মিতা নূরের শরীরে আঘাতের চিহ্ন by নূরুজ্জামান
অভিনেত্রী মিতা নূরের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আর এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মৃত্যুর আগে।
লাশের
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আঘাতের চিহ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে এ
সংক্রান্তে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে
হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক
বিভাগের প্রভাষক ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. শফিউজ্জামান বলেন, ময়নাতদন্তে
মিতা নূরের বাম পা, ডান হাত ও ডান হাতের বগলে আঘাতের জখম পাওয়া গেছে। এ
থেকে ধারণা করা হচ্ছে- মৃত্যুর আগে কেউ তাকে আঘাত করেছিলেন। তবে ওই আঘাতে
মিতা নূরের মৃত্যু না হলেও আত্মহত্যার প্ররোচনার জন্য যথেষ্ট বলে মন্তব্য
করেন চিকিৎসক। তিনি বলেন, ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যার লক্ষণ পাওয়া গেছে মিতা
নূরের গলায়। ফরেনসিক সায়েন্সে বিষয়টিকে ‘অবলিগ নন কনটিউয়াস হাইআপ উইথ এ
গ্যাপ অফ ব্যাক সাইড অফ নেক’ বলে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ গলায় আত্মহত্যার
অর্ধ চন্দ্রাকৃতির দাগ খুঁজে পেয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। মৃত্যুর আগে
মিতার শরীরে বিষক্রিয়া হয়েছিল কিনা তদন্তের জন্য ভিসেরা পরীক্ষা করা হচ্ছে
রাসায়নিক পরীক্ষাগারে। এছাড়া পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি’র
কার্যালয়ে মিতা নূরের ওড়না, মুখের লালা ও গোপন অঙ্গের কোষ পরীক্ষা করা
হচ্ছে। গতকাল দুপুরে মিতা নূরের গুলশানের বাড়িতে গেলে কাউকে পাওয়া যায়নি।
ফ্ল্যাটের ভেতরে দুই কাজের মেয়েকে রেখে বাইরে থেকে লক করা ছিল। বাসার
ইন্টারকমে ফোন করলে হালিমা নামে এক কাজের মেয়ে বলে, স্যার (শাহ নূর রহমান
মজুমদার) ও তার দুই ছেলে বাসার বাইরে গেছেন। কারও সঙ্গে কথা বলা বারণ আছে।
পরে শাহ নূরের গাড়িচালক সবুজকে ফোন করলে মিতা নূরের বড় ছেলে ধরে। মায়ের
মৃত্য প্রসঙ্গে বলে, সন্তান হিসেবে বিশ্বাসই করতে পারছি না আমার মা মারা
গেছেন। সে আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলে, বেশ কয়েক মাস ধরে মা হতাশায় ভুগছিলেন।
নিয়মিত ঘুমের ট্যাবলেট খেতেন। একপর্যায়ে আসক্ত হয়ে পড়েন। অল্পতেই তার মেজাজ
গরম হয়ে যেতো। খিটখিটে স্বভাবের হয়েছিলেন। ঘনিষ্ঠ স্বজনদের ধারণা-
বিষণ্ন্নতার কারণেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন মিতা নূর। গত কয়েক মাস
ধরে তিনি অত্যধিক বিষণ্ন্নতায় ভুগছিলেন। বাড়ির বাইরে যেতেন কম, অভিনয় জগৎ
থেকেও গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। কথা বলতেন কম, নিয়মিত খাবারেও আগ্রহ ছিল
না। সারাক্ষণ ঘরের ভেতর দরজা বন্ধ করে শুয়ে কাটাতেন। কেউ ডাকাডাকি করলে
হতেন বিরক্ত। কারণে-অকারণে রাগারাগি করা ছিল তার নৈমিত্তিক বিষয়। তার
বিষণ্নতার নেপথ্যে স্বামী শাহনূর রহমান মজুমদার ওরফে রানার কোন পরকীয়া,
মিতা নূরের নিজেরই কারো সঙ্গে কোন বিশেষ সম্পর্ক নাকি শোবিজে আগের মতো
অবস্থান ধরে রাখতে না পারা, জানা যায়নি এসব বিষয়েও। কিন্তু শোবিজসহ সবখানেই
এখন এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।
ঘটনার দিন বিকালে মিতা নূরের স্বামী শাহনূর তাদের মধ্যে দাম্পত্য জীবনে কোন ধরনের কলহের কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ও (মিতা নূর) একটু অস্থির হয়ে উঠেছিল। আমি তাকে একা বাসায় বসে না থেকে দু’-একটা নাটক-টেলিফিল্মে কাজ করতে বলতাম। কিন্তু ও কাজ করতে ভালো লাগে না বলে জানাত। আবার বাসায় বসে থাকতেও বিরক্ত হতো। শাহনূর বলেন, ‘স্লিপিং পিল’ খাওয়া ছাড়া ও ঘুমাতে পারতো না। রোববার রাতে সিঁড়ির গোড়ায় অনেকগুলো স্লিপিং পিলের খোসা পাই। এগুলো অনেক দিনের জমানো ছিল মনে হয়। কিন্তু রাতে সে স্বাভাবিকই ছিল। বোঝাই যায়নি যে, রাতে সে এমন কোন একটা অঘটন ঘটাতে পারে। বাগান পরিচর্যা করতে খুব ভালবাসতেন মিতা নূর। ঘরের ভেতরেও যেমন লতাগুল্ম ও ফুল-ফলের কৃত্রিম-অকৃত্রিম গাছগাছালি লাগিয়েছেন তেমনি ছাদেও ছিল তার বড় বাগান। ওই বাগানের পরিচর্যাকারী রিপন জানান, ম্যাডাম আগের মতো বাগানে সময় দিতেন না। কখনও ছাদের বাগানে অলসভাবে দীর্ঘ সময় বসে থাকতেন। বাগান নিয়ে তার উৎসাহ যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন। শাহ নূরের ঘনিষ্ঠ স্বজনরা আরও জানান, ২৪ বছরের দাম্পত্য জীবনে বড় ধরণের কোন সমস্যা হয়নি। মিতা নূর যখন টিভি মিডিয়ার আলোচিত অভিনেত্রী, তখন তার অনেক অনিয়ম মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন শাহ নূর। মিতা নূর তার আয়ের একটি বড় অংশ মা-বাবার কাছে পাঠাতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তার কাজের পরিধি ও আয় কমে যেতে থাকে। উল্টো শাহ নূরের বায়িং হাউজের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠলে দু’জনের দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। ২০১১ সাল থেকে তাদের দাম্পত্য কলহ বাইরে প্রকাশ পেতে থাকে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। শাহ নূর মাঝে-মধ্যেই মদের আড্ডায় যেতেন। বায়িং হাউজে কাজের কথা বলে বাইরে রাত যাপন করতেন। সেখানে বিভিন্ন তরুণীদের আসা-যাওয়া ছিল। এমন খবরে মিতা নূর সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে শাহনূরও মিতা নূরের গভীর রাতে বাসায় ফেরা নিয়ে নানা ধরনের কটূ মন্তব্য করতেন। বিভিন্ন জনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলা নিয়ে সন্দেহ শুরু করেন। পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব থেকেই তাদের সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। এরই মধ্যে একাধিকবার মিতা নূর শাহ নূরকে ডিভোর্স দেয়ার চেষ্টা করেন। দুই ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পিছু হটেন। সর্বশেষ শাহ নূরের হাতে দফায় দফায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। সমানতালে মানসিক নির্যাতনও চলতো। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ গত শনিবার নিকেতনের অফিসের কর্মচারীরা থানায় ফোন করে পুলিশ ডেকে নেন। সেখানে যাওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার মাধ্যমে তাদের সম্পর্কের প্রকৃত টানাপড়েন বুঝতে পারি। যেহেতু মিতা নূর একজন পরিচিত মুখ তাই বিষয়টি গোপন রাখি। তবে তার মতো স্বনামধন্য ব্যক্তির মৃত্যকে কেন্দ্র করে কোন অপরাধ জড়িত আছে কিনা তা তদন্ত করা হচ্ছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ জানার পর কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, মিতা নূরের পিতা ফজলুর রহমান আমাদের কাছে কোন অভিযোগ করেননি। তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করেননি। তার কাছে একাধিকবার জানতে চেয়েছি কিন্তু বলতে চাননি। তারমতে- মিতার আত্মহত্যার নেপথ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকলে তা তদন্তেই পরিষ্কার হবে। এদিকে মিতা নূরের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ করেছেন একাধিক মানবাধিকার কর্মী। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট্স ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এডভোকেট এলিনা খান বলেন, লাশের শরীরে আঘাতের জখম থাকলে সুরতহাল প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হলো না কেন? তার মানে পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করছে না। তার মতে- মিতার শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে তা আত্মহত্যার প্ররোচনার জন্য যথেষ্ট। পুলিশকে এ নির্যাতনের রহস্য বের করতে হবে। তিনি বলেন, মিতা নূর আমার পরিচিত। ২০১২ সালে একটি পিকনিকে গিয়ে তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তখন থেকেই তিনি আমাকে ফোন করতেন। প্রথমদিকে বলতেন- তার এক বন্ধুর সমস্যা হয়েছে। ওই বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায়। এর কিছুদিন পর প্রায় তিন মাস আগে তিনি ফোন করে বলেন- সমস্যা তার নিজের। তার সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত বলতে চেয়েছিলেন। নানা ব্যস্ততার কারণে আর বলা হয়ে ওঠেনি। তার আগেই সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। এলিনা খান আক্ষেপ করে বলেন, শুনতে পারলে বুঝতাম- কি হয়েছিল তার ব্যক্তিগত জীবনে। কেন বার বার আত্মহত্যার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। জীবনকে আঁকড়ে ধরার জন্য তার দু’টি সন্তান ছিল। তারপরও তিনি আত্মহত্যা করবেন- এটি যুক্তিসঙ্গত নয়। নিশ্চয়ই তার জীবনে এমন কোন কারণ ছিল যার কারণে এ অকাল পরিণতি। পারিবারিক কলহ পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তার মানে পুলিশ সবই জানে। তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এ মৃত্যুর অনেক ক্লু আছে। এখন তাদেরকেই এ মৃত্যুর রহস্য বের করতে হবে। এটি হত্যা না আত্মহত্যা তা উদঘাটন করতে হবে। আত্মহত্যা করলে কেন করেছেন, এর জন্য কারা দায়ী তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। গত সোমবার ভোরে রাজধানীর গুলশানে নিজের বাসার ড্রইং রুমে মিতা নূরের (৪২) ঝুলন্ত লাশ পায় পুলিশ। এ অভিনেত্রী আত্মহত্যা করেছেন, নাকি এটি হত্যাকাণ্ড- পুলিশ সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাতে না পারায় দু’দিন ধরে নানা গুঞ্জন শুরু হয়। মিতার মৃত্যুর নেপথ্যে অন্য কোন কারণ আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে কিডনি, লিভার ও পাকস্থলীর অংশবিশেষ রাসায়নিক পরীক্ষার (ভিসেরা) জন্য পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। পারিবারিক সূত্রমতে, মিতা নূরের আসল নাম সাবিনা ইয়াসমিন। ডাকনাম ছিল মিতা। ইডেন কলেজে পড়ার সময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ব্যবসায়ী শাহনূর রহমান মজুমদার ওরফে রানার সঙ্গে। পরে পারিবারিকভাবে ২৪ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর ডাকনাম মিতার সঙ্গে স্বামীর নূর অংশ যুক্ত করে মিতা নূর নাম রাখেন। ওই নামেই অভিনয় জগতে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাদের দু’টি ছেলের মধ্যে সাদমান নূর প্রিয় ও লেভেলের ছাত্র। আর শেহজাদ নূর পৃথি পড়ে সাউথ ব্রিজ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাপ্তাহিক নাটক ‘সাগর সেঁচা সাধ’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মিতা নূরের অভিষেক হয়। ১৯৯২ সালে আফজাল হোসেনের নির্দেশনায় অলিম্পিক ব্যাটারির বিজ্ঞাপনে মডেল হয়ে ব্যাপক পরিচিত পান। এরপর তাকে নিয়মিত বিভিন্ন নাটকে দেখা যায়। টিভি নাটকে অভিনয় ও মডেলিংয়ের পথ ধরে ২০১১ সালে নাট্য নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মিতা নূর। ওই বছর ‘চৌঙ্গালি’ নামের একটি খণ্ড নাটক নির্মাণ করেন তিনি।
ঘটনার দিন বিকালে মিতা নূরের স্বামী শাহনূর তাদের মধ্যে দাম্পত্য জীবনে কোন ধরনের কলহের কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ও (মিতা নূর) একটু অস্থির হয়ে উঠেছিল। আমি তাকে একা বাসায় বসে না থেকে দু’-একটা নাটক-টেলিফিল্মে কাজ করতে বলতাম। কিন্তু ও কাজ করতে ভালো লাগে না বলে জানাত। আবার বাসায় বসে থাকতেও বিরক্ত হতো। শাহনূর বলেন, ‘স্লিপিং পিল’ খাওয়া ছাড়া ও ঘুমাতে পারতো না। রোববার রাতে সিঁড়ির গোড়ায় অনেকগুলো স্লিপিং পিলের খোসা পাই। এগুলো অনেক দিনের জমানো ছিল মনে হয়। কিন্তু রাতে সে স্বাভাবিকই ছিল। বোঝাই যায়নি যে, রাতে সে এমন কোন একটা অঘটন ঘটাতে পারে। বাগান পরিচর্যা করতে খুব ভালবাসতেন মিতা নূর। ঘরের ভেতরেও যেমন লতাগুল্ম ও ফুল-ফলের কৃত্রিম-অকৃত্রিম গাছগাছালি লাগিয়েছেন তেমনি ছাদেও ছিল তার বড় বাগান। ওই বাগানের পরিচর্যাকারী রিপন জানান, ম্যাডাম আগের মতো বাগানে সময় দিতেন না। কখনও ছাদের বাগানে অলসভাবে দীর্ঘ সময় বসে থাকতেন। বাগান নিয়ে তার উৎসাহ যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন। শাহ নূরের ঘনিষ্ঠ স্বজনরা আরও জানান, ২৪ বছরের দাম্পত্য জীবনে বড় ধরণের কোন সমস্যা হয়নি। মিতা নূর যখন টিভি মিডিয়ার আলোচিত অভিনেত্রী, তখন তার অনেক অনিয়ম মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন শাহ নূর। মিতা নূর তার আয়ের একটি বড় অংশ মা-বাবার কাছে পাঠাতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তার কাজের পরিধি ও আয় কমে যেতে থাকে। উল্টো শাহ নূরের বায়িং হাউজের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠলে দু’জনের দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। ২০১১ সাল থেকে তাদের দাম্পত্য কলহ বাইরে প্রকাশ পেতে থাকে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। শাহ নূর মাঝে-মধ্যেই মদের আড্ডায় যেতেন। বায়িং হাউজে কাজের কথা বলে বাইরে রাত যাপন করতেন। সেখানে বিভিন্ন তরুণীদের আসা-যাওয়া ছিল। এমন খবরে মিতা নূর সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে শাহনূরও মিতা নূরের গভীর রাতে বাসায় ফেরা নিয়ে নানা ধরনের কটূ মন্তব্য করতেন। বিভিন্ন জনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলা নিয়ে সন্দেহ শুরু করেন। পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব থেকেই তাদের সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। এরই মধ্যে একাধিকবার মিতা নূর শাহ নূরকে ডিভোর্স দেয়ার চেষ্টা করেন। দুই ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পিছু হটেন। সর্বশেষ শাহ নূরের হাতে দফায় দফায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। সমানতালে মানসিক নির্যাতনও চলতো। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ গত শনিবার নিকেতনের অফিসের কর্মচারীরা থানায় ফোন করে পুলিশ ডেকে নেন। সেখানে যাওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার মাধ্যমে তাদের সম্পর্কের প্রকৃত টানাপড়েন বুঝতে পারি। যেহেতু মিতা নূর একজন পরিচিত মুখ তাই বিষয়টি গোপন রাখি। তবে তার মতো স্বনামধন্য ব্যক্তির মৃত্যকে কেন্দ্র করে কোন অপরাধ জড়িত আছে কিনা তা তদন্ত করা হচ্ছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ জানার পর কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, মিতা নূরের পিতা ফজলুর রহমান আমাদের কাছে কোন অভিযোগ করেননি। তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করেননি। তার কাছে একাধিকবার জানতে চেয়েছি কিন্তু বলতে চাননি। তারমতে- মিতার আত্মহত্যার নেপথ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকলে তা তদন্তেই পরিষ্কার হবে। এদিকে মিতা নূরের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ করেছেন একাধিক মানবাধিকার কর্মী। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট্স ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এডভোকেট এলিনা খান বলেন, লাশের শরীরে আঘাতের জখম থাকলে সুরতহাল প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হলো না কেন? তার মানে পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করছে না। তার মতে- মিতার শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে তা আত্মহত্যার প্ররোচনার জন্য যথেষ্ট। পুলিশকে এ নির্যাতনের রহস্য বের করতে হবে। তিনি বলেন, মিতা নূর আমার পরিচিত। ২০১২ সালে একটি পিকনিকে গিয়ে তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তখন থেকেই তিনি আমাকে ফোন করতেন। প্রথমদিকে বলতেন- তার এক বন্ধুর সমস্যা হয়েছে। ওই বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায়। এর কিছুদিন পর প্রায় তিন মাস আগে তিনি ফোন করে বলেন- সমস্যা তার নিজের। তার সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত বলতে চেয়েছিলেন। নানা ব্যস্ততার কারণে আর বলা হয়ে ওঠেনি। তার আগেই সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। এলিনা খান আক্ষেপ করে বলেন, শুনতে পারলে বুঝতাম- কি হয়েছিল তার ব্যক্তিগত জীবনে। কেন বার বার আত্মহত্যার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। জীবনকে আঁকড়ে ধরার জন্য তার দু’টি সন্তান ছিল। তারপরও তিনি আত্মহত্যা করবেন- এটি যুক্তিসঙ্গত নয়। নিশ্চয়ই তার জীবনে এমন কোন কারণ ছিল যার কারণে এ অকাল পরিণতি। পারিবারিক কলহ পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তার মানে পুলিশ সবই জানে। তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এ মৃত্যুর অনেক ক্লু আছে। এখন তাদেরকেই এ মৃত্যুর রহস্য বের করতে হবে। এটি হত্যা না আত্মহত্যা তা উদঘাটন করতে হবে। আত্মহত্যা করলে কেন করেছেন, এর জন্য কারা দায়ী তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। গত সোমবার ভোরে রাজধানীর গুলশানে নিজের বাসার ড্রইং রুমে মিতা নূরের (৪২) ঝুলন্ত লাশ পায় পুলিশ। এ অভিনেত্রী আত্মহত্যা করেছেন, নাকি এটি হত্যাকাণ্ড- পুলিশ সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাতে না পারায় দু’দিন ধরে নানা গুঞ্জন শুরু হয়। মিতার মৃত্যুর নেপথ্যে অন্য কোন কারণ আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে কিডনি, লিভার ও পাকস্থলীর অংশবিশেষ রাসায়নিক পরীক্ষার (ভিসেরা) জন্য পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। পারিবারিক সূত্রমতে, মিতা নূরের আসল নাম সাবিনা ইয়াসমিন। ডাকনাম ছিল মিতা। ইডেন কলেজে পড়ার সময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ব্যবসায়ী শাহনূর রহমান মজুমদার ওরফে রানার সঙ্গে। পরে পারিবারিকভাবে ২৪ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর ডাকনাম মিতার সঙ্গে স্বামীর নূর অংশ যুক্ত করে মিতা নূর নাম রাখেন। ওই নামেই অভিনয় জগতে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাদের দু’টি ছেলের মধ্যে সাদমান নূর প্রিয় ও লেভেলের ছাত্র। আর শেহজাদ নূর পৃথি পড়ে সাউথ ব্রিজ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাপ্তাহিক নাটক ‘সাগর সেঁচা সাধ’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মিতা নূরের অভিষেক হয়। ১৯৯২ সালে আফজাল হোসেনের নির্দেশনায় অলিম্পিক ব্যাটারির বিজ্ঞাপনে মডেল হয়ে ব্যাপক পরিচিত পান। এরপর তাকে নিয়মিত বিভিন্ন নাটকে দেখা যায়। টিভি নাটকে অভিনয় ও মডেলিংয়ের পথ ধরে ২০১১ সালে নাট্য নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মিতা নূর। ওই বছর ‘চৌঙ্গালি’ নামের একটি খণ্ড নাটক নির্মাণ করেন তিনি।
No comments