প্রত্নতত্ত্ব পুরাকীর্তি নিয়ে আরও কিছু কথা by সাইফুদ্দীন চৌধুরী

বেশ কিছুদিন আগে এই কাগজেই দেশের পুরাকীর্তির বিষয়ে একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছিলাম—ব্রিটিশ শাসনামলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জরিপ করা সব প্রত্নস্থল ধ্বংস করে আবাদি জমিতে রূপান্তর করা হচ্ছে।
দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যে কৌতূহলী অনেক সুধীজনই আমাকে বিষয়টি নিয়ে আরও বিশদভাবে লেখার পরামর্শ দেন। বলা বাহুল্য, নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর ও মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনী উৎখননের পরিচালক বন্ধু-গবেষকের কাছ থেকে প্রথম ওই তাগিদ এসেছিল।
সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দেশের পুরাকীর্তির দেখভাল করে। সম্প্র্রতি তারা একটি তালিকা তৈরি করেছে দেশে কতগুলো প্রত্ন অঞ্চল ও প্রত্নপীঠ রয়েছে। তাদের পরিসংখ্যানমতে, দেশে ৪৪৮টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি অঞ্চল রয়েছে। বিভাগওয়ারি ওই সংখ্যা হলো ঢাকা ১০৩, চট্টগ্রাম ৪৮, খুলনা ৮২, সিলেট ১৩, বরিশাল ১৯, রংপুর ৪৯ ও রাজশাহী ১৩৪টি। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধিদপ্তরের প্রণীত ওই তালিকা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। তালিকাটি একেবারেই অসম্পূর্ণ। গোটা বিশেক প্রত্ন অঞ্চলের কথা আমার নিজেরই জানা আছে, যেগুলো ব্রিটিশ শাসনামলের জরিপ রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কী কারণে এগুলো প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তালিকাভুক্ত হয়নি, বুঝতে পারলাম না। তালিকায় বাদ পড়া কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন অঞ্চলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে উপস্থাপন করছি।
রাজশাহী শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গোদাগাড়ী উপজেলার মান্ডৈল গ্রামে রয়েছে বিশাল প্রত্নপীঠ। ১৯১০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও রাজশাহী বরেন্দ্র অনুসন্ধা সমিতি এখানে উৎখনন করে বেশ কিছুসংখ্যক শৈব, বৌদ্ধ ও জৈন মূর্তি যৌথভাবে উদ্ধার করে, যার অধিকাংশ এখন রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে রয়েছে। কলা ইতিহাসবেত্তাদের অনেকেই মন্তব্য করেছেন, মান্ডৈলে প্রাপ্ত হরগৌরীর ভাস্কর্যটি বঙ্গীয় ভাস্কর্যের ইতিহাসের এক অমূল্য সংযোজন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তাঁর এনসিয়েন্ট মনুমেন্ট অব বরেন্দ্র গ্রন্থে লিখেছেন রাজশাহীর অচিনঘাট প্রত্নপীঠ থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে বেশ কিছু পুরাকীর্তির নিদর্শন সংগৃহীত হয়। জেলার বাগমারার এই প্রত্নপীঠ থেকে একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর বেশ কটি প্রস্তর নির্মিত ব্রাহ্মণ্য ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। মধ্য যুগের কবি শুকুর মামুদের গুপীচন্দ্রের সন্ন্যাস গ্রন্থে উল্লিখিত ‘মৃকুলসহর’ নাকি এখানে ছিল বলে অনেকে মনে করেন।
নওগাঁর পোরশা উপজেলার ঘাটনগর প্রত্ন অঞ্চল ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগে জরিপ রিপোর্টের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। ওই রিপোর্টে সেখানে পাঁচটি হিন্দু মন্দির ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এখান থেকেও বেশ কিছু পুরাকীর্তি সংগ্রহ করে পূর্বাঞ্চলীয় পুরাতত্ত্ব অফিসের জন্য সে সময় কলকাতায় নিয়ে যায়। অনুরূপ, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকায় স্থান পায়নি নওগাঁর ধামইরহাটের আরানগর প্রত্নপীঠ। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের রিপোর্ট এবং রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্টার্ন ইন্ডিয়ান স্কুল অব মেডিয়েভাল স্কালপচারস বইয়ে উল্লেখ আছে, ৮ম, ৯ম শতকের এই প্রত্নপীঠে অজস্র পুরাকীর্তি নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে।
রাজশাহীর তানোরে বিহারোইল ও ধানোরা মার্দত্ত তালিকাভুক্ত করা হলেও পাঁড়িশো ও জিয়োতকুতি তালিকায় আসেনি। এই চারটি প্রত্ন অঞ্চলই সমসাময়িক। এখানে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা গুপ্ত আমলে এই অঞ্চল পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির একটি ‘মণ্ডলে’র অন্তর্ভুক্ত ছিল। জিয়োতকুড়ি প্রত্নপীঠ ১৯১১ সালে আবিষ্কৃত হয়েছে। এখন সেখানে মন্দির ও বাসগৃহ নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এভাবে লিখতে গেলে প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের অশনাক্ত তালিকা শুধু বাড়তেই থাকবে।
উইলকিন্স কোনব্রুক, বুকানন হ্যামিলটন, আলেকজান্ডার কানিংহাম, র‌্যাভেনশ, ওয়েস্টমেকট প্রমুখ ব্রিটিশ এবং এ দেশীয় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ঔপনিবেশিক শাসন আমলে জরিপ করে যেসব প্রত্ন অঞ্চল শনাক্ত করেছিলেন, তার কাগজপত্র কী প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে নেই? থাকলে তো এমন দশা হওয়ার কথা নয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রত্নপীঠের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জরিপকাজ সম্পন্ন করেছিলেন আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭১-৭২ এবং ১৮৭৯-৮০ সালে।
সার্ধশত বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘গ্রীন ল্যাণ্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে, মাত্তরি জাতির ইতিহাসও আছে কিন্তু যে দেশে গৌড়-তাম্রলিপ্তি সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, সে দেশের ইতিহাস নাই।’ ঐতিহাসিকেরা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, উপাদানের অভাব নয়, অনুসন্ধানের অভাবই এর কারণ। দেশের প্রাচীন ইতিহাসের আকর উপকরণের ধারক প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এমন দুরবস্থার মূল কারণ, তাদের মতে দক্ষ জনবলের অভাব। তা হতে পারে। তবে, একটি বিষয় ‘হাইলি টেকনিক্যাল’ এই প্রতিষ্ঠানে যোগ্য প্রধান নির্বাহী নিয়োগ করা হচ্ছে না। সরকারের প্রশাসনিক পুল থেকে যাঁরা আসেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা যোগ্য ব্যক্তি প্রশাসনের ক্ষেত্রে, কিন্তু যথেষ্ট চেষ্টা করেও এই বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে তাঁরা কোনো অবদান রাখতে সমর্থ হচ্ছেন না। এমন অবস্থা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে প্রায় দুই দশক ধরেই চলে আসছে। বলতে কি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আরও দু-একটি অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানে এমন অবস্থা বিরাজ করছে। সেসব প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি প্রায় থমকে দাঁড়িয়ে আছে। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, পেশাদার নির্বাহী না থাকার দরুণই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের ভাষায় একমাত্র ব্যতিক্রম মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী। মহান ভাষা আন্দোলনের স্মারক ওই প্রতিষ্ঠানটি পেশাদার নির্বাহীর কারণেই দেশে ও বহির্বিশ্বে ঈর্ষণীয় অবদান রাখতে সমর্থ হচ্ছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিয়ে সরকারের অনেক করণীয় আছে। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির অতীত ঠিকানা সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত এই মহান প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে অনেক কিছু ভাবার আছে।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pৎ_saif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.