এখনও সেটা রহস্য
হাইভোল্টেজ চার সিটি নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দিনে দেশবাসী যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) তখন ছিলেন বিশ্রামে!
‘অসুস্থ’
বলে কমিশনে অনুপস্থিত ছিলেন কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ। এই সময়ে কমিশন
সচিবালয়ের সঙ্গে তার টেলিফোন যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন ছিল। অবশ্য দুপুরের পর
তিনি শেরে বাংলা নগরস্থ কমিশন কার্যালয়ে যান, ছিলেন বেশ সময়। তবে তার
বেরিয়ে যাওয়ার পর খুলনায় অঘটনের খবরটি আসে। বিভিন্ন কেন্দ্রে সরকার
সমর্থকদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। নিরুপায় রিটার্নিং
অফিসার কমিশনের নির্দেশনা চান। সিইসি’র অনুপস্থিতি এবং যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটায়
বাধ্য হয়ে সচিব র্যাব-পুলিশ ও বিজিবি’র উচ্চপর্যায়ে কথা বলেন। প্রায়
দু’ঘণ্টার তৎপরতায় সেদিন খুলনায় বিভিন্ন কেন্দ্রে আটকেপড়া প্রিজাইডিং,
সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ১৫ই জুন শনিবার
হলেও কমিশন সচিবালয় সরব ছিল ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। সচিবালয়ের
সর্বস্তরের কর্মকর্তারা হাজির ছিলেন। ছিলেন না কেবল সিইসি। পদস্থ এক
কর্মকর্তা মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপকালে তার এ অনুপস্থিতিকে রহস্যজনক বলে
মন্তব্য করেন। এ নিয়ে খোদ তার দপ্তরেই নানা গুঞ্জন রয়েছে। অবশ্য সেই
কর্মকর্তা সিইসি’র চোখে অপারেশন হওয়ার রেশ এখনও কাটেনি বলে দাবি করেন।
জুনের প্রথম সপ্তাহে তার অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে
কমিশন সচিবালয়ে ১৫ই জুনের স্মৃতিচারণ করেন এক কর্মকর্তা। জানান, কমিশনারদের
মধ্যে সবার আগে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন মো. শাহ নেওয়াজ। সকাল ১০টার আগেই
তিনি তার দপ্তরে পৌঁছান। বাকিরাও আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে নিজ নিজ
দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার খোঁজ নেন। তখনও কোন এলাকা থেকে অপ্রীতিকর ঘটনার খবর
কমিশনে আসেনি। দুপুরের আগেই খুলনায় একজন এডিশনাল ডিআইজি’র দায়িত্ব ছাড়াই
বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘোরাঘুরির খবরে বেশ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। কমিশনে নালিশ আসে
সরকারি জোট সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে দিদার নামের ওই পুলিশ কর্মকর্তা
বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত
কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে পুলিশের ওই কর্মকর্তা এসাইন্ড কিনা জানতে
চেয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন বলেও খবর আসে। সিইসি তখনও কমিশনে
অনুপস্থিত। কমিশনের নির্দেশনায় জোরালো তৎপরতা শুরু হয় পুলিশ কর্মকর্তাকে
কেন্দ্র থেকে বের করার। অবশ্য সফলতাও এসেছে। শুধু ওই কেন্দ্রই নয়, দিনভর
কোন কেন্দ্রেই তিনি আর সক্রিয় হতে পারেননি। সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৪ দলীয়
জোট সমর্থিত প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের স্ত্রী আসমা কামরানের একটি
কেন্দ্রে দীর্ঘ সময় অবস্থানের খবরেও উত্তাপ তৈরি হয়। কামরানের নিজ কেন্দ্র
সিলেট পাইলট স্কুলে তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা নিয়ে একের পর এক অভিযোগ
আসতে থাকে কমিশনে। রিটার্নিং অফিসারসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ঘটনাটি
জানিয়ে কমিশনের নির্দেশনা চান। দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ও গণমাধ্যম
কর্মীদের তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন আসমা কামরান। চার সিটির
মোটামুটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজক খবর আসে বরিশাল
থেকে। ১৪ দলীয় জোটের মেয়রপ্রার্থী শওকত হোসেন হিরন নিজেই এক কেন্দ্রে ঢুকে
প্রিজাইডিং অফিসারকে গালমন্দ করে ভোট বন্ধ করে দেন। উত্তেজনা তৈরি হয়
পক্ষে-বিপক্ষে। কমিশনের নির্দেশনা চান রিটার্নিং অফিসার। সরকারের
উচ্চপর্যায় থেকেও টেলিফোন আসে কমিশন সচিবালয়ে। তখন অবশ্য সিইসি দপ্তরে
আছেন। তার শরণাপন্ন হন সচিবালয়ের অন্যরা। প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টার পর পৌনে
৩টায় পুনরায় ভোট গ্রহণ শুরু করা সম্ভব হয় বলে জানান কমিশনের বরিশাল
দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। রাজশাহীতে ভোটগ্রহণ শেষে একটি কেন্দ্রে
ইভিএম নষ্ট হয়ে গেলে ফল স্থগিতের পক্ষে-বিপক্ষে শোডাউন শুরু হয়। রিটার্নিং
অফিসারের কার্যালয় থেকে মাত্র দু’শ’ গজের মধ্যে স্থগিত ওই কেন্দ্রে তুমুল
উত্তেজনা দেখা দেয়। গত সোমবার কমিশন সচিবালয়ে এক অনির্ধারিত আলোচনায় সেই
পরিস্থিতি সামলে নেয়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলেন রিটার্নিং অফিসার। বলেন,
সেদিন আর কয়েক মিনিট সময় গেলেই তার কার্যালয়ে আক্রমণ করতো বিক্ষোভকারীরা।
পুলিশের রহস্যজনক নীরবতায় কিভাবে কৌশলি হয়েছেন তা-ও বর্ণনা করেন রিটার্নিং
অফিসার। বলেন, দেখলাম সরকার সমর্থক ও বিরোধীরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে।
কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। রাজশাহীতে এমনিতেই জামায়াত-শিবির খুবই
শক্তিশালী। নির্বাচন চলাকালে বাইরে থেকে যাতে জামায়াত-শিবিরের কেউ শহরে
প্রবেশ করতে না পারে এজন্য ৫টি প্রবেশপথে দিনভর পুলিশের স্ট্রাইকিং ফোর্স
মোতায়েন ছিল। তাদের নড়তে মানা ছিল। রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় ঘিরে থাকা
দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যরা সরকারি দলের বিরুদ্ধে কোন ধরনের অ্যাকশনে
যেতে রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে র্যাব-এর শরণাপন্ন হই। পক্ষে-বিপক্ষে
শোডাউনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিই। প্রথমে পুলিশ দিয়ে বিরোধীদের
ধাওয়া দেই। তারপর র্যাব দিয়ে সরকারি দলের সমর্থকদের সরানোর চেষ্টা করি।
বিজিবিকে রাখা হয় রিজার্ভ। পরে মাইকিং করে প্রার্থী ও তাদের নির্ধারিত
এজেন্ট ছাড়া অন্যদের মাঠ থেকে বের করে দিয়ে ফল ঘোষণা শুরু করি। এত ঘটনার
মধ্যেও কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনার একবার ফোন করে কোন খবর নেননি বলে
দুঃখ করেন এই কর্মকর্তা। সন্ধ্যায় খুলনার কেন্দ্রগুলোতে ফল প্রকাশের পর
থেকে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং ও সহায়ক কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ
করে রাখার খবর আসে। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বের হতে পারছেন
না বলে খবর আসতে থাকে। তাদের উদ্ধার করে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে
পৌঁছানো নিয়ে কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা যখন গভীর দুশ্চিন্তায়, তখনও
সিইসি অনুপস্থিত। তিনি অফিস ছেড়ে গেছেন অল্প আগে। তার অনুপস্থিতিতে
নির্বাচন কমিশন সচিব র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি’র প্রধানদের সঙ্গে কথা বলেন।
তাদের সম্মিলিত চেষ্টায় রাত ১০টা নাগাদ কেন্দ্র থেকে কর্মকর্তাদের বের করে
আনা শুরু হয়। সিলেট নির্বাচনের চূড়ান্তভাবে বেসরকারি ফল ঘোষণা নিয়ে উত্তাপ
তৈরি হলে কমিশনের নির্দেশনায় মধ্যরাতে তা ঘোষণা হয়। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চার সিটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা, ত্রুটি-বিচ্যুতির
চুলচেরা বিশ্লেষণে রমজানের আগেই একটি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করার চিন্তা-ভাবনা
চলছে। প্রাথমিকভাবে আগামী ৮ই জুলাই এর তারিখ ঠিক হয়েছে। সেখানে কমিশনের
অধীন কর্মকর্তাদের যেমন ডাকা হয়েছে, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। তবে ওই অনুষ্ঠানে সিইসি
সভাপতিত্ব করবেন বলে নিশ্চিত করেছেন তার অধঃস্তন কর্মকর্তারা।
No comments