নতুন গণমাধ্যম কোথায় যাবেন এডওয়ার্ড স্নোডেন by মশিউল আলম

২৯ বছর বয়সী মার্কিন নাগরিক এডওয়ার্ড স্নোডেনের জন্য এক করুণ মুহূর্ত। মস্কোর শেরেমেতোভা বিমানবন্দরের ট্রানজিট এলাকায় তাঁর অবস্থা এখন ঝুলন্ত। কারণ, মস্কো এখন আর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী নয়, বরং এক মুক্তকচ্ছ পুঁজিবাদী রাশিয়ার ক্ষমতাকেন্দ্র।
এই ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে ওয়াশিংটনের ক্ষমতাকেন্দ্রের কোনো আদর্শিক দ্বন্দ্ব নেই। মার্কিন-সোভিয়েত ঠান্ডা যুদ্ধের দিনগুলো এখন ইতিহাস। তাই ওবামা প্রশাসনের ঘোষিত ‘বিশ্বাসঘাতক’ এডওয়ার্ড স্নোডেন ক্রেমলিনের আতিথ্য থেকে বঞ্চিত। ওয়াশিংটন ক্রেমলিনকে অনুরোধ করেছে, ক্রেমলিন যেন স্নোডেনকে আশ্রয় না দিয়ে আটক করে আমেরিকান সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। প্রেসিডেন্ট পুতিন ওয়াশিংটনকে আশ্বস্ত করে প্রথমে বলেন, স্নোডেন ‘টেকনিক্যালি’ মস্কো বিমানবন্দরে আছেন বটে, কিন্তু ওটা ট্রানজিট এলাকা—রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড নয়। তিনি রাশিয়ার আইন ভঙ্গ করেননি, তাই রুশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে না। তবে, স্নোডেন যত তাড়াতাড়ি নিজের চূড়ান্ত গন্তব্য নির্ধারণ করে সেখানে চলে যান, ততই মঙ্গল।
তারপর খবর পাওয়া গেল, গত রোববার স্নোডেনের পক্ষে উইকিলিকসের আইনজ্ঞ সারা হ্যারিসন রাশিয়ায় স্নোডেনের রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। এবার প্রেসিডেন্ট পুতিন বললেন, স্নোডেন যদি অন্য কোনো দেশে চলে যেতে চান এবং অন্য কোনো দেশ যদি তাঁকে গ্রহণ করতে চায়, তবে সেটাই হোক। আর তিনি যদি রাশিয়ায় থেকে যেতে চান, তাহলে শর্ত একটাই: আমাদের আমেরিকান সহযোগীদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে স্নোডেন যে কাজ করছেন, তা বন্ধ করতে হবে। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই পুতিন এও বলেছেন, যেহেতু স্নোডেন নিজেকে একজন মানবাধিকারকর্মী এবং মানবাধিকারের পক্ষের লড়াকু সৈনিক বলে মনে করেন, সেহেতু তিনি সম্ভবত তাঁর কাজ বন্ধ করবেন না। সুতরাং তাঁর অন্য কোনো দেশ বেছে নেওয়া উচিত এবং সেই দেশে চলে যাওয়া উচিত।
কিন্তু এডওয়ার্ড স্নোডেন যাবেন কোথায়? তাঁর জন্মভূমি আমেরিকা তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করেছে। গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত কঠোর আইনের অধীনে তাঁর বিচার করে চরম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ শুরু করেছে। স্নোডেনের পৃষ্ঠপোষক উইকিলিকসের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে বসে চেষ্টা করছিলেন, স্নোডেনকে যেন ইকুয়েডর রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। কিন্তু ইকুয়েডর খুব সতর্ক। অ্যাসাঞ্জকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ইকুয়েডরের সম্পর্ক ইতিমধ্যেই খারাপ হয়েছে। ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়া যদিও অ্যাসাঞ্জের ব্যক্তিগত বন্ধু এবং আমেরিকার দাপুটেপনার থোরাই পরোয়া করেন, তবু স্নোডেনের ব্যাপারে তাঁর কথাবার্তায় উত্তেজনা কম। ‘গেম থিয়োরি’ বিশেষজ্ঞ রাফায়েল কোরেয়া স্নোডেন ইস্যু নিয়ে কদিন ধরে আমেরিকার সঙ্গে ভালোই খেলা খেলে আসছিলেন। আমেরিকা ইকুয়েডর থেকে গোলাপ ফুল আমদানি করে; এ থেকে ইকুয়েডরের বছরে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়। এই বাণিজ্যে ইকুয়েডরের পক্ষে শুল্কছাড়ের একটা বন্দোবস্ত আছে। ওয়াশিংটন হুমকি দিয়েছিল, ইকুয়েডর যদি স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়, তাহলে তারা সেই শুল্কছাড়ের বন্দোবস্তটি আর নবায়ন করবে না। তাদের এই হুমকি শুনে ইকুয়েডর বলল, তোমরা আমাদের ব্ল্যাকমেল করার ভয় দেখাচ্ছ? দরকার নেই তোমাদের শুল্কছাড়!
কিন্তু তাই বলে ইকুয়েডর বলেনি যে তারা স্নোডেনকে আশ্রয় দেবে। প্রেসিডেন্ট কোরেয়া প্রথমে বললেন, স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া বা না দেওয়ার প্রশ্নটি তাঁদের জন্য এখন প্রাসঙ্গিক নয়, কারণ স্নোডেন ইকুয়েডরের ভূখণ্ডে অবস্থান করছেন না। তিনি যদি কোনোভাবে ইকুয়েডরের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানাতেন, তাহলে সে আবেদন বিবেচনা করা বা নাকচ করার প্রশ্নটি উঠত। আপাতত সেই প্রশ্ন তাঁদের সামনে নেই। সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট কোরেয়াকে বলতে শোনা গেল, ইকুয়েডরের লন্ডন দূতাবাস স্নোডেনকে যেটুকু সহযোগিতা এ পর্যন্ত দিয়েছে, সেটা ভুল হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। আর স্নোডেনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য: স্নোডেন রাশিয়ার প্রযত্নে আছেন, রাশিয়াই দেখবে তাঁর কী হবে।
ব্রিটেন, আমেরিকা ও রাশিয়ার কয়েকটি সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ ও সংবাদ পোর্টাল এবং উইকিলিকসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নানা সংবাদ, পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্যধর্মী লেখালেখি ও বিবৃতি থেকে মনে হচ্ছে, স্নোডেন, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকসের আইনজ্ঞ দল যেভাবে পরিকল্পনা করেছিল, ঘটনাবলি সেভাবে অগ্রসর হতে পারেনি। ইকুয়েডরের লন্ডন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সম্পর্কে টানাপোড়েনের খবর কিছু সূত্রে পাওয়া যায়। স্নোডেন ইস্যুর আসল কলকাঠি নাড়ছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ—এমন অভিযোগ ইতিমধ্যেই বেশ চাউর। স্নোডেনের মার্কিন পাসপোর্ট বাতিল হওয়ার পর ইকুয়েডরের লন্ডন দূতাবাস থেকে তাঁর জন্য যে ট্রাভেল ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে, বলা হচ্ছে, সেটি বৈধ নয়। অর্থাৎ স্নোডেনের এখন কোনো বৈধ ট্রাভেল ডকুমেন্ট নেই। আন্তর্জাতিক কোনো বিমান সংস্থার তাঁকে বহন করার কথা নয়। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ তখন ঘোষণা করেন যে উইকিলিকসের একটি ভাড়া করা বিমানে করে স্নোডেনকে আইসল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। আইসল্যান্ডে উইকিলিকসের অনেক প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর ও ধনী সমর্থক আছে। দেশটিতে অবাধ তথ্যপ্রবাহের পক্ষে খুব শক্তিশালী আইনও আছে। কিন্তু উইকিলিকসের সেই বিমানের খবর আর পাওয়া যায়নি। স্নোডেনকে হংকং থেকে মস্কো পর্যন্ত বহন করেছে রাশিয়ার জাতীয় বিমান সংস্থা আয়েরোফ্লত। শোনা গিয়েছিল, স্নোডেন মস্কো থেকে কিউবার হাভানা অথবা ভেনেজুয়েলার কারাকাসে যাবেন, সেখান থেকে ইকুয়েডরে ঢোকার চেষ্টা করবেন, অথবা ওই দুটি দেশের কোনো একটিতে ইকুয়েডরের দূতাবাসে হাজির হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করবেন। সর্বশেষ জানা গেল, স্নোডেন অন্তত ১৫টি দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন বা করতে যাচ্ছেন। সেসব দেশের মধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, চীন ও কিউবা আছে।
কিন্তু কোন দেশ স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে, বৈধ ট্রাভেল ডকুমেন্ট ছাড়া স্নোডেন কীভাবে মস্কো থেকে সেই দেশে গিয়ে পৌঁছাবেন, তা এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ক্রেমলিনের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ স্নোডেনকে রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুতিন স্নোডেনকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত আমলের বিরুদ্ধবাদী আন্দ্রেই সাখারভের সঙ্গে তুলনা করলেও, তাঁকে রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে আগ্রহী বলে অন্তত তাঁর সর্বশেষ কথাবার্তায় মনে হচ্ছে না। বরং তিনি আমেরিকানদের সন্দেহ দূর করতে বারবার বলছেন, ‘স্নোডেন আমাদের লোক নন’। স্নোডেন রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার পর পুতিন আবারও বলেছেন, ‘স্নোডেন আমাদের এজেন্ট নন, কখনো ছিলেন না, এখনো নন।’ এর আগেও পুতিন জোরালো ভাষায় বলেছেন, স্নোডেন কখনো রাশিয়ার সিক্রেট সার্ভিসের হয়ে কাজ করেননি, এখনো করছেন না।
আসলে রাশিয়ার জবরদস্ত শাসক ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে এডওয়ার্ড স্নোডেনের মতো স্বাধীনচেতা মানবাধিকার যোদ্ধাকে সহ্য করা কঠিন। দেশটিতে পুতিন প্রায় জারের শাসন চালু রেখেছেন, যেখানে মানবাধিকারকর্মী এবং ব্লগাররা ব্যাপক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। স্নোডেন আমেরিকান সরকারের যে গণগোয়েন্দাগিরির তথ্য-প্রমাণ ফাঁস করে দিয়েছেন, পুতিনের বুনিয়াদি গোয়েন্দা ব্যবস্থাও রাশিয়ার নাগরিকদের ওপর একই রকমের গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যাচ্ছে। এডওয়ার্ড স্নোডেন যে রাজনৈতিক আদর্শে তাড়িত হয়ে ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের গণবিরোধী আচরণকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, পুতিন থেকে কোরেয়া পর্যন্ত কোনো জবরদস্ত রাষ্ট্রশাসকই সেই আদর্শের অনুসারী নন, হতে পারেন না। স্নোডেন যদি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক না হয়ে রাশিয়া, চীন, কিউবা, ভেনেজুয়েলা কিংবা ইকুয়েডরের নাগরিক হতেন এবং একই কাজ করতেন, তাহলে তাঁকে কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
কিন্তু সুখের বিষয়, পুতিনের রাশিয়ায় কিছু মানুষ স্নোডেনের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তাঁরা স্নোডেনকে রাশিয়ায় আশ্রয় দিতে চান। তাঁরা বলছেন, স্নোডেন মস্কোর শেরেমেতোভা বিমানবন্দরে আটকে রয়েছেন, মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না—এটা তো জেলখানার চেয়েও অমানবিক, এটা অন্যায়। তাঁকে রাশিয়ায় ঢোকার ব্যবস্থা করা হোক। রাশিয়ার কয়েকজন এমপি এমন কথাও বলেছেন যে তাঁরা স্নোডেনকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার পক্ষে প্রস্তাব পাঠাবেন।
তবে স্নোডেনের পক্ষে সবচেয়ে বড় শক্তি-সমর্থন-সংহতি আছে সম্ভবত তাঁর নিজের দেশ যুক্তরাষ্ট্রেই। কারণ, তিনি যা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কাছে তা-ই প্রত্যাশা করে। নাগরিকদের ইন্টারনেট যোগাযোগ ও টেলিফোন যোগাযোগের ওপর মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) গোপন নজরদারির প্রামাণ্য তথ্য মূলধারার সংবাদমাধ্যমের কাছে ফাঁস করে দিতে গিয়ে স্নোডেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ‘আই ক্যান্ট অ্যালাউ ইউএস গভর্নমেন্ট টু ডেসট্রয় আওয়ার প্রাইভেসি অ্যান্ড বেসিক লিবার্টিজ।’ মুক্তি, স্বাধীনতা, ব্যক্তি-নাগরিকের মানবিক মর্যাদা—এসব মৌলিক মূল্যবোধের ওপর যে রাষ্ট্রটিকে দাঁড় করানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন আমেরিকান সংবিধানপ্রণেতারা, সেই রাষ্ট্রকে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদী গোয়েন্দা নজরদারিভিত্তিক শাসনযন্ত্রে পর্যবসিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন এডওয়ার্ড স্নোডেন। তাই তাঁকে স্যালুট জানিয়েছেন আমেরিকার সর্বজনশ্রদ্ধের হুইসলব্লোয়ার, পেন্টাগন পেপার্সখ্যাত ড্যানিয়েল এলসবার্গ, অনেক বিশিষ্ট নাগরিকসহ পুরো ইন্টারনেট প্রজন্ম।
কেন জানি মনে হচ্ছে, স্নোডেনের শেষ গন্তব্য সম্ভবত আমেরিকাই। আমেরিকান সংবিধান, ও ক্রমশক্তিমান সাইবার গণমাধ্যমসহ প্রবল সিভিল লিবার্টিজ আন্দোলন তাঁর পক্ষে আছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.