বাজেট ২০১৩-১৪ ॥ প্রতিক্রিয়া ও সুপারিশ by ড. আবুল বারকাত ও ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী

(শেষাংশ)

রাজস্ব আয় বৃদ্ধি আর একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের নেয়া চলমান সংস্কার পদক্ষেপসমূহ সময়-নির্দিষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকারকে অবশ্যই বেগ পেতে হবে।
বাজেট ঘাটতি কমানোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অনুন্নয়নমূলক খরচ কমানো, বিশেষ করে জনপ্রশাসনের ব্যয় কমানো, অপচয় কমানো ইত্যাদি সম্পর্কে বাজেটে সুস্পষ্ট দিক নিদের্শনা নেই। এসব বিষয় চূড়ান্ত বাজেটে স্পষ্টীকরণ প্রয়োজন।
২.ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে বিপুল ঘাটতি অর্থায়ন এবং মূল্যস্ফীতি পরস্পর সস্পর্কিত বিধায় সরকারের জন্য এটি একটি বড় ধাঁধা। শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও টিসিবি শক্তিশালী করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি প্রতিরোধ হবে না। এ ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত রাজস্ব ব্যবস্থা, বাজার তদারকী ও বাজার হস্তক্ষেপÑবিষয়টি চূড়ান্ত বাজেটে স্পষ্ট করা উচিত।
৩.বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য দৃঢ় ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সরকারী বিনিয়োগ বাড়িয়ে জাতীয় বিনিয়োগ স্বল্পতা (ওহাবংঃসবহঃ মধঢ়) দূর করা সম্ভব নয়। বেসরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম পথ অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধিসহ ব্যবসা-ব্যয় (পড়ংঃ ড়ভ ফড়রহম নঁংরহবংং) কমিয়ে আনা। এ বিষয়ে চূড়ান্ত বাজেটে সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন কৌশলসমূহ নির্দেশ করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্বসহ বিবেচনার ক্ষেত্রসমূহ হলো: শিল্প স্থাপনের জন্য ভূমি প্রাপ্তি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, আইন শৃঙ্খলা উন্নয়ন, দুর্নীতি হ্রাসে “ক্ষতি হ্রাস কৌশল”, বিদ্যুৎ-জ্বালানির সহজলভ্যতাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো সুবিধে সৃষ্টি, ব্যাংক-বীমা-কাস্টমসহ দলিল-দস্তাবেজ সহজীকরণ, ব্যবসা-দ্রুতায়ন সংশ্লিষ্ট নীতিÑসহায়ক পদক্ষেপ ইত্যাদি।
৪. পুঁজিবাজার উন্নয়নকল্পে সরকার বর্তমান বাজেট ও বাজেটের বাইরেও অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছেন। তথাপি পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ফিরে আসেনি এবং পুঁজিবাজারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা বর্তমান সরকারের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কারসাজি রোধকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। তাছাড়া এ মূহূর্তে পুঁজিবাজারের সমস্যা শুধু সরবরাহ ঘাটতি নয়। চাহিদা স্বল্পতাই বরং প্রকট আকার ধারণ করেছে। পুঁজিবাজার ও অর্থবাজারের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ। তবে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে সরকারী ও কর্পোরেট বন্ড মার্কেট সৃষ্টি করা উচিত। এর ফলে একদিকে ংঃড়পশ সধৎশবঃ-এর উপর নির্ভরশীলতা কমবে, অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তাদের পোর্টফোলিও বৈচিত্রকরণে সক্ষম হবে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার নিমিত্তে গঁঃঁধষ ঋঁহফ-এর উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ অবশ্যই প্রয়োজন। বিষয়সমূহ চূড়ান্ত বাজেটে উল্লেখ জরুরী।
৫.বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থা মূলত: ব্যাংক নির্ভর। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সিকিউরিটিজ মার্কেট-এর সীমিত ভূমিকাও বর্তমান অবস্থায় তেমন কোন অবদান রাখতে সক্ষম নয়। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি “ব্যক্তি খাত”-এর অর্থায়ন যাতে কোন অবস্থায় হুমকির সম্মুখীন না হয়, তার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। নিকট- অতীতে সংগঠিত ব্যাংকিং জালিয়াতিসমূহ আগ্রহী ব্যাংকারদের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অনুৎসাহী করছে; আবার অন্যদিকে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশের অভাবে এবং ঋণের উচ্চ সুদ হারের কারণে ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যেও ঋণ গ্রহণের উৎসাহ কম। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারকে একসঙ্গে নীতি-কৌশল উদঘাটন করতে হবে। ব্যাংকিং শৃংখলা নিশ্চিত করাসহ বাংলাদেশ ব্যাংক-এর মুদ্রানীতি ও ঋণনীতি হতে হবে বিনিয়োগ বান্ধব এবং বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নতিকল্পে বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হবে উপযুক্ত রাজস্ব নীতিমালা।
৬. কৃষিখাতের অর্জনসমূহ ধরে রাখার জন্য নিশ্চিত করা জরুরী যেন কৃষি ভর্তুকি হ্রাস না পায় এবং একই সঙ্গে যেন ভর্তুকি-বৈষম্য হ্রাস পায়। সেই সঙ্গে আমরা এও মনে করি যে, প্রস্তাবিত বাজেট বছরেই কৃষি ও কৃষক ভাবনার যথার্থতা বিচারে ৫০ হাজার ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে ১০ হাজার একর কৃষি জমি বন্দোবস্ত দেয়া সম্ভব; আর পাশাপাশি ২০ হাজার জলাহীন মৎস্যজীবী পরিবারের মধ্যে ৫ হাজার একর খাস জলাশয় বন্দোবস্ত দেয়া সম্ভব। বিষয়টি চূড়ান্ত বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা এবং এ লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ দেয়া সমীচীন হবে।
৭. যদিও নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ভূমি সংস্কার কমিশন’ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিলো, বাজেটে এ বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই। আমরা মনে করি চূড়ান্ত বাজেটে বিষয়টি উল্লেখপূর্বক সংশ্লিষ্ট বরাদ্দ স্থির করা প্রয়োজন।
৮. এবারের বাজেটেই প্রথম অতি দরিদ্রদের তালিকা (যধৎফ পড়ৎব ঢ়ড়ড়ৎ ষরংঃরহম)-এর কথা বলা হয়েছে। এজন্য ধন্যবাদ। মনে রাখা জরুরী যে, দারিদ্র্য হার হ্রাস নিয়ে আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই; কারণ, দারিদ্র্য বহুমুখী। বহুমুখী দারিদ্র্য দূরীকরণে বিভিন্ন ধরনের দরিদ্র মানুষ নিয়ে জাতীয় তথ্যভা-ার (ডাটা বেইস) গড়ে তোলা জরুরীÑ যেখানে থাকবে দারিদ্রের বিভিন্ন ধরনভিত্তিক দরিদ্র মানুষের নাম-ঠিকানা; যার অর্ন্তভুক্ত হবে ক্ষুধার দারিদ্র্য, আয়ের দারিদ্র্য, আবাসনের দারিদ্র্য, বেকারত্ব-উদ্ভূত দারিদ্র্য, অসুস্থতা-উদ্ভূত দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব-উদ্ভূত দারিদ্র্য, সুপেয় পানির অভাব-উদ্ভূত দারিদ্র্য, নারী প্রধান খানার দারিদ্র্য, অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের দারিদ্র্য, ভৌগলিক অবস্থান জনিত দারিদ্র্য ইত্যাদি। দারিদ্রের এ ধরণের তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলার লক্ষ্যে চূড়ান্ত বাজেটে বরাদ্দসহ দিক নিদের্শনা থাকা জরুরী বলে আমরা মনে করি।
৯. এদেশে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সুবিধা পাবার যোগ্য খানার সংখ্যা ২ কোটি, যাদের ৭৫ শতাংশ এ সুবিধে বঞ্চিত। সামাজিক বৈষম্য হ্রাস ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় এ খাতটি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সামগ্রিক বিচারে এ খাতে ব্যয় বরাদ্দ এবং পরিধি (পড়াবৎধমব) এখনও তুলনামূলক কম। আমরা মনে করি জনকল্যাণ নিশ্চিত ও রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে চূড়ান্ত বাজেটে এ খাতে (বিভিন্ন উপখাত ও ভাতা কার্যক্রম) প্রস্তাবিত বরাদ্দ ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা জরুরী। সেইসঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুবিধা প্রাপ্তির সহজগম্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এবং একই সঙ্গে পথ-পদ্ধতি নিরূপণ করা প্রয়োজন যেন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর “অন্তর্ভুক্তি ভ্রান্তি” (রহপষঁংরড়হ বৎৎড়ৎ) দূর করা যায়। চূড়ান্ত বাজেটে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা জরুরী।
১০. ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য “শস্য বীমা”, “কৃষি বীমা”, “জীবিকা বীমা”, “প্রাকৃতিক দুর্যোগ বীমা”, “স্বাস্থ্য বীমা” ইত্যাদি চালু করার পথনিদের্শসহ ব্যয়-বরাদ্দ চূড়ান্ত বাজেটে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন।
১১. দারিদ্র্য-পীড়িত ভৌগোলিক এলাকা (চর-হাওর-বাওর-মঙ্গা)এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ (আইলা-সিডর-সাইক্লোন) এলাকার ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে কৃষিজ উপকরণ ক্রয়ে সুদবিহীন স্বল্পমেয়াদি (৬ মাস) ঋণ প্রদান দারিদ্র্য দূরীকরণে অন্যতম পন্থা হিসেবে ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে সুপ্রমাণিত হয়েছে। বিষয়টি এবারের চূড়াান্ত বাজেটে বিবেচিত হতে পারে; সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বরাদ্দ উল্লেখ করা প্রয়োজন।
১২. এবারের বাজেটে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি এখন জটিল রূপ ধারণ করেছে (প্রত্যর্পণযোগ্য অর্পিত সম্পত্তি ‘ক’ তালিকা, ‘খ’ তালিকা এবং মে ২০১৩-এর সংশোধিত আইন)। এসব সমস্যার আইনগত সমাধান করে সুরাহার পথ-পদ্ধতি নিরূপণ করা উচিত। এসব সমাধানের পরই সংশ্লিষ্ট আর্থিক বরাদ্দ দিতে হবে। আমরা মনে করি চূড়ান্ত বাজেটে এ বিষয়ে উল্লেখ থাকা জরুরী।
১৩. নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ চূড়ান্ত বাজেটে উল্লেখ থাকা যুক্তিযুক্ত। সেইসঙ্গে শিক্ষার স্তর ভেদে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ, বিশেষায়িত, ভোকেশনাল ইত্যাদি, এবং মূলধারা ও মাদ্রাসা শিক্ষার বাজেট বরাদ্দ ভিন্ন দেখানো উচিত।
১৪. জেন্ডার বাজেট বাস্তবায়নে জাতীয় পর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা থাকতে হবে। চূড়ান্ত বাজেটে এ বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রয়োজন।
১৫. বিগত দুই অর্থবছরসহ বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে পরিবেশকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হলেও পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি সামগ্রিকভাবে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত হয়নি। নদীর দখল-দূষণ প্রতিকারে “জাতীয় নদী কমিশন” গঠনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা উচিত। পরিবেশবান্ধব বাজেটের জন্য প্রয়োজন প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠীর পরিবেশবিরোধী অন্যায় কর্মকা- প্রতিরোধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার। বিষয়টি চূড়ান্ত বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া জরুরী।
১৬. সকল ঞওঘ ধারীর (ব্যক্তিগত এবং কোম্পানী) রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত এবং প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট ফি প্রদানের মাধ্যমে ঞওঘ নবায়ন করা যেতে পারে।
১৭. এ দেশে মাত্র ৪৬ ব্যক্তি বছরে ১ কোটি টাকা বা তদুর্ধ্ব ব্যক্তিগত আয়কর প্রদান করেন। আমাদের হিসেবে বছরে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা বা তদুর্ধ্ব ব্যক্তিগত আয়কর দেবার যোগ্য মানুষের সংখ্যা এদেশে কমপক্ষে ৫০,০০০ জন। অর্থাৎ এদের কাছ থেকেই ব্যক্তিগত আয়কর হিসেবে বছরে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকা আহরণ সম্ভব। আর এ অর্থ ব্যয় হতে হবে ‘রূপকল্প ২০২১’-এর নিরিখে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য নিরসন-উদ্দিষ্ট খাতসমুহে। আশা করি বিষয়টি চূড়ান্ত বাজেটে বিবেচনা করা হবে; অন্তত বিষয়টি উল্লেখ থাকার যোগ্য। এ উৎসটিও হতে পারে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু বিনিমার্ণের অন্যতম উৎস।
১৮. দেশে এখন ঞওঘ ধারী মানুষের সংখ্যা ৩০ লাখ, যাদের মধ্যে আনুমানিক ১০ লাখ মানুষ কর দেন (তাদের মধ্যে ৬-৭ লাখ সরকারী চাকুরে)। আবার ১০ লাখ ঞওঘ ধারীর কোন হদিস নেই। এ দেশে ঞওঘ ধারী মানুষের সম্ভাব্য সংখ্যা হওয়া উচিত কমপক্ষে ৫০ লাখ, যাদের ৫০ শতাংশ নিম্নতম কর দেবার যোগ্য। বিষয়টি ভাবতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর আদায়ে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা আশা করি বিষয়টি চূড়ান্ত বাজেটে স্থান পাবে।
১৯. কালো টাকা অথবা মার্জিত ভাষায় অপ্রদর্শিত আয়Ñ বাজেটে এ বিষয়ে কিছু কথা আছে। আমাদের মতে এ দেশে পুঞ্জিভূত কালো টাকার আনুমানিক পরিমাণ হবে ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ কোটি টাকা (অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে জিডিপি-র ৪২%Ñ৮০%)। বিষয়টি বাস্তব সত্য। এ অর্থ উদ্ধার প্রয়োজন। একদিকে এমন কোন পথ-পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত হবে না যার ফলে সৎ ব্যক্তিরা ভবিষ্যতে অসৎ হতে প্রণোদিত হতে পারেন। অন্যদিকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির নীতি-নৈতিকতা বজায় রেখে কালো টাকা সংশ্লিষ্ট “সিজর ইফেক্ট” কিভাবে সমাধান করা যায় বিষয়টি চূড়ান্ত বাজেটে থাকা জরুরি। এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের বাজেট ঘোষণায় নির্দিষ্ট কর এবং ১০ শতাংশ ফাইন দিয়ে আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। দেশের মানুষের আবাসন সমস্যা সমাধানের এ ফর্দ ভাল ফর্দ নয়; তদুপরি মাননীয় অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, প্রণোদনা দিলেও কালো টাকা বেরুচ্ছে না। কালো টাকার আকার যেহেতু অনেক বড় (জিডিপি-র ৪২%Ñ৮২%) এবং যেহেতু উৎপাদনশীল বিনিয়োগ-এর চাহিদা অনেক বেশী সেহেতু শক্ত শর্তে কালো টাকার গন্তব্যস্থল হিসেবে অবকাঠামো খাতের রাস্তাঘাট-ব্রিজ-বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ শিল্প খাতের কথা ভাবা যেতে পারে। এ বিষয়ে সরকার একদিকে যেমন একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারেন, অন্যদিকে একটি কমিশন গঠন করতে পারেন। আমরা আশা করবো চূড়ান্ত বাজেটে এ কমিশনসহ শ্বেতপত্র প্রকাশের কথা থাকবে।
২০. গবেষণায় প্রমাণিত যে, তামাকজাত পণ্যের উপর আরো অধিকহারে শুল্ক কর আরোপ করে মূল্য বৃদ্ধি করলে তামাকের ব্যবহার হ্রাস সম্ভব; সম্ভব সংশ্লিষ্ট অকালমৃত্যুসহ অসুস্থতা হ্রাস এবং একই সঙ্গে এ খাত থেকে অতিরিক্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার উর্ধ্বে রাজস্ব আহরণ। সেই সঙ্গে বাড়তি এ রাজস্ব আয় সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনসহ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বাজেটে বিবেচনার জন্য আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হলো, সিগারেটের ৪ স্তরবিশিষ্ট মূল্যস্তর তুলে দিয়ে গড়-পড়তা খুচরা মূল্যের উপর ৭০ শতাংশ কর আরোপ করা হোক (যা তামাক নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ)।
২১. ব্যাপক মাত্রায় গবেষণা ও উন্নয়ন (জ্উ) ব্যয় ছাড়া প্রকৃত টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত সম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে আমাদের নিদিষ্ট সুপারিশ যে, জ্উ খাতে, বিশেষত কৃষি-সংশ্লিষ্ট উপখাতে পৃথক বরাদ্দ দেয়া উচিত; এ বরাদ্দ হওয়া উচিত কমপক্ষে ১ হাজার কোটি টাকা।
২২. সময় এসেছে দেশে ভর্তুকি-বৈষম্য নিরসনের। দেখা দরকার দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ যেন অপেক্ষাকৃত ধনীদের তুলনায় আনুপাতিক বেশী ভর্তুকি পান। বিষয়টি চূড়ান্ত বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।
২৩. পানি সরবরাহ-স্যানিটেশন-স্বাস্থ্য পরির্চযা (ধিঃবৎ, ংধহরঃধঃরড়হ, যুমরবহব) খাতে এ বছরে উ্ন্নয়ন বরাদ্দ কমেছে (এক হিসেবে গত বছরের ২ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা থেকে এবারে ২ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা)। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এখাতে বর্দ্ধিত বরাদ্দ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বাজেটের জন্য আমাদের সুপারিশ হলো, এখাতের বরাদ্দ দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা হোক (অর্থাৎ ২,৬৫৩ কোটি টাকা থেকে কমপক্ষে ৫,০০০ কোটি টাকা), এবং বর্ধিত বরাদ্দের পুরোটাই গ্রামাঞ্চলসহ সুবিধা-বঞ্চিত এলাকার মানুষের জন্য (চর, হাওর, বাওর, উপকূলীয় এলাকা, পাবর্ত্য এলাকা, শহরের বস্তি এলাকা ইত্যাদি) ব্যয় করা হোক।
২৪. চূড়ান্ত বাজেটে মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে আমদানিকৃত শিশু খাদ্যের উপর অত্যুচ্চ কর হার আরোপ করা হোক এবং ঐ সব শিশু খাদ্যের প্রচার-প্রচারণা বন্ধের স্পষ্ট দিক নিদের্শনা দেয়া হোক।
২৫. বিদ্যুত খাতের হিসেবপত্তর উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ‘স্থাপিত ক্ষমতা’র (রহংঃধষষবফ পধঢ়ধপরঃু) পাশাপাশি প্রকৃত উৎপাদন চিত্র দেয়া উচিত। আমরা আশা করবো, চূড়ান্ত বাজেটে এ হিসেব দেয়া হবে।
আমাদের কিছু শেষ কথা
বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ত পরিবর্তনশীল। বিশ্ব অর্থনীতির ভরকেন্দ্রে ভৌগোলিক স্থানান্তর ঘটছে। প্রক্ষেপণ করা হয়েছে যে, নিকট ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতির নেতৃত্বে থাকবে পাঁচটি দেশÑ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্্িরকা; আর তারপরের এগারোটির মধ্যে (বর্ণক্রমানুসারে) থাকবে বাংলাদেশ। এ প্রক্ষেপণের অনুমান ভিত্তিতে আছে বড় আকারের মানব সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ-এর প্রাপ্যতা। অর্থাৎ সামনের ২০/২৫ বছরে আমরাও পারি বিশ্ব অর্থনীতিতে উচ্চ আসনে আসীন হতে। বৈশ্বিক অর্থনীতির মধ্যে আমাদের এ সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা; প্রয়োজন মুক্তি সংগ্রামের চেতনায় উদ্ভাসিত গভীর অন্তর্দৃষ্টিসস্পন্ন দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব এবং সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকা-ে জনগণের স্বতঃর্স্ফুত অংশগ্রহণ। যে নেতৃত্ব এ বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় “সম্পদের কার্যকর ব্যবস্থাপনা”-কে সর্ব্বোচ অগ্রধিকার ভিত্তিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করবে। আর এ সব সম্পদের মধ্যে আছেÑ (১) মানব সম্পদ (যেখানে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে এবং যে ক্ষেত্রে অত্যুচ্চ বিনিয়োগ করতে হবে শিক্ষায়, জনস্বাস্থ্যে, দক্ষতা বৃদ্ধিসহ সংশ্লিষ্ট খাত-ক্ষেত্রে), (২) ভৌত সম্পদ (সব ধরণের ভৌত অবকাঠামো: বিদ্যুৎ-জ্বালানি, রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট ইত্যাদি), এবং (৩) প্রাকৃতিক সম্পদ (জমি-জলা-জঙ্গলসহ গ্যাস-তেল-কয়লা-বঙ্গোপসাগর-আকাশ-মহাকাশ)। এ সব সম্পদের সমন্বিত অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক ফলপ্রদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রায়োগিক ভাবনার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে এবং সে অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত উন্নয়ন-বিকাশ-প্রগতি নিয়ে নতুন এ দর্শন চিন্তার বিকল্প নেই। এ দর্শন চিন্তাটিও চূড়ান্ত বাজেটে প্রতিফলিত হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীর সময় নাগাদ ২০২১ সালের মধ্যে আমরা সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, উদার গণতান্ত্রিক একটি কল্যাণরাষ্ট্র বিনির্মাণ-এর স্বপ্ন দেখছি। এ নির্মাণের কারিগর হবেন এ দেশেরই আপামর মানুষ, যা এবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী অনেক বার উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন “........এদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি প্রযুক্তি-নির্ভর, সুখী, সমৃদ্ধ ও কল্যাণকামী দেশ গঠন”; পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী আরো একটা অনাকাক্সিক্ষত বাস্তবতা উল্লেখ করেছেন: “বরাবরের মত এবারো আমাদের এই অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করতে মাঠে নেমেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি”; আর শেষ কথা বলেছেন: “বাংলাদেশের সম্ভাবনা অপরিমেয়”, “যে কোন সংকটে তাঁরা (বাংলাদেশের মানুষ) আস্থা রেখেছেন উদার, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর,” বরাবরের মত আমাদের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে এই অপশক্তিকে প্রতিহত করবে”, “রেখে যাবে ভবিষ্যৎ প্রজম্মের জন্য উজ্জ্বল উত্তরাধিকার।’’ ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নসহ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতির উচ্চস্তরে পৌঁছে দেবার এ বিনির্মাণ এক বাজেটের বিষয় নয়, কিন্তু বাজেট নিঃসন্দেহে এ বিনির্মাণের পথ-কৌশল। এ নিরিখে এ বছরের বাজেটে বেশ কিছু সাহসী, স্বচ্ছ, লক্ষ্য নির্দিষ্ট এবং বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ রয়েছে। একারণেই এ বছরের বাজেট আশা সঞ্চারণকারী দলিল। এবারের বাজেট অনেক দূর পর্যন্ত “দেশের মাটি থেকে উত্থিত উন্নয়ন দর্শন উদ্ভূত” দলিল। ভবিষ্যতে এ দলিলের “দেশজ” মাত্রা বাড়াতে হবে। ‘রূপকল্প ২০২১’ যারা বাস্তবায়ন করবেন তাদের মনের গভীরে বিশ্বাস থাকতে হবে যেÑ রাজস্ব, কর, সরকারী ব্যয়, আর্থিক নীতিমালা যা-ই বলা হোক না কেন তা দেশের বৃহত্তর দরিদ্র-বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বার্র্থানুকূলে হতেই হবে। অর্থাৎ উন্নয়ন প্রক্রিয়াটি হতে হবে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বণ্টন ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণের, দ্রুত ভিত্তিতে বৈষম্য হ্রাসকরণের, ভূমি-কৃষি-জলা সংস্কারের, মানব সম্পদ দ্রুত বিকশিতকরণের, শিল্পায়ন ত্বরান্নয়নের, ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগসহ আত্মকর্মসংস্থান বিকশিতকরণের, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ-সর্বোত্তম ব্যবহারকরণের, তরুণ প্রজন্মকে সাহসী ও আলোকিত- করণের, নারীর ক্ষমতায়ন সংশ্লিষ্ট উদ্যোগের, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের, এবং সর্বোপরি সমগ্র প্রক্রিয়ায় জনগণের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এ বিশ্বাস অলীক নয়। এ বিশ্বাস অর্থনৈতিক, নৈতিক, মানবিক যে কোনো মানদ-েই যুক্তিযুক্ত। কারণ এসবই ছিল আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার মূল ভিত্তি।

লেখক : ড. আবুল বারকাত, সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি; ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

No comments

Powered by Blogger.