জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে সুশাসন by ড. এম শামসুল আলম
ব্যক্তিমালিকানায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত
উন্নয়ন কৌশল ও নীতি গ্রহণ করায় এ উন্নয়নে ব্যক্তি খাত এবং সরকারি খাতের
মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়নি। বরং পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জ্বালানি ও
বিদ্যুৎ খাতে ব্যক্তি খাতের একচেটিয়া প্রভাব বেড়েছে।
সরকারি খাত নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ
খাত সেবা খাত থেকে বাণিজ্যিক খাতে রূপান্তরিত হয়েছে। এর পর ব্যক্তি খাত
বিনিয়োগ আকর্ষণের অজুহাতে মুনাফা বৃদ্ধির নানা কৌশল গ্রহণ করায় জ্বালানি ও
বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বেড়েছে অসহনীয়। ফলে এ ব্যয় বৃদ্ধি ও সাধারণ জনগণের
স্বল্প ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আগের লেখাগুলো
বিশ্লেষণে দেখা যায়, সুশাসনের অভাবে জনস্বার্থসম্মত টেকসই জ্বালানি ও
বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের অবকাশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল না। তা ছাড়া
ক্ষেত্রবিশেষে নির্বিচারে জ্বালানি অপরাধের মতো ঘটনাও ঘটেছে। জনস্বার্থও
তছনছ হয়েছে। তার আইনি প্রতিকার হয়নি।
অব্যাহত আর্থিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) পূর্বশর্ত হলো, সহনীয় দামহারে নির্ভরযোগ্য জ্বালানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত হলেই টেকসই উন্নয়নের জন্য ১০ শতাংশের অধিক হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা সহজ হয়। চলতি অর্থবছরে আর্থিক প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু এডিবির পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে। গত অর্থবছরে তা ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২০ শতাংশ। অথচ ১০ শতাংশও অর্জিত হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব থাকার কারণে মূলত সরকারি খাতে দুর্নীতি ও ব্যক্তি খাতে মুনাফা বাড়ায় বিনিয়োগ ব্যয় বেড়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা না হলে এ ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা বাড়বে। তাতে জ্বালানি ও বিদ্যুতের সরবরাহ-ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। ফলে আজকেরই মতো আগামীতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে অর্থাৎ বিদ্যুৎ ঘাটতি বাড়িয়ে জ্বালানি ও বিদ্যুতের সরবরাহ-ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার মতো এই একই অভিনব কৌশল গ্রহণ অব্যাহত থাকবে। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ এস বিশ্বনাথন তাঁর Highway Robbery শিরোনামের প্রবন্ধে বলেছেন, 'ভারতে জ্বালানি সরবরাহে নিয়োজিত ডিলাররা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ।' বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসব ডিলারসহ ব্যক্তি খাত বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোর মালিকদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে এ খাতের নির্বাহী, আইন ও রেগুলেটরি ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন প্রয়োজন। সে জন্য সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। তাতে আইনি বিধি-বিধান, রাজনৈতিক সক্ষমতা ও স্থিতিশীলতা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা, কৌশলগত রূপকল্প, সমতা ও জনমতের প্রাধান্য- সুশাসনের এসব উপাদান উন্নত ও জনস্বার্থসম্মত হলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে। ফ্রান্সের এক গবেষণায় দেখা যায়, সুশাসনের সঙ্গে মাথাপিছু জিডিপির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মাথাপিছু জিডিপির সঙ্গে মাথাপিছু ব্যবহৃত বিদ্যুতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে তাই সুশাসন নিশ্চিত হওয়া অপরিহার্য। বিগত দুই দশকের বেশি সময় বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার কার্যক্রম চলছে। তাতে এ খাতের নির্বাহী, আইন ও রেগুলেটরি ব্যবস্থায় কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সুশাসনের উপাদানগুলো কতটা উন্নত হচ্ছে, তার পর্যালোচনা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয় হিসেবে সংবিধানে প্রাধান্য পায় দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ জ্বালানি সম্পদের মালিক প্রজাতন্ত্র। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ বিধায় জ্বালানি সম্পদের মালিকানা জনগণের হাতে চলে আসে। সংবিধানের ১৩ ধারামতে, উৎপাদন যন্ত্র ও বণ্টন প্রণালি চলে আসে রাষ্ট্রীয় মালিকানায়। পরে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বণ্টন ও বিতরণ ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের আওতায় বিধিবদ্ধভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা হয়। পিডিবি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যুৎ খাতের নির্বাহী ক্ষমতা পিডিবিকে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার আগে যেসব গ্যাসক্ষেত্র বিদেশি কম্পানির হাতে ছিল, ক্রয়সূত্রে সে সবই রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা হয়। ১৯৭৪ সালে পেট্রোলিয়াম অ্যাক্টের আওতায় পেট্রোবাংলা গঠন করে তার মাধ্যমে জ্বালানি সম্পদে রাষ্ট্রীয় মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে সচিবের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং এ পদে আনা হয় জ্বালানি বিষয়ে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ড. হাবিবুর রহমানকে। গ্যাস তথা জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাকে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে। ফলে নির্বাহী কর্তৃপক্ষ হিসেবে পেট্রোবাংলার স্বশাসন ও প্রফেশনাল ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের দর্শন ও নীতি বাস্তবায়নে পরিকল্পনা কমিশন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অনন্য ভূমিকা রাখে। রেহমান সোবহান, মোজাফ্ফর আহমদ, আনিসুর রহমানের মতো বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদদের পরিকল্পনা কমিশনে আনা হয়। তখন রাষ্ট্র/সরকারপ্রধান সরাসরি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁদের পরামর্শ নিতেন। ফলে রাষ্ট্রের সব উন্নয়ন কার্যক্রম পরিকল্পনা কমিশনের আওতায় সুসমৃদ্ধ পরিকল্পনা মাফিক যেন হতে পারে, তা নিশ্চিত হয়। এ পরিকল্পনা প্রণয়ন মূলত বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভরশীল। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এভাবে শুরু হয়। এ পরিকল্পনায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। এভাবেই রাষ্ট্র জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের নির্বাহী, আইন ও রেগুলেটরি ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নে হাত দেয় এবং এ খাতের সুশাসনের কাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়।
১৯৭৫ সালে বিয়োগান্তক পথে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন যখন হলো, তখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনস্বার্থবিরোধী নানা পরিবর্তন আসে। তার মধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে আনীত পরিবর্তনগুলো সবচেয়ে মারাত্মক ছিল।
স্বল্প খরচে জ্বালানি সরবরাহ করার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়ায় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গ্যাস খাত উন্নয়ন প্রাধান্য পায়। জ্বালানি তেল আমদানি কমিয়ে পরিবহনসহ অন্যান্য খাতে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করা হয়। পিএসসির আওতায় বিদেশি বিনিয়োগে আইওসির মাধ্যমে দেশের মজুদ গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন শুরু হয়। তাতে জ্বালানি আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে এলেও সরবরাহ করা গ্যাসে আইওসির গ্যাসের অনুপাত দ্রুত বাড়তে থাকে। ফলে জ্বালানি তেল আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হলেও গ্যাস ক্রয়ে ব্যয় বৃদ্ধিতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের এ কৌশল কার্যকারিতা হারায়।
জ্বালানি খাতে জনস্বার্থ রক্ষায় যদি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা ও রাজনৈতিক সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যেত, তাহলে ১. সাগরের গ্যাস তোলার জন্য আইওসির ভাগের গ্যাসের সিলিং ক্রয় মূল্যহারসহ আইওসিকে দেওয়া সুবিধাদির আওতায় ২০১০ সালে যে পিএসসি হয়, তার থেকেও অধিক মূল্যহারসহ আরো অধিক সুবিধা দিয়ে পিএসসি ২০১২ করার উদ্যোগ নেওয়া হতো না; ২. দেশি কম্পানির গ্যাসের ক্রয় মূল্যহার যেখানে ২৫ টাকা, সেখানে আইওসির গ্যাসর মূল্যহার প্রায় ২৪০ টাকা। এর পরও তাদের নানাভাবে বেশি বেশি লাভবান করার চেষ্টা হতো না; ৩. মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডের পিএসসি বাতিলের পর অক্সিডেন্টালের সঙ্গে সম্পূরক চুক্তি হতো না এবং এ গ্যাসফিল্ড বিস্ফোরণ ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বীমার টাকা নিয়ে অক্সিডেন্টাল পালানোর সুযোগ পেত না; ৪. ছাতক ও ফেনী গ্যাসফিল্ড প্রান্তিক/পরিত্যক্ত ঘোষিত হতো না, গ্যাস তোলার জন্য সে গ্যাসফিল্ড নাইকোর হাতে তুলে দেওয়া হতো না; ৫. ছাতক গ্যাসফিল্ড বিস্ফোরণ ক্ষতিপূরণ আদায়ের মামলা থাকা সত্ত্বেও ক্ষতিপূরণ ছাড়াই এ চুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ দিয়ে নাইকোর পালানোর পথ তৈরির গোপন তৎপরতা শুরু হতো না; ৬. গ্যাস রপ্তানির বিরুদ্ধে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট অবস্থান কাজে আসত এবং সাগরের গ্যাস তোলার ব্যাপারে কনোকো-ফিলিপসের পিএসসিতে এলএনজি হিসেবে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ থাকত না; ৭. আইওসির গ্যাসের একক ক্রেতা সরকার। সরকারের পক্ষে এ গ্যাস ২.৯ ডলার মূল্যহারে পেট্রোবাংলার জন্য কেনা বাধ্যতামূলক। এ বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সাংগুর গ্যাস ৪.৫ ডলার মূল্যহারে পিডিবিকে দিয়ে কিনিয়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির নতুন নিয়ামক সৃষ্টি করা হতো না; ৮. ব্যক্তি খাত বিকাশের স্বার্থে সরকারি খাতে জ্বালানিসমৃদ্ধ শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বাধা হতে পারত না; ৯. সরকারি ইস্পাত কারখানা টিকে থাকত, ছাতক সিমেন্ট কারখানা বাঁচানো হতো; ১০. ভর্তুকিতে গ্যাস দিয়ে বিদেশি ব্যক্তিমালিকানাধীন রপ্তানিমুখী সার কারখানা কাফকো ও সিমেন্ট কারখানা লাফার্জের দরকার হতো না; ১১. টাটার গ্যাসজাত পণ্য, কয়লা ও কয়লাজাত পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত জনস্বার্থবিরোধী বিনিয়োগ প্রকল্প প্রস্তাব আমন্ত্রণের দরকার হতো না এবং ১২. সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মাইনিং রুলসের আওতায় রয়ালটির বিনিময়ে কয়লা সম্পদ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীর হাতে তুলে দেওয়ার প্রয়োজনে দেশকে জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলা হতো না।
এসব ঘটনা ঘটায় রাষ্ট্রের নীতিগত চরিত্র বদলে ফেলা হয়েছে। এসব ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব ঘটনা ঘটেছে অপস্ট্রিমে। তারই সম্পূরক হিসেবে ডাউন স্ট্রিমে যা কিছু ঘটেছে, তার মধ্যে ৫৮ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ উদঘাটিত হলেও যাঁরা এসব করেছেন তাঁদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই শুধু রাখা হয়নি বরং তাঁদেরই একজন নির্বাহী প্রধানকে পুরস্কৃত (!) করার জন্য তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব জ্বালানি বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও পাঠিয়েছে। এই একটি ঘটনা জ্বালানি খাতের ডাউন স্ট্রিমে সুশাসনের কী ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটছে তা বোঝার জন্য যথেষ্ট। যদি সুশাসন অটুট থাকত, তাহলে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় আজ যা কিছু হচ্ছে, সে জন্য সরকার মানুষের সহানুভূতি পেত। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে এ বিষয়টি জ্বালানি বিভাগ বা উপদেষ্টা আমলে নেননি। আগামী লেখায় থাকবে বিদ্যুৎ খাতের সুশাসন প্রসঙ্গ।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
অব্যাহত আর্থিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) পূর্বশর্ত হলো, সহনীয় দামহারে নির্ভরযোগ্য জ্বালানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত হলেই টেকসই উন্নয়নের জন্য ১০ শতাংশের অধিক হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা সহজ হয়। চলতি অর্থবছরে আর্থিক প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু এডিবির পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে। গত অর্থবছরে তা ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২০ শতাংশ। অথচ ১০ শতাংশও অর্জিত হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব থাকার কারণে মূলত সরকারি খাতে দুর্নীতি ও ব্যক্তি খাতে মুনাফা বাড়ায় বিনিয়োগ ব্যয় বেড়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা না হলে এ ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা বাড়বে। তাতে জ্বালানি ও বিদ্যুতের সরবরাহ-ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। ফলে আজকেরই মতো আগামীতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে অর্থাৎ বিদ্যুৎ ঘাটতি বাড়িয়ে জ্বালানি ও বিদ্যুতের সরবরাহ-ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার মতো এই একই অভিনব কৌশল গ্রহণ অব্যাহত থাকবে। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ এস বিশ্বনাথন তাঁর Highway Robbery শিরোনামের প্রবন্ধে বলেছেন, 'ভারতে জ্বালানি সরবরাহে নিয়োজিত ডিলাররা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ।' বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসব ডিলারসহ ব্যক্তি খাত বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোর মালিকদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে এ খাতের নির্বাহী, আইন ও রেগুলেটরি ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন প্রয়োজন। সে জন্য সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। তাতে আইনি বিধি-বিধান, রাজনৈতিক সক্ষমতা ও স্থিতিশীলতা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা, কৌশলগত রূপকল্প, সমতা ও জনমতের প্রাধান্য- সুশাসনের এসব উপাদান উন্নত ও জনস্বার্থসম্মত হলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে। ফ্রান্সের এক গবেষণায় দেখা যায়, সুশাসনের সঙ্গে মাথাপিছু জিডিপির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মাথাপিছু জিডিপির সঙ্গে মাথাপিছু ব্যবহৃত বিদ্যুতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে তাই সুশাসন নিশ্চিত হওয়া অপরিহার্য। বিগত দুই দশকের বেশি সময় বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার কার্যক্রম চলছে। তাতে এ খাতের নির্বাহী, আইন ও রেগুলেটরি ব্যবস্থায় কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সুশাসনের উপাদানগুলো কতটা উন্নত হচ্ছে, তার পর্যালোচনা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয় হিসেবে সংবিধানে প্রাধান্য পায় দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ জ্বালানি সম্পদের মালিক প্রজাতন্ত্র। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ বিধায় জ্বালানি সম্পদের মালিকানা জনগণের হাতে চলে আসে। সংবিধানের ১৩ ধারামতে, উৎপাদন যন্ত্র ও বণ্টন প্রণালি চলে আসে রাষ্ট্রীয় মালিকানায়। পরে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বণ্টন ও বিতরণ ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের আওতায় বিধিবদ্ধভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা হয়। পিডিবি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যুৎ খাতের নির্বাহী ক্ষমতা পিডিবিকে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার আগে যেসব গ্যাসক্ষেত্র বিদেশি কম্পানির হাতে ছিল, ক্রয়সূত্রে সে সবই রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা হয়। ১৯৭৪ সালে পেট্রোলিয়াম অ্যাক্টের আওতায় পেট্রোবাংলা গঠন করে তার মাধ্যমে জ্বালানি সম্পদে রাষ্ট্রীয় মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে সচিবের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং এ পদে আনা হয় জ্বালানি বিষয়ে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ড. হাবিবুর রহমানকে। গ্যাস তথা জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাকে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে। ফলে নির্বাহী কর্তৃপক্ষ হিসেবে পেট্রোবাংলার স্বশাসন ও প্রফেশনাল ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের দর্শন ও নীতি বাস্তবায়নে পরিকল্পনা কমিশন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অনন্য ভূমিকা রাখে। রেহমান সোবহান, মোজাফ্ফর আহমদ, আনিসুর রহমানের মতো বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদদের পরিকল্পনা কমিশনে আনা হয়। তখন রাষ্ট্র/সরকারপ্রধান সরাসরি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁদের পরামর্শ নিতেন। ফলে রাষ্ট্রের সব উন্নয়ন কার্যক্রম পরিকল্পনা কমিশনের আওতায় সুসমৃদ্ধ পরিকল্পনা মাফিক যেন হতে পারে, তা নিশ্চিত হয়। এ পরিকল্পনা প্রণয়ন মূলত বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভরশীল। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এভাবে শুরু হয়। এ পরিকল্পনায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। এভাবেই রাষ্ট্র জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের নির্বাহী, আইন ও রেগুলেটরি ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নে হাত দেয় এবং এ খাতের সুশাসনের কাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়।
১৯৭৫ সালে বিয়োগান্তক পথে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন যখন হলো, তখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনস্বার্থবিরোধী নানা পরিবর্তন আসে। তার মধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে আনীত পরিবর্তনগুলো সবচেয়ে মারাত্মক ছিল।
স্বল্প খরচে জ্বালানি সরবরাহ করার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়ায় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গ্যাস খাত উন্নয়ন প্রাধান্য পায়। জ্বালানি তেল আমদানি কমিয়ে পরিবহনসহ অন্যান্য খাতে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করা হয়। পিএসসির আওতায় বিদেশি বিনিয়োগে আইওসির মাধ্যমে দেশের মজুদ গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন শুরু হয়। তাতে জ্বালানি আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে এলেও সরবরাহ করা গ্যাসে আইওসির গ্যাসের অনুপাত দ্রুত বাড়তে থাকে। ফলে জ্বালানি তেল আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হলেও গ্যাস ক্রয়ে ব্যয় বৃদ্ধিতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের এ কৌশল কার্যকারিতা হারায়।
জ্বালানি খাতে জনস্বার্থ রক্ষায় যদি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা ও রাজনৈতিক সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যেত, তাহলে ১. সাগরের গ্যাস তোলার জন্য আইওসির ভাগের গ্যাসের সিলিং ক্রয় মূল্যহারসহ আইওসিকে দেওয়া সুবিধাদির আওতায় ২০১০ সালে যে পিএসসি হয়, তার থেকেও অধিক মূল্যহারসহ আরো অধিক সুবিধা দিয়ে পিএসসি ২০১২ করার উদ্যোগ নেওয়া হতো না; ২. দেশি কম্পানির গ্যাসের ক্রয় মূল্যহার যেখানে ২৫ টাকা, সেখানে আইওসির গ্যাসর মূল্যহার প্রায় ২৪০ টাকা। এর পরও তাদের নানাভাবে বেশি বেশি লাভবান করার চেষ্টা হতো না; ৩. মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডের পিএসসি বাতিলের পর অক্সিডেন্টালের সঙ্গে সম্পূরক চুক্তি হতো না এবং এ গ্যাসফিল্ড বিস্ফোরণ ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বীমার টাকা নিয়ে অক্সিডেন্টাল পালানোর সুযোগ পেত না; ৪. ছাতক ও ফেনী গ্যাসফিল্ড প্রান্তিক/পরিত্যক্ত ঘোষিত হতো না, গ্যাস তোলার জন্য সে গ্যাসফিল্ড নাইকোর হাতে তুলে দেওয়া হতো না; ৫. ছাতক গ্যাসফিল্ড বিস্ফোরণ ক্ষতিপূরণ আদায়ের মামলা থাকা সত্ত্বেও ক্ষতিপূরণ ছাড়াই এ চুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ দিয়ে নাইকোর পালানোর পথ তৈরির গোপন তৎপরতা শুরু হতো না; ৬. গ্যাস রপ্তানির বিরুদ্ধে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট অবস্থান কাজে আসত এবং সাগরের গ্যাস তোলার ব্যাপারে কনোকো-ফিলিপসের পিএসসিতে এলএনজি হিসেবে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ থাকত না; ৭. আইওসির গ্যাসের একক ক্রেতা সরকার। সরকারের পক্ষে এ গ্যাস ২.৯ ডলার মূল্যহারে পেট্রোবাংলার জন্য কেনা বাধ্যতামূলক। এ বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সাংগুর গ্যাস ৪.৫ ডলার মূল্যহারে পিডিবিকে দিয়ে কিনিয়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির নতুন নিয়ামক সৃষ্টি করা হতো না; ৮. ব্যক্তি খাত বিকাশের স্বার্থে সরকারি খাতে জ্বালানিসমৃদ্ধ শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বাধা হতে পারত না; ৯. সরকারি ইস্পাত কারখানা টিকে থাকত, ছাতক সিমেন্ট কারখানা বাঁচানো হতো; ১০. ভর্তুকিতে গ্যাস দিয়ে বিদেশি ব্যক্তিমালিকানাধীন রপ্তানিমুখী সার কারখানা কাফকো ও সিমেন্ট কারখানা লাফার্জের দরকার হতো না; ১১. টাটার গ্যাসজাত পণ্য, কয়লা ও কয়লাজাত পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত জনস্বার্থবিরোধী বিনিয়োগ প্রকল্প প্রস্তাব আমন্ত্রণের দরকার হতো না এবং ১২. সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মাইনিং রুলসের আওতায় রয়ালটির বিনিময়ে কয়লা সম্পদ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীর হাতে তুলে দেওয়ার প্রয়োজনে দেশকে জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলা হতো না।
এসব ঘটনা ঘটায় রাষ্ট্রের নীতিগত চরিত্র বদলে ফেলা হয়েছে। এসব ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব ঘটনা ঘটেছে অপস্ট্রিমে। তারই সম্পূরক হিসেবে ডাউন স্ট্রিমে যা কিছু ঘটেছে, তার মধ্যে ৫৮ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ উদঘাটিত হলেও যাঁরা এসব করেছেন তাঁদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই শুধু রাখা হয়নি বরং তাঁদেরই একজন নির্বাহী প্রধানকে পুরস্কৃত (!) করার জন্য তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব জ্বালানি বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও পাঠিয়েছে। এই একটি ঘটনা জ্বালানি খাতের ডাউন স্ট্রিমে সুশাসনের কী ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটছে তা বোঝার জন্য যথেষ্ট। যদি সুশাসন অটুট থাকত, তাহলে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় আজ যা কিছু হচ্ছে, সে জন্য সরকার মানুষের সহানুভূতি পেত। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে এ বিষয়টি জ্বালানি বিভাগ বা উপদেষ্টা আমলে নেননি। আগামী লেখায় থাকবে বিদ্যুৎ খাতের সুশাসন প্রসঙ্গ।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
No comments