পদ্মা সেতু প্রকল্পে দরপত্র আহ্বান সরকারের মেয়াদে কাজ শুরু করা নিয়ে সংশয়

পদ্মা সেতু প্রকল্পের অধীনে মূল সেতু নির্মাণে প্রথম পর্যায়ের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে সেতু বিভাগ। তবে এ সরকারের মেয়াদে কাজ শুরু করা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
গতকাল বুধবার দুপুরে প্রাকেযাগ্য চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দরপত্র ক্রয় এবং তা জমা দেওয়ার জন্য চিঠি দেয় সেতু বিভাগ। আগামী ৭ জুলাই থেকে দরপত্র দলিল সংগ্রহ করা যাবে এবং তা জমা দেওয়ার শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ সেপ্টেম্বর।
সেতু বিভাগ ২০১১ সালে পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রাকেযাগ্য হিসেবে নির্বাচন করেছিল। এগুলো হচ্ছে স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন (দক্ষিণ কোরিয়া), চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (চীন), ডালিম-ভিসিআই (দক্ষিণ কোরিয়া) ও ভিন্সি-এইচসিসি (ফ্রান্স) ও চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। তবে সিসিসিসিকে দরপত্র প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছে।
সূত্র জানায়, সিসিসিসিকে বিশ্বব্যাংক ২০১৭ সাল পর্যন্ত কালো তালিকাভুক্ত করেছিল। আন্তর্জাতিক চর্চা হচ্ছে বিশ্বব্যাংক কোনো প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করলে সেটি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানি সংস্থা জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) জন্যও প্রযোজ্য হয়।
দরপত্র প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও আইডিবি সমন্বিতভাবে যে নীতিমালা তৈরি করেছিল, পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সেটাই অনুসরণ করা হচ্ছে। এ জন্য সিসিসিসিকে দরপত্র প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে মূল সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গতকাল যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে তাতে দেশীয় অর্থে বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সব ঠিকাদার আসবে কি না, তা নিয়ে মতভেদ আছে।
এ দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল বিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দরপত্র আহ্বান করেছি। কিছু কৌশলও নিয়েছি। আশা করি, ঠিকাদাররা আসবে। তবে ডিসেম্বরের মধ্যে কাজের অর্ডার দিতে পারব কি না, সন্দেহ আছে।’
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা এমনভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি করছি, পরবর্তীতে যে সরকারই আসুক না কেন, কাজটি যাতে অব্যাহতভাবে চলতে পারে।’
কাজ করলে টাকা না-ও পাওয়া যেতে পারে—ঠিকাদারদের এমন সংশয় যাতে না থাকে, সে জন্য ১২০ কোটি ডলারের আলাদা হিসাব খোলা হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
২৯১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ কীভাবে আসবে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কেন? রিজার্ভ থেকে আসবে? আমাদের তো এখন এক হাজার ৫০০ ডলারের বেশি রিজার্ভ রয়েছে। এ থেকে ১২০ কোটি ডলার পদ্মা সেতুর জন্য আলাদা হিসাবে রাখলে কোনো সমস্যা হবে না।’
পরবর্তী প্রক্রিয়া: সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, মূল সেতুর জন্য দুই পর্বের দরপত্র প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হবে। প্রথম পর্বে ঠিকাদারদের কারিগরি দিক যাচাই-বাছাই করে যোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হবে। তারপর আর্থিক প্রস্তাব আহ্বান করা হবে।
গতকালের দরপত্র বা এক্সপ্রেস অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) হচ্ছে চূড়ান্ত দরপত্রের প্রাথমিক ধাপ। সেপ্টেম্বরে দরপত্র জমা হওয়ার পর কমপক্ষে দুই মাস সময় লাগবে মূল্যায়নে। আর্থিক প্রস্তাব জমা দেওয়ার জন্যও দুই মাস সময় দেওয়া হবে। সেটা মূল্যায়নে আরও দুই মাস লাগবে। চূড়ান্ত করার আগে ঠিকাদারের সঙ্গে শেষ পর্যায়ের আলোচনা বা দর-কষাকষির জন্যও কিছু সময় ব্যয় হবে। এরপর সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন নিতে হবে। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ঠিকাদার নিয়োগে আট থেকে ১০ মাস সময় লাগতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।
জানতে চাইলে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্র আহ্বান, মূল্যায়ন, আইনি মতামত ও অনুমোদন সব মিলিয়ে ছয়-সাত মাস সময় লেগে যাবে। এরপর ঠিকাদার নিয়োগ করে সরঞ্জামাদি নিয়ে আসার জন্যও সময় দিতে হবে। এরপর কাজ শুরু করতে হবে।
অন্য কাজ: পাঁচ ভাগে বিভক্ত করে পদ্মা সেতুর কাজ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মূল সেতু, নদীশাসন, দুই পাড়ে দুটি সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও সার্ভিস এলাকা (নির্মাণ অবকাঠামো) নির্মাণ।
গতকাল মূল সেতুর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সড়ক নির্মাণে আবদুল মোনেম লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদারক করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এখন নদীশাসন, মাওয়া প্রান্তের সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এলাকা নির্মাণে চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান বাকি আছে।
ব্যয় ও বরাদ্দ: পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার। মূল সেতুর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৩৬১ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে যে ব্যয় ধরা হয়েছে এর প্রায় ৮০ শতাংশই পরিশোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। পদ্মা সেতু হবে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে। চার লেনের এ সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এতে রেল চলাচলের ব্যবস্থাও রাখা হবে।

No comments

Powered by Blogger.