গোধূলির ছায়াপথে ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’ by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
দিনটি ভরে যায় গানে গানে, যখনই খুলে বসি
পাশের বাড়ির ‘তারা’ টিভি। অনেক দিন থেকে সুন্দর সুন্দর গানের ডালি নিয়ে
উপস্থিত তিন উপস্থাপিকা। তাঁদের নিরাভরণ সাবলীল বাক্যবিন্যাসে মন ভরে যায়।
দুই বাংলা আলাদা হয়ে গেলেও কোথায় যেন মিল, কোথায় যেন অভিন্ন আমরা। কী
আমাদের আলাদা করে, জানা হয়ে গেছে, কিন্তু কোথায় আমরা এক, তা বুঝতে পেরেছে
‘সকালের আমন্ত্রণ’। সকালবেলা যখন একটি নতুন দিনের আহ্বান, পূর্ব দিনের
বাদানুবাদের ইতিহাস ও ক্ষুদ্রতা তখন ভুলে যেতে চাই। নতুন দিনের সূর্য
আমাদের নতুনের ডাক দিয়ে যায়, যার আহ্বান শুনেছি প্রথমে কবিদের কণ্ঠে।
আমাদের রবীন্দ্রনাথ, আমাদের নজরুলের কণ্ঠে।
কিছুদিন আগে জানতে পারি যে পশ্চিমবঙ্গের ‘তারা’ টিভির মালিকেরা সরে পড়েছেন। তখন থেকেই বিপাকে টিভি স্টেশনটি। কদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শুধু গানের টানে ছুটে এসেছেন এবং সরকার প্রতিষ্ঠানটি অধিগ্রহণ করেছে। এখানেই ভালোবাসার জয়, এখানেই সংস্কৃতির জয়। রাজনৈতিক টানাপোড়েন নিশ্চয়ই থাকবে, থাকবে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, কিন্তু যখন পুরোনো গানগুলো পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরা ভরাট কণ্ঠের সহযোগিতায় দিনের পর দিন পরিবেশন করেন, তখন বোঝা যায় সংগীতে আমরা কত ঐশ্বর্যময়। আমরা যেসব গান ভুলে গেছি, তাঁরা আমাদের মনে করিয়ে দেন। সহজেই বুঝতে পারি আমাদের রয়েছে একই ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকার, সেখানে আলাদা হলেও এক।
সংগীতের ভুবনে আমাদের শিল্পীরা সৃষ্টি করে চলেছেন নতুন জগৎ, রবীন্দ্রসংগীত, নব্য সংগীত ও নজরুলসংগীতের ক্ষেত্রে, লোকসংগীত তো আছেই। ‘তারা’ বহুদিন থেকে বাংলাদেশের সেরা শিল্পীদের সমাদরে ডেকে নিয়ে গেছে তাদের মঞ্চে। এটা তাদের বিরাট কৃতিত্ব। বাংলাদেশের অনেক শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, যে আদর তাঁরা পেয়েছেন তা অভাবনীয়, বিশেষ করে, তিনজন উপস্থাপক বাঙালির মনমানসিকতা ও তাঁদের ভালোবাসার জায়গাটি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছেন। এতে লাভ হয়েছে, আমাদের শিল্পীরা এখন পৃথিবীর বাংলাভাষী মানুষের জন্য, এটা তাঁরা অনুভব করতে পেরেছেন। জয় করেছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফাতেমা-তুজ-জোহরা, মিতা হক, ইয়াসমীন মুশতারী, খায়রুল আলম শাকিল, সালাহউদ্দিন ও আরও অনেকে।
পশ্চিম বাংলায় অনেক ভালো শিল্পী আছেন। যদি ‘তারা’ না দেখতাম, তাঁদের চিনতাম না। পিয়ানো বাজিয়ে যিনি রবীন্দ্রসংগীত করেন, চোখ বন্ধ করে গান সকালের গোষ্ঠ সংগীত, ক্লাসিক্যাল গান, গজল, ঠুমরি, পুরোনো বাংলা গান, আড়ষ্টতা কাটিয়ে নতুন ভঙ্গিতে অপূর্ব পরিবেশনা, সবই রয়ে যেত অজানিত। আরও অনুষ্ঠান যেখানে কলকাতায় না গিয়েও কলকাতা অনুভবে আনতে পারি। ‘তারা’র কৃতিত্ব। নাম সামনে আঁকা, অথচ এত নাম বললে পাতা ভরে যাবে।
অনুষ্ঠানের আরও কৃতিত্ব আছে। তা হলো আমাদের টিভি স্টেশনগুলো সকালের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে এবং রিলের মধ্যে আবদ্ধ অনুষ্ঠান না চালিয়ে নতুন নতুন প্রাত্যহিক অনুষ্ঠানের সূচনা করেছে। তখন আমরা ছুটে চলি এক ‘তারা’ থেকে অন্য তারায়, যেখানে ‘চ্যানেল আই’, ‘মাছরাঙা টিভি’, ‘বাংলাভিশন’, ‘দেশ টিভি’ নিয়ে উপস্থিত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পীদের, যাঁদের কণ্ঠে বিস্ময়ের পর বিস্ময়। নতুন স্বাদে নতুন আবহে এই অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে এসেছে টিভি দেখার আনন্দ।
শুধু দুঃখ, পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা এই অনুষ্ঠানগুলো দেখা থেকে বঞ্চিত। শিল্পীরা এত দিন ভোরবেলা গলা সাধতেন না। এখন শুনছি তারা ভোর পাঁচটা থেকে গলা সাধছেন, কারণ সাতটায় অনুষ্ঠান। এই ঘুম ভাঙানোর কৃতিত্ব এখন সবাই ভাগ করে নিতে পারবেন। সকালবেলার রাগগুলো আলাদা, এগুলো আমাদের অস্তিত্বের ঘুম ভাঙায়। পিতা সকালবেলা সাধতেন ভৈরবী, ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’। এখন আমার পরিণত বয়সে এমন হয়েছে যে ভৈরবী সাধলেই পিতা এসে উপস্থিত। নামাজ, কোরআন পাঠে জগৎপিতা হাজির। এক রাগেই সকলে উপস্থিত। সংগীতের এমনই মর্যাদা।
রবীন্দ্রনাথ কাকভোরে উপস্থিত তাঁর প্রার্থনা ঘরে, চিরতার রস পান করার সঙ্গে সাধনায় বসেছেন অদেখা। এদিকে ভোর হয়ে সূর্যদেব দেখা দিয়েছেন, আশ্রমের ছাত্রছাত্রীরা তার সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে সাধনায়। ভোরবেলার গান নিয়ে আসে শুদ্ধ অনুভূতি, শুদ্ধ চিন্তা।
ঘুমিয়ে আছে বিটিভি। ওর ঘুম ভাঙাবে কার বাবার সাধ্যি। ওখানে কেন ঢুকতে দেয় না, কার লেখা সে নিয়ম তা-ও এত দিনে বুঝতে পারিনি। সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে বিটিভির তাবৎ কর্মচারী, অফিসার, পিয়ন, চাপরাসি, দারোয়ান ভালোবাসা জানান। বলেন, কত দিন দেখি না আপনাকে। দলের বাইরে ওদের কাউকেই চোখে পড়ে না। অনুষ্ঠানের মান কোথায় গিয়ে নেমেছে, ভাবাই যায় না। কোনো পত্রিকায় ওদের সম্বন্ধে একটা ভালো কথাও কেউ লেখে না। সরকার পরিবর্তিত হলে যাঁরা আসবেন, একই কাজ করবেন। ‘এই ট্রাডিশন সমানে চলিতে থাকিবে’।
কলকাতায় মাঝে মাঝে বেড়াতে গিয়ে ফেলে আসা পুরোনো দিনের আবহ, গন্ধ, স্মৃতি আঁকড়ে ধরি। একবার তারার আমন্ত্রণে হাজির হলাম সস্ত্রীক সাতসকালে। উপস্থাপক এত সুন্দর সুন্দর কথা বললেন যে আমরা দুজনে অভিভূত। গান গাইলাম একটার পর একটা, আমাদের কণ্ঠে ছিল: ভালোবাসার, ঐক্যের, সুন্দরের সুর। জানালাম কলকাতায় কোন স্কুলে পড়তাম, কোথায় থাকতাম, নজরুলের বাসার কথা, গোলাম মোস্তফার বাসার কথা। কোন গানগুলো পিতা গাইতে ভালোবাসতেন, পশ্চিম বাংলার কী কী ভালো লাগে, যেমন গোলাপজাম। পৃথিবীর প্রান্ত থেকে ফোন এল, অতটুকু ছোট ঘরে পৃথিবী যেন এক।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
কিছুদিন আগে জানতে পারি যে পশ্চিমবঙ্গের ‘তারা’ টিভির মালিকেরা সরে পড়েছেন। তখন থেকেই বিপাকে টিভি স্টেশনটি। কদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শুধু গানের টানে ছুটে এসেছেন এবং সরকার প্রতিষ্ঠানটি অধিগ্রহণ করেছে। এখানেই ভালোবাসার জয়, এখানেই সংস্কৃতির জয়। রাজনৈতিক টানাপোড়েন নিশ্চয়ই থাকবে, থাকবে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, কিন্তু যখন পুরোনো গানগুলো পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরা ভরাট কণ্ঠের সহযোগিতায় দিনের পর দিন পরিবেশন করেন, তখন বোঝা যায় সংগীতে আমরা কত ঐশ্বর্যময়। আমরা যেসব গান ভুলে গেছি, তাঁরা আমাদের মনে করিয়ে দেন। সহজেই বুঝতে পারি আমাদের রয়েছে একই ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকার, সেখানে আলাদা হলেও এক।
সংগীতের ভুবনে আমাদের শিল্পীরা সৃষ্টি করে চলেছেন নতুন জগৎ, রবীন্দ্রসংগীত, নব্য সংগীত ও নজরুলসংগীতের ক্ষেত্রে, লোকসংগীত তো আছেই। ‘তারা’ বহুদিন থেকে বাংলাদেশের সেরা শিল্পীদের সমাদরে ডেকে নিয়ে গেছে তাদের মঞ্চে। এটা তাদের বিরাট কৃতিত্ব। বাংলাদেশের অনেক শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, যে আদর তাঁরা পেয়েছেন তা অভাবনীয়, বিশেষ করে, তিনজন উপস্থাপক বাঙালির মনমানসিকতা ও তাঁদের ভালোবাসার জায়গাটি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছেন। এতে লাভ হয়েছে, আমাদের শিল্পীরা এখন পৃথিবীর বাংলাভাষী মানুষের জন্য, এটা তাঁরা অনুভব করতে পেরেছেন। জয় করেছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফাতেমা-তুজ-জোহরা, মিতা হক, ইয়াসমীন মুশতারী, খায়রুল আলম শাকিল, সালাহউদ্দিন ও আরও অনেকে।
পশ্চিম বাংলায় অনেক ভালো শিল্পী আছেন। যদি ‘তারা’ না দেখতাম, তাঁদের চিনতাম না। পিয়ানো বাজিয়ে যিনি রবীন্দ্রসংগীত করেন, চোখ বন্ধ করে গান সকালের গোষ্ঠ সংগীত, ক্লাসিক্যাল গান, গজল, ঠুমরি, পুরোনো বাংলা গান, আড়ষ্টতা কাটিয়ে নতুন ভঙ্গিতে অপূর্ব পরিবেশনা, সবই রয়ে যেত অজানিত। আরও অনুষ্ঠান যেখানে কলকাতায় না গিয়েও কলকাতা অনুভবে আনতে পারি। ‘তারা’র কৃতিত্ব। নাম সামনে আঁকা, অথচ এত নাম বললে পাতা ভরে যাবে।
অনুষ্ঠানের আরও কৃতিত্ব আছে। তা হলো আমাদের টিভি স্টেশনগুলো সকালের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে এবং রিলের মধ্যে আবদ্ধ অনুষ্ঠান না চালিয়ে নতুন নতুন প্রাত্যহিক অনুষ্ঠানের সূচনা করেছে। তখন আমরা ছুটে চলি এক ‘তারা’ থেকে অন্য তারায়, যেখানে ‘চ্যানেল আই’, ‘মাছরাঙা টিভি’, ‘বাংলাভিশন’, ‘দেশ টিভি’ নিয়ে উপস্থিত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পীদের, যাঁদের কণ্ঠে বিস্ময়ের পর বিস্ময়। নতুন স্বাদে নতুন আবহে এই অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে এসেছে টিভি দেখার আনন্দ।
শুধু দুঃখ, পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা এই অনুষ্ঠানগুলো দেখা থেকে বঞ্চিত। শিল্পীরা এত দিন ভোরবেলা গলা সাধতেন না। এখন শুনছি তারা ভোর পাঁচটা থেকে গলা সাধছেন, কারণ সাতটায় অনুষ্ঠান। এই ঘুম ভাঙানোর কৃতিত্ব এখন সবাই ভাগ করে নিতে পারবেন। সকালবেলার রাগগুলো আলাদা, এগুলো আমাদের অস্তিত্বের ঘুম ভাঙায়। পিতা সকালবেলা সাধতেন ভৈরবী, ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’। এখন আমার পরিণত বয়সে এমন হয়েছে যে ভৈরবী সাধলেই পিতা এসে উপস্থিত। নামাজ, কোরআন পাঠে জগৎপিতা হাজির। এক রাগেই সকলে উপস্থিত। সংগীতের এমনই মর্যাদা।
রবীন্দ্রনাথ কাকভোরে উপস্থিত তাঁর প্রার্থনা ঘরে, চিরতার রস পান করার সঙ্গে সাধনায় বসেছেন অদেখা। এদিকে ভোর হয়ে সূর্যদেব দেখা দিয়েছেন, আশ্রমের ছাত্রছাত্রীরা তার সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে সাধনায়। ভোরবেলার গান নিয়ে আসে শুদ্ধ অনুভূতি, শুদ্ধ চিন্তা।
ঘুমিয়ে আছে বিটিভি। ওর ঘুম ভাঙাবে কার বাবার সাধ্যি। ওখানে কেন ঢুকতে দেয় না, কার লেখা সে নিয়ম তা-ও এত দিনে বুঝতে পারিনি। সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে বিটিভির তাবৎ কর্মচারী, অফিসার, পিয়ন, চাপরাসি, দারোয়ান ভালোবাসা জানান। বলেন, কত দিন দেখি না আপনাকে। দলের বাইরে ওদের কাউকেই চোখে পড়ে না। অনুষ্ঠানের মান কোথায় গিয়ে নেমেছে, ভাবাই যায় না। কোনো পত্রিকায় ওদের সম্বন্ধে একটা ভালো কথাও কেউ লেখে না। সরকার পরিবর্তিত হলে যাঁরা আসবেন, একই কাজ করবেন। ‘এই ট্রাডিশন সমানে চলিতে থাকিবে’।
কলকাতায় মাঝে মাঝে বেড়াতে গিয়ে ফেলে আসা পুরোনো দিনের আবহ, গন্ধ, স্মৃতি আঁকড়ে ধরি। একবার তারার আমন্ত্রণে হাজির হলাম সস্ত্রীক সাতসকালে। উপস্থাপক এত সুন্দর সুন্দর কথা বললেন যে আমরা দুজনে অভিভূত। গান গাইলাম একটার পর একটা, আমাদের কণ্ঠে ছিল: ভালোবাসার, ঐক্যের, সুন্দরের সুর। জানালাম কলকাতায় কোন স্কুলে পড়তাম, কোথায় থাকতাম, নজরুলের বাসার কথা, গোলাম মোস্তফার বাসার কথা। কোন গানগুলো পিতা গাইতে ভালোবাসতেন, পশ্চিম বাংলার কী কী ভালো লাগে, যেমন গোলাপজাম। পৃথিবীর প্রান্ত থেকে ফোন এল, অতটুকু ছোট ঘরে পৃথিবী যেন এক।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments