বহে কাল নিরবধি-শুভবুদ্ধির জয় হোক by এম আবদুল হাফিজ
আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন আওয়ামী লীগের
ক্ষয়িষ্ণু জনপ্রিয়তা, যার একাধিক উপসর্গ এখন দৃশ্যমান। আমরা যাঁরা অহরহ
নানা ধরনের 'পাবলিকের' সঙ্গে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় মিশি কিংবা আমাদের মধ্যে
যাঁদের মিশতে হয় এবং যাঁদের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ শুধু বাসি হলেই ফলে,
তাঁদের অনুমানকে সত্য প্রমাণ করে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চারটি সিটি করপোরেশনের
মেয়র পদের ফলাফল এক রকম চোখে আঙুল দিয়ে আওয়ামী লীগের পরিতৃপ্ত নেতৃত্বকে
এক ঝটকায় বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে তাদের ঐতিহ্যবাহী দলটির জনপ্রিয়তা এবং
জনসম্পৃক্ততা কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। জনপ্রিয়তা ও রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা
পারদের ওঠা-নামার মতো কখনো স্থির থাকে না। তাই এতে বিচলিত হওয়ারও কিছু
নেই।
কিন্তু আওয়ামী লীগ এতে স্পষ্টতই বিচলিত হয়েছে। কেননা তাদের তো আবার ক্ষমতায় যেতে হবে, রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়ন করতে হবে। এই পোড়াকপাল দেশটাকে 'সোনার বাংলা'য় রূপান্তরিত করতে হবে এবং মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হবে। দলনেত্রী প্রধানমন্ত্রীর বহুল উচ্চারিত বক্তব্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগই শুধু এসব করতে পারবে, অন্যের অর্থাৎ তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তো ক্ষমতা হাতে পেলে দেশকে কিছু দেওয়া তো দূরের কথা, আওয়ামী শাসকদের কষ্টার্জিত সব উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং জনহিতকর কাজকে নস্যাৎ করে লুটপাট, চুরিচামারি বা অর্থ পাচারের মতো মারাত্মক অপরাধে লিপ্ত 'সোনার বাংলাকে' ছিবড়া করে দেবে। প্রধানমন্ত্রীর বহু বক্তৃতা-বক্তব্যের সারমর্মে আমরা অন্তত এমনটাই বুঝি। তাঁর কথায় শুধু 'আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশ কিছু পায়।'
আওয়ামী নেতৃত্বের পরিচিত আচরণ ও উচ্চারণে বোঝাই যায় যে নিছক দেশের এবং জনগণের খাতিরেই দলটিকে আবার ক্ষমতায় আসতে হবে। যেন অন্যথায় তাদের ক্ষমতায় সামান্যই রুচি। কিন্তু কিভাবে আওয়ামী লীগের জন্য সেই ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন সম্ভব হবে? স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল, বিভিন্ন মহলের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য জনমত জরিপ বা খসড়া হিসাব-নিকাশে তো তেমন কোনো আভাস পাওয়া যায় না। এবং জানা যায় যে সঙ্গোপনে সরকারের বিভিন্ন মাধ্যমে জনমত যাচাইয়েও দলের জন্য আশার আলো নেই। শোনা যায়, বর্তমান সংসদের একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্যের মনোনয়ন পুনর্বিবেচনায় আসছে। এর ফলে দলটিকে নিকট-অতীতে করিৎকর্মা বিবেচিত বেশ কিছু সদস্য ছাঁটাইয়ে পড়বে।
জাতীয় নির্বাচনে সম্ভাব্য গতি-প্রকৃতি এবং জোট-মহাজোটে ভাঙাগড়ার ফিরিস্তি দিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ এসেছে। সেগুলো খুঁটে খুঁটে পড়লে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ভবিষ্যতের বড়জোর এক মিশ্র সম্ভাবনাই আঁচ করা যায়। অথচ আমরা সম্ভাবনা যা দেখছি, তাতে রয়েছে আওয়ামী লীগের অন্তত ২০২১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পর্যন্ত আওয়ামী লীগেরই ক্ষমতাধারণ। যে দলটি স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেই দলটি যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে সম্পৃক্ত থাকে, তা তো খারাপ কিছু নয়। কিন্তু কিভাবে আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে সব অপবাদের প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে সে সময় পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবে, তা অবশ্যই একটি বিস্ময়।
এ কথা কবুল করত দ্বিধা নেই যে আমরা আমাদের তারুণ্য ও যৌবনের উজ্জ্বল দিনগুলোকে একদা আওয়ামী লীগ ও তার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের উদ্দেশে সঁপে দিয়েছিলাম। আমাদের ভাগ্য, ভবিষ্যৎ ও স্বপ্ন-অনুভূতি এই মহান নেতার নামে বিবর্তিত হয়। তাঁর প্রতিটি উচ্চারণে আমরা সম্মোহিত থেকেছি। আজও শেখ মুজিবসহ অনেক চেনা-অচেনা আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে যৎসামান্য সম্পৃক্ততার স্মরণে নস্টালজিক না হয়ে পারি না।
স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কী মর্মভেদী তা বুঝলাম আমাদের আরাধ্য সব কিছু হাতে পেয়েও নেতৃত্বের বিপথগামিতার কারণে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সব কিছু যখন হাতছাড়া হয়ে গেল। আজ স্বাধীনতার ৪২ বছর ধরে জাতি সেই গ্লানি অথবা তারই জের বহন করছে। একটি নামসর্বস্ব গণতন্ত্রের পরিচিতি থাকলেও, বাংলাদেশের গণতন্ত্রে নেই তার ঔদার্য, সহিষ্ণুতা, মৌলিক অধিকার, ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা বা রাষ্ট্র পরিচালনার এই পদ্ধতিটির ন্যূনতম চর্চা।
আজ প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ফোরামে উচ্চ কণ্ঠে দাবি করেন যে তাঁর আওয়ামী লীগই নাকি জনগণকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। শুধু 'ভোটাধিকার'ই কি গণতন্ত্র, ১৯৭২ প্রণীত সংবিধানের এক নম্বর মূলনীতির অর্থ কি শুধু মৌলিক অধিকারহীন দেশে যেনতেনভাবে পরিচালিত এক নির্বাচনের জন্য জনগণের ভোটদান নিশ্চিতকরণ? তবু ধরে নিলাম আওয়ামী লীগ ভোটদানের অধিকার নিশ্চিত (এতে নিশ্চিত করার কিছু নেই, গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যোগ্য ভোটাররা তো ভোট দেবেই) করেছে, ভালো কথা। তার জন্য কৃতিত্ব দাবি করার কী আছে। কৃতিত্ব দাবি করার কথা ছিল যিনি বাকশালী থাবা থেকে গণতন্ত্রকে উদ্ধার করে জনগণকে ফেরত দিয়েছিলেন সেই মহান ত্রাতা জিয়াউর রহমানের। আওয়ামীরা এত সহজে ভুলে গেলেন যে বাকশাল প্রক্রিয়ায় বিলুপ্ত আওয়ামী লীগও তার ফলেই অস্তিত্বে ফিরতে পেরেছিল। এ-ও গণতন্ত্রেরই শিক্ষা যে এই মন্ত্রের অনুসারীদের সবাইকে তাদের স্ব স্ব প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে হয়।
আওয়ামী দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক স্ববিরোধিতা এবং বৈপরিত্যের অন্যতম এ-ও যে তা ইচ্ছা করেই ভোটাধিকার, মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সংবিধান সংশোধনকরত সংগঠিত নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের মধ্যে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের যোগ্যতা, অর্জন দেখা ইত্যাদিকে একত্রে গুলিয়ে ফেলে হয় একটি পক্ষপাত নির্বাচন অথবা আদৌ কোনো নির্বাচন না করে বাকশালের কোনো বিকল্প পদ্ধতিতে ক্ষমতা ধরে রাখার পাঁয়তারা করছে। সরকার উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে তাদের অধীনে বিশ্বের আর দশটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের মডেলে আগামী নির্বাচনের ধারণাকে বিরোধী দল কর্তৃক গেলানোর এক অশুভ মনস্তাত্তি্ব্বক খেলায় প্রবৃত্ত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী নেতারা যখন তাঁদের অধীনে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দৃষ্টান্ত দিয়ে নিরপেক্ষতায় তাঁদের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠেপড়ে লাগে, সন্দেহের বীজে সেখানেই শিকড় গজায় এবং জনগণের শঙ্কা ঘনীভূত হয়। এই তথাকথিত যুক্তিটিকে আওয়ামী লীগ দলীয় স্ট্যান্ট হিসেবে গ্রহণ করে সেটিকেই এখন আঁকড়ে ধরেছে। এর অর্থ এই নয় যে বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবেই হেরে যাবে। তখন একটি win win পরিস্থিতিতে তাদেরও জিতবার সমান সম্ভাবনা থাকবে।
এ ছাড়া নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে রাখতে আওয়ামী লীগ বিগত চার বছরে স্তরে স্তরে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেকোনো কৌশল ভেস্তে গেলে অন্যটি তার স্থান নেবে। তবু আওয়ামীদের অপরাধী মননে পরাজয়ের ভয় এমনভাবে ছায়া বিস্তার করেছে যে তারা নির্বাচনও নিজেদের কর্তৃত্বাধীন রাখার মধ্যেই বিজয়লাভ নিরাপদ মনে করছে। যদিও তা এক নেতিবাচক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন। যাদের সঙ্গে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে শুরু করে শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ব্যাংক কেলেঙ্কারি এবং ক্ষমতার দাপটে সরকারি সম্পদের লুণ্ঠন, সংক্রমণের মতো দুর্নীতির কলঙ্ক লেপ্টে আছে, আছে পুলিশি নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি, ভারতের কাছে দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্কের নামে দেশের স্বার্থকে বিলিয়ে দেওয়া এবং বিনিময়ে প্রণব মুখার্জির ত্রিপুরা রাজ্যে গ্যাস সরবরাহের সুযোগ করে দেওয়ার শুকনো ধন্যবাদ দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নীরবে অবলোকন করলেও শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে।
বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র দেশ, যেখানে সবাই সবার হাঁড়ির খবর জানে। যেকোনো দলের শাসকগোষ্ঠী যতই চতুর হোক না কেন, কৃত অপকর্মকে কিছুতেই লুকিয়ে রাখতে পারে না। আজ যদিও আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি দলে পরাজয়ের গন্ধে মনোবিকৃতি ঘটেছে এবং এক প্রকার হীনম্মন্যতা ভর করেছে, আমি বিশ্বাস করি ইমেজ বিনষ্ট হলেও দলটির প্রাণশক্তি নিঃশেষিত হয়নি। ভবিষ্যতেও তা হবে না এবং অতীতের মতো গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখির মতো আপন ভস্ম থেকেই তা পুনর্জন্ম নেবে। দরকার শুধু একটি ইতিবাচক মনোভাবের এবং বস্তুনিষ্ঠ আত্মসমালোচনার।
ক্ষমতা পুনর্দখলের জন্য ধড়াবাজি করে acrobat-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে দলটি যদি একটি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে শুধু বিরোধী দলকে হীনতন্ত্রের পথে আসার উপদেশ না দিয়ে নিজেরাই গণতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে হাত বাড়াত, আমার মনে হয়, তাদের উদ্দেশ্য পূরণের সম্ভাবনা বৃদ্ধিই পেত। প্রয়াত জিয়ার অনেক মহৎ গুণ অবশ্যই বেগম জিয়ার মধ্যে নেই। তবে আমার ধারণায় তাঁর স্বল্পভাষিতা এবং অনর্থক রেটোরিক বর্জন তাঁকে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ থেকে বাঁচায়। শুধু তা-ই নয়, এই গুণটি তাঁকে একটি রাজনৈতিক mileage অর্জনে সাহায্য করে। তা ছাড়া আল্লাহ তায়ালা সব সময়ই মজলুমের পক্ষেই থাকেন এবং তাঁর সর্বাপেক্ষা অপছন্দ দম্ভ।
জাতি এখনো খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। সাংঘর্ষিক অবস্থায় বিভাজিত জাতি আজ মুখোমুখি। উভয় পক্ষের মধ্যেই শুভবুদ্ধি উদয় হোক। তবে পরিত্রাণের জন্য দায়ভার অধিক ক্ষমতাসীনদের।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস
কিন্তু আওয়ামী লীগ এতে স্পষ্টতই বিচলিত হয়েছে। কেননা তাদের তো আবার ক্ষমতায় যেতে হবে, রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়ন করতে হবে। এই পোড়াকপাল দেশটাকে 'সোনার বাংলা'য় রূপান্তরিত করতে হবে এবং মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হবে। দলনেত্রী প্রধানমন্ত্রীর বহুল উচ্চারিত বক্তব্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগই শুধু এসব করতে পারবে, অন্যের অর্থাৎ তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তো ক্ষমতা হাতে পেলে দেশকে কিছু দেওয়া তো দূরের কথা, আওয়ামী শাসকদের কষ্টার্জিত সব উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং জনহিতকর কাজকে নস্যাৎ করে লুটপাট, চুরিচামারি বা অর্থ পাচারের মতো মারাত্মক অপরাধে লিপ্ত 'সোনার বাংলাকে' ছিবড়া করে দেবে। প্রধানমন্ত্রীর বহু বক্তৃতা-বক্তব্যের সারমর্মে আমরা অন্তত এমনটাই বুঝি। তাঁর কথায় শুধু 'আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশ কিছু পায়।'
আওয়ামী নেতৃত্বের পরিচিত আচরণ ও উচ্চারণে বোঝাই যায় যে নিছক দেশের এবং জনগণের খাতিরেই দলটিকে আবার ক্ষমতায় আসতে হবে। যেন অন্যথায় তাদের ক্ষমতায় সামান্যই রুচি। কিন্তু কিভাবে আওয়ামী লীগের জন্য সেই ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন সম্ভব হবে? স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল, বিভিন্ন মহলের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য জনমত জরিপ বা খসড়া হিসাব-নিকাশে তো তেমন কোনো আভাস পাওয়া যায় না। এবং জানা যায় যে সঙ্গোপনে সরকারের বিভিন্ন মাধ্যমে জনমত যাচাইয়েও দলের জন্য আশার আলো নেই। শোনা যায়, বর্তমান সংসদের একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্যের মনোনয়ন পুনর্বিবেচনায় আসছে। এর ফলে দলটিকে নিকট-অতীতে করিৎকর্মা বিবেচিত বেশ কিছু সদস্য ছাঁটাইয়ে পড়বে।
জাতীয় নির্বাচনে সম্ভাব্য গতি-প্রকৃতি এবং জোট-মহাজোটে ভাঙাগড়ার ফিরিস্তি দিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ এসেছে। সেগুলো খুঁটে খুঁটে পড়লে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ভবিষ্যতের বড়জোর এক মিশ্র সম্ভাবনাই আঁচ করা যায়। অথচ আমরা সম্ভাবনা যা দেখছি, তাতে রয়েছে আওয়ামী লীগের অন্তত ২০২১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পর্যন্ত আওয়ামী লীগেরই ক্ষমতাধারণ। যে দলটি স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেই দলটি যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে সম্পৃক্ত থাকে, তা তো খারাপ কিছু নয়। কিন্তু কিভাবে আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে সব অপবাদের প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে সে সময় পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবে, তা অবশ্যই একটি বিস্ময়।
এ কথা কবুল করত দ্বিধা নেই যে আমরা আমাদের তারুণ্য ও যৌবনের উজ্জ্বল দিনগুলোকে একদা আওয়ামী লীগ ও তার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের উদ্দেশে সঁপে দিয়েছিলাম। আমাদের ভাগ্য, ভবিষ্যৎ ও স্বপ্ন-অনুভূতি এই মহান নেতার নামে বিবর্তিত হয়। তাঁর প্রতিটি উচ্চারণে আমরা সম্মোহিত থেকেছি। আজও শেখ মুজিবসহ অনেক চেনা-অচেনা আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে যৎসামান্য সম্পৃক্ততার স্মরণে নস্টালজিক না হয়ে পারি না।
স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কী মর্মভেদী তা বুঝলাম আমাদের আরাধ্য সব কিছু হাতে পেয়েও নেতৃত্বের বিপথগামিতার কারণে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সব কিছু যখন হাতছাড়া হয়ে গেল। আজ স্বাধীনতার ৪২ বছর ধরে জাতি সেই গ্লানি অথবা তারই জের বহন করছে। একটি নামসর্বস্ব গণতন্ত্রের পরিচিতি থাকলেও, বাংলাদেশের গণতন্ত্রে নেই তার ঔদার্য, সহিষ্ণুতা, মৌলিক অধিকার, ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা বা রাষ্ট্র পরিচালনার এই পদ্ধতিটির ন্যূনতম চর্চা।
আজ প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ফোরামে উচ্চ কণ্ঠে দাবি করেন যে তাঁর আওয়ামী লীগই নাকি জনগণকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। শুধু 'ভোটাধিকার'ই কি গণতন্ত্র, ১৯৭২ প্রণীত সংবিধানের এক নম্বর মূলনীতির অর্থ কি শুধু মৌলিক অধিকারহীন দেশে যেনতেনভাবে পরিচালিত এক নির্বাচনের জন্য জনগণের ভোটদান নিশ্চিতকরণ? তবু ধরে নিলাম আওয়ামী লীগ ভোটদানের অধিকার নিশ্চিত (এতে নিশ্চিত করার কিছু নেই, গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যোগ্য ভোটাররা তো ভোট দেবেই) করেছে, ভালো কথা। তার জন্য কৃতিত্ব দাবি করার কী আছে। কৃতিত্ব দাবি করার কথা ছিল যিনি বাকশালী থাবা থেকে গণতন্ত্রকে উদ্ধার করে জনগণকে ফেরত দিয়েছিলেন সেই মহান ত্রাতা জিয়াউর রহমানের। আওয়ামীরা এত সহজে ভুলে গেলেন যে বাকশাল প্রক্রিয়ায় বিলুপ্ত আওয়ামী লীগও তার ফলেই অস্তিত্বে ফিরতে পেরেছিল। এ-ও গণতন্ত্রেরই শিক্ষা যে এই মন্ত্রের অনুসারীদের সবাইকে তাদের স্ব স্ব প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে হয়।
আওয়ামী দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক স্ববিরোধিতা এবং বৈপরিত্যের অন্যতম এ-ও যে তা ইচ্ছা করেই ভোটাধিকার, মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সংবিধান সংশোধনকরত সংগঠিত নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের মধ্যে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের যোগ্যতা, অর্জন দেখা ইত্যাদিকে একত্রে গুলিয়ে ফেলে হয় একটি পক্ষপাত নির্বাচন অথবা আদৌ কোনো নির্বাচন না করে বাকশালের কোনো বিকল্প পদ্ধতিতে ক্ষমতা ধরে রাখার পাঁয়তারা করছে। সরকার উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে তাদের অধীনে বিশ্বের আর দশটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের মডেলে আগামী নির্বাচনের ধারণাকে বিরোধী দল কর্তৃক গেলানোর এক অশুভ মনস্তাত্তি্ব্বক খেলায় প্রবৃত্ত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী নেতারা যখন তাঁদের অধীনে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দৃষ্টান্ত দিয়ে নিরপেক্ষতায় তাঁদের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠেপড়ে লাগে, সন্দেহের বীজে সেখানেই শিকড় গজায় এবং জনগণের শঙ্কা ঘনীভূত হয়। এই তথাকথিত যুক্তিটিকে আওয়ামী লীগ দলীয় স্ট্যান্ট হিসেবে গ্রহণ করে সেটিকেই এখন আঁকড়ে ধরেছে। এর অর্থ এই নয় যে বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবেই হেরে যাবে। তখন একটি win win পরিস্থিতিতে তাদেরও জিতবার সমান সম্ভাবনা থাকবে।
এ ছাড়া নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে রাখতে আওয়ামী লীগ বিগত চার বছরে স্তরে স্তরে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেকোনো কৌশল ভেস্তে গেলে অন্যটি তার স্থান নেবে। তবু আওয়ামীদের অপরাধী মননে পরাজয়ের ভয় এমনভাবে ছায়া বিস্তার করেছে যে তারা নির্বাচনও নিজেদের কর্তৃত্বাধীন রাখার মধ্যেই বিজয়লাভ নিরাপদ মনে করছে। যদিও তা এক নেতিবাচক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন। যাদের সঙ্গে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে শুরু করে শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ব্যাংক কেলেঙ্কারি এবং ক্ষমতার দাপটে সরকারি সম্পদের লুণ্ঠন, সংক্রমণের মতো দুর্নীতির কলঙ্ক লেপ্টে আছে, আছে পুলিশি নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি, ভারতের কাছে দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্কের নামে দেশের স্বার্থকে বিলিয়ে দেওয়া এবং বিনিময়ে প্রণব মুখার্জির ত্রিপুরা রাজ্যে গ্যাস সরবরাহের সুযোগ করে দেওয়ার শুকনো ধন্যবাদ দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নীরবে অবলোকন করলেও শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে।
বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র দেশ, যেখানে সবাই সবার হাঁড়ির খবর জানে। যেকোনো দলের শাসকগোষ্ঠী যতই চতুর হোক না কেন, কৃত অপকর্মকে কিছুতেই লুকিয়ে রাখতে পারে না। আজ যদিও আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি দলে পরাজয়ের গন্ধে মনোবিকৃতি ঘটেছে এবং এক প্রকার হীনম্মন্যতা ভর করেছে, আমি বিশ্বাস করি ইমেজ বিনষ্ট হলেও দলটির প্রাণশক্তি নিঃশেষিত হয়নি। ভবিষ্যতেও তা হবে না এবং অতীতের মতো গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখির মতো আপন ভস্ম থেকেই তা পুনর্জন্ম নেবে। দরকার শুধু একটি ইতিবাচক মনোভাবের এবং বস্তুনিষ্ঠ আত্মসমালোচনার।
ক্ষমতা পুনর্দখলের জন্য ধড়াবাজি করে acrobat-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে দলটি যদি একটি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে শুধু বিরোধী দলকে হীনতন্ত্রের পথে আসার উপদেশ না দিয়ে নিজেরাই গণতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে হাত বাড়াত, আমার মনে হয়, তাদের উদ্দেশ্য পূরণের সম্ভাবনা বৃদ্ধিই পেত। প্রয়াত জিয়ার অনেক মহৎ গুণ অবশ্যই বেগম জিয়ার মধ্যে নেই। তবে আমার ধারণায় তাঁর স্বল্পভাষিতা এবং অনর্থক রেটোরিক বর্জন তাঁকে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ থেকে বাঁচায়। শুধু তা-ই নয়, এই গুণটি তাঁকে একটি রাজনৈতিক mileage অর্জনে সাহায্য করে। তা ছাড়া আল্লাহ তায়ালা সব সময়ই মজলুমের পক্ষেই থাকেন এবং তাঁর সর্বাপেক্ষা অপছন্দ দম্ভ।
জাতি এখনো খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। সাংঘর্ষিক অবস্থায় বিভাজিত জাতি আজ মুখোমুখি। উভয় পক্ষের মধ্যেই শুভবুদ্ধি উদয় হোক। তবে পরিত্রাণের জন্য দায়ভার অধিক ক্ষমতাসীনদের।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস
No comments