কমেছে চিংড়ি উৎপাদন
হিমায়িত
চিংড়িতে এ বছর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশ্ববাজারে
দরপতন এবং চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় আরও বেশি সঙ্কটে পড়েছে হিমায়িত
চিংড়ি শিল্প। বর্তমানে দেশে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলোর বাৎসরিক
গড় চাহিদা সাড়ে তিন লাখ টন। উৎপাদিত চিংড়ির পরিমাণ মাত্র ৭০ হাজার টন।
চিংড়ি সঙ্কটসহ নানা সঙ্কটে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়েছে অর্ধেকেরও বেশি কারখানা।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের তথ্য মতে, দেশে ১৬৬টি
চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা প্রতিষ্ঠা হলেও বর্তমানে লাইসেন্স আছে
৯০টির, আর চালু আছে ৪০টি। খুলনার ৫০টি কারখানার ৩৫টি এবং চট্টগ্রামে চালু
আছে ৫টি কারখানা। ১৯৭২ সালে ২০ কোটি টাকার চিংড়ি রপ্তানি দিয়ে যাত্রা শুরুর
পর থেকে প্রতি বছর রপ্তানি আয় বাড়তে থাকে। গত ৪০ বছরে যা বেড়ে দাঁড়ায়
প্রায় ৫ হাজার কোটিতে। ২০০৭-৮ অর্থবছরে বিশ্বমন্দার কারণে চিংড়িকে বিলাসী
খাদ্য হিসেবে ধরা হলেও ২০১০-১১ অর্থবছরে পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হয়।
পরবর্তী দু’বছরে আবারও ঘুরে দাঁড়ায় হিমায়িত চিংড়ি শিল্প। ২০১২-১৩ অর্থবছরে
বাংলাদেশ চিংড়ি রপ্তানি করে চার হাজার ২৪২ কোটি টাকার, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে
বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার নয়শ’ কোটিতে। কিন্তু ২০১৪-১৫ অর্থবছরের শুরুতেই
কমতে থাকে চিংড়ি রপ্তানি। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-এর অক্টোবর মাস থেকে হিমায়িত চিংড়ির রপ্তানি কমেছে ৩০
ভাগ। খুলনা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন জানান,
২০১৪-এর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গত বছরের চেয়ে রপ্তানি কমেছে ১৫ ভাগেরও
কম। রপ্তানিকারকদের মতে, বিশ্ববাজারে বর্তমানে দ্রুত বর্ধনশীল বেনামি
চিংড়ির সরবরাহ বেশি থাকায় বাংলাদেশের চিংড়ির চাহিদা কম। রপ্তানিকারকরা
জানান, বেনামি জাতের (হাইব্রিড) দ্রুত বর্ধনশীল চিংড়ির চাষ ও বিপুল পরিমাণ
উৎপাদন হয় ভারত, চায়না, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া,
লাওসসহ বেশ কয়েকটি দেশে। কিন্তু গত কয়েক বছর এই চিংড়িতে মড়ক দেখা দেয়ায়
উৎপাদন ব্যাহত হয়। যে কারণে বাংলাদেশের চিংড়ির চাহিদা ও দাম বেড়ে যায়। ফলে
গত বছর চিংড়ি রপ্তানিতে আয় বাড়ে। তবে দাম বৃদ্ধির কারণে রপ্তানি আয় বাড়লেও
প্রকৃতপক্ষে দেশে উৎপাদন বাড়েনি। সি-ফুড এক্সপোর্ট বাইং এজেন্টস
এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুজন আহমেদ জানান, বিশ্ববাজারে বেনামি চিংড়ির
চেয়ে বাগদা চিংড়ির দাম দ্বিগুণ হওয়ায় বাংলাদেশী ব্ল্যাক টাইগার বা বাগদা
চিংড়ির চাহিদা দিন দিন কমছে। বাংলাদেশী প্রাকৃতিক চিংড়ির স্বাদ ভাল হলেও
বিভিন্ন সময় চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ ও এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়ায়
অধিকাংশ ক্রেতা বাংলাদেশী চিংড়ির ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছে। এছাড়া বিশ্বের
অধিকাংশ বিক্রেতা, রেস্টুরেন্ট ও হোটেলগুলো কম দামে মানসম্মত বেনামি চিংড়ি
পাওয়ায় বেশি লাভের কারণে বাংলাদেশী চিংড়ি কিনতে অনীহা দেখাচ্ছে। তবে
বাংলাদেশী ব্ল্যাক টাইগার বা বাগদা চিংড়ির চাহিদা কমলেও গলদা চিংড়ির চাহিদা
বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় রপ্তানি আয় বাড়ছে না।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোটার্স এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এম খলিলুল্লাহ
জানান, সরকার এক বছর আগে চিংড়ি শিল্প নীতিমালা ঘোষণা করলেও তা কোন কাজে
আসেনি। এর সঙ্গে জড়িত খামারি, প্রক্রিয়াজাতকারী ও রপ্তানিকারক কারও কাছেই
পৌঁছায়নি এ নীতিমালা। এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার প্রশিক্ষণসহ যথাযথ
পদক্ষেপ নিলে চিংড়ি শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে। এসোসিয়েশনের দাবি, সমপ্রতি
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশের হিমায়িত চিংড়ির মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
এসোসিয়েশনের সাবেক পরিচালক এস হুমায়ুন কবির জানান, দেশের ৭০ ভাগ চিংড়ি
খুলনা অঞ্চল থেকে রপ্তানি হলেও দিন দিন নানা সঙ্কটে এর রপ্তানি ব্যাহত
হচ্ছে। ইতিমধ্যে পরিবেশবাদী ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের কারণে খুলনার বেশ কিছু
এলাকায় চিংড়ি চাষ বন্ধ হয়েছে। এবং কিছু অসাধু সরবরাহকারী ওজন বাড়ানোর জন্য
চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করে বিশ্ববাজারে দেশের সুনাম নষ্ট করেছে, যা
রপ্তানিতে প্রভাব ফেলেছে। মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ খুলনার
উপ-পরিচালক মো. আবদুর রাশেদ জানান, চলতি বছরে উৎপাদন কম হলেও তা খুবই
সামান্য। তার তথ্য মতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত
খুলনা থেকে রপ্তানি হয় ১৬ হাজার ৮৭০ টন। আর একই সময়ে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের
জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি হয় ১৬ হাজার ৪৮৯ টন। উৎপাদন কমেছে ৩৮১
টন। উপপরিচালক জানান, বর্তমানে খুলনায় আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব চালু রয়েছে
এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে রপ্তানিকারকদের মান-নিয়ন্ত্রণ সনদ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া
এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে নিয়মিত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে পরিদর্শন করে অসাধু
ব্যবসায়ীদের অপদ্রব্য পুশ রোধ করতে জেল, জরিমানা ও মামলা করা হচ্ছে। তিনি
জানান, ২০১৪-এর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ২৫০টি অভিযান চালিয়ে ৬
হাজার ৫৫৬ কেজি পুশকৃত চিংড়ি বিনষ্ট করা হয়েছে। ৩৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকা
জরিমানা, ৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল ও একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা
করা হয়েছে। খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রফুল্ল কুমার সরকার জানান, জেলায়
এক হাজার হেক্টরে চিংড়ি চাষ কম হয়েছে। যে কারণে উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে।
তবে ইতিমধ্যে সনাতন পদ্ধতি থেকে উন্নত হয়েছে বেশ কিছু এলাকার চাষ পদ্ধতি।
উন্নত চাষ পদ্ধতিতে এরই মধ্যে ২৫০ হেক্টরে উৎপাদন শুরু হয়েছে। যে কারণে
চাষের এলাকা কিছুটা কমলেও উৎপাদন কমেনি। এছাড়া দাকোপ, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা ও
রূপসা উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় একই জমিতে গলদা এবং বাগদা চাষ শুরু হওয়ায়
গলদার উৎপাদনও বাড়ছে।
No comments