বিনিয়োগ বাড়েনি, অর্থ পাচার হয়েছে
সিপিডির
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা : গ্যাস, বিদ্যুৎ ও প্রাতিষ্ঠানিক
সংস্কারের অভাব এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাই প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না হওয়ার
মূল কারণ (রাজধানীর
সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৪-২০১৫: অন্তর্বর্তীকালীন
পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য l ছবি: প্রথম আলো) নির্বাচনের
পর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা না থাকলেও গত এক বছরে দেশে প্রত্যাশিত বেসরকারি
বিনিয়োগ হয়নি। আর এ জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের প্রচলিত
প্রতিবন্ধকতা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অভাব এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা—মূলত এ
তিন কারণকে দায়ী করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ
(সিপিডি)। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল শনিবার আয়োজিত ‘বাংলাদেশ
অর্থনীতি ২০১৪-১৫: অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে
সিপিডি আরও বলেছে, বিনিয়োগ তো হয়ইনি, উল্টো বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার
হয়েছে দেশ থেকে। টাকার অঙ্কে যা বৈদেশিক সাহায্যের চেয়েও বেশি। পাচারের
অর্থই আবার দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ হিসেবে ফিরে আসছে বলে আশঙ্কা
সিপিডির।
পর্যালোচনায় সিপিডি বলেছে, গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-অক্টোবর) তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে তিন ধরনের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ৪৪ থেকে ৫৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। এত বেশি পরিমাণ আমদানি সন্দেহজনক। আড়ালে কম মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচারের ঘটনা থাকতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে মূল পর্যালোচনাটি তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। অন্যান্যের মধ্যে কথা বলেন সংস্থার বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
অর্থ পাচার নিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে আমাদের আশঙ্কা। ২০১২ সালে পাচার হয়েছে ১৮০ কোটি ডলার, যা বৈদেশিক সাহায্যের চেয়েও বেশি। এই অর্থই আবার বৈদেশিক বিনিয়োগ হিসেবে দেশে ফিরে আসছে বলে মনে হয়।’ কয়েক বছর আগে আফ্রিকাতেও বিনিয়োগের নাম করে এ ধরনের চেষ্টা হয়েছে বলে স্মরণ করেন দেবপ্রিয়।
পর্যালোচনায় সামষ্টিক অর্থনীতিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি, খাদ্যনিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতি, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ, বাজেট ঘাটতি অর্থায়ন ও আমদানিতে মিশ্র বার্তার কথা তুলে ধরেছে সিপিডি। সংস্থাটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, লেনদেনের ভারসাম্য, মুদ্রা বিনিময় হার, রপ্তানি আয় ও ভর্তুকিতে ইতিবাচক প্রবণতাও চিহ্নিত করেছে। তবে সিপিডির মতে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যার প্রথমটিই হচ্ছে বেসরকারি খাতে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ। বাকিগুলো হচ্ছে রাজস্ব সংগ্রহ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন, বৈদেশিক সাহায্য, খেলাপি ঋণ, তারল্য পরিস্থিতি ও প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স)।
পর্যালোচনায় বলা হয়, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ সময় চলছে এখন। এই সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের বেশি এবং জিডিপি-বিনিয়োগ অনুপাত ৩২ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রবৃদ্ধি ৬ ও বিনিয়োগ ২৬ শতাংশেই আটকে রয়েছে।
অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায় রাজস্ব সংগ্রহে এ বছরও ২৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হবে বলে পর্যালোচনায় উঠে আসে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জন্য যে তিন হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হতো, সেটা দিতে হবে না বলে সরকারের জন্য স্বস্তিকর হয়েছে। পর্যালোচনায় বলা হয়, তেলের দাম সমন্বয় করতে হলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকির কথাও যেন ভাবা হয়। কারণ, একবারে কিছু করতে গেলে জনগণের ওপর চাপ পড়বে।
সিপিডি বলেছে, মূলধনি যন্ত্রপাতি যে বেশি আমদানি হয়েছে, এগুলোর বেশির ভাগই শূন্য শুল্কের। বিনিয়োগের সঙ্গে এগুলো সম্পর্কিত কি না খতিয়ে দেখা দরকার। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও শিল্প খাতে কতটুকু যাচ্ছে, সেটিও দেখতে হবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনো নির্মাণ করতে না পারায় দীর্ঘ মেয়াদে ভুগতে হতে পারে বলে মনে করে সিপিডি।
প্রবৃদ্ধি ও বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিউ নরমাল’-এ পরিণত হয়েছে। ষাটের দশকে ভারতে তা সাড়ে ৩ শতাংশে আটকে ছিল। আর আমাদের আটকে রয়েছে ৬ শতাংশে। এই হার ৭, ৮, ৯ শতাংশে নিয়ে যাওয়াই মূল চ্যালেঞ্জ। এ জন্য একক নিয়ামক হিসেবে বেসরকারি বিনিয়োগকে চিহ্নিত করে দেবপ্রিয় বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে প্রতিবছর শ্রমবাজারে যে পরিমাণ লোক আসছে, তাদের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে।
ব্যাংক খাত নিয়ে আলাদা মূল্যায়ন করে সিপিডি বলেছে, প্রত্যাশিত বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ব্যাংক খাতে যে ধরনের ঋণপ্রবাহ দরকার, তা হয়নি। সুশাসনের দিক থেকে ব্যাংক খাতে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক।
খেলাপি ঋণের হার ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশ থেকে কমে ১১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এলেও পরিমাণ আগের বছরের ৪৩ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৭ হাজার কোটি টাকা। আবার খেলাপি ঋণের হারের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপির হার দ্বিগুণ অর্থাৎ ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এসব তথ্য উল্লেখ করে এক বছর আগে করা নমনীয় ঋণ পুনঃ তফসিল নীতিমালা প্রণয়নের সমালোচনা করেছে সিপিডি।
সংস্থাটি বলেছে, ঋণ পুনঃ তফসিল করা হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। দুর্নীতির ক্ষতিপূরণ করা হচ্ছে সরকারের তহবিল থেকে। অর্থনীতির জন্য এগুলো ভালো নয়। প্রতিকার হিসেবে অভ্যন্তরীণ সুশাসন শক্তিশালী, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মান বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর দরকার। আর্থিক তথা ব্যাংক খাতে কী হচ্ছে, তা যাচাই ও খতিয়ে দেখতে একটি আর্থিক খাত কমিশন গঠন জরুরি বলে মনে করে সিপিডি।
এ বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমানে শিল্পঋণের যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, তা বেশির ভাগই বিশ্বাসী ঋণ বা এলটিআরের। আবার খেলাপি ঋণের তথ্যেও সন্দেহের জায়গা রয়েছে অর্থাৎ বানিয়ে দেখানো হচ্ছে (উইন্ডো ড্রেসিং) এ তথ্য। আবার বেনামি ঋণও পুনঃ তফসিল হতে দেখা যাচ্ছে।
পর্যালোচনায় বলা হয়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরও পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ শতাংশ। এখন কম। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে ঋণাত্মক, আবার দামও কমে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর ক্ষেত্রে একই অবস্থা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১৫ ও ইইউতে ২৪ শতাংশ। পোশাক খাতে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) তুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে মালিকেরা এক হাজার ২০০ কোটি টাকার সুবিধা পাবেন। প্রণোদনার অনেক মূল্য (কস্ট) আছে, তাই এটিকে যৌক্তিক হতে হবে।
পোশাক খাতে বড় কারখানাগুলো টিকলেও ছোটগুলো ঝরে পড়ার আশঙ্কা সিপিডির। তবে পর্যালোচনায় এ-ও বলা হয়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর উৎপাদনে বেশি মনোযোগী হতে পারেননি মালিকেরা। এই সময়ে কারখানার মান উন্নয়নে তাঁরা বেশি নজর দিয়েছেন বলে এর ইতিবাচক ফলও পাবেন তাঁরা ভবিষ্যতে।
সিপিডি বলেছে, ‘বাংলাদেশের বেশি প্রবাসী আয় আসে সৌদি আরব থেকে। কিন্তু দেশটিতে আমাদের লোক কম যাচ্ছে। তারা লোক ঠিকই নিচ্ছে কিন্তু আমাদের থেকে নিচ্ছে কম। কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে এর সমাধান করতে হবে।’
সিপিডি বলেছে, নেপাল থেকে আগের তুলনায় বেশি লোক যাচ্ছে সৌদি আরবে। আবার ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে তেমন প্রবাসী-আয় অর্জিত হয় না। সম্প্রতি ভারতে প্রকাশিত একটি হিসাবে দেখা গেছে, দেশটি পঞ্চম প্রবাসী-আয় সংগ্রহ করে বাংলাদেশ থেকে। বিদেশে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে শুধু সরকারের পরিবর্তে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতেও পাঠানো যায় কি না, ভাবার পরামর্শ সিপিডির। সিপিডি বলেছে, প্রবাসী-আয় শুধু এলেই হবে না, দেশ থেকে কী পরিমাণ এ আয় চলে যাচ্ছে, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।
সিপিডির গবেষণার মান পড়ে গেছে—সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের কাছে এমন মন্তব্য করেন। প্রশ্নোত্তর-পর্বে গতকাল এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সিপিডির তথ্য-উপাত্ত সব সরকারি। এখন পর্যন্ত কোনো মন্ত্রীর কাছ থেকে শুনিনি সিপিডি বলেছে ২, আর আসলে তা হবে ৩।’ দেবপ্রিয় আরও বলেন, ‘সিপিডির ২০০-৩০০ প্রকাশনা পড়ার যদি কারও সময় হয় এবং তারপর কেউ যদি মন্তব্য করে থাকেন, তাহলে তাঁকে সালাম জানাই।’
প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না হওয়ায় ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচনের কোনো প্রভাব আছে কি না জানতে চাইলে দেবপ্রিয় বলেন, ‘ওই নির্বাচনের কারণে কি না বলতে পারব না। তবে নির্বাচনের পরে যে ধরনের বিনিয়োগ প্রত্যাশা ছিল, তা হয়নি।’
পর্যালোচনায় সিপিডি বলেছে, গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-অক্টোবর) তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে তিন ধরনের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ৪৪ থেকে ৫৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। এত বেশি পরিমাণ আমদানি সন্দেহজনক। আড়ালে কম মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচারের ঘটনা থাকতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে মূল পর্যালোচনাটি তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। অন্যান্যের মধ্যে কথা বলেন সংস্থার বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
অর্থ পাচার নিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে আমাদের আশঙ্কা। ২০১২ সালে পাচার হয়েছে ১৮০ কোটি ডলার, যা বৈদেশিক সাহায্যের চেয়েও বেশি। এই অর্থই আবার বৈদেশিক বিনিয়োগ হিসেবে দেশে ফিরে আসছে বলে মনে হয়।’ কয়েক বছর আগে আফ্রিকাতেও বিনিয়োগের নাম করে এ ধরনের চেষ্টা হয়েছে বলে স্মরণ করেন দেবপ্রিয়।
পর্যালোচনায় সামষ্টিক অর্থনীতিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি, খাদ্যনিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতি, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ, বাজেট ঘাটতি অর্থায়ন ও আমদানিতে মিশ্র বার্তার কথা তুলে ধরেছে সিপিডি। সংস্থাটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, লেনদেনের ভারসাম্য, মুদ্রা বিনিময় হার, রপ্তানি আয় ও ভর্তুকিতে ইতিবাচক প্রবণতাও চিহ্নিত করেছে। তবে সিপিডির মতে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যার প্রথমটিই হচ্ছে বেসরকারি খাতে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ। বাকিগুলো হচ্ছে রাজস্ব সংগ্রহ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন, বৈদেশিক সাহায্য, খেলাপি ঋণ, তারল্য পরিস্থিতি ও প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স)।
পর্যালোচনায় বলা হয়, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ সময় চলছে এখন। এই সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের বেশি এবং জিডিপি-বিনিয়োগ অনুপাত ৩২ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রবৃদ্ধি ৬ ও বিনিয়োগ ২৬ শতাংশেই আটকে রয়েছে।
অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায় রাজস্ব সংগ্রহে এ বছরও ২৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হবে বলে পর্যালোচনায় উঠে আসে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জন্য যে তিন হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হতো, সেটা দিতে হবে না বলে সরকারের জন্য স্বস্তিকর হয়েছে। পর্যালোচনায় বলা হয়, তেলের দাম সমন্বয় করতে হলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকির কথাও যেন ভাবা হয়। কারণ, একবারে কিছু করতে গেলে জনগণের ওপর চাপ পড়বে।
সিপিডি বলেছে, মূলধনি যন্ত্রপাতি যে বেশি আমদানি হয়েছে, এগুলোর বেশির ভাগই শূন্য শুল্কের। বিনিয়োগের সঙ্গে এগুলো সম্পর্কিত কি না খতিয়ে দেখা দরকার। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও শিল্প খাতে কতটুকু যাচ্ছে, সেটিও দেখতে হবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনো নির্মাণ করতে না পারায় দীর্ঘ মেয়াদে ভুগতে হতে পারে বলে মনে করে সিপিডি।
প্রবৃদ্ধি ও বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিউ নরমাল’-এ পরিণত হয়েছে। ষাটের দশকে ভারতে তা সাড়ে ৩ শতাংশে আটকে ছিল। আর আমাদের আটকে রয়েছে ৬ শতাংশে। এই হার ৭, ৮, ৯ শতাংশে নিয়ে যাওয়াই মূল চ্যালেঞ্জ। এ জন্য একক নিয়ামক হিসেবে বেসরকারি বিনিয়োগকে চিহ্নিত করে দেবপ্রিয় বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে প্রতিবছর শ্রমবাজারে যে পরিমাণ লোক আসছে, তাদের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে।
ব্যাংক খাত নিয়ে আলাদা মূল্যায়ন করে সিপিডি বলেছে, প্রত্যাশিত বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ব্যাংক খাতে যে ধরনের ঋণপ্রবাহ দরকার, তা হয়নি। সুশাসনের দিক থেকে ব্যাংক খাতে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক।
খেলাপি ঋণের হার ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশ থেকে কমে ১১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এলেও পরিমাণ আগের বছরের ৪৩ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৭ হাজার কোটি টাকা। আবার খেলাপি ঋণের হারের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপির হার দ্বিগুণ অর্থাৎ ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এসব তথ্য উল্লেখ করে এক বছর আগে করা নমনীয় ঋণ পুনঃ তফসিল নীতিমালা প্রণয়নের সমালোচনা করেছে সিপিডি।
সংস্থাটি বলেছে, ঋণ পুনঃ তফসিল করা হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। দুর্নীতির ক্ষতিপূরণ করা হচ্ছে সরকারের তহবিল থেকে। অর্থনীতির জন্য এগুলো ভালো নয়। প্রতিকার হিসেবে অভ্যন্তরীণ সুশাসন শক্তিশালী, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মান বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর দরকার। আর্থিক তথা ব্যাংক খাতে কী হচ্ছে, তা যাচাই ও খতিয়ে দেখতে একটি আর্থিক খাত কমিশন গঠন জরুরি বলে মনে করে সিপিডি।
এ বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমানে শিল্পঋণের যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, তা বেশির ভাগই বিশ্বাসী ঋণ বা এলটিআরের। আবার খেলাপি ঋণের তথ্যেও সন্দেহের জায়গা রয়েছে অর্থাৎ বানিয়ে দেখানো হচ্ছে (উইন্ডো ড্রেসিং) এ তথ্য। আবার বেনামি ঋণও পুনঃ তফসিল হতে দেখা যাচ্ছে।
পর্যালোচনায় বলা হয়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরও পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ শতাংশ। এখন কম। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে ঋণাত্মক, আবার দামও কমে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর ক্ষেত্রে একই অবস্থা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১৫ ও ইইউতে ২৪ শতাংশ। পোশাক খাতে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) তুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে মালিকেরা এক হাজার ২০০ কোটি টাকার সুবিধা পাবেন। প্রণোদনার অনেক মূল্য (কস্ট) আছে, তাই এটিকে যৌক্তিক হতে হবে।
পোশাক খাতে বড় কারখানাগুলো টিকলেও ছোটগুলো ঝরে পড়ার আশঙ্কা সিপিডির। তবে পর্যালোচনায় এ-ও বলা হয়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর উৎপাদনে বেশি মনোযোগী হতে পারেননি মালিকেরা। এই সময়ে কারখানার মান উন্নয়নে তাঁরা বেশি নজর দিয়েছেন বলে এর ইতিবাচক ফলও পাবেন তাঁরা ভবিষ্যতে।
সিপিডি বলেছে, ‘বাংলাদেশের বেশি প্রবাসী আয় আসে সৌদি আরব থেকে। কিন্তু দেশটিতে আমাদের লোক কম যাচ্ছে। তারা লোক ঠিকই নিচ্ছে কিন্তু আমাদের থেকে নিচ্ছে কম। কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে এর সমাধান করতে হবে।’
সিপিডি বলেছে, নেপাল থেকে আগের তুলনায় বেশি লোক যাচ্ছে সৌদি আরবে। আবার ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে তেমন প্রবাসী-আয় অর্জিত হয় না। সম্প্রতি ভারতে প্রকাশিত একটি হিসাবে দেখা গেছে, দেশটি পঞ্চম প্রবাসী-আয় সংগ্রহ করে বাংলাদেশ থেকে। বিদেশে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে শুধু সরকারের পরিবর্তে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতেও পাঠানো যায় কি না, ভাবার পরামর্শ সিপিডির। সিপিডি বলেছে, প্রবাসী-আয় শুধু এলেই হবে না, দেশ থেকে কী পরিমাণ এ আয় চলে যাচ্ছে, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।
সিপিডির গবেষণার মান পড়ে গেছে—সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের কাছে এমন মন্তব্য করেন। প্রশ্নোত্তর-পর্বে গতকাল এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সিপিডির তথ্য-উপাত্ত সব সরকারি। এখন পর্যন্ত কোনো মন্ত্রীর কাছ থেকে শুনিনি সিপিডি বলেছে ২, আর আসলে তা হবে ৩।’ দেবপ্রিয় আরও বলেন, ‘সিপিডির ২০০-৩০০ প্রকাশনা পড়ার যদি কারও সময় হয় এবং তারপর কেউ যদি মন্তব্য করে থাকেন, তাহলে তাঁকে সালাম জানাই।’
প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না হওয়ায় ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচনের কোনো প্রভাব আছে কি না জানতে চাইলে দেবপ্রিয় বলেন, ‘ওই নির্বাচনের কারণে কি না বলতে পারব না। তবে নির্বাচনের পরে যে ধরনের বিনিয়োগ প্রত্যাশা ছিল, তা হয়নি।’
No comments