পদ্মা সেতু প্রকল্প‘ভোটের’ টেন্ডার by পার্থ সারথি দাস
ক্ষমতার শেষ বছরে জাতীয় নির্বাচন সামনে
রেখে অবশেষে পদ্মা সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করেছে আওয়ামী
লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। বাংলাদেশ সেতু বিভাগের ওয়েবসাইটে এটি প্রকাশ
করা হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন
আকারে এটি প্রকাশ করার কথা। গত বছরের ৯ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে দেশীয়
অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এর পরও অতি আগ্রহী
হয়ে বিদেশি তহবিল খুঁজেছেন অর্থমন্ত্রী। বিদেশি অর্থায়নের নিশ্চয়তা না
পাওয়ায় দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে তাই শুরু হয়েছে তোড়জোড়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দরপত্র আহবান করা হলেও প্রকল্পের মূল সেতুর দরপত্র মূল্যায়নপ্রক্রিয়া শেষ করতে পারবে না এই সরকার। দরপত্র মূল্যায়ন শেষ করতে কম করে হলেও ছয় মাস লেগে যাবে। কিন্তু এর আগেই সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। অন্যদিকে আগামী নির্বাচনে মহাজোট জিততে না পারলে এই প্রকল্প দেশীয় অর্থায়নে আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলেছেন, তাঁদের দল ক্ষমতায় গেলে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করা হবে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে দরপত্র আহবানের ঘটনাকে আগামী নির্বাচনে ভোটারদের টানার কৌশল হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রকল্পের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণ করেছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোই পদ্মা সেতু নির্মাণের দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। আমাদের দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান নেই। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নে কম হলেও ছয় মাস লেগে যাবে। এর মধ্যে কারিগরি প্রস্তাব মুল্যায়নে লাগবে আড়াই মাস।’
প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দরপত্র দিয়ে দিয়েছি। এটি সেতু বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আর তা বিভিন্ন সংবাদপত্রেও বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হবে।’
এদিকে গতকাল সচিবালয়ে চীনের পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার ফেং ঝেংলিনের সঙ্গে এক বৈঠকের পর যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণেই নয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো অর্থ সরকারের হাতে আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক গবেষণা পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কে এ এস মুরশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগে কম্বোডিয়া থেকে এসেছি। সেখানে বিশ্বব্যাংকের করুণ দশা। কোনোরকমে একটি অফিস আছে বিশ্বব্যাংকের। কম্বোডিয়ার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের দ্বন্দ্বের কারণে কম্বোডিয়া বিশ্বব্যাংকের কোনো সহায়তা নিচ্ছে না। কিন্তু চীন কম্বোডিয়াকে সহযোগিতা করছে। আমাদের দেশকে সহযোগিতা করার মতো শক্ত কোনো দেশ নেই। এ কারণেই এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মালয়েশিয়া থেকে প্রস্তাব এসেছিল সেটিও আশা জাগাতে পারেনি। দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ আগে নিলে ভালো হতো।’
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জাজিরা পয়েন্টে এক হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং মাওয়া পয়েন্টে ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত মে মাসে জাজিরা তীররক্ষা প্রকল্প উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ৮ জুলাই মাওয়া সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করা হবে। সার্ভিস এরিয়ার জন্য ব্যয় হবে ২৪০ কোটি টাকা। এ জন্য আগামী ১৫ জুলাই দরপত্র আহবান করা হবে। তবে নদী শাসনের মূল কাজ শুরু করার উদ্যোগ এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশীয় অর্থায়নে মূল সেতু নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব এই সেতুর কাজ শুরু করতে চাই। তবে মানসম্মত সেতুর জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করতে হবে। এ জন্য নিয়ম অনুযায়ী যা সময় লাগার তা লাগবে।’
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্র“য়ারি থেকেই পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করে। এক পর্যায়ে গ্রহণ করা হয় প্রকল্প। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২৯০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১২০ কোটি ডলার ঋণ হিসেবে দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। এ বিষয়ে ২০১১ সালের ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তি হয়। কিন্তু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায় ২০১১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। অনেক দেন-দরবারের পর গত জানুয়ারিতে সরকার বিশ্বব্যাংককে এই প্রকল্পে ‘না’ বলে দেয়। প্রকল্পের অন্য তিন সহযোগী সংস্থা এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। প্রায় এক বছর মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিনিধিরা দফায় দফায় ঢাকায় এসে বৈঠক করেছেন। কিন্তু কারিগরি দুর্বলতাসহ নানা কারণে মালয়েশিয়ার প্রস্তাব নিয়েও এগোতে পারেনি সরকার। চীনের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও এই প্রতিষ্ঠানের শক্ত ভিত্তি দেখতে পায়নি সরকার। বিদেশি অর্থায়নের সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় সরকার দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু করার কর্মসূচি নির্ধারিত ছিল। ওই সময়ে কাজ শুরু করতে পারলে এখন সেতুর অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যেত। প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এখন মূল সেতুর দরপত্র মূল্যায়ন কত দিনে শেষ হবে, তা বলা যাচ্ছে না। এটি মূল্যায়ন কমিটিই বলতে পারবে।
জানা গেছে, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ শুরু করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সেতু বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকেই সেতু বিভাগ ভেতরে ভেতরে দরপত্র আহবানের প্রস্তুতি নেয়। গত নভেম্বর মাসে মূল সেতুর দরপত্র আহবান করার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ ও ১১ সালে প্রকল্পের মূল সেতু, নদী শাসন, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক, সার্ভিস এলাকা নির্মাণ, নির্মাণকাজ তদারকির জন্য পরামর্শক নিয়োগসহ ছয়টি কাজের প্রাক-যোগ্যতা যাচাই দরপত্র আহবান করা হয়েছিল। মূল্যায়ন শেষ করে সম্ভাব্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি থেকে ঠিকাদার অনুমোদনের জন্য তা বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয় ২০১১ সালের জুন মাসে। কিন্তু এর পর পরই দুর্নীতির অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক।
সব দরপত্রের দলিল তৈরি করেছিল পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নকারী নিউজিল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকম। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের ৩১ অক্টোবর। দেশীয় অর্থায়নে কাজ শুরুর ক্ষেত্রে আবারও দরপত্র আহবানের প্রয়োজনে মনসেল এইকমের সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে হবে। এ জন্য আগ্রহ দেখিয়ে চিঠি দিয়েছে সেতু বিভাগ।
জানা যায়, গত বছরের ৯ জুলাই অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকের আলোচনায় বলা হয়, দেশে বসবাসকারী ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা এবং বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সেতু নির্মাণের অর্থায়নে বিপুল আগ্রহ প্রকাশ করছে। সরকারের অনুন্নয়মূলক ব্যয় যথাসম্ভব হ্রাস, অগ্রাধিকার সম্পন্ন নয়- এমন প্রকল্পের বাস্তবায়ন স্থগিত এবং সারচার্জ আরোপসহ অনান্য উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা যেতে পারে।
অর্থমন্ত্রীর সংশয় : পদ্মা সেতুর দরপত্র আহবান প্রসঙ্গে গতকাল বিকেলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘আমরা দরপত্র আহবান করেছি। কিছু কৌশলও নিয়েছি। আশা করি, ঠিকাদাররা আসবে। তবে ডিসেম্বরের মধ্যে কার্যাদেশ দিতে পারব কি না, সন্দেহ আছে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এমনভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার সঙ্গে করছি, যাতে পরবর্তীতে যে সরকারই আসুক না কেন, এই কাজটি অব্যাহতভাবে চলতে পারে। ঠিকাদারদের আস্থার জন্য সরকার ১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারের আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলবে। ফলে কাজ করলে টাকা পাবে না- এমন কোনো সংশয় ঠিকাদারদের থাকবে না।’
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মহাজোট সরকারের নেওয়া সবচেয়ে বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প এটি। জাজিরা ও মাওয়া সংযোগ সড়ক, সার্ভিস এরিয়া, নদী শাসন, পুনর্বাসন ও মূল সেতু নির্মাণের জন্য প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল সেতুতে ব্যয় হবে প্রায় নয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পুরো অর্থের জোগান দেওয়া হবে দেশীয় উৎস থেকে। আগামী অর্থবছরে এ প্রকল্পের জন্য সরকারের বরাদ্দ আছে ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা সড়কপথে সরাসরি যুক্ত হবে রাজধানীর সঙ্গে। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.২ শতাংশ বাড়বে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
মহাজোট সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তির অন্যতম এই প্রকল্পে সহায়তার জন্য ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দরপত্র আহবান করা হলেও প্রকল্পের মূল সেতুর দরপত্র মূল্যায়নপ্রক্রিয়া শেষ করতে পারবে না এই সরকার। দরপত্র মূল্যায়ন শেষ করতে কম করে হলেও ছয় মাস লেগে যাবে। কিন্তু এর আগেই সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। অন্যদিকে আগামী নির্বাচনে মহাজোট জিততে না পারলে এই প্রকল্প দেশীয় অর্থায়নে আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলেছেন, তাঁদের দল ক্ষমতায় গেলে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করা হবে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে দরপত্র আহবানের ঘটনাকে আগামী নির্বাচনে ভোটারদের টানার কৌশল হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রকল্পের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণ করেছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোই পদ্মা সেতু নির্মাণের দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। আমাদের দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান নেই। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নে কম হলেও ছয় মাস লেগে যাবে। এর মধ্যে কারিগরি প্রস্তাব মুল্যায়নে লাগবে আড়াই মাস।’
প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দরপত্র দিয়ে দিয়েছি। এটি সেতু বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আর তা বিভিন্ন সংবাদপত্রেও বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হবে।’
এদিকে গতকাল সচিবালয়ে চীনের পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার ফেং ঝেংলিনের সঙ্গে এক বৈঠকের পর যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণেই নয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো অর্থ সরকারের হাতে আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক গবেষণা পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কে এ এস মুরশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগে কম্বোডিয়া থেকে এসেছি। সেখানে বিশ্বব্যাংকের করুণ দশা। কোনোরকমে একটি অফিস আছে বিশ্বব্যাংকের। কম্বোডিয়ার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের দ্বন্দ্বের কারণে কম্বোডিয়া বিশ্বব্যাংকের কোনো সহায়তা নিচ্ছে না। কিন্তু চীন কম্বোডিয়াকে সহযোগিতা করছে। আমাদের দেশকে সহযোগিতা করার মতো শক্ত কোনো দেশ নেই। এ কারণেই এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মালয়েশিয়া থেকে প্রস্তাব এসেছিল সেটিও আশা জাগাতে পারেনি। দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ আগে নিলে ভালো হতো।’
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জাজিরা পয়েন্টে এক হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং মাওয়া পয়েন্টে ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত মে মাসে জাজিরা তীররক্ষা প্রকল্প উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ৮ জুলাই মাওয়া সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করা হবে। সার্ভিস এরিয়ার জন্য ব্যয় হবে ২৪০ কোটি টাকা। এ জন্য আগামী ১৫ জুলাই দরপত্র আহবান করা হবে। তবে নদী শাসনের মূল কাজ শুরু করার উদ্যোগ এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশীয় অর্থায়নে মূল সেতু নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব এই সেতুর কাজ শুরু করতে চাই। তবে মানসম্মত সেতুর জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করতে হবে। এ জন্য নিয়ম অনুযায়ী যা সময় লাগার তা লাগবে।’
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্র“য়ারি থেকেই পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করে। এক পর্যায়ে গ্রহণ করা হয় প্রকল্প। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২৯০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১২০ কোটি ডলার ঋণ হিসেবে দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। এ বিষয়ে ২০১১ সালের ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তি হয়। কিন্তু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায় ২০১১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। অনেক দেন-দরবারের পর গত জানুয়ারিতে সরকার বিশ্বব্যাংককে এই প্রকল্পে ‘না’ বলে দেয়। প্রকল্পের অন্য তিন সহযোগী সংস্থা এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। প্রায় এক বছর মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিনিধিরা দফায় দফায় ঢাকায় এসে বৈঠক করেছেন। কিন্তু কারিগরি দুর্বলতাসহ নানা কারণে মালয়েশিয়ার প্রস্তাব নিয়েও এগোতে পারেনি সরকার। চীনের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও এই প্রতিষ্ঠানের শক্ত ভিত্তি দেখতে পায়নি সরকার। বিদেশি অর্থায়নের সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় সরকার দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু করার কর্মসূচি নির্ধারিত ছিল। ওই সময়ে কাজ শুরু করতে পারলে এখন সেতুর অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যেত। প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এখন মূল সেতুর দরপত্র মূল্যায়ন কত দিনে শেষ হবে, তা বলা যাচ্ছে না। এটি মূল্যায়ন কমিটিই বলতে পারবে।
জানা গেছে, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ শুরু করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সেতু বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকেই সেতু বিভাগ ভেতরে ভেতরে দরপত্র আহবানের প্রস্তুতি নেয়। গত নভেম্বর মাসে মূল সেতুর দরপত্র আহবান করার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ ও ১১ সালে প্রকল্পের মূল সেতু, নদী শাসন, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক, সার্ভিস এলাকা নির্মাণ, নির্মাণকাজ তদারকির জন্য পরামর্শক নিয়োগসহ ছয়টি কাজের প্রাক-যোগ্যতা যাচাই দরপত্র আহবান করা হয়েছিল। মূল্যায়ন শেষ করে সম্ভাব্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি থেকে ঠিকাদার অনুমোদনের জন্য তা বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয় ২০১১ সালের জুন মাসে। কিন্তু এর পর পরই দুর্নীতির অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক।
সব দরপত্রের দলিল তৈরি করেছিল পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নকারী নিউজিল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকম। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের ৩১ অক্টোবর। দেশীয় অর্থায়নে কাজ শুরুর ক্ষেত্রে আবারও দরপত্র আহবানের প্রয়োজনে মনসেল এইকমের সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে হবে। এ জন্য আগ্রহ দেখিয়ে চিঠি দিয়েছে সেতু বিভাগ।
জানা যায়, গত বছরের ৯ জুলাই অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকের আলোচনায় বলা হয়, দেশে বসবাসকারী ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা এবং বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সেতু নির্মাণের অর্থায়নে বিপুল আগ্রহ প্রকাশ করছে। সরকারের অনুন্নয়মূলক ব্যয় যথাসম্ভব হ্রাস, অগ্রাধিকার সম্পন্ন নয়- এমন প্রকল্পের বাস্তবায়ন স্থগিত এবং সারচার্জ আরোপসহ অনান্য উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা যেতে পারে।
অর্থমন্ত্রীর সংশয় : পদ্মা সেতুর দরপত্র আহবান প্রসঙ্গে গতকাল বিকেলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘আমরা দরপত্র আহবান করেছি। কিছু কৌশলও নিয়েছি। আশা করি, ঠিকাদাররা আসবে। তবে ডিসেম্বরের মধ্যে কার্যাদেশ দিতে পারব কি না, সন্দেহ আছে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এমনভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার সঙ্গে করছি, যাতে পরবর্তীতে যে সরকারই আসুক না কেন, এই কাজটি অব্যাহতভাবে চলতে পারে। ঠিকাদারদের আস্থার জন্য সরকার ১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারের আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলবে। ফলে কাজ করলে টাকা পাবে না- এমন কোনো সংশয় ঠিকাদারদের থাকবে না।’
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মহাজোট সরকারের নেওয়া সবচেয়ে বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প এটি। জাজিরা ও মাওয়া সংযোগ সড়ক, সার্ভিস এরিয়া, নদী শাসন, পুনর্বাসন ও মূল সেতু নির্মাণের জন্য প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল সেতুতে ব্যয় হবে প্রায় নয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পুরো অর্থের জোগান দেওয়া হবে দেশীয় উৎস থেকে। আগামী অর্থবছরে এ প্রকল্পের জন্য সরকারের বরাদ্দ আছে ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা সড়কপথে সরাসরি যুক্ত হবে রাজধানীর সঙ্গে। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.২ শতাংশ বাড়বে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
মহাজোট সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তির অন্যতম এই প্রকল্পে সহায়তার জন্য ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছিল।
No comments