শাস্তির কোনো ব্যবস্থা এ সরকারের আমলে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের এক মন্ত্রী সেখানে উপস্থিত হয়ে সরকারি লোকদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য বলেন যে, পাইপের মধ্যে কোনো জীবিত শিশু তো নয়ই, এমনকি মৃত শিশুও নেই!!! অথচ শিশুটির কান্নার শব্দ তার খেলার সাথীরা, অন্য স্থানীয় লোকজন, এমনকি ফায়ার ব্রিগেডের একজন অফিসার পর্যন্ত শুনেছিলেন!!! মন্ত্রীর উপরোক্ত বক্তব্যের পর শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য সরকারি চেষ্টা বন্ধ করা হয়। এখানে যা বিস্ময়ের সঙ্গে বলা দরকার তা হল, সরকারি লোকজন তাদের উদ্ধার-প্রচেষ্টা বন্ধ করার পনেরো মিনিটের মধ্যেই স্থানীয় লোকেরা শিশুটির মৃতদেহ উপরে নিয়ে আসে!!! এর থেকে সরকারের অপদার্থতা ও অমানবিকতার যে প্রমাণ পাওয়া যায় তার থেকে ভয়াবহ একটি দেশ ও সমাজের জন্য আর কী হতে পারে? দেশের জনগণ কি ভয়ংকর অপশাসনের অধীনে জীবন কাটাচ্ছেন তার পরিচয় কি এর মধ্যে পাওয়া যায় না? কিন্তু এর জন্য শেখ হাসিনার সরকার তাদের মন্ত্রীর কাছে কোনো জবাবদিহিতা চায়নি। এর জন্য ওয়াসা ও ফায়ার ব্রিগেডের অপদার্থতা ও অমানবিকতা সরকারকে বিচলিত করেনি।
বিগত ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির ভুয়া নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এ সংক্ষিপ্ত কথা বলার প্রয়োজন হল এ কারণে যে, বাংলাদেশের জনগণের ওপর শুধু শোষণ-শাসনের নিষ্ঠুরতাই চলছে তাই নয়। সব থেকে বিপজ্জনক অবস্থা হল, তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব। এসব কিছুর মধ্যেই আওয়ামী লীগ সরকার তার ফ্যাসিস্ট শাসনেরই স্বাক্ষর রাখছে।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
বর্তমানে বাংলাদেশে যে ব্যবস্থা জারি আছে, একে পুলিশি রাজত্ব ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। দেশের সংবিধান থেকে নিয়ে সাধারণ নিয়ম-কানুনকে পর্যন্ত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এরা যেভাবে নিজেদের বেপরোয়া শাসন চালিয়ে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের ৪৩ বছরের গণতন্ত্রশূন্য শাসনের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণ, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো, এমনকি শাসকশ্রেণীর নিজের ক্ষমতাবহির্ভূত অংশ পর্যন্ত আজ সভা-সমিতি, মিছিল করার অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ দিক দিয়ে সরকারের শাসন নীতি অনুযায়ী জনগণ এখন পুলিশের হাতে জিম্মি। কারণ সভা-সমিতি, মিছিল করার জন্য নির্বাচনের আগে থেকেই পুলিশ ঢাকার মুক্তাঙ্গনকে পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং তা এখনও বলবৎ আছে। এভাবে তারা সভা-সমিতির জায়গা কমিয়ে দিয়েছে। ভিন্নমত প্রকাশের যে কোনো উদ্যোগকে কঠোরভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এরা আইন-শৃংখলা রক্ষার নামে পুলিশের হাতে সব ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। সরকারের নির্দেশে পুলিশ জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছে। একে পুলিশি শাসনব্যবস্থা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? বর্তমান সরকারের এ কার্যকলাপ বিগত নির্বাচনপূর্ব পাঁচ বছরব্যাপী দেখা গেলেও ৫ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের পর এটা এক ভয়াবহ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
ফ্যাসিবাদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, যারা এ ব্যবস্থা পরিচালনা করে তাদের বেপরোয়া কার্যকলাপ। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার মধ্যে সরকারি ও সরকারি দলের লোকদের জবাবদিহিতার কোনো ব্যাপার আজ নেই। যে যেভাবে পারছে চুরি-দুর্নীতি, জনগণের কণ্ঠরোধ, পুলিশি হেফাজতে হত্যা-নির্যাতন, অপহরণ, পুলিশি হেফাজতের বাইরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ নামে সরকারি ঠেঙ্গাড়ে বাহিনী এবং খোদ আওয়ামী লীগের লাগামছাড়া লোকজন জনগণের ওপর যে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, তার সব কিছুই সরকারি নির্দেশে ও তাদের ছাতার তলে থাকার কারণে এর কোনো জবাবদিহিতা নেই। আদালতের কোনো নিয়ন্ত্রণও এ ক্ষেত্রে দৃষ্টিগোচর নয়।
এ সরকারের অধীনে দুষ্কৃতকারী এবং নানা ধরনের অপরাধীর বিচার ও শাস্তির কোনো ব্যবস্থা এ দেশে নেই বললেই সবটুকু বলা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যারা এসব অপকর্ম ও ক্রিমিনাল কাজ করে তাদের শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা আছে। রেলের কর্মচারী ও রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ কেলেংকারিতে ধরা পড়লেও কারও শাস্তি হয়নি। গাড়িতে আটক ৭০ লাখ টাকা গাড়ির মালিককে ব্যাংকে নিজের হিসাবে জমা দিতে দেয়া হয়েছিল, যা এক বড় মাপের দুর্নীতি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সে টাকা কীভাবে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছিল, তা জানার কোনো উপায় নেই। এ কেলেংকারির জন্য রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে তার পদ থেকে অপসারণ করলেও তার দুর্নীতির পুরস্কারস্বরূপ তাকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দফতরবিহীনমন্ত্রী করা হয়েছিল।
বর্তমান সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের লোকজন এবং তাদের সমর্থক ছাড়া কারও কোনো সামান্য চাকরি থেকে নিয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও চাকরি হওয়ার উপায় নেই। এ নীতি তারা প্রথম থেকেই ব্যতিক্রমহীনভাবে কার্যকর করে এসেছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচটি ইমাম একেবারে উলঙ্গভাবে যা বলেছিলেন তা উল্লেখযোগ্য। ছাত্রলীগের এক সভায় তিনি বলেছিলেন, কোনো রকমে
(অর্থাৎ দুর্নীতির মাধ্যমে হলেও) লিখিত পরীক্ষায় পাস করতে পারলে মৌখিক পরীক্ষার জন্য তাদের ভাবনার কারণ নেই। তাদের সবারই চাকরি হবে! তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি যখনই কারও চাকরির তদবিরে যান, তখন তিনি জিজ্ঞেস করেন প্রার্থী আওয়ামী লীগের লোক কি-না। আওয়ামী লীগের লোক হলে তার চাকরি হতে কোনো অসুবিধা নেই!! তার এ বক্তব্যের
পর সরকারি মহলেও কিছু কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও ইমামের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের এ ধরনের কার্যকলাপের কোনো শেষ নেই। প্রতিদিনই তারা এসব কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন কোনো বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই।
এ আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরের শাসনকাল এবং তারপর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে এ দেশের শাসনব্যবস্থায় যা ঘটে চলেছে তার ফিরিস্তি দেয়া ও পর্যালোচনা কোনো কোনো মহল থেকে হচ্ছে। এ নিয়ে কোনো বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। কাজেই খণ্ড খণ্ড উদাহরণ ছাড়া উপায় নেই। এ রকম এক অতি সাম্প্রতিক ঘটনা হল, একটি চার বছরের শিশু ওয়াসার একটি খোলা পাইপের মধ্যে পড়ে নিহত হওয়ার ঘটনা। কাজ শেষ হওয়ার পর ওয়াসা কর্তৃক পাইপের মুখ খোলা রাখার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই তুচ্ছ অবহেলা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং অপরাধের তদন্ত করে ওয়াসার কোনো কর্মকর্তাকে শাস্তি দেয়ার প্রশ্নই বর্তমান সরকারের আমলে ওঠে না! এটা তো গেল এর একটা দিক। এর অন্যদিক হল, দুদিন ধরে নানা ধরনের অকেজো যন্ত্রপাতি নিয়ে ফায়ার ব্রিগেড এবং ওয়াসা ছেলেটিকে উদ্ধার করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এ ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য ছেলেটির অসহায় ও শোকার্ত বাবাকে পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়ে তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়, তাকে ক্রসফায়ারে দেয়ার উদ্দেশ্যে র্যাবের হাতে সমর্পণের হুমকি দেয়। তাদের কথা হল, ছেলেটি নাকি পাইপের মধ্যে পড়েনি! তাকে নাকি তার বাবা অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়েছে, এজন্যই তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!! থানার ওসির এ অপরাধের জন্য শাস্তির কোনো ব্যবস্থা এ সরকারের আমলে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের এক মন্ত্রী সেখানে উপস্থিত হয়ে সরকারি লোকদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য বলেন যে, পাইপের মধ্যে কোনো জীবিত শিশু তো নয়ই, এমনকি মৃত শিশুও নেই!!! অথচ শিশুটির কান্নার শব্দ তার খেলার সাথীরা, অন্য স্থানীয় লোকজন, এমনকি ফায়ার ব্রিগেডের একজন অফিসার পর্যন্ত শুনেছিলেন!!! মন্ত্রীর উপরোক্ত বক্তব্যের পর শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য সরকারি চেষ্টা বন্ধ করা হয়। এখানে যা বিস্ময়ের সঙ্গে বলা দরকার তা হল, সরকারি লোকজন তাদের উদ্ধার-প্রচেষ্টা বন্ধ করার পনেরো মিনিটের মধ্যেই স্থানীয় লোকেরা শিশুটির মৃতদেহ উপরে নিয়ে আসে!!! এর থেকে সরকারের অপদার্থতা ও অমানবিকতার যে প্রমাণ পাওয়া যায় তার থেকে ভয়াবহ একটি দেশ ও সমাজের জন্য আর কী হতে পারে? দেশের জনগণ কি ভয়ংকর অপশাসনের অধীনে জীবন কাটাচ্ছেন তার পরিচয় কি এর মধ্যে পাওয়া যায় না? কিন্তু এর জন্য শেখ হাসিনার সরকার তাদের মন্ত্রীর কাছে কোনো জবাবদিহিতা চায়নি। এর জন্য ওয়াসা ও ফায়ার ব্রিগেডের অপদার্থতা ও অমানবিকতা সরকারকে বিচলিত করেনি।
বিগত ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির ভুয়া নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এ সংক্ষিপ্ত কথা বলার প্রয়োজন হল এ কারণে যে, বাংলাদেশের জনগণের ওপর শুধু শোষণ-শাসনের নিষ্ঠুরতাই চলছে তাই নয়। সব থেকে বিপজ্জনক অবস্থা হল, তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব। এসব কিছুর মধ্যেই আওয়ামী লীগ সরকার তার ফ্যাসিস্ট শাসনেরই স্বাক্ষর রাখছে।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments