দ্বিতীয় পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র by ড. তারেক শামসুর রেহমান
দ্বিতীয় আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
নির্মাণের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, দ্বিতীয় পরমাণু
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হবে দক্ষিণাঞ্চলের কোনো একটি চরে। প্রধানমন্ত্রীর
এই বক্তব্যটি ছাপা হয়েছে গত ৩০ মে।
প্রধানমন্ত্রীর এই
ঘোষণা নানা কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। কেননা রূপপুরে প্রথম পারমাণবিক
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া
সফরের সময় রাশিয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
রূপপুরে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার
২৪২ কোটি টাকা। বাকি এক হাজার ২৪২ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে
জোগান দেওয়া হবে।
পারমাণবিক প্রকল্প ব্যয়বহুল তো বটেই, চূড়ান্ত পর্যায়ে আসতেও অনেক সময়ের প্রয়োজন। আমাদের ন্যূনতম ছয় থেকে আট বছর অপেক্ষা করতে হবে রূপপুর প্রকল্পটি চালু হতে। অর্থাৎ ধরে নিচ্ছি, ২০২০ সালের আগে আর রূপপুর থেকে কোনো বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। কিন্তু এই কয়লার উত্তোলন আটকে আছে একটি ইস্যুতে- কোন পদ্ধতিতে আমরা কয়লা তুলব? সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে, নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে? এখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে জনমত বেশি বলেই মনে হচ্ছে, যদিও একটি জাতীয় কমিটি এর বিরোধিতা করছে। গত ৪ ডিসেম্বর (২০১২) সংবাদপত্রে প্রকাশিত এ প্রতিবেদন (যুগান্তর) থেকে জানা যায়, পরিকল্পনা কমিশন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে অভিমত দিয়েছে। এর আগে একটি সংসদীয় কমিটিও একই ধরনের অভিমত দিয়েছিল। আমরা ভারত থেকে কয়লা আমদানি করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে। ভারতের কয়লা নিম্নমানের, সেটা একটা সমস্যা। অন্যদিকে খুলনায় যেখানে আমদানীকৃত কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, তা সুন্দরবনের খুব কাছে। এতে করে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবে। স্থানীয় পর্যায়ে এর বিরোধিতা রয়েছে। এই বিরোধিতার খবর জাতীয় পর্যায়েও ছাপা হয়েছে। বলা ভালো, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এতে ব্যয় হবে ১৩ হাজার ২০০ কোটি ভারতীয় রুপি, যা কিনা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার সমান। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী আমদানি করা কয়লা নিয়ে এই কেন্দ্র দুটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভারত সমান অংশীদারিত্বে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির ব্যয়ভার বহন করবে।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পমিরাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে ভালো জাতের বিটুমিনাস কয়লা পাওয়া গেছে। উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়ায় যে কয়লা পাওয়া গেছে, তা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১৯ থেকে ৫৬০ মিটার গভীরতায় অবস্থিত। মোট ছয়টি কয়লাস্তর পাওয়া গেছে, যার পুরুত্ব সর্বনিম্ন তিন মিটার এবং সর্বোচ্চ ৮২ মিটার। মোট মজুদের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে এ কয়লা খনিটি ভূগর্ভস্থ খননপদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বড়পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬৪০ মিটার থেকে ১১৫৮ মিটার গভীরতায় সাতটি কয়লাস্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা খনি এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ১২ বর্গকিলোমিটার এবং মোট আনুমানিক মজুদের পরিমাণ ১০৫৩ মিলিয়ন টন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফুলবাড়ীর এই কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৭ সালে এবং কয়লা মজুদ নিশ্চিত হয়েছে ৫৭২ মিলিয়ন টন।
ভারতের সেন্ট্রাল মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. অজয় কুমার ঘোষ একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা গেলে ফুলবাড়ী থেকে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা সম্ভব। এমনকি পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক ভূতত্ত্ববিদ ড. ইউনুস আকনও একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, উন্মুক্তভাবে কয়লা তোলা সফলভাবে সম্ভব। ভারতে উৎপাদিত কয়লার ৮১ শতাংশ আসে উন্মুক্ত পদ্ধতি বা ওপেন কাস্ট মাইনিং থেকে। 'বাংলাদেশের নিরাপত্তা ভাবনা : অপ্রচলিত ধারণা' শীর্ষক একটি গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে দেখেছি, ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে ২০ শতাংশের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হয় না (গবেষণাকর্মটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে)। বড়পুকুরিয়া কয়লা ক্ষেত্রের বেলায় দেখা গেছে, ১০ শতাংশ কয়লা তোলাও সম্ভব হচ্ছে না।
সরকার পারমাণবিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে শুধু একটাই কারণে। আর তা হচ্ছে দেশের বিপুল জ্বালানি চাহিদা মোকাবিলা করা। চূড়ান্ত বিচারে পারমাণবিক প্রকল্প কোনো সমাধান নয়। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল (যেমন- অস্ট্রেলিয়ায় ৭৯ শতাংশ, ভারতে ৬৯ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯২ শতাংশ)। ফুলবাড়ী কয়লা খনি নিয়ে বড় অভিযোগে- কৃষি তথা বসতভিটা অধিগ্রহণ, পানিশূন্যতা, ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তর ইত্যাদি। জাতীয় কমিটি এ বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তবে পরিকল্পনা কমিশন যে মতামত দিয়েছে (যুগান্তর : ঐ), তাতে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সম্ভব বলে জানিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সময়কার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সময় ১২০০ একর জমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার বাসিন্দাকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তাই রূপপুর প্রকল্প আমাদের জ্বালানি সংকটের কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে (৮৭ শতাংশ), কয়লা (৩ দশমিক ৭ শতাংশ), বাকি ফার্নেস ওয়েল, জলবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে। নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃতও হচ্ছে না। ফলে কয়লার ব্যাপারে আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জাপানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ বিস্ফোরণ (২০১১) কিংবা তারও আগে রাশিয়ার চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর অনেক দেশ 'শিক্ষা' নিয়েছে। জার্মানি ধীরে ধীরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনি একসময় আমরা আরো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা ভালো নয়। আমাদের তাতে আদৌ কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। বরং আমাদের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে আমরা যদি বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর উদ্যাগ নিই, তা আমাদের মঙ্গল ডেকে আনবে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com
পারমাণবিক প্রকল্প ব্যয়বহুল তো বটেই, চূড়ান্ত পর্যায়ে আসতেও অনেক সময়ের প্রয়োজন। আমাদের ন্যূনতম ছয় থেকে আট বছর অপেক্ষা করতে হবে রূপপুর প্রকল্পটি চালু হতে। অর্থাৎ ধরে নিচ্ছি, ২০২০ সালের আগে আর রূপপুর থেকে কোনো বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। কিন্তু এই কয়লার উত্তোলন আটকে আছে একটি ইস্যুতে- কোন পদ্ধতিতে আমরা কয়লা তুলব? সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে, নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে? এখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে জনমত বেশি বলেই মনে হচ্ছে, যদিও একটি জাতীয় কমিটি এর বিরোধিতা করছে। গত ৪ ডিসেম্বর (২০১২) সংবাদপত্রে প্রকাশিত এ প্রতিবেদন (যুগান্তর) থেকে জানা যায়, পরিকল্পনা কমিশন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে অভিমত দিয়েছে। এর আগে একটি সংসদীয় কমিটিও একই ধরনের অভিমত দিয়েছিল। আমরা ভারত থেকে কয়লা আমদানি করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে। ভারতের কয়লা নিম্নমানের, সেটা একটা সমস্যা। অন্যদিকে খুলনায় যেখানে আমদানীকৃত কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, তা সুন্দরবনের খুব কাছে। এতে করে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবে। স্থানীয় পর্যায়ে এর বিরোধিতা রয়েছে। এই বিরোধিতার খবর জাতীয় পর্যায়েও ছাপা হয়েছে। বলা ভালো, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এতে ব্যয় হবে ১৩ হাজার ২০০ কোটি ভারতীয় রুপি, যা কিনা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার সমান। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী আমদানি করা কয়লা নিয়ে এই কেন্দ্র দুটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভারত সমান অংশীদারিত্বে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির ব্যয়ভার বহন করবে।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পমিরাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে ভালো জাতের বিটুমিনাস কয়লা পাওয়া গেছে। উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়ায় যে কয়লা পাওয়া গেছে, তা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১৯ থেকে ৫৬০ মিটার গভীরতায় অবস্থিত। মোট ছয়টি কয়লাস্তর পাওয়া গেছে, যার পুরুত্ব সর্বনিম্ন তিন মিটার এবং সর্বোচ্চ ৮২ মিটার। মোট মজুদের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে এ কয়লা খনিটি ভূগর্ভস্থ খননপদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বড়পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬৪০ মিটার থেকে ১১৫৮ মিটার গভীরতায় সাতটি কয়লাস্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা খনি এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ১২ বর্গকিলোমিটার এবং মোট আনুমানিক মজুদের পরিমাণ ১০৫৩ মিলিয়ন টন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফুলবাড়ীর এই কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৭ সালে এবং কয়লা মজুদ নিশ্চিত হয়েছে ৫৭২ মিলিয়ন টন।
ভারতের সেন্ট্রাল মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. অজয় কুমার ঘোষ একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা গেলে ফুলবাড়ী থেকে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা সম্ভব। এমনকি পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক ভূতত্ত্ববিদ ড. ইউনুস আকনও একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, উন্মুক্তভাবে কয়লা তোলা সফলভাবে সম্ভব। ভারতে উৎপাদিত কয়লার ৮১ শতাংশ আসে উন্মুক্ত পদ্ধতি বা ওপেন কাস্ট মাইনিং থেকে। 'বাংলাদেশের নিরাপত্তা ভাবনা : অপ্রচলিত ধারণা' শীর্ষক একটি গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে দেখেছি, ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে ২০ শতাংশের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হয় না (গবেষণাকর্মটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে)। বড়পুকুরিয়া কয়লা ক্ষেত্রের বেলায় দেখা গেছে, ১০ শতাংশ কয়লা তোলাও সম্ভব হচ্ছে না।
সরকার পারমাণবিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে শুধু একটাই কারণে। আর তা হচ্ছে দেশের বিপুল জ্বালানি চাহিদা মোকাবিলা করা। চূড়ান্ত বিচারে পারমাণবিক প্রকল্প কোনো সমাধান নয়। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল (যেমন- অস্ট্রেলিয়ায় ৭৯ শতাংশ, ভারতে ৬৯ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯২ শতাংশ)। ফুলবাড়ী কয়লা খনি নিয়ে বড় অভিযোগে- কৃষি তথা বসতভিটা অধিগ্রহণ, পানিশূন্যতা, ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তর ইত্যাদি। জাতীয় কমিটি এ বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তবে পরিকল্পনা কমিশন যে মতামত দিয়েছে (যুগান্তর : ঐ), তাতে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সম্ভব বলে জানিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সময়কার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সময় ১২০০ একর জমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার বাসিন্দাকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তাই রূপপুর প্রকল্প আমাদের জ্বালানি সংকটের কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে (৮৭ শতাংশ), কয়লা (৩ দশমিক ৭ শতাংশ), বাকি ফার্নেস ওয়েল, জলবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে। নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃতও হচ্ছে না। ফলে কয়লার ব্যাপারে আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জাপানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ বিস্ফোরণ (২০১১) কিংবা তারও আগে রাশিয়ার চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর অনেক দেশ 'শিক্ষা' নিয়েছে। জার্মানি ধীরে ধীরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনি একসময় আমরা আরো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা ভালো নয়। আমাদের তাতে আদৌ কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। বরং আমাদের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে আমরা যদি বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর উদ্যাগ নিই, তা আমাদের মঙ্গল ডেকে আনবে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com
No comments