সাক্ষাৎকার-যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত রফতানি খাতের জন্য সতর্কবার্তা by আহসান এইচ মনসুর
সাক্ষাৎকার গ্রহণ :অজয় দাশগুপ্ত
সমকাল :যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত রেখেছে।
সমকাল :যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত রেখেছে।
কেউ কেউ বলছেন, এটা লঘু পাপে গুরুদণ্ড। কেউ কেউ মনে করছেন, এটা হচ্ছে গুরুতর কিছু ঘটার আগে সতর্কসংকেত। আপনি কীভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?
আহসান মনসুর :হ্যাঁ। কেউ কেউ বলতেই পারেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে লঘু পাপে গুরুতর দণ্ড দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাংলাদেশ তেমন বড় ধরনের ভুল না করার পরেও গুরুতর শাস্তি দিয়েছেন। এর ফলে দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে। কিন্তু শিল্প-কারখানার পরিবেশের উন্নতির যে প্রত্যাশা, সেটা পূরণ হবে না। কিন্তু আমাদের উচিত হবে সার্বিক প্রেক্ষাপট ভেবে দেখা। এ স্থগিতাদেশকে আমরা আগামী দিনের জন্য গুরুদণ্ড যাতে নেমে না আসে, তার জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে দেখতে পারি।
সমকাল :এ স্থগিতাদেশের আওতা তো খুব বেশি নয়...।
আহসান মনসুর :যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। এ সিদ্ধান্তকে তারা এই পণ্যে প্রয়োগ করবে না। এই বিবেচনায় ক্ষতির পরিমাণ সীমিত। মাত্র ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের মতো পণ্য এর আওতায় আসবে। এ বাবদ আমরা তাদের কাছ থেকে সামান্য পরিমাণ আর্থিক সুবিধা লাভ করে থাকি। অর্থাৎ বলতে পারেন যে, তারা লঘুদণ্ডই দিয়েছে বাংলাদেশকে। যদি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অঙ্গনে ভাবমূর্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিই, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ সামান্য বলা ঠিক হবে না। সিদ্ধান্ত এসেছে হোয়াইট হাউস থেকে। কিন্তু যে ইস্যু বিবেচনায় নিয়ে এ পদক্ষেপ, তার পেছনে সমর্থন রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ এবং আরও একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের বাইরে যে জনমত, তার চাপও কাজ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের পয়লা নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি। তাদের আমদানি প্রচুর এবং ধনী ও দরিদ্র সব ধরনের দেশ থেকে তারা পণ্য কিনে থাকে। বলতে পারেন, সবার প্রতিনিধি হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যারা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি, তাদের নৈতিক সমর্থনও এর পেছনে ক্রিয়াশীল_ এভাবেই বিষয়টি দেখা উচিত। অন্যথায় বিভ্রান্তির চোরাবালিতে আমরা ঘুরপাক খেতে থাকব এবং এক সময় আরও বড় ধরনের বাণিজ্য ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে পড়ব।
সমকাল :অন্য দেশগুলোও কি বাংলাদেশের শ্রমমান বিষয়ে একইভাবে উদ্বিগ্ন?
আহসান মনসুর :ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের মতো শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ড বিষয়ে সোচ্চার নয়। কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যু তেমন জোরালোভাবে তুলছে না। কিন্তু তারা মানবাধিকার বিষয়ে সোচ্চার হবে না_ সেটা ভাবা ঠিক নয়। তারা জিএসপি সুবিধা স্থগিত করছে না ঠিকই, কিন্তু উদ্বেগ তাদেরও রয়েছে। তাজরীনে অগি্নকাণ্ড কিংবা রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় তাদেরও প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যেসব ইস্যু তুলছে, সেটা তাদেরও ইস্যু। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাখলে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে কেউ কেউ লঘু পাপে গুরুদণ্ড মনে করতে পারেন। কিন্তু আমরা ঠিক পথে না চললে ভবিষ্যতে গুরুদণ্ড আসতে পারে।
সমকাল :যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেউ প্রভাবিত করেছেন বলে মনে করেন কি?
আহসান মনসুর :আমার ধারণা_ এ রকম কিছু নেই। বাংলাদেশের প্রতিযোগী একাধিক দেশ রয়েছে। এটা ঠিক যে, কখনও কখনও এমন অভিযোগ শোনা যায়। শিল্প মালিকরাও বলেন। সরকারও বলে। তবে এর যদি প্রমাণ থাকে, তা উপস্থাপন করা উচিত। দেশের ভেতরে কেউ সেটা করলে তাকে দণ্ডও দেওয়া যেতে পারে।
সমকাল :যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে কেন জিএসপি সুবিধার আওতায় আনছে না?
আহসান মনসুর : ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও উন্নত। কিন্তু তারা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিনা শুল্কে প্রবেশ করতে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র দিচ্ছে না। এর একটি কারণ সম্ভবত, যুক্তরাষ্ট্রের এখনও সীমিত পরিমাণে বস্ত্রশিল্প লবি সক্রিয় রয়েছে, যারা মনে করে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে এ সুবিধা দিলে তাদের ক্ষতি হতে পারে। ইউরোপে এ ধরনের অভ্যন্তরীণ চাপ নেই। এটাও মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একক বৃহত্তম ক্রেতা দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে জিএসপি সুবিধা না পেয়েও আমরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছি এবং পোশাক রফতানিতে বিশ্বে দুই নম্বর অবস্থানে পেঁৗছেছি। আমাদের রফতানি নিয়মিত বাড়ছে এবং এতে ধারাবাহিকতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চীন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশের সঙ্গে তুলনা করছে। তাদেরও তারা পোশাক খাতে জিএসপি সুবিধা প্রদান করে না। তারা পোশাক রফতানিতে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোকে এ সুবিধা দিচ্ছে। যেমন, আফ্রিকার অনেক দেশ এ সুবিধা ভোগ করে। বাংলাদেশ এ সুবিধা পেলে ওই সব দেশকে প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলে দেবে বলে হয়তো তাদের ধারণা।
সমকাল :জিএসপি সুবিধা স্থগিতের অন্যতম কারণ পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধা প্রদান না করা। অথচ সাধারণ ধারণা যে, উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো শ্রমিক আন্দোলনকে ভয় পায়। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আহসান মনসুর :শ্রমিক আন্দোলনকে পুঁজিবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলা যাবে না। মে দিবসের আন্দোলনের সূচনা যুক্তরাষ্ট্রেই। সেখানকার শ্রমিকরা অধিকার আদায় করে নিয়েছে এবং অন্য দেশেও এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। তারা শক্তিশালী এবং সরকারের ওপরে তাদের চাপ রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও যে সনদ অনুসরণ করছে, তার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠন যেন কাজ করতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো তা চায়।
সমকাল :বাংলাদেশে তৈরি পোশাক সস্তায় পাওয়া যায়। এ জন্যই উন্নত দেশগুলোর ক্রেতারা আসছে এখানে। শ্রমিকদের সুবিধা বাড়ানো হলে পোশাকের দাম বেশি পড়বে এবং আমরা বাজার হারাব_ এমন শঙ্কার কথা অনেকে বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে যদি বেশি দামে এখান থেকে পোশাক কিনতে হয়, তাহলে সেখানকার ভোক্তাদেরও ব্যয় বেশি করতে হবে। আপনি কীভাবে বিষয়টি দেখছেন?
আহসান মনসুর :আমরা শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিলেও এখানকার শ্রম তুলনামূলক সস্তাই থাকবে। আমরা যতদিন পর্যন্ত না উন্নত দেশ হচ্ছি, ততদিন এখানে স্বল্প মজুরিতে কর্মী মিলবে। আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ। স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বে আমাদের মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়নের মানদণ্ড হচ্ছে অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা শ্রমমান বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। নাগরিক অধিকার আন্দোলন রয়েছে। তারা লক্ষ্য করে, যারা তাদের জন্য পণ্য উৎপাদন করে তাদের জীবনমান উন্নত করায় সরকার ও মালিকপক্ষ কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তাজরীন অগি্নকাণ্ড কিংবা রানা প্লাজায় ধসের মতো ঘটনা তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নৈতিক অবস্থান থেকে। আমাদের এটা উপেক্ষা করলে চলবে না।
সমকাল : আমরা বিশ্ববাণিজ্যে নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার বা অশুল্ক বাধা বলি। এটাকে কি সেইভাবে দেখা যায় না?
আহসান মনসুর :হ্যাঁ। কেউ কেউ এভাবে দেখতে পারেন। তবে আমার বিবেচনায় তা ঠিক নয়। চীন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর পোশাক রফতানি করে। তারা বিশ্বের মোট পোশাক চাহিদার ৪০ শতাংশ মেটায়। যুক্তরাষ্ট্রের তারা প্রধান প্রতিযোগী দেশ। অর্থনীতি, সমর শক্তিসহ আরও অনেক বিষয়ে তাদের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। রাজনৈতিক দর্শনেও পার্থক্য। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাকসহ আরও অনেক পণ্য যায়। চীনের শ্রমমান এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। বেতন-ভাতা কম_ তেমন কথা শোনা যায় না। কারখানার পরিবেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ নেই। আমরা যদি শ্রমিকদের কাজ করার পরিবেশ উন্নত করি, তাহলে বাজার হারানোর শঙ্কা কেন করা হবে?
সমকাল :কিন্তু এটা তো ঠিক যে, চীনের রয়েছে নিজস্ব কাঁচামাল। অর্থাৎ বস্ত্রশিল্প। এর বিপরীতে আমাদের কাপড়, মেশিনসহ অনেক কিছু আমদানি করতে হয়...।
আহসান মনসুর :চীন ও ভারতের নিজস্ব কাঁচামাল রয়েছে। পাকিস্তানেও আছে। মিসর, সুদানেও আছে। কিন্তু তারা তো বিশ্বের দুই নম্বর পোশাক রফতানিকারক দেশ হতে পারেনি। কঙ্গো বিশ্বের খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। কিন্তু তারা দরিদ্র রয়ে গেছে। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শ্রমিকদের কাজের উৎকর্ষ বাড়ানো। উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। কম দক্ষতা ও কম বেতন_ এমন পরিবেশ অব্যাহত থাকলে আমরা উন্নত দেশ হতে পারব না। আমাদের পোশাকশিল্পের বাজার ধরে রাখতে হলে শ্রমমান ও পরিবেশের প্রতি মনোযোগ দিতেই হবে। শ্রমিকরাও বেশি দিন এত কম বেতনে কাজ করতে চাইবে না।
সমকাল :যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে একটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের জন্য আর কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে?
আহসান মনসুর :যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক প্রভাব আপাতত সীমিত। তবে নিকট ভবিষ্যতে তা প্রত্যাহার করা না হলে আমাদের জন্য ভাবমূর্তির সমস্যা সৃষ্টি হবে। আমাদের কপালে যদি 'শ্রমমান ভালো নয়'_ এমন কলঙ্কতিলক লেপ্টে থাকে তাহলে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তারা একইভাবে প্রথমে স্থগিতাদেশ দেবে, পরে সুবিধা প্রত্যাহার করে নেবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকে এ সুবিধা আমরা পাই না। কিন্তু ইউরোপে পাই, কানাডায় পাই। সরকারের উচিত হবে, ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে যেন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করে তা নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা। বাংলাদেশ রফতানি খাতে ভালো করছে। এটা গর্বের বিষয়। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, গাছ বড় হলে সবার নজরে পড়ে। এর ভালো দিক রয়েছে। তৈরি পোশাক রফতানিতে আমরা দ্বিতীয় স্থানে পেঁৗছে যাওয়ায় অনেক দেশ বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগী হয়েছে। আমরা উন্নত হচ্ছি_ এ খবর অনেক দেশের মানুষ জানছে। একই সঙ্গে এখানে কীভাবে কাজ হচ্ছে, সে বিষয়েও তাদের কাছে খবর যাচ্ছে। আমরা নিজেদের সোনার বাংলা বলছি। এটা যেন অন্যের জন্য মুচকি হাসির কারণ না হয়, সেটা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের অন্যরা কীভাবে দেখছে এবং কোথায় কোথায় পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে, সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। এ থেকে যে করণীয় বের হয়ে আসে, সেটাও সম্পাদন করতে হবে। এখন আমাদের বিরুদ্ধে কাজের পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এক সময় হয়তো দেখবেন, কেউ বলবে যে বাংলাদেশ ডাম্পিং করছে। বিশ্ববাজারের নিয়ম-কানুন লঙ্ঘনের অভিযোগে হয়তো অভিযুক্ত হতে হবে। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকা চাই।
সমকাল :বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ বলেই জিএসপি সুবিধা ভোগ করছে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছি। এ অবস্থাতেও কি এ সুবিধা বহাল থাকবে?
আহসান মনসুর :বাংলাদেশ দ্রুত নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে। এ লক্ষ্যে পেঁৗছালে উন্নত দেশগুলো জিএসপিসহ যেসব বাণিজ্য কনসেশন দেয়, তার অনেকটাই আমরা হারাতে পারি। যেমন, স্বল্প সুদে বিশ্বব্যাংকের ঋণ মিলবে না। এ ধরনের সুবিধা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য নির্দিষ্ট। আগামীতে এটা হবে বড় চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবেলায় বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে। চীন সফলভাবে তা মোকাবেলা করেছে। আমাদের এখন শিল্পের পরিবেশ উন্নত করায় মনোযোগী হতে হবে। কেবল পোশাকশিল্প নয়, অন্যান্য শিল্পের কথাও ভাবতে হবে। শ্রমের উৎকর্ষ বাড়াতেই হবে। অবকাঠামো খাতের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কারখানা শ্রমিকদের মজুরি ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ার তুলনায় ৪০ শতাংশ কম। তারপরও তাদের উন্নতি হচ্ছে। বিশ্ববাজারে তারা প্রতিযোগিতা করে চলেছে। আমাদের এখানে বেতন কম। একই সঙ্গে কাজের উৎকর্ষও কম। আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে। কস্ট অব প্রোডাকশন কমাতে হবে। এ জন্য শ্রমিকের মজুরি কমানোর দরকার নেই। বরং তা বাড়াতে হবে। আমাদের নজর দিতে হবে কারখানায় কাঁচামাল পেঁৗছানো এবং উৎপাদিত পণ্য বন্দরে পেঁৗছাতে সময় কমিয়ে আনার জন্য। চট্টগ্রাম বন্দরে যদি ঢাকা থেকে ১০ ঘণ্টার পরিবর্তে ৪-৫ ঘণ্টায় পণ্য পেঁৗছাতে পারি এবং সেখানে জাহাজে তোলার জন্য বেশি সময় অপেক্ষা করতে না হয়, তাহলে ব্যয় অনেক সাশ্রয় হবে। বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য যেন কারখানায় শ্রমিকরা বসে না থাকে, সেটা নিশ্চিত করা চাই। শিল্পে অস্থিরতাও কমিয়ে আনতে হবে। ক্রেতারা যদি দেখে, বাংলাদেশে অর্ডার দিলে সময়মতো পণ্য আসে না, তাহলে তারা মুখ ফিরিয়ে নেবে। বিশ্ববাজারের অভিজ্ঞতা এটাই বলে যে, আমাদের পোশাক এবং অন্যান্য শিল্পে শ্রমিকদের বেশি বেতন ও অন্যান্য সুবিধা দিয়েও আমরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব। কনসেশন ভোগ করে আমরা বেশি দিন সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে পারব না। করুণা চাই না, মর্যাদার অবস্থানে আমরা যেতে চাই। আমাদের অদক্ষতা কাটাতে হবে। এ জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
সমকাল :শ্রমমান উন্নত করা হলে যেসব সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে, তাতে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প টিকবে না_ এমন অভিমত রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?
আহসান মনসুর :উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারলে এ সমস্যা হবে না। চীন পারলে আমরা কেন পারব না? তারা তো শ্রমিকদের বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বেতন দিচ্ছে। ভারত এবং পাকিস্তানও ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পায় না। আমাদের শিল্প খাতে ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটাতে হবে। শ্রমিকদের জীবনমান বাড়াতে হবে। এতে তাদের বেতন বাড়বে এবং তারা বাজারে অন্যান্য পণ্য কেনায় বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারবে। দেশের উন্নতির এটাই শর্ত এবং তা পূরণ করতেই হবে।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
আহসান মনসুর :সমকাল পাঠকদের ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।
আহসান মনসুর :হ্যাঁ। কেউ কেউ বলতেই পারেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে লঘু পাপে গুরুতর দণ্ড দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাংলাদেশ তেমন বড় ধরনের ভুল না করার পরেও গুরুতর শাস্তি দিয়েছেন। এর ফলে দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে। কিন্তু শিল্প-কারখানার পরিবেশের উন্নতির যে প্রত্যাশা, সেটা পূরণ হবে না। কিন্তু আমাদের উচিত হবে সার্বিক প্রেক্ষাপট ভেবে দেখা। এ স্থগিতাদেশকে আমরা আগামী দিনের জন্য গুরুদণ্ড যাতে নেমে না আসে, তার জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে দেখতে পারি।
সমকাল :এ স্থগিতাদেশের আওতা তো খুব বেশি নয়...।
আহসান মনসুর :যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। এ সিদ্ধান্তকে তারা এই পণ্যে প্রয়োগ করবে না। এই বিবেচনায় ক্ষতির পরিমাণ সীমিত। মাত্র ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের মতো পণ্য এর আওতায় আসবে। এ বাবদ আমরা তাদের কাছ থেকে সামান্য পরিমাণ আর্থিক সুবিধা লাভ করে থাকি। অর্থাৎ বলতে পারেন যে, তারা লঘুদণ্ডই দিয়েছে বাংলাদেশকে। যদি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অঙ্গনে ভাবমূর্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিই, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ সামান্য বলা ঠিক হবে না। সিদ্ধান্ত এসেছে হোয়াইট হাউস থেকে। কিন্তু যে ইস্যু বিবেচনায় নিয়ে এ পদক্ষেপ, তার পেছনে সমর্থন রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ এবং আরও একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের বাইরে যে জনমত, তার চাপও কাজ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের পয়লা নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি। তাদের আমদানি প্রচুর এবং ধনী ও দরিদ্র সব ধরনের দেশ থেকে তারা পণ্য কিনে থাকে। বলতে পারেন, সবার প্রতিনিধি হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যারা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি, তাদের নৈতিক সমর্থনও এর পেছনে ক্রিয়াশীল_ এভাবেই বিষয়টি দেখা উচিত। অন্যথায় বিভ্রান্তির চোরাবালিতে আমরা ঘুরপাক খেতে থাকব এবং এক সময় আরও বড় ধরনের বাণিজ্য ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে পড়ব।
সমকাল :অন্য দেশগুলোও কি বাংলাদেশের শ্রমমান বিষয়ে একইভাবে উদ্বিগ্ন?
আহসান মনসুর :ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের মতো শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ড বিষয়ে সোচ্চার নয়। কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যু তেমন জোরালোভাবে তুলছে না। কিন্তু তারা মানবাধিকার বিষয়ে সোচ্চার হবে না_ সেটা ভাবা ঠিক নয়। তারা জিএসপি সুবিধা স্থগিত করছে না ঠিকই, কিন্তু উদ্বেগ তাদেরও রয়েছে। তাজরীনে অগি্নকাণ্ড কিংবা রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় তাদেরও প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যেসব ইস্যু তুলছে, সেটা তাদেরও ইস্যু। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাখলে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে কেউ কেউ লঘু পাপে গুরুদণ্ড মনে করতে পারেন। কিন্তু আমরা ঠিক পথে না চললে ভবিষ্যতে গুরুদণ্ড আসতে পারে।
সমকাল :যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেউ প্রভাবিত করেছেন বলে মনে করেন কি?
আহসান মনসুর :আমার ধারণা_ এ রকম কিছু নেই। বাংলাদেশের প্রতিযোগী একাধিক দেশ রয়েছে। এটা ঠিক যে, কখনও কখনও এমন অভিযোগ শোনা যায়। শিল্প মালিকরাও বলেন। সরকারও বলে। তবে এর যদি প্রমাণ থাকে, তা উপস্থাপন করা উচিত। দেশের ভেতরে কেউ সেটা করলে তাকে দণ্ডও দেওয়া যেতে পারে।
সমকাল :যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে কেন জিএসপি সুবিধার আওতায় আনছে না?
আহসান মনসুর : ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও উন্নত। কিন্তু তারা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিনা শুল্কে প্রবেশ করতে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র দিচ্ছে না। এর একটি কারণ সম্ভবত, যুক্তরাষ্ট্রের এখনও সীমিত পরিমাণে বস্ত্রশিল্প লবি সক্রিয় রয়েছে, যারা মনে করে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে এ সুবিধা দিলে তাদের ক্ষতি হতে পারে। ইউরোপে এ ধরনের অভ্যন্তরীণ চাপ নেই। এটাও মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একক বৃহত্তম ক্রেতা দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে জিএসপি সুবিধা না পেয়েও আমরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছি এবং পোশাক রফতানিতে বিশ্বে দুই নম্বর অবস্থানে পেঁৗছেছি। আমাদের রফতানি নিয়মিত বাড়ছে এবং এতে ধারাবাহিকতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চীন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশের সঙ্গে তুলনা করছে। তাদেরও তারা পোশাক খাতে জিএসপি সুবিধা প্রদান করে না। তারা পোশাক রফতানিতে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোকে এ সুবিধা দিচ্ছে। যেমন, আফ্রিকার অনেক দেশ এ সুবিধা ভোগ করে। বাংলাদেশ এ সুবিধা পেলে ওই সব দেশকে প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলে দেবে বলে হয়তো তাদের ধারণা।
সমকাল :জিএসপি সুবিধা স্থগিতের অন্যতম কারণ পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধা প্রদান না করা। অথচ সাধারণ ধারণা যে, উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো শ্রমিক আন্দোলনকে ভয় পায়। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আহসান মনসুর :শ্রমিক আন্দোলনকে পুঁজিবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলা যাবে না। মে দিবসের আন্দোলনের সূচনা যুক্তরাষ্ট্রেই। সেখানকার শ্রমিকরা অধিকার আদায় করে নিয়েছে এবং অন্য দেশেও এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। তারা শক্তিশালী এবং সরকারের ওপরে তাদের চাপ রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও যে সনদ অনুসরণ করছে, তার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠন যেন কাজ করতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো তা চায়।
সমকাল :বাংলাদেশে তৈরি পোশাক সস্তায় পাওয়া যায়। এ জন্যই উন্নত দেশগুলোর ক্রেতারা আসছে এখানে। শ্রমিকদের সুবিধা বাড়ানো হলে পোশাকের দাম বেশি পড়বে এবং আমরা বাজার হারাব_ এমন শঙ্কার কথা অনেকে বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে যদি বেশি দামে এখান থেকে পোশাক কিনতে হয়, তাহলে সেখানকার ভোক্তাদেরও ব্যয় বেশি করতে হবে। আপনি কীভাবে বিষয়টি দেখছেন?
আহসান মনসুর :আমরা শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিলেও এখানকার শ্রম তুলনামূলক সস্তাই থাকবে। আমরা যতদিন পর্যন্ত না উন্নত দেশ হচ্ছি, ততদিন এখানে স্বল্প মজুরিতে কর্মী মিলবে। আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ। স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বে আমাদের মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়নের মানদণ্ড হচ্ছে অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা শ্রমমান বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। নাগরিক অধিকার আন্দোলন রয়েছে। তারা লক্ষ্য করে, যারা তাদের জন্য পণ্য উৎপাদন করে তাদের জীবনমান উন্নত করায় সরকার ও মালিকপক্ষ কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তাজরীন অগি্নকাণ্ড কিংবা রানা প্লাজায় ধসের মতো ঘটনা তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নৈতিক অবস্থান থেকে। আমাদের এটা উপেক্ষা করলে চলবে না।
সমকাল : আমরা বিশ্ববাণিজ্যে নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার বা অশুল্ক বাধা বলি। এটাকে কি সেইভাবে দেখা যায় না?
আহসান মনসুর :হ্যাঁ। কেউ কেউ এভাবে দেখতে পারেন। তবে আমার বিবেচনায় তা ঠিক নয়। চীন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর পোশাক রফতানি করে। তারা বিশ্বের মোট পোশাক চাহিদার ৪০ শতাংশ মেটায়। যুক্তরাষ্ট্রের তারা প্রধান প্রতিযোগী দেশ। অর্থনীতি, সমর শক্তিসহ আরও অনেক বিষয়ে তাদের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। রাজনৈতিক দর্শনেও পার্থক্য। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাকসহ আরও অনেক পণ্য যায়। চীনের শ্রমমান এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। বেতন-ভাতা কম_ তেমন কথা শোনা যায় না। কারখানার পরিবেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ নেই। আমরা যদি শ্রমিকদের কাজ করার পরিবেশ উন্নত করি, তাহলে বাজার হারানোর শঙ্কা কেন করা হবে?
সমকাল :কিন্তু এটা তো ঠিক যে, চীনের রয়েছে নিজস্ব কাঁচামাল। অর্থাৎ বস্ত্রশিল্প। এর বিপরীতে আমাদের কাপড়, মেশিনসহ অনেক কিছু আমদানি করতে হয়...।
আহসান মনসুর :চীন ও ভারতের নিজস্ব কাঁচামাল রয়েছে। পাকিস্তানেও আছে। মিসর, সুদানেও আছে। কিন্তু তারা তো বিশ্বের দুই নম্বর পোশাক রফতানিকারক দেশ হতে পারেনি। কঙ্গো বিশ্বের খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। কিন্তু তারা দরিদ্র রয়ে গেছে। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শ্রমিকদের কাজের উৎকর্ষ বাড়ানো। উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। কম দক্ষতা ও কম বেতন_ এমন পরিবেশ অব্যাহত থাকলে আমরা উন্নত দেশ হতে পারব না। আমাদের পোশাকশিল্পের বাজার ধরে রাখতে হলে শ্রমমান ও পরিবেশের প্রতি মনোযোগ দিতেই হবে। শ্রমিকরাও বেশি দিন এত কম বেতনে কাজ করতে চাইবে না।
সমকাল :যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে একটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের জন্য আর কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে?
আহসান মনসুর :যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক প্রভাব আপাতত সীমিত। তবে নিকট ভবিষ্যতে তা প্রত্যাহার করা না হলে আমাদের জন্য ভাবমূর্তির সমস্যা সৃষ্টি হবে। আমাদের কপালে যদি 'শ্রমমান ভালো নয়'_ এমন কলঙ্কতিলক লেপ্টে থাকে তাহলে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তারা একইভাবে প্রথমে স্থগিতাদেশ দেবে, পরে সুবিধা প্রত্যাহার করে নেবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকে এ সুবিধা আমরা পাই না। কিন্তু ইউরোপে পাই, কানাডায় পাই। সরকারের উচিত হবে, ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে যেন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করে তা নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা। বাংলাদেশ রফতানি খাতে ভালো করছে। এটা গর্বের বিষয়। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, গাছ বড় হলে সবার নজরে পড়ে। এর ভালো দিক রয়েছে। তৈরি পোশাক রফতানিতে আমরা দ্বিতীয় স্থানে পেঁৗছে যাওয়ায় অনেক দেশ বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগী হয়েছে। আমরা উন্নত হচ্ছি_ এ খবর অনেক দেশের মানুষ জানছে। একই সঙ্গে এখানে কীভাবে কাজ হচ্ছে, সে বিষয়েও তাদের কাছে খবর যাচ্ছে। আমরা নিজেদের সোনার বাংলা বলছি। এটা যেন অন্যের জন্য মুচকি হাসির কারণ না হয়, সেটা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের অন্যরা কীভাবে দেখছে এবং কোথায় কোথায় পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে, সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। এ থেকে যে করণীয় বের হয়ে আসে, সেটাও সম্পাদন করতে হবে। এখন আমাদের বিরুদ্ধে কাজের পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এক সময় হয়তো দেখবেন, কেউ বলবে যে বাংলাদেশ ডাম্পিং করছে। বিশ্ববাজারের নিয়ম-কানুন লঙ্ঘনের অভিযোগে হয়তো অভিযুক্ত হতে হবে। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকা চাই।
সমকাল :বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ বলেই জিএসপি সুবিধা ভোগ করছে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছি। এ অবস্থাতেও কি এ সুবিধা বহাল থাকবে?
আহসান মনসুর :বাংলাদেশ দ্রুত নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে। এ লক্ষ্যে পেঁৗছালে উন্নত দেশগুলো জিএসপিসহ যেসব বাণিজ্য কনসেশন দেয়, তার অনেকটাই আমরা হারাতে পারি। যেমন, স্বল্প সুদে বিশ্বব্যাংকের ঋণ মিলবে না। এ ধরনের সুবিধা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য নির্দিষ্ট। আগামীতে এটা হবে বড় চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবেলায় বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে। চীন সফলভাবে তা মোকাবেলা করেছে। আমাদের এখন শিল্পের পরিবেশ উন্নত করায় মনোযোগী হতে হবে। কেবল পোশাকশিল্প নয়, অন্যান্য শিল্পের কথাও ভাবতে হবে। শ্রমের উৎকর্ষ বাড়াতেই হবে। অবকাঠামো খাতের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কারখানা শ্রমিকদের মজুরি ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ার তুলনায় ৪০ শতাংশ কম। তারপরও তাদের উন্নতি হচ্ছে। বিশ্ববাজারে তারা প্রতিযোগিতা করে চলেছে। আমাদের এখানে বেতন কম। একই সঙ্গে কাজের উৎকর্ষও কম। আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে। কস্ট অব প্রোডাকশন কমাতে হবে। এ জন্য শ্রমিকের মজুরি কমানোর দরকার নেই। বরং তা বাড়াতে হবে। আমাদের নজর দিতে হবে কারখানায় কাঁচামাল পেঁৗছানো এবং উৎপাদিত পণ্য বন্দরে পেঁৗছাতে সময় কমিয়ে আনার জন্য। চট্টগ্রাম বন্দরে যদি ঢাকা থেকে ১০ ঘণ্টার পরিবর্তে ৪-৫ ঘণ্টায় পণ্য পেঁৗছাতে পারি এবং সেখানে জাহাজে তোলার জন্য বেশি সময় অপেক্ষা করতে না হয়, তাহলে ব্যয় অনেক সাশ্রয় হবে। বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য যেন কারখানায় শ্রমিকরা বসে না থাকে, সেটা নিশ্চিত করা চাই। শিল্পে অস্থিরতাও কমিয়ে আনতে হবে। ক্রেতারা যদি দেখে, বাংলাদেশে অর্ডার দিলে সময়মতো পণ্য আসে না, তাহলে তারা মুখ ফিরিয়ে নেবে। বিশ্ববাজারের অভিজ্ঞতা এটাই বলে যে, আমাদের পোশাক এবং অন্যান্য শিল্পে শ্রমিকদের বেশি বেতন ও অন্যান্য সুবিধা দিয়েও আমরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব। কনসেশন ভোগ করে আমরা বেশি দিন সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে পারব না। করুণা চাই না, মর্যাদার অবস্থানে আমরা যেতে চাই। আমাদের অদক্ষতা কাটাতে হবে। এ জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
সমকাল :শ্রমমান উন্নত করা হলে যেসব সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে, তাতে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প টিকবে না_ এমন অভিমত রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?
আহসান মনসুর :উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারলে এ সমস্যা হবে না। চীন পারলে আমরা কেন পারব না? তারা তো শ্রমিকদের বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বেতন দিচ্ছে। ভারত এবং পাকিস্তানও ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পায় না। আমাদের শিল্প খাতে ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটাতে হবে। শ্রমিকদের জীবনমান বাড়াতে হবে। এতে তাদের বেতন বাড়বে এবং তারা বাজারে অন্যান্য পণ্য কেনায় বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারবে। দেশের উন্নতির এটাই শর্ত এবং তা পূরণ করতেই হবে।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
আহসান মনসুর :সমকাল পাঠকদের ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।
No comments