পরিবেশ-অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশ বিপর্যয় by অলক পাল
বিকাশমান সভ্যতার সঙ্গে পালা দিয়ে মানুষের
মৌলিক চাহিদার পাশাপাশি নিত্যনতুন 'প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের অভাব' বেড়েই চলছে।
নগরায়ন আর সভ্যতার দাবি মেটাতে গিয়ে উন্নয়নের লাগামহীন ছাঁচে প্রায়ই জীবন ও
পরিবেশ পিষ্ট হয়।
বিপুল পরিমাণে শিল্পায়ন, নগরায়ন,
অপরিকল্পিত ও বিক্ষিপ্ত কাঠামোগত পরিবর্তন এবং পরিমাপযোগ্য সূচকে উন্নয়নের
প্রবাহকে মাপতে গিয়ে পরিবেশকে প্রায় চড়া দাম দিতে হয়, যার আর্থিক মূল্য
সবসময় নিরূপণ করা সম্ভব নয়। পরিবেশকে সংকটাপন্ন করে প্রাপ্ত অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি আপাতদৃষ্টিতে লাভজনক মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা উন্নয়নের মৌলিক
লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিপরীতে পরিবেশ সংকট
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের বা বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোয় আরও গভীর।
দুর্যোগকবলিত, দরিদ্র, অশিক্ষিত জনবহুল এ দেশ গত কয়েক দশকে অপরিকল্পিত,
সমন্বয়হীন উন্নয়নের প্রভাবে বেশকিছুর ক্ষেত্রে সংকটের সম্মুখীন।
এ দেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও জলবায়ু যেমন_ ভূমিরূপ, পানি, বাতাস, বৃষ্টিপাত, নদী, দেশের জনসংখ্যা কাঠামো, মানুষের আচরণ, জীবনযাপন পদ্ধতি, সংস্কৃতি ও জীবিকাকে বহুলাংশে নির্ধারণ করে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১৪২.৩ মিলিয়ন মানুষের বাস। মাথাপিছু আয় প্রায় ৬৯০ মার্কিন ডলার। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে পরিবেশকে প্রায় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়। উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণ-পশ্চিমের জীব-ভূগোলের সমন্বয়ে জটিল মিথস্ক্রিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান। জলবায়ু ও ভূমি উর্বরতায় আশীর্বাদপুষ্ট এ অঞ্চল বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর। বর্তমানে এখানে প্রায় ৫ হাজার প্রজাতির পুষ্পজীবী উদ্ভিদ ও ১ হাজার ৫০০ প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে, যা গত শতকের তুলনায় নগণ্য বটে। বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপ ও প্রাণের বিন্যাসকে প্রায় অস্তিত্বের সংকটে ফেলেছে ভূমির অতিরিক্ত ও অপরিকল্পিত ব্যবহার, বনভূমি উজাড়, অপর্যাপ্ত বন ব্যবস্থাপনা, কৃষি ও শিল্পদূষণ, স্থানান্তরিত চাষ ব্যবস্থা, উপকূলীয় চিংড়ি চাষ, লবণাক্ততা, বৃহৎ আকারের স্থাপনা, বন্যা ও সেচ প্রকল্প ইত্যাদি। শিল্পায়নে প্রচুর পরিমাণে বনজ কাঁচামালের ব্যবহার বনজ সম্পদ হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে এসব অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র্যকে বিপদাপন্ন করেছে। দেশের প্রায় ৯৪ শতাংশ প্রাকৃতিক আবাসস্থল ও বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে কৃষিজমি ও মানুষের অবকাঠামো নির্মাণে। শুধু চকোরিয়া ম্যানগ্রোভ এলাকা ১৯৬৭ থেকে ৮৮_ এ ২১ বছরে সাড়ে ৭ হাজার থেকে কমে ৯৭৩ হেক্টরে এসে দাঁড়ায়। দেশের যত্রতত্র যথাযথ 'পারিবেশিক অভিঘাত মূল্যায়ন' ব্যতীত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সেচ প্রকল্প নির্মাণের ফলে জলাভূমি, জলাধার, মৎস্য খাত ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। জনসংখ্যার বর্ধিত চাহিদা মেটাতে অনেক জলাভূমি, জলাধার ও বনাঞ্চলকে কৃষিজমিতে রূপান্তর করায় উৎপাদনশীলতা হ্রাস ও বাস্তুসংস্থানের জটিল প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
এ দেশের আদি ও প্রচলিত চাষ পদ্ধতি, নদী ও কৃষিনির্ভর জীবিকা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব। উন্নয়নের যান্ত্রিক-অনিয়মতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের বাইরে জীববৈচিত্র্য স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে উন্নত করে। পাশাপাশি দেশের কৃষি ও বনাঞ্চলকে রাখে সুন্দর-সুরক্ষিত, পর্যটন খাতে আয় বৃদ্ধি করে, বাস্তুসংস্থানের খাদ্যজাল ও জীবনচক্র সমুন্নত রাখে এবং সর্বোপরি পরিবেশকে বাঁচিয়ে তোলে। গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে কয়েকটি অঞ্চল বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সেচ প্রকল্প, বন্যা ও জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণে এবং ধান উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিপুল পরিমাণে বাঁধ ও পোল্ডার নির্মাণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে উৎপাদন বহু গুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় কাঠামোগত উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলে অন্যান্য চাষ যেমন_ লবণ উৎপাদন, চিংড়ি চাষ প্রচলিত থাকায় ধীরে ধীরে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। এসব অঞ্চলে নির্মিত বাঁধ ও পোল্ডার লবণ পানি আটকে রাখায় ফসলি জমি ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে লবণ ও চিংড়ি চাষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ৭০ শতাংশ জমি এরই মধ্যে লবণাক্ততায় আক্রান্ত, যা মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে উৎপাদনের মাত্রাকে হ্রাস করছে। এ ছাড়া ৫০ শতাংশ জমি বাঁধ ও পোল্ডারের কারণে জলাবদ্ধ ও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। ফলে ভূমিদূষণ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, ভারি সঞ্চয়ন, গোচারণভূমি হ্রাস, সুপেয় পানির অভাব, দূষণ ও বাস্তুসংস্থানে ব্যাঘাত ঘটছে। শুধু কৃষি ক্ষেত্রেই নয়, মানুষ বসবাসের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। কৃষিজমি কমে যাওয়ার দরুন বর্গাচাষি, দিনমজুর তাদের জীবিকা হারিয়ে চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন, যা প্রায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নেয়। গত দুই দশকে এ অঞ্চলগুলোয় দাঙ্গায় দেড় শতাধিক মানুষ আহত ও নিহত হয়। ভূমি ব্যবহারে সৃষ্ট সংকট, ক্ষতিগ্রস্ত জীবন ও জীবিকা, সামাজিক অস্থিরতা, কোন্দল, পারিবেশিক ক্ষতি নগর অভিমুখে স্থানাস্তরের হার বৃদ্ধি করেছে। আর্থসামাজিক, পারিবেশিক_ এসব ক্ষতি আর্থিক মূল্যে নিরূপণ করা গেলে প্রবৃদ্ধির তুলনায় ক্ষতির পরিমাণ হবে ব্যাপক।
নগরায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষায় কিছু শিল্প তৈরি হয়েছে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ইতিবাচক নয়। উদাহরণ হিসেবে বলতে হয়_ চট্টগ্রামে জাহাজভাঙা শিল্প, ঢাকায় হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্প, ইটভাটা এমনই কিছু ক্ষেত্র। এদের প্রতিটি পরিবেশ দূষণ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। জাহাজভাঙা শিল্পে নিয়মিত তেল ও অন্যান্য বিষাক্ত বর্জ্য আশপাশের এলাকা, বনভূমি, সমুদ্র অঞ্চলের প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করে তুলছে। এ শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা ত্বক, ফুসফুসের সমস্যা, ক্যান্সার, হঠাৎ দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি এমনকি মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করে। বর্জ্য অপসারণের সময় বা তেল ট্যাংকার কাটার সময় একটু অসাবধানতায় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, যেমনটি হয়েছিল ২০০৩ সালে। ওই সময় ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানিকৃত একটি জাহাজের তেল ট্যাংক কাটার সময় বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। বাতাসে এসিডিটি বৃদ্ধির ফলে গাছপালা পুড়ে যায়। পানি দূষিত হয়ে খামারের মাছ, হাঁস-মুরগি মারা যায়। মানুষের ত্বকে ফোসকা পড়ে, চোখ ও শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভোগে বছর ধরে। এসব শিল্প অনুমোদন ও নির্মাণের আগে পরিবেশের উপাদান_ মাটি, পানি, বায়ু, গাছপালা, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের ওপর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব, শ্রমিকদের সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা হ্রাস, চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি এবং মূল্যবান জীবনের ঝুঁকি বিবেচনায় আনা হলে দেখা যেত অর্থনৈতিক লাভের আশায় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অজুহাতে সৃষ্ট শিল্পগুলো আসলেই ততটা লাভজনক নয়, বরং ক্ষতিকর।
নগরে বন্যা বা জলাবদ্ধতার তীব্রতা ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পায় নিকটবর্তী নদীগুলো দখল, ভরাট, সংস্কারের অভাব এবং কলকারখানার বর্জ্য নিক্ষেপের ফলে। জলাধার ভরাট করে দালান বা কাঠামো নির্মাণের ফলে পানিপৃষ্ঠ আবৃত হওয়ায় মাটিতে এর অনুপ্রবেশ হার ও পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পায় এবং পৃষ্ঠপানি সরণ বৃদ্ধি পায়। পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় নগরে বন্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় দৈনন্দিন নগরজীবন ব্যাহত হয়, রোগ-জীবাণুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, স্বাস্থ্যহানি ঘটে ও চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। শিল্প এলাকায় কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুদূষণ, নগর ও জনস্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলে। হাইড্রোকার্বনের প্রভাবে শ্বসন, হৃৎপিণ্ডের ব্যাধি ও ফুসফুসের ক্যান্সার তৈরি হয়। ক্রমশ পুঞ্জীভূত সালফার ডাই-অক্সাইড অম্লবৃষ্টি ও প্রাণনাশক ধোঁয়াশা তৈরি করে। প্রচুর পরিমাণে ধুলোবালি, ভস্ম, ভাসমান কণা, গ্যাস কণা শিল্প এলাকার উপরে ভাসমান থাকে। দীর্ঘদিনের প্রভাবে শিশুদের শ্বাসকষ্ট, শারীরিক ও মেধার বিকাশ ব্যাহত হয়, এমনকি মানসিক বৈকল্য দেখা দিতে পারে।
নগদ অর্থের লোভে নগরে বা নগরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে প্রাণের বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ, সংবেদনশীল, সংকটাপন্ন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত অঞ্চলগুলোকে বাণিজ্যিক বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত করা হয়। চট্টগ্রামের ফয়'স লেক, সীতাকুণ্ডের ইকোপার্ক, ডুলাহাজারার সাফারি পার্ক, সেন্টমার্টিন কিংবা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতকে অপরিকল্পিত বাণিজ্যিকীকরণের ফলে এখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ যেমন বিপদাপন্ন, তেমনি প্রাকৃতিকভাবে জীবিকা নির্বাহকারী এসব অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল প্রান্তিক দরিদ্রগোষ্ঠী জীবিকা হারিয়ে আরও নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। তথাকথিত উন্নয়নে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর পকেট ফুলে-ফেঁপে উঠলেও দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের অনিরূপিত-অপরিমাপযোগ্য ক্ষতি, তৃণমূল পর্যায়ে সীমাহীন বেকারত্ব, দারিদ্র্য একমাত্র বাস্তবতা। অথচ সঠিক কর্মপরিকল্পনা, প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পারিবেশিক অভিঘাত মূল্যায়ন, সংবেদনশীলতা পরিমাপের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চলগুলোকে সংরক্ষণ, সম্ভাব্য পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ও প্রান্তীয় জনগণকে পুনর্বাসন সম্ভব।
উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবেশিক উন্নয়ন বা পরিবেশবান্ধব উন্নয়নকে পাশ কাটিয়ে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে পরিবেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। পরিবেশগত সমাধান সবসময় বড় বাজেটে হবে এমন কোনো কথা নেই। সঠিক জ্ঞান, নীতিনির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুটিই অর্জন সম্ভব অনায়াসে।
স ড. অলক পাল :সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
alak1973@yahoo.com
এ দেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও জলবায়ু যেমন_ ভূমিরূপ, পানি, বাতাস, বৃষ্টিপাত, নদী, দেশের জনসংখ্যা কাঠামো, মানুষের আচরণ, জীবনযাপন পদ্ধতি, সংস্কৃতি ও জীবিকাকে বহুলাংশে নির্ধারণ করে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১৪২.৩ মিলিয়ন মানুষের বাস। মাথাপিছু আয় প্রায় ৬৯০ মার্কিন ডলার। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে পরিবেশকে প্রায় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়। উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণ-পশ্চিমের জীব-ভূগোলের সমন্বয়ে জটিল মিথস্ক্রিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান। জলবায়ু ও ভূমি উর্বরতায় আশীর্বাদপুষ্ট এ অঞ্চল বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর। বর্তমানে এখানে প্রায় ৫ হাজার প্রজাতির পুষ্পজীবী উদ্ভিদ ও ১ হাজার ৫০০ প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে, যা গত শতকের তুলনায় নগণ্য বটে। বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপ ও প্রাণের বিন্যাসকে প্রায় অস্তিত্বের সংকটে ফেলেছে ভূমির অতিরিক্ত ও অপরিকল্পিত ব্যবহার, বনভূমি উজাড়, অপর্যাপ্ত বন ব্যবস্থাপনা, কৃষি ও শিল্পদূষণ, স্থানান্তরিত চাষ ব্যবস্থা, উপকূলীয় চিংড়ি চাষ, লবণাক্ততা, বৃহৎ আকারের স্থাপনা, বন্যা ও সেচ প্রকল্প ইত্যাদি। শিল্পায়নে প্রচুর পরিমাণে বনজ কাঁচামালের ব্যবহার বনজ সম্পদ হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে এসব অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র্যকে বিপদাপন্ন করেছে। দেশের প্রায় ৯৪ শতাংশ প্রাকৃতিক আবাসস্থল ও বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে কৃষিজমি ও মানুষের অবকাঠামো নির্মাণে। শুধু চকোরিয়া ম্যানগ্রোভ এলাকা ১৯৬৭ থেকে ৮৮_ এ ২১ বছরে সাড়ে ৭ হাজার থেকে কমে ৯৭৩ হেক্টরে এসে দাঁড়ায়। দেশের যত্রতত্র যথাযথ 'পারিবেশিক অভিঘাত মূল্যায়ন' ব্যতীত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সেচ প্রকল্প নির্মাণের ফলে জলাভূমি, জলাধার, মৎস্য খাত ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। জনসংখ্যার বর্ধিত চাহিদা মেটাতে অনেক জলাভূমি, জলাধার ও বনাঞ্চলকে কৃষিজমিতে রূপান্তর করায় উৎপাদনশীলতা হ্রাস ও বাস্তুসংস্থানের জটিল প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
এ দেশের আদি ও প্রচলিত চাষ পদ্ধতি, নদী ও কৃষিনির্ভর জীবিকা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব। উন্নয়নের যান্ত্রিক-অনিয়মতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের বাইরে জীববৈচিত্র্য স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে উন্নত করে। পাশাপাশি দেশের কৃষি ও বনাঞ্চলকে রাখে সুন্দর-সুরক্ষিত, পর্যটন খাতে আয় বৃদ্ধি করে, বাস্তুসংস্থানের খাদ্যজাল ও জীবনচক্র সমুন্নত রাখে এবং সর্বোপরি পরিবেশকে বাঁচিয়ে তোলে। গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে কয়েকটি অঞ্চল বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সেচ প্রকল্প, বন্যা ও জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণে এবং ধান উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিপুল পরিমাণে বাঁধ ও পোল্ডার নির্মাণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে উৎপাদন বহু গুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় কাঠামোগত উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলে অন্যান্য চাষ যেমন_ লবণ উৎপাদন, চিংড়ি চাষ প্রচলিত থাকায় ধীরে ধীরে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। এসব অঞ্চলে নির্মিত বাঁধ ও পোল্ডার লবণ পানি আটকে রাখায় ফসলি জমি ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে লবণ ও চিংড়ি চাষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ৭০ শতাংশ জমি এরই মধ্যে লবণাক্ততায় আক্রান্ত, যা মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে উৎপাদনের মাত্রাকে হ্রাস করছে। এ ছাড়া ৫০ শতাংশ জমি বাঁধ ও পোল্ডারের কারণে জলাবদ্ধ ও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। ফলে ভূমিদূষণ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, ভারি সঞ্চয়ন, গোচারণভূমি হ্রাস, সুপেয় পানির অভাব, দূষণ ও বাস্তুসংস্থানে ব্যাঘাত ঘটছে। শুধু কৃষি ক্ষেত্রেই নয়, মানুষ বসবাসের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। কৃষিজমি কমে যাওয়ার দরুন বর্গাচাষি, দিনমজুর তাদের জীবিকা হারিয়ে চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন, যা প্রায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নেয়। গত দুই দশকে এ অঞ্চলগুলোয় দাঙ্গায় দেড় শতাধিক মানুষ আহত ও নিহত হয়। ভূমি ব্যবহারে সৃষ্ট সংকট, ক্ষতিগ্রস্ত জীবন ও জীবিকা, সামাজিক অস্থিরতা, কোন্দল, পারিবেশিক ক্ষতি নগর অভিমুখে স্থানাস্তরের হার বৃদ্ধি করেছে। আর্থসামাজিক, পারিবেশিক_ এসব ক্ষতি আর্থিক মূল্যে নিরূপণ করা গেলে প্রবৃদ্ধির তুলনায় ক্ষতির পরিমাণ হবে ব্যাপক।
নগরায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষায় কিছু শিল্প তৈরি হয়েছে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ইতিবাচক নয়। উদাহরণ হিসেবে বলতে হয়_ চট্টগ্রামে জাহাজভাঙা শিল্প, ঢাকায় হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্প, ইটভাটা এমনই কিছু ক্ষেত্র। এদের প্রতিটি পরিবেশ দূষণ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। জাহাজভাঙা শিল্পে নিয়মিত তেল ও অন্যান্য বিষাক্ত বর্জ্য আশপাশের এলাকা, বনভূমি, সমুদ্র অঞ্চলের প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করে তুলছে। এ শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা ত্বক, ফুসফুসের সমস্যা, ক্যান্সার, হঠাৎ দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি এমনকি মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করে। বর্জ্য অপসারণের সময় বা তেল ট্যাংকার কাটার সময় একটু অসাবধানতায় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, যেমনটি হয়েছিল ২০০৩ সালে। ওই সময় ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানিকৃত একটি জাহাজের তেল ট্যাংক কাটার সময় বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। বাতাসে এসিডিটি বৃদ্ধির ফলে গাছপালা পুড়ে যায়। পানি দূষিত হয়ে খামারের মাছ, হাঁস-মুরগি মারা যায়। মানুষের ত্বকে ফোসকা পড়ে, চোখ ও শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভোগে বছর ধরে। এসব শিল্প অনুমোদন ও নির্মাণের আগে পরিবেশের উপাদান_ মাটি, পানি, বায়ু, গাছপালা, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের ওপর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব, শ্রমিকদের সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা হ্রাস, চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি এবং মূল্যবান জীবনের ঝুঁকি বিবেচনায় আনা হলে দেখা যেত অর্থনৈতিক লাভের আশায় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অজুহাতে সৃষ্ট শিল্পগুলো আসলেই ততটা লাভজনক নয়, বরং ক্ষতিকর।
নগরে বন্যা বা জলাবদ্ধতার তীব্রতা ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পায় নিকটবর্তী নদীগুলো দখল, ভরাট, সংস্কারের অভাব এবং কলকারখানার বর্জ্য নিক্ষেপের ফলে। জলাধার ভরাট করে দালান বা কাঠামো নির্মাণের ফলে পানিপৃষ্ঠ আবৃত হওয়ায় মাটিতে এর অনুপ্রবেশ হার ও পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পায় এবং পৃষ্ঠপানি সরণ বৃদ্ধি পায়। পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় নগরে বন্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় দৈনন্দিন নগরজীবন ব্যাহত হয়, রোগ-জীবাণুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, স্বাস্থ্যহানি ঘটে ও চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। শিল্প এলাকায় কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুদূষণ, নগর ও জনস্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলে। হাইড্রোকার্বনের প্রভাবে শ্বসন, হৃৎপিণ্ডের ব্যাধি ও ফুসফুসের ক্যান্সার তৈরি হয়। ক্রমশ পুঞ্জীভূত সালফার ডাই-অক্সাইড অম্লবৃষ্টি ও প্রাণনাশক ধোঁয়াশা তৈরি করে। প্রচুর পরিমাণে ধুলোবালি, ভস্ম, ভাসমান কণা, গ্যাস কণা শিল্প এলাকার উপরে ভাসমান থাকে। দীর্ঘদিনের প্রভাবে শিশুদের শ্বাসকষ্ট, শারীরিক ও মেধার বিকাশ ব্যাহত হয়, এমনকি মানসিক বৈকল্য দেখা দিতে পারে।
নগদ অর্থের লোভে নগরে বা নগরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে প্রাণের বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ, সংবেদনশীল, সংকটাপন্ন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত অঞ্চলগুলোকে বাণিজ্যিক বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত করা হয়। চট্টগ্রামের ফয়'স লেক, সীতাকুণ্ডের ইকোপার্ক, ডুলাহাজারার সাফারি পার্ক, সেন্টমার্টিন কিংবা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতকে অপরিকল্পিত বাণিজ্যিকীকরণের ফলে এখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ যেমন বিপদাপন্ন, তেমনি প্রাকৃতিকভাবে জীবিকা নির্বাহকারী এসব অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল প্রান্তিক দরিদ্রগোষ্ঠী জীবিকা হারিয়ে আরও নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। তথাকথিত উন্নয়নে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর পকেট ফুলে-ফেঁপে উঠলেও দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের অনিরূপিত-অপরিমাপযোগ্য ক্ষতি, তৃণমূল পর্যায়ে সীমাহীন বেকারত্ব, দারিদ্র্য একমাত্র বাস্তবতা। অথচ সঠিক কর্মপরিকল্পনা, প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পারিবেশিক অভিঘাত মূল্যায়ন, সংবেদনশীলতা পরিমাপের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চলগুলোকে সংরক্ষণ, সম্ভাব্য পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ও প্রান্তীয় জনগণকে পুনর্বাসন সম্ভব।
উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবেশিক উন্নয়ন বা পরিবেশবান্ধব উন্নয়নকে পাশ কাটিয়ে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে পরিবেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। পরিবেশগত সমাধান সবসময় বড় বাজেটে হবে এমন কোনো কথা নেই। সঠিক জ্ঞান, নীতিনির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুটিই অর্জন সম্ভব অনায়াসে।
স ড. অলক পাল :সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
alak1973@yahoo.com
No comments