জাতীয় সংসদে কুবচন-অপসংস্কৃতি রোধে চাই শীর্ষ নেতৃত্বের অঙ্গীকার by আবু সাঈদ খান
আমরা কত আবেদন-নিবেদন করেছি_ বিরোধী দল
সংসদে ফিরে আসুক, সংসদ সচল হোক। সাড়ে চার বছর পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে
বিরোধী দল সংসদে ফিরে এসেছে। ইতিমধ্যেই সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যদের
অংশগ্রহণে সংসদে প্রাণের ছোঁয়াও লেগেছে।
কিন্তু ক্ষমতাসীন
ও বিরোধী দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য যে অশালীন উক্তির দুর্গন্ধ ছড়িয়েছেন,
প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কদর্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করেছেন বা করছেন_ তা আমাদের
হতাশ ও ব্যথিত করেছে।
সংসদের ট্রেজারি বেঞ্চ ও বিরোধী দলের সদস্যদের কাছ থেকে এসব সংসদ সদস্যের বহিষ্কার, জরিমানা ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে। স্পিকারকে এমন আচরণ বন্ধে কঠোর হওয়ার কথাও বলা হয়েছে। সংসদের বিধি অনুযায়ী যা করার সেটি করা হোক। কিন্তু আইন দেখিয়ে কারও অশালীন আচরণ কি রোধ করা সম্ভব? এটি আসলে ব্যক্তির শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রুচির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাপার।
আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, যারা এ ধরনের খিস্তিখেউর অবলীলায় উচ্চারণ করতে পারেন, দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গি করতে পারেন, তারা আমাদের সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি! দেশের নাগরিকদের জন্যও এটি লজ্জার। দেশ-বিদেশের মানুষ টিভির পর্দায় এসব দেখছেন, শুনছেন। তারা দেশটি সম্পর্কে কী ভাবছেন? উল্লেখ্য, এখন অনেক ভিনদেশি নর-নারী বাংলা জানেন, তারা এসব বোঝেন। আর ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষার সংবাদপত্রে এসব তথ্য প্রকাশিতও হচ্ছে, এভাবে তা বিভিন্ন ভাষার মানুষের কাছে পেঁৗছে যাচ্ছে, যা আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তির ওপর কালো ছায়া ফেলছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি দু'চারজন সংসদ সদস্যের সাংস্কৃতিক দৈন্যের প্রতিফলন? সেটি ধরে নেওয়া যেত, যদি না নিজ নিজ দলের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কদর্য ভাষায় বক্তৃতারত সদস্যকে টেবিল চাপড়িয়ে সমর্থন জানাতেন। হতে পারে কেউ কেউ লজ্জায় মাথানত করেছিলেন। তবে টেলিভিশনের পর্দায় সগোত্রের সংসদ সদস্যদের সমর্থন ও উল্লাসের চিত্রই দেখা গেছে। শোনা যায়, এহেন কর্মের পর শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা নাকি বাহবাও দিয়ে থাকেন। এ থেকে কি প্রতীয়মান হয় না যে, দলের শীর্ষ নেতাদের প্রশ্রয় রয়েছে।
সংসদ হচ্ছে আইন প্রণয়ন, নীতিনির্ধারণ, সরকারের কার্যক্রম নিরীক্ষণ, বাজেট অনুমোদনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজের স্থান। তবে এমন সব গুরুগম্ভীর আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে হিউমার বা রসিকতা সংসদে আনন্দের হিল্লোল বইয়ে দেয়। এমন হিউমার আমরা শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান প্রমুখ ঝানু সংসদ সদস্যের মুখে শুনেছি। সেসব রসিকতা সংসদের বাইরে ছড়িয়ে পড়ত। আর এখন কিছু তরুণ সংসদ সদস্যের খিস্তিখেউর শুনছি। এর কারণ কি এই নয় যে, সংসদে আজ খিস্তিখেউর মার্কারাও প্রবেশ করছেন।
অতীতে সংসদ সদস্য হতে হলে রাজনৈতিক অনুশীলনের প্রয়োজন হতো, জেল-জুলুম সইতে হতো। তখন দলের মনোনয়ন বোর্ড থেকে প্রার্থীদের জ্ঞান-গরিমা, ত্যাগ-সততা সবকিছু বিবেচনা করে মনোনয়ন দেওয়া হতো। এখন টাকা দিয়ে বড় দলগুলো থেকে মনোনয়ন খরিদ করা যায়। আত্মীয়তা এবং ব্যক্তির পছন্দের কারণেও মনোনয়ন পাওয়া যায়। যার ফলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাশূন্য সামরিক-বেসামরিক আমলা, নব্য ব্যবসায়ীরা সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী হচ্ছেন। সংরক্ষিত নারী আসনে অযোগ্য অনেকে নির্বাচিত হচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে কী আর আশা করা যায়!
এবার খিস্তিখেউরে রেকর্ড স্থাপনকারীরা সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য। কেউ কেউ মনের খেদে লিখেছেন এবং বলেছেন, এভাবে দলীয় বিবেচনায় নারীদের সংসদ সদস্য করার আর দরকার নেই_ সংরক্ষণের এ বিধান বাতিল করা হোক। আমি ওই লেখক ও বিশিষ্টজনের ক্ষোভের মর্মার্থ উপলব্ধি করি। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে সংসদে নারী সদস্যদের উপস্থিতির গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারি না। তবে যে পদ্ধতিতে অর্থাৎ সংসদ সদস্যদের ভোটে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচন করা হয়, তা যৌক্তিক নয়। নারীরা যাতে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতে পারেন, সেজন্য প্রত্যেক দলের প্রার্থী তালিকার এক-চতুর্থ বা এক-তৃতীয়াংশ নারী রাখার বিধান প্রবর্তন করা উচিত। এ নিয়ে আগেও লিখেছি। এটি আজকের বিষয় নয়।
সরাসরি নির্বাচিত নয় বলে সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা হীন মানসিকতায় ভোগেন। তাই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে কিংবা শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রমণাত্মক এমন কদর্য ভাষা ব্যবহার করে থাকতে পারেন। অতীতে এ কাজে নেতৃত্বের কাছ থেকে বাহবা মিলেছে। তাই এবার দ্বিগুণ উৎসাহে তারা মাইক ফাটিয়েছেন।
কী ছিল তাদের ভাষণে_ তা গোপন নেই। কোনো কোনো সংবাদপত্র স্ব-আরোপিত সেন্সর করে তা প্রকাশ করলেও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সে সুযোগ ছিল না। তা সবারই জানা হয়ে গেছে। কোনো কোনো সাংসদের বক্তৃতায় উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকো, সজীব ওয়াজেদ জয়ের চরিত্র হনন ও কদর্যপূর্ণ উক্তি। সংসদে প্রাসঙ্গিকভাবে নেতা-নেত্রীর সমালোচনা হতে পারে, তবে তা সংসদের স্বীকৃত ভাষায় করতে হয়। এমন কদর্য ও অশ্লীলতায় নয়।
সংসদে যেসব কদর্যপূর্ণ কথাবার্তা হয়েছে. তা নতুন নয়। রাজনীতিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একদল অন্য দলের নেতাদের চরিত্র হননের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আবিষ্কৃত হয়েছে কলকাতার একজন গৌরী বালা ও তার ছেলে দেবদাস চক্রবর্তী, জলপাইগুড়ির ইহুদি উইলসন ও লক্ষ্মীরানী মারমার কন্যা, আরও অনেক কিছু। যা কয়েকজন নারী সদস্য নতুন করে সংসদে উদ্গিরণ করেছেন।
এদের বক্তব্যে কেবল নেতা-নেত্রীর চরিত্র হননের চেষ্টাই হয়নি, দুটি ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু (সনাতন) ধর্ম ও ইহুদি ধর্মের প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা-তাড়িত হীন রাজনীতি।
বাংলাদেশে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের ব্যবহার নতুন নয়। তবে কিছুটা ম্রিয়মাণ ছিল_ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী চাঙ্গা করেছে। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে কাছে টেনে কল্পিত নাস্তিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে তারা। বিএনপি চেয়ারপারসন গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের নাস্তিক-ফাস্তিক বলে ধর্মীয় উন্মাদনায় বাতাস দিয়েছেন। আর আওয়ামী লীগ সেই ধর্মীয় উন্মাদনার মুখে নিজেদের সাচ্চা মুসলমান প্রমাণের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের অপব্যবহারের নগ্নরূপ আমরা দেখেছি। এ প্রবণতা রোধ না করা হলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে তা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে_গণতন্ত্রের জন্য হতে পারে বড় হুমকি।
বিএনপি এখন জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলার পাশাপাশি রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের ব্যবহারকে নীতি হিসেবে বিবেচনা করছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ২০ জুন জনৈক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যের অশোভন বক্তৃতার প্রতিবাদে বিএনপির সংসদ সদস্যরা 'হরে কৃষ্ণ হরে রাম' বলে ওয়াকআউট করার মধ্য দিয়ে তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চেহারা আরেকবার উন্মোচন করেছেন। অন্যদিকে বলাবাহুল্য, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের বক্তৃতাও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত নয়।
রাজনীতিতে এখন কে 'হিন্দু বিয়ে করেছে', কার 'পুত্রবধূ বা জামাই ইহুদি'_ সেটি আক্রমণের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছে। ১৯ জুন জাতীয় সংসদে 'বিরোধী দলের অভিযোগের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমার ছেলের বউ নাকি ইহুদি। আমার ছেলের বউকে তারা ইহুদি বানিয়ে দিয়েছে। আসলে সে ইহুদি নয়, খ্রিস্টান। আমাদের আহলে কিতাব। অবশ্য ড. কামাল হোসেনের মেয়ের জামাই ইহুদি। তারা সম্ভবত ওটা বলতে গিয়ে আমার ছেলের বউয়ের কথা বলেছে' (দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ জুন, ২০১৩)। আসলে প্রধানমন্ত্রীর পুত্রবধূ খ্রিস্টান কিংবা কামাল হোসেনের জামাই ইহুদি কোনোটাই দোষের নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জিল (বাইবেল) আহলে কিতাব, তেমনি ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতও (ওল্ড টেস্টামেন্ট) আহলে কিতাব। ইসলামের বিধান অনুযায়ী আহলে কিতাবের অনুসারীদের বিয়েতে বাধা নেই। আর বাংলাদেশের আইনে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষ মানব-মানবীর বৈবাহিক বন্ধনের বিষয়টি কোনো অপরাধ নয়। একদা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক রাজনীতিক হুমায়ুন কবীরের বিয়ে কোন ধর্মমতে হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম সমাজ তাদের এ কারণে পরিহার করেনি, বরং তাদের নিয়ে গর্বিত। কালক্রমে নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় আসীন।
বারবার প্রশ্ন জাগে, এসব কি সংসদ বা রাজনীতির আলোচনার বিষয়বস্তু? দেশের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, উন্নয়ন, কল্যাণ কীভাবে হবে, কীভাবে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে_ তা নিয়ে তেমন কথা নেই। জনগণের অর্থে পরিচালিত সংসদে আর কত সময় ধরে কদর্যপূর্ণ অশ্লীল ব্যক্তিচরিত্র হনন আর সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা শুনতে হবে, সেটাই আজ বড় প্রশ্ন?
এ ধরনের অপসংস্কৃতি বন্ধ এবং সংসদ ও রাজনীতির মর্যাদা রক্ষায় সর্বাগ্রে প্রয়োজন উভয় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অঙ্গীকার। কেবল দু'চারজন সংসদ সদস্যকে দায়ী বা ভৎর্সনা করে এই অপসংস্কৃতির বলয় থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।
সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
সংসদের ট্রেজারি বেঞ্চ ও বিরোধী দলের সদস্যদের কাছ থেকে এসব সংসদ সদস্যের বহিষ্কার, জরিমানা ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে। স্পিকারকে এমন আচরণ বন্ধে কঠোর হওয়ার কথাও বলা হয়েছে। সংসদের বিধি অনুযায়ী যা করার সেটি করা হোক। কিন্তু আইন দেখিয়ে কারও অশালীন আচরণ কি রোধ করা সম্ভব? এটি আসলে ব্যক্তির শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রুচির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাপার।
আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, যারা এ ধরনের খিস্তিখেউর অবলীলায় উচ্চারণ করতে পারেন, দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গি করতে পারেন, তারা আমাদের সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি! দেশের নাগরিকদের জন্যও এটি লজ্জার। দেশ-বিদেশের মানুষ টিভির পর্দায় এসব দেখছেন, শুনছেন। তারা দেশটি সম্পর্কে কী ভাবছেন? উল্লেখ্য, এখন অনেক ভিনদেশি নর-নারী বাংলা জানেন, তারা এসব বোঝেন। আর ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষার সংবাদপত্রে এসব তথ্য প্রকাশিতও হচ্ছে, এভাবে তা বিভিন্ন ভাষার মানুষের কাছে পেঁৗছে যাচ্ছে, যা আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তির ওপর কালো ছায়া ফেলছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি দু'চারজন সংসদ সদস্যের সাংস্কৃতিক দৈন্যের প্রতিফলন? সেটি ধরে নেওয়া যেত, যদি না নিজ নিজ দলের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কদর্য ভাষায় বক্তৃতারত সদস্যকে টেবিল চাপড়িয়ে সমর্থন জানাতেন। হতে পারে কেউ কেউ লজ্জায় মাথানত করেছিলেন। তবে টেলিভিশনের পর্দায় সগোত্রের সংসদ সদস্যদের সমর্থন ও উল্লাসের চিত্রই দেখা গেছে। শোনা যায়, এহেন কর্মের পর শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা নাকি বাহবাও দিয়ে থাকেন। এ থেকে কি প্রতীয়মান হয় না যে, দলের শীর্ষ নেতাদের প্রশ্রয় রয়েছে।
সংসদ হচ্ছে আইন প্রণয়ন, নীতিনির্ধারণ, সরকারের কার্যক্রম নিরীক্ষণ, বাজেট অনুমোদনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজের স্থান। তবে এমন সব গুরুগম্ভীর আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে হিউমার বা রসিকতা সংসদে আনন্দের হিল্লোল বইয়ে দেয়। এমন হিউমার আমরা শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান প্রমুখ ঝানু সংসদ সদস্যের মুখে শুনেছি। সেসব রসিকতা সংসদের বাইরে ছড়িয়ে পড়ত। আর এখন কিছু তরুণ সংসদ সদস্যের খিস্তিখেউর শুনছি। এর কারণ কি এই নয় যে, সংসদে আজ খিস্তিখেউর মার্কারাও প্রবেশ করছেন।
অতীতে সংসদ সদস্য হতে হলে রাজনৈতিক অনুশীলনের প্রয়োজন হতো, জেল-জুলুম সইতে হতো। তখন দলের মনোনয়ন বোর্ড থেকে প্রার্থীদের জ্ঞান-গরিমা, ত্যাগ-সততা সবকিছু বিবেচনা করে মনোনয়ন দেওয়া হতো। এখন টাকা দিয়ে বড় দলগুলো থেকে মনোনয়ন খরিদ করা যায়। আত্মীয়তা এবং ব্যক্তির পছন্দের কারণেও মনোনয়ন পাওয়া যায়। যার ফলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাশূন্য সামরিক-বেসামরিক আমলা, নব্য ব্যবসায়ীরা সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী হচ্ছেন। সংরক্ষিত নারী আসনে অযোগ্য অনেকে নির্বাচিত হচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে কী আর আশা করা যায়!
এবার খিস্তিখেউরে রেকর্ড স্থাপনকারীরা সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য। কেউ কেউ মনের খেদে লিখেছেন এবং বলেছেন, এভাবে দলীয় বিবেচনায় নারীদের সংসদ সদস্য করার আর দরকার নেই_ সংরক্ষণের এ বিধান বাতিল করা হোক। আমি ওই লেখক ও বিশিষ্টজনের ক্ষোভের মর্মার্থ উপলব্ধি করি। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে সংসদে নারী সদস্যদের উপস্থিতির গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারি না। তবে যে পদ্ধতিতে অর্থাৎ সংসদ সদস্যদের ভোটে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচন করা হয়, তা যৌক্তিক নয়। নারীরা যাতে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতে পারেন, সেজন্য প্রত্যেক দলের প্রার্থী তালিকার এক-চতুর্থ বা এক-তৃতীয়াংশ নারী রাখার বিধান প্রবর্তন করা উচিত। এ নিয়ে আগেও লিখেছি। এটি আজকের বিষয় নয়।
সরাসরি নির্বাচিত নয় বলে সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা হীন মানসিকতায় ভোগেন। তাই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে কিংবা শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রমণাত্মক এমন কদর্য ভাষা ব্যবহার করে থাকতে পারেন। অতীতে এ কাজে নেতৃত্বের কাছ থেকে বাহবা মিলেছে। তাই এবার দ্বিগুণ উৎসাহে তারা মাইক ফাটিয়েছেন।
কী ছিল তাদের ভাষণে_ তা গোপন নেই। কোনো কোনো সংবাদপত্র স্ব-আরোপিত সেন্সর করে তা প্রকাশ করলেও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সে সুযোগ ছিল না। তা সবারই জানা হয়ে গেছে। কোনো কোনো সাংসদের বক্তৃতায় উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকো, সজীব ওয়াজেদ জয়ের চরিত্র হনন ও কদর্যপূর্ণ উক্তি। সংসদে প্রাসঙ্গিকভাবে নেতা-নেত্রীর সমালোচনা হতে পারে, তবে তা সংসদের স্বীকৃত ভাষায় করতে হয়। এমন কদর্য ও অশ্লীলতায় নয়।
সংসদে যেসব কদর্যপূর্ণ কথাবার্তা হয়েছে. তা নতুন নয়। রাজনীতিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একদল অন্য দলের নেতাদের চরিত্র হননের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আবিষ্কৃত হয়েছে কলকাতার একজন গৌরী বালা ও তার ছেলে দেবদাস চক্রবর্তী, জলপাইগুড়ির ইহুদি উইলসন ও লক্ষ্মীরানী মারমার কন্যা, আরও অনেক কিছু। যা কয়েকজন নারী সদস্য নতুন করে সংসদে উদ্গিরণ করেছেন।
এদের বক্তব্যে কেবল নেতা-নেত্রীর চরিত্র হননের চেষ্টাই হয়নি, দুটি ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু (সনাতন) ধর্ম ও ইহুদি ধর্মের প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা-তাড়িত হীন রাজনীতি।
বাংলাদেশে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের ব্যবহার নতুন নয়। তবে কিছুটা ম্রিয়মাণ ছিল_ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী চাঙ্গা করেছে। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে কাছে টেনে কল্পিত নাস্তিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে তারা। বিএনপি চেয়ারপারসন গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের নাস্তিক-ফাস্তিক বলে ধর্মীয় উন্মাদনায় বাতাস দিয়েছেন। আর আওয়ামী লীগ সেই ধর্মীয় উন্মাদনার মুখে নিজেদের সাচ্চা মুসলমান প্রমাণের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের অপব্যবহারের নগ্নরূপ আমরা দেখেছি। এ প্রবণতা রোধ না করা হলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে তা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে_গণতন্ত্রের জন্য হতে পারে বড় হুমকি।
বিএনপি এখন জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলার পাশাপাশি রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের ব্যবহারকে নীতি হিসেবে বিবেচনা করছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ২০ জুন জনৈক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যের অশোভন বক্তৃতার প্রতিবাদে বিএনপির সংসদ সদস্যরা 'হরে কৃষ্ণ হরে রাম' বলে ওয়াকআউট করার মধ্য দিয়ে তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চেহারা আরেকবার উন্মোচন করেছেন। অন্যদিকে বলাবাহুল্য, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের বক্তৃতাও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত নয়।
রাজনীতিতে এখন কে 'হিন্দু বিয়ে করেছে', কার 'পুত্রবধূ বা জামাই ইহুদি'_ সেটি আক্রমণের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছে। ১৯ জুন জাতীয় সংসদে 'বিরোধী দলের অভিযোগের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমার ছেলের বউ নাকি ইহুদি। আমার ছেলের বউকে তারা ইহুদি বানিয়ে দিয়েছে। আসলে সে ইহুদি নয়, খ্রিস্টান। আমাদের আহলে কিতাব। অবশ্য ড. কামাল হোসেনের মেয়ের জামাই ইহুদি। তারা সম্ভবত ওটা বলতে গিয়ে আমার ছেলের বউয়ের কথা বলেছে' (দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ জুন, ২০১৩)। আসলে প্রধানমন্ত্রীর পুত্রবধূ খ্রিস্টান কিংবা কামাল হোসেনের জামাই ইহুদি কোনোটাই দোষের নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জিল (বাইবেল) আহলে কিতাব, তেমনি ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতও (ওল্ড টেস্টামেন্ট) আহলে কিতাব। ইসলামের বিধান অনুযায়ী আহলে কিতাবের অনুসারীদের বিয়েতে বাধা নেই। আর বাংলাদেশের আইনে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষ মানব-মানবীর বৈবাহিক বন্ধনের বিষয়টি কোনো অপরাধ নয়। একদা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক রাজনীতিক হুমায়ুন কবীরের বিয়ে কোন ধর্মমতে হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম সমাজ তাদের এ কারণে পরিহার করেনি, বরং তাদের নিয়ে গর্বিত। কালক্রমে নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় আসীন।
বারবার প্রশ্ন জাগে, এসব কি সংসদ বা রাজনীতির আলোচনার বিষয়বস্তু? দেশের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, উন্নয়ন, কল্যাণ কীভাবে হবে, কীভাবে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে_ তা নিয়ে তেমন কথা নেই। জনগণের অর্থে পরিচালিত সংসদে আর কত সময় ধরে কদর্যপূর্ণ অশ্লীল ব্যক্তিচরিত্র হনন আর সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা শুনতে হবে, সেটাই আজ বড় প্রশ্ন?
এ ধরনের অপসংস্কৃতি বন্ধ এবং সংসদ ও রাজনীতির মর্যাদা রক্ষায় সর্বাগ্রে প্রয়োজন উভয় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অঙ্গীকার। কেবল দু'চারজন সংসদ সদস্যকে দায়ী বা ভৎর্সনা করে এই অপসংস্কৃতির বলয় থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।
সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments