ঢাকা বিভাগে রেলের ৪৫৮ একর জমি বেদখল by রাশিম মোল্লাহ
বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় মোট সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার একর। এর মধ্যে ৪৫৮ একর জমিই বেদখলে। এছাড়া রেলভূমিতে গড়ে ওঠা অবৈধ বাজারের সংখ্যা ২৬টি। এসব বাজারের বেশির ভাগ রেললাইনের উপরে গড়ে উঠেছে। রেলের এসব সম্পত্তির বেহাতের মূলে রয়েছে এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ। রেলের বেহাত হওয়া এসব সম্পত্তি কর্মকর্তারা নিজেদের আয়ত্তে আনতে তেমন আগ্রহ নেই। যদিও সময় সময় লোক দেখানো অভিযান চালায় রেলওয়ে। এরই মাঝে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে গেলে পোহাতে হয় আইনি ঝামেলা। এ পর্য়ন্ত রেলের জমি উদ্ধারে ৩৫০টি মামলা হয়েছে। মামলার কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। পুনর্বাসন না করে রেলের বস্তি থেকে উচ্ছেদ না করার হাইকোর্টের একটি রিট রয়েছে বলে রেলের জমি উদ্ধার করা যাচ্ছে না। সমপ্রতি ডাবল রেললাইন করার জন্য রাজধানী দয়াগঞ্জ থেকে গেণ্ডারিয়া স্টেশন পর্যন্ত বেদখলি জমি উদ্ধার করলেও এখনও জুরাইন বাজার রয়েছে আগের মতোই। তবে উদ্ধারের প্রায় এক মাস পার হলেও জমি রক্ষণাবেক্ষণে নেই কোনও কার্যকর উদ্যোগ। জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তারা মাল্টিপারপাস আর স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলীয় নেতা-কর্মীরা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নামে রেলের এসব সম্পত্তি দখল করছে। বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধারে উপর মহলের চাপে তৎপর হলেও উদ্ধার করা যাচ্ছে না। মূলত আইনি জটিলতা, ক্ষমতাসীনদের প্রভাব আর রেলের কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে ব্যাহত হচ্ছে রেলের জমি উদ্ধার তৎপরতা। অভিযোগ রয়েছে, রেলের কর্মকর্তা থেকে শুরুর করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা রয়েছেন এসব দখলের নেপথ্যে। এদিকে, লাইসেন্স নিয়ে যারা ভোগ করছেন রেলের জমি অনেকেই মানছেন না মাস্টার প্লান। রেল লাইন থেকে ২৫ ফুট জায়গা রেখে স্থাপনা নির্মাণের কথা থাকলেও তোয়াক্কা নেই তাদের। বিষয়টি দখলদাররা স্বীকার করে জানালেন, এর জন্য নিয়মিত টাকা দিচ্ছেন তারা। রেলওয়ের দেয়া তথ্য মতে, ঢাকা বিভাগীয় রেলের মোট জমি ১২৭৫১.০২ একর। এর মধ্যে অপারেশনাল ভূমির পরিমান ৫৫৪৮ একর এবং অব্যবহৃত ভূমির পরিমাণ ৩৯৮৬.২৬ একর। বিভিন্ন নামে বেনামে লাইসেন্সধারীর সংখ্যা ৯৩৭৮। এসব লাইসেন্স ধারীর অধীনে রয়েছে প্রায় ৩ হাজার একর জমি। বানিজ্যিক লাইসেন্সেকৃত ভূমির পরিমান ২৭.১৮ একর, কৃষি লাইসেন্সকৃত ভূমির পরিমাণ ২৫৩৬.৫৩ একর, মৎস্য লাইসেন্সকৃত ভূমির পরিমাণ ১৫৬.৮৭ একর, স্কুল, মাদরাসা, কলেজ ভূমির পরিমাণ ৩৫.৩৬ একর, বাকি ৪৫৮.২৮ একর ভূমি অবৈধ দখলে। অবৈধ দখলারদের সংখ্যা ৭৮৮৪ জন। এদিকে রেল লাইনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে অবৈধ বাজার। কেবল সরকারি হিসেবেই ঢাকা বিভাগীয় রেললাইনের উপরে গড়ে ওঠেছে ২৬টি অবৈধ কাঁচাবাজার। এসব অবৈধ বাজারের নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। সরকারি হিসেবে এগুলো সকালের কাঁচাবাজার দেখানো হলেও প্রায় সারা দিন ধরেই চলে বাজারগুলো। সে সঙ্গে রেল লাইনের পাশে গড়ে উঠেছে ছিন্নমূল মানুষের বসবাস। আর এসব বাজার আর বস্তির কারণে কিছুদিন পর পরই ঘটছে দুর্ঘটনা। রেলওয়ের তথ্যমতে, সদ্য শেষ হওয়া ২০১৪ সালে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে আগের বছরের দ্বিগুণেরও বেশি। ২০১৪ সালে ছোট-বড় মিলিয়ে সারা দেশে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৫১৯টি। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৩৬। রেলওয়ের সম্পওি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা এস্টেট বিভাগের রেললাইনের উপরে ২৬টি অবৈধ বাজার গড়ে উঠেছে। আর এসব অবৈধ কাঁচাবাজার দখল করে আছে রেলের ৪৬ দশমিক ৭৫ একর ভূমি। টঙ্গী স্টেশনের আরিচপুর রেলগেট সংলগ্ন কাঁচাবাজার গড়ে উঠেছে ৩ একর জায়গাজুড়ে। বিমানবন্দর স্টেশনের আশকোনা রেলগেটসংলগ্ন এলাকায় ১ একর ও খিলক্ষেত রেলগেটসংলগ্ন কাঁচাবাজারটি ২ একর। তেজগাঁও স্ট্রেশন এলাকার নাখাল পাড়া রেলগেটসংলগ্ন কাঁচাবাজারটি ৫ একর, বিজয় সরণি ফ্লাইওভারসংলগ্ন বাজারটি ২ একর এবং কাওরান বাজার রেলগেটসংলগ্ন বাজারটি ২.৫০ একর। ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের তিনটি পয়েন্টে ৭.৫০ একর জায়গাজুড়ে প্রতিদিন বসছে এসব কাঁচাবাজার। এগুলো হচ্ছে মালিবাগ বাজার রেলগেটসংলগ্ন বাজারটি ৩.৫০ একর, খিলগাঁও রেলগেটসংলগ্ন বাজারটি ১.৫০ একর, গোপীবাহ রেলগেটসংলগ্ন বাজারটি ২.৫০ একর। গেন্ডারিয়া স্টেশন এলাকায় চারটি স্থানে ১৩ একর জায়গাজুড়ে প্রতিদিন বসছে কাঁচাবাজার। এগুলো হচ্ছে দয়াগঞ্জ ব্রিজসংলগ্ন কাঁচাবাজারটি গড়ে উঠেছে ৪ একর জায়গাজুড়ে, গেন্ডারিয়াসংলগ্ন বাজারটি ১.৫০ একর, জুরাইন বাজারসংলগ্ন ৪.৫০ একর, শ্যামপুর বাজারসংলগ্ন বাজারটি ৩ একর। পাগলা স্টেশন এলাকায় পাগলা রেলগেটসংলগ্ন বাজারটি ১.৫০ একর জায়গাজুড়ে। নারায়ণগঞ্জ স্টেশন এলাকায় তিনটি স্থানে ৭.৫০ একর জায়গাজুড়ে বসছে এসব বাজার। নারায়ণগঞ্জ ১ থেকে ২ নম্বর রেলগেটসংলগ্ন বাজারটি ৫ একর, স্টেশনের পেছনে ১ একর, স্টেশনের রোড খালসংলগ্ন কাঠের বাজারটি ১.৫০। ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন এলাকায় স্টেশনের দক্ষিণ পাশের মাছ বাজারটি ০.১২ একর জায়গা জুরে। আশুগঞ্জ স্টেশন এলাকায় স্ট্রেশন মাল গুদামসংলগ্ন মাছ বাজারটি ০.৪৬ একর। শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশন এলাকায় রেলগেটসংলগ্ন উভয় পাশের বাজারটি ০.০৭ একর জায়গাজুড়ে। পুবাইল স্টেশন এলাকায় স্টেশনের দক্ষিণ পাশের কাঁচাবাজারটি ০.০৮ একর জায়গা জুড়ে। ঘোড়াশাল ফ্লাগ স্টেশন এলাকার সাপ্তাহিক গরুর হাটটি ০.৬০ একর। নরসিংদী স্টেশনের পশ্চিম ও রেললাইনের দক্ষিণ পাশের বাজারটি ০.২২ একর। জয়দেবপুর স্টেশন এলাকায় জয়দেবপুর রেলগেটসংলগ্ন ফলের বাজারটি ০.০৭ একর। কওরাইদ স্টেশন এলাকার কাওরাইদ ব্রিজের উভয় পাশের কাঁচাবাজারটি ০.০৩ একর। ময়মনসিংহ স্টেশন এলাকার সানকিপাড়া হতে নতুন বাজার রেলগেটসংলগ্ন কাঁচাবাজারটি ০.১০ একর। বস্তি ও বাজারগুলো উদ্ধারে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাকে প্রধান অন্তরায় হিসেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে এটিকে কর্মকর্তারা অজুহাত ছাড়া অন্য কিছু নয় বলে দাবি করছেন অভিজ্ঞ মহল। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় সম্পদ কর্মকর্তা এ কে এম নুরনবী কবির মানবজমিনকে বলেন, দখলদাররা যত বড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, রেলের জমি কেউ স্থায়ীভাবে দখলে রাখতে পারবে না। রেলের জমি উদ্ধারে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছি। আর এ ব্যাপারে বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মো. কামরুল আহসান বলেন, রেলের ভূমি উদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান। পর্যায়ক্রমে সব জমিই উদ্ধার করা হবে।
No comments