উপকূলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত, মানুষ পানিবন্দী
উপকূলীয় অঞ্চলে অস্বাভাবিক জোয়ারের
তা-বলীলা বুধবারও অব্যাহত ছিল। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে অনেক নতুন
নতুন এলাকা। জোয়ারের পাশাপাশি প্রবল বৃষ্টিতে প্লাবিত শতাধিক গ্রামের কয়েক
লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে।
একের পর এক বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে
পড়ছে। প্লাবিত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। হাজার
হাজার একর ফসলী জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি,
মসজিদ, শিক্ষা ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক
এলাকা। স্টাফ রিপোর্টার, নিজস্ব সংবাদদাতা, আবহাওয়া অধিদফতর ও পানি উন্নয়ন
বোর্ড সূত্রে উপকূলীয় অঞ্চলের এমন চিত্র পাওয়া গেছে। বুধবার দেশের প্রায় সব
বিভাগেই মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ হয়েছে। রাজধানীতেও দিনভর হাল্কা থেকে
মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হয়। দেশের তিন সমুদ্রবন্দরসমূহকে দেয়া তিন নম্বর
স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত বহাল রয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতারা জানান, অস্বাভাবিক জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পুরো আয়তন ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করতে আরও সময় লাগবে। কক্সবাজারের ৫০টি গ্রাম, বিশেষ করে মহেশখালীর ১০টি গ্রাম, ৮ শতাধিক ঘরবাড়ি, মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাজার হাজার একর লবণের মাঠ পানিতে তলিয়ে গেছে। আমতলীর ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে ১ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দী এবং তলিয়ে গেছে ৩০ হাজার একর ফসলী জমি। ভোলা জেলার ৭ উপজেলার লক্ষাধিক লোক পানিবন্দী অবস্থায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৪২টি গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, উড়িষ্যা এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে এখন মধ্যপ্রদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। মৌসুমী বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, লঘুচাপের কেন্দ্র, বিহার, গাঙ্গেত্রীয় পশ্চিমবঙ্গ অতঃপর উত্তর পূর্ব দিক হয়ে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল দিয়ে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল রয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল এবং সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে। সূত্র আরও জানায়, বুধবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকায় ৯ মিলিমিটার, ময়মনসিংহে ২ মিমি, টাঙ্গাইলে ২৮ মিমি, ফরিদপুরে ৮ মিমি, মাদারীপুরে ৫ মিমি, চট্টগ্রামে ১৯ মিমি, সন্দ্বীপে ৩৯ মিমি, রাঙ্গামাটিতে ৮ মিমি, কুমিল্লায় ১২ মিমি, চাঁদপুরে ৪০ মিমি, মাইজদীকোর্টে ৬ মিমি, ফেনীতে ৪৬ মিমি, হাতিয়ায় ৩২ মিমি, কক্সবাজারে ১৭ মিমি, কুতুবদিয়ায় ৩২ মিমি, টেকনাফে ২০ মিমি, সিলেটে ২০ মিমি, শ্রীমঙ্গলে ৩ মিমি, রাজশাহীতে ৬ মিমি, বগুড়ায় ৫ মিমি, রংপুরে ৩২ মিমি, দিনাজপুরে ১১ মিমি, সৈয়দপুরে ১২ মিমি, খুলনায় ৫ মিমি, সাতক্ষীরায় ৪ মিমি, যশোরে ২৩ মিমি, বরিশালে ১১ মিমি, পটুয়াখালীতে ২৬ মিমি, খেপুপাড়ায় ১৬ মিমি ও ভোলায় ২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বুধবার সন্ধ্যায় জানায়, যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা নদীর পানি বৃদ্ধি আগামী ৩ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। মঙ্গলবার দেশের ৭৩টি নদীর মধ্যে ৫৩টির পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, হ্রাস পেয়েছে ১৬টি নদীর পানি। তবে দেশের কোন নদীই এখন পর্যন্ত বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।
নিজস্ব সংবাদদাতা মহেশখালী থেকে জানান, প্রবল বর্ষণ ও পূর্ণিমার জোয়ারের পানিতে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ধলঘাটা ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। যে কোন মুহ’র্তে পুরো বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে দ্বীপটি সাগরের করাল গ্রাসে তলিয়ে যাবার আশংকা দেখা দিয়েছে। এলাকার হাজার হাজার মানুষ চরম আতঙ্কে রয়েছে।
জানা গেছে, জোয়ারের পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ধলঘাটার সর্বপশ্চিমে প্রায় ৩২ চেন বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে শরইতলা, ষাইটপাড়া, সুতরিয়া, বেগুনবনিয়া, প-িতের ডেইল, সাপমারার ডেইল, দক্ষিণ সুতরিয়া, সিকদারপাড়া, পানিরছড়া ও বৃহত্তর মহরী ঘোনাসহ অন্তত ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। আট শতাধিক ঘরবাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাজার হাজার একর লবণের মাঠ, ১২টি চিংড়িঘের, ৬২টি পুকুর ও সদ্য নির্মিত প্রধান সড়কের ৭ কিমি এলাকা সম্পূর্ণ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ওসব এলাকার লোকজন খোলা আকাশের নিচে এবং বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সরকারীভাবে এখনও কোন ধরনের ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছায়নি। সেখানে প্রচ- খাবার ও পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে ধলঘাটা ইউপি চেয়ারম্যান আহছান উল্লাহ বাচ্চু বলেন, দীর্ঘ এক যুগ ধরে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধটি জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট একাধিকবার আবেদন করে আসছি। এসব আবেদন কোন কাজে না আসায় আমি জনগনকে সঙ্গে নিযে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেড়িবাঁধটি সংস্কার করেছিলাম। কিন্তু গত দু’দিনের প্রবল বর্ষণ ও পূর্ণিমার জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফের বেড়িবাঁধটি পুনরায় ভেঙ্গে গিয়ে পুরো ধলঘাটা দ্বীপ প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনোয়ারুল নাসের বলেন, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ক্ষয়ক্ষতির যথাযথ তথ্য বিস্তারিতভাবে জানালে সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।
সংবাদদাতা আমতলী থেকে জানান, জোয়ারের কারণে পায়রা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪৯ সেন্টিমিটার বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। বুধবার আমতলী-তালতলীর ৩টি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে উপজেলার নিশানবাড়িয়া ও সোনাকাটা ইউনিয়নের ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ওই সব গ্রামের ১ হাজারের বেশি পরিবার ও ৩০ হাজার একর ফসলী জমি তলিয়ে গেছে। আমতলী ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে তলিয়ে বরগুনা জেলা সদরের সঙ্গে যান চলাচল সকাল থেকে ৩ ঘণ্টা বন্ধ ছিল।
এ ছাড়া বেরিবাঁধের বাইরে থাকা বড়বগী, ছোটবগী, পচাকোড়ালিয়া, চাওড়া ও গুলিশাখালীর ৫টি ইউনিয়ন ও আমতলী পৌরসভার আমুয়ার চরের ৬ শতাধিক পরিবার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা ভোলা থেকে জানান, ভোলায় ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধ সংস্কার না করায় জেলার ৭ উপজেলার লক্ষাধিক লোক পানিবন্দী অবস্থায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বুধবার সকালে সদরের ধনিয়া, বাপ্তা, কাচিয়া, ইলিশা ইউনিয়নের পানিবন্দী কয়েক হাজার মানুষ বেড়িবাঁধ ও ব্লকের দাবিতে বাস ভাংচুর, বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এ সময় ৮/১০ যাত্রী আহত হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা ভোলা-লক্ষ্মীপুর সড়কের ইলিশা পরানগঞ্জ এলাকার প্রায় ৩ কিলোমিটার রাস্তায় গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ করেছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। পরে দুপুর সাড়ে ১১টায় মেঘনার পাড়ে ব্লক বাঁধ নির্মাণের দাবিতে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে।
অপর দিকে দৌলতখান উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের ছোট ধলি, এসাক মোড়সহ ভবানীপুর, মদনপুর, ইউনিয়নে বিস্তীর্ণ এলাকা বহু মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাসান নগর, টবগী, বড় মানিকা ইউনিয়নের অন্তত ২২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, পাতিলা, কুকরী, সিকদার চর, মুজিব নগর ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রাম।
লালমোহন ও তজুমদ্দিন উপজেলায় ৪০টি গ্রামে পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। তজুমদ্দিন টু মঙ্গলসিকদার লালমোহন সড়কের ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্লাবিত হওয়ায় দুই উপজেলার যোগাযোগ ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়াও জেলার বিচ্ছিন্ন দুর্গম দ্বীপ উপজেলা মনপুরায় সাকুচিয়ার ইউনিয়নের তালতলা, চর জ্ঞান, হাজির হাট এলাকায় ভেঙ্গে যাওয়া বাধ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বহু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার ক্ষেতের ফসল, পানের বরজ, পুকুর ও ঘেরের মাছ, বাগানের গাছ পানিতে তলিযে গেছে। ভেঙ্গে গেছে রাস্তাঘাট। অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে মেঘনার তীরবর্তী হাজার হাজার বসতঘর।
নিজস্ব সংবাদদাতা কক্সবাজার থেকে জানান, জোয়ারের পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বুধবার রাতে কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় উপজেলা কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া ও টেকনাফের অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সেই সঙ্গে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলো আরও বিলীন হয়ে গেছে। বাঁধ ভেঙ্গে জেলার অন্তত ৬০টি চিংড়ি প্রকল্পের মাছ ভেসে গেছে সাগরে। বিশেষ করে কক্সবাজার সদরের কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া ও নাজিরার টেক শুঁটকি মহাল, খুরুস্কুল, চৌফলদ-ি, পোকখালী, ইসলামপুর, মহেশখালীর ধলঘাটা, কুতুবদিয়া ও টেকনাফে শাহপরী দ্বীপে বুধবার মধ্য রাতের জোয়ারের সময় আরও নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা বাঁশখালী থেকে জানান, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৪২টি গ্রামে অস্বাভাবিক জোয়ারে ল-ভ- অবস্থা। জোয়ার-ভাটার খেলায় জনজীবন বিপন্ন। আকস্মিক সামুদ্রিক এই জোয়ারে উপকূলবাসীদের জীবন-জীবিকা অস্থির হয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলে ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানি প্লাবিত হয়ে কমপক্ষে ৩ শতাধিক কাঁচা ঘর-বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। ওইসব অঞ্চলের হাট-বাজারগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ দিয়ে অস্বাভাবিক জোয়ারের সামুদ্রিক লোনা পানি হু হু করে ঢুকে পুকুর, ডোবা, ধানী-জমি, লোকালয় থৈ থৈ পানি। বসতভিটা ডুবে এবং রান্নাঘর পানিতে চুপসে মানুষের উনুনে আগুন দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল ও শীলকূপ ইউপি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক সিকদার মনকির চর নয়াঘোনা এলাকা প্লাবনের দৃশ্য পরিদর্শনকালে বলেন, অস্বাভাবিক জোয়ারের এলাকার জনজীবন ল-ভ- হয়ে গেছে। যা কল্পনা করা যাবে না। এই দুরবস্থা চলতে এতদঞ্চলে মানুষের বসবাস ভবিষ্যতে বন্ধ হয়ে যাবে। এই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বাঁশখালী খানখানাবাদ, বাহারছড়া, গ-ামারা, সরল, শীলকূপ, শেখেরখীল ও ছনুয়া ইউনিয়নের কমপক্ষে ৪২টি গ্রামে।
স্টাফ রিপোর্টার চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, দেশের অভ্যন্তরেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ। উত্তর বঙ্গোপসাগরে মওসুমী বায়ুর তীব্রতা ও লঘুচাপের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর এখনও প্রচ- উত্তাল। গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার কারণে উপকূলীয় এলাকা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কবলে। দ্বিতীয় দিনের মতো অব্যাহত রয়েছে সাগরের ফুঁসে ওঠা। জোয়ারের পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় শুধু উপকূলীয় এলাকা নয়, চট্টগ্রাম শহরের নিম্নাঞ্চলগুলোতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। আগ্রাবাদ, হালিশহর, চকবাজার, বাকলিয়া, চান্দগাঁওসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া বিভাগ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও মংলা সমুদ্র বন্দরকে ৩ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলেছে।
সাগরে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে দু‘দিন ধরে কোন ফিশিং বোট মাছ ধরার জন্য যাত্রা করেনি। এর আগে কিছু ফিশিং বোট সাগর থেকে ইলিশ ধরে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে উপকূলে ফিরে এসেছে। জেলেরা জানিয়েছেন, এ সময়ে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময় বঙ্গোপসাগরে পতিত মিঠা পানির নদীগুলোর মোহনায় ব্যাপকহারে ইলিশ ধরা পড়ে। দীর্ঘদিন ইলিশের আকালের পর এবার বর্ষার শুরুতে সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। কিন্তু সিগন্যালের কারণে অনেক মাছধরার নৌযান সাগরে যাত্রার সাহস পাচ্ছে না। তার পরও স্বল্পপাল্লায় কিছু নৌযান ফিশিং শুরু করেছে। অন্যদিকে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কর্ণফুলী নৌ চ্যানেলে অলস বসে আছে বহু লাইটার জাহাজ। বহির্নোঙ্গরেও স্রোতের কারণে লাইটার জাহাজগুলো মাদার ভেসেল থেকে পণ্য লাইটারিং করতে পারছে না। ফলে প্রভাব পড়েছে নিয়মিত লাইটারিং কাজে। নদী মোহনা ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় চট্টগ্রাম থেকে অভ্যন্তরীণ নৌরুটেও লাইটার জাহাজ চলাচল বন্ধ।
দীর্ঘ প্রায় পনেরো দিন খরায় দুরবস্থার পর বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেড়েছে চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকায়। খরার কারণে বিভিন্ন পুকুর এবং জমি শুকিয়ে যাওয়ায় এবার মৎস্য চাষে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। এখন তা কেটেছে। দু’দিন ধরে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। বৃষ্টির চেয়েও দুর্ভোগের কারণ ছিল জোয়ারের সময় নগরীতে জলাবদ্ধতা। কর্ণফুলী নদীর পানি জোয়ারের সময় উপচে পড়ে সংযুক্ত খালগুলোতে। এতে চাক্তাই, রাজাখালী, খাতুনগঞ্জ, চকবাজার, ডিসি রোড, চান্দগাঁও, মোহরা, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, হালিশহর, ডবলমুরিং, পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাগুলো দু‘তিন ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। এতে যানবাহন চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়। অবশ্য জোয়ার কেটে যাওয়ার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। লঘুচাপের প্রভাব ও মৌসুমী বায়ুর প্রবাহ সক্রিয় হয়ে ওঠায় বৃষ্টিপাতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে।
স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতারা জানান, অস্বাভাবিক জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পুরো আয়তন ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করতে আরও সময় লাগবে। কক্সবাজারের ৫০টি গ্রাম, বিশেষ করে মহেশখালীর ১০টি গ্রাম, ৮ শতাধিক ঘরবাড়ি, মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাজার হাজার একর লবণের মাঠ পানিতে তলিয়ে গেছে। আমতলীর ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে ১ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দী এবং তলিয়ে গেছে ৩০ হাজার একর ফসলী জমি। ভোলা জেলার ৭ উপজেলার লক্ষাধিক লোক পানিবন্দী অবস্থায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৪২টি গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, উড়িষ্যা এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে এখন মধ্যপ্রদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। মৌসুমী বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, লঘুচাপের কেন্দ্র, বিহার, গাঙ্গেত্রীয় পশ্চিমবঙ্গ অতঃপর উত্তর পূর্ব দিক হয়ে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল দিয়ে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল রয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল এবং সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে। সূত্র আরও জানায়, বুধবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকায় ৯ মিলিমিটার, ময়মনসিংহে ২ মিমি, টাঙ্গাইলে ২৮ মিমি, ফরিদপুরে ৮ মিমি, মাদারীপুরে ৫ মিমি, চট্টগ্রামে ১৯ মিমি, সন্দ্বীপে ৩৯ মিমি, রাঙ্গামাটিতে ৮ মিমি, কুমিল্লায় ১২ মিমি, চাঁদপুরে ৪০ মিমি, মাইজদীকোর্টে ৬ মিমি, ফেনীতে ৪৬ মিমি, হাতিয়ায় ৩২ মিমি, কক্সবাজারে ১৭ মিমি, কুতুবদিয়ায় ৩২ মিমি, টেকনাফে ২০ মিমি, সিলেটে ২০ মিমি, শ্রীমঙ্গলে ৩ মিমি, রাজশাহীতে ৬ মিমি, বগুড়ায় ৫ মিমি, রংপুরে ৩২ মিমি, দিনাজপুরে ১১ মিমি, সৈয়দপুরে ১২ মিমি, খুলনায় ৫ মিমি, সাতক্ষীরায় ৪ মিমি, যশোরে ২৩ মিমি, বরিশালে ১১ মিমি, পটুয়াখালীতে ২৬ মিমি, খেপুপাড়ায় ১৬ মিমি ও ভোলায় ২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বুধবার সন্ধ্যায় জানায়, যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা নদীর পানি বৃদ্ধি আগামী ৩ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। মঙ্গলবার দেশের ৭৩টি নদীর মধ্যে ৫৩টির পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, হ্রাস পেয়েছে ১৬টি নদীর পানি। তবে দেশের কোন নদীই এখন পর্যন্ত বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।
নিজস্ব সংবাদদাতা মহেশখালী থেকে জানান, প্রবল বর্ষণ ও পূর্ণিমার জোয়ারের পানিতে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ধলঘাটা ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। যে কোন মুহ’র্তে পুরো বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে দ্বীপটি সাগরের করাল গ্রাসে তলিয়ে যাবার আশংকা দেখা দিয়েছে। এলাকার হাজার হাজার মানুষ চরম আতঙ্কে রয়েছে।
জানা গেছে, জোয়ারের পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ধলঘাটার সর্বপশ্চিমে প্রায় ৩২ চেন বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে শরইতলা, ষাইটপাড়া, সুতরিয়া, বেগুনবনিয়া, প-িতের ডেইল, সাপমারার ডেইল, দক্ষিণ সুতরিয়া, সিকদারপাড়া, পানিরছড়া ও বৃহত্তর মহরী ঘোনাসহ অন্তত ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। আট শতাধিক ঘরবাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাজার হাজার একর লবণের মাঠ, ১২টি চিংড়িঘের, ৬২টি পুকুর ও সদ্য নির্মিত প্রধান সড়কের ৭ কিমি এলাকা সম্পূর্ণ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ওসব এলাকার লোকজন খোলা আকাশের নিচে এবং বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সরকারীভাবে এখনও কোন ধরনের ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছায়নি। সেখানে প্রচ- খাবার ও পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে ধলঘাটা ইউপি চেয়ারম্যান আহছান উল্লাহ বাচ্চু বলেন, দীর্ঘ এক যুগ ধরে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধটি জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট একাধিকবার আবেদন করে আসছি। এসব আবেদন কোন কাজে না আসায় আমি জনগনকে সঙ্গে নিযে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেড়িবাঁধটি সংস্কার করেছিলাম। কিন্তু গত দু’দিনের প্রবল বর্ষণ ও পূর্ণিমার জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফের বেড়িবাঁধটি পুনরায় ভেঙ্গে গিয়ে পুরো ধলঘাটা দ্বীপ প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনোয়ারুল নাসের বলেন, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ক্ষয়ক্ষতির যথাযথ তথ্য বিস্তারিতভাবে জানালে সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।
সংবাদদাতা আমতলী থেকে জানান, জোয়ারের কারণে পায়রা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪৯ সেন্টিমিটার বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। বুধবার আমতলী-তালতলীর ৩টি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে উপজেলার নিশানবাড়িয়া ও সোনাকাটা ইউনিয়নের ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ওই সব গ্রামের ১ হাজারের বেশি পরিবার ও ৩০ হাজার একর ফসলী জমি তলিয়ে গেছে। আমতলী ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে তলিয়ে বরগুনা জেলা সদরের সঙ্গে যান চলাচল সকাল থেকে ৩ ঘণ্টা বন্ধ ছিল।
এ ছাড়া বেরিবাঁধের বাইরে থাকা বড়বগী, ছোটবগী, পচাকোড়ালিয়া, চাওড়া ও গুলিশাখালীর ৫টি ইউনিয়ন ও আমতলী পৌরসভার আমুয়ার চরের ৬ শতাধিক পরিবার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা ভোলা থেকে জানান, ভোলায় ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধ সংস্কার না করায় জেলার ৭ উপজেলার লক্ষাধিক লোক পানিবন্দী অবস্থায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বুধবার সকালে সদরের ধনিয়া, বাপ্তা, কাচিয়া, ইলিশা ইউনিয়নের পানিবন্দী কয়েক হাজার মানুষ বেড়িবাঁধ ও ব্লকের দাবিতে বাস ভাংচুর, বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এ সময় ৮/১০ যাত্রী আহত হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা ভোলা-লক্ষ্মীপুর সড়কের ইলিশা পরানগঞ্জ এলাকার প্রায় ৩ কিলোমিটার রাস্তায় গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ করেছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। পরে দুপুর সাড়ে ১১টায় মেঘনার পাড়ে ব্লক বাঁধ নির্মাণের দাবিতে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে।
অপর দিকে দৌলতখান উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের ছোট ধলি, এসাক মোড়সহ ভবানীপুর, মদনপুর, ইউনিয়নে বিস্তীর্ণ এলাকা বহু মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাসান নগর, টবগী, বড় মানিকা ইউনিয়নের অন্তত ২২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, পাতিলা, কুকরী, সিকদার চর, মুজিব নগর ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রাম।
লালমোহন ও তজুমদ্দিন উপজেলায় ৪০টি গ্রামে পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। তজুমদ্দিন টু মঙ্গলসিকদার লালমোহন সড়কের ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্লাবিত হওয়ায় দুই উপজেলার যোগাযোগ ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়াও জেলার বিচ্ছিন্ন দুর্গম দ্বীপ উপজেলা মনপুরায় সাকুচিয়ার ইউনিয়নের তালতলা, চর জ্ঞান, হাজির হাট এলাকায় ভেঙ্গে যাওয়া বাধ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বহু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার ক্ষেতের ফসল, পানের বরজ, পুকুর ও ঘেরের মাছ, বাগানের গাছ পানিতে তলিযে গেছে। ভেঙ্গে গেছে রাস্তাঘাট। অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে মেঘনার তীরবর্তী হাজার হাজার বসতঘর।
নিজস্ব সংবাদদাতা কক্সবাজার থেকে জানান, জোয়ারের পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বুধবার রাতে কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় উপজেলা কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া ও টেকনাফের অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সেই সঙ্গে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলো আরও বিলীন হয়ে গেছে। বাঁধ ভেঙ্গে জেলার অন্তত ৬০টি চিংড়ি প্রকল্পের মাছ ভেসে গেছে সাগরে। বিশেষ করে কক্সবাজার সদরের কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া ও নাজিরার টেক শুঁটকি মহাল, খুরুস্কুল, চৌফলদ-ি, পোকখালী, ইসলামপুর, মহেশখালীর ধলঘাটা, কুতুবদিয়া ও টেকনাফে শাহপরী দ্বীপে বুধবার মধ্য রাতের জোয়ারের সময় আরও নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা বাঁশখালী থেকে জানান, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৪২টি গ্রামে অস্বাভাবিক জোয়ারে ল-ভ- অবস্থা। জোয়ার-ভাটার খেলায় জনজীবন বিপন্ন। আকস্মিক সামুদ্রিক এই জোয়ারে উপকূলবাসীদের জীবন-জীবিকা অস্থির হয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলে ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানি প্লাবিত হয়ে কমপক্ষে ৩ শতাধিক কাঁচা ঘর-বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। ওইসব অঞ্চলের হাট-বাজারগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ দিয়ে অস্বাভাবিক জোয়ারের সামুদ্রিক লোনা পানি হু হু করে ঢুকে পুকুর, ডোবা, ধানী-জমি, লোকালয় থৈ থৈ পানি। বসতভিটা ডুবে এবং রান্নাঘর পানিতে চুপসে মানুষের উনুনে আগুন দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল ও শীলকূপ ইউপি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক সিকদার মনকির চর নয়াঘোনা এলাকা প্লাবনের দৃশ্য পরিদর্শনকালে বলেন, অস্বাভাবিক জোয়ারের এলাকার জনজীবন ল-ভ- হয়ে গেছে। যা কল্পনা করা যাবে না। এই দুরবস্থা চলতে এতদঞ্চলে মানুষের বসবাস ভবিষ্যতে বন্ধ হয়ে যাবে। এই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বাঁশখালী খানখানাবাদ, বাহারছড়া, গ-ামারা, সরল, শীলকূপ, শেখেরখীল ও ছনুয়া ইউনিয়নের কমপক্ষে ৪২টি গ্রামে।
স্টাফ রিপোর্টার চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, দেশের অভ্যন্তরেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ। উত্তর বঙ্গোপসাগরে মওসুমী বায়ুর তীব্রতা ও লঘুচাপের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর এখনও প্রচ- উত্তাল। গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার কারণে উপকূলীয় এলাকা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কবলে। দ্বিতীয় দিনের মতো অব্যাহত রয়েছে সাগরের ফুঁসে ওঠা। জোয়ারের পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় শুধু উপকূলীয় এলাকা নয়, চট্টগ্রাম শহরের নিম্নাঞ্চলগুলোতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। আগ্রাবাদ, হালিশহর, চকবাজার, বাকলিয়া, চান্দগাঁওসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া বিভাগ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও মংলা সমুদ্র বন্দরকে ৩ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলেছে।
সাগরে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে দু‘দিন ধরে কোন ফিশিং বোট মাছ ধরার জন্য যাত্রা করেনি। এর আগে কিছু ফিশিং বোট সাগর থেকে ইলিশ ধরে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে উপকূলে ফিরে এসেছে। জেলেরা জানিয়েছেন, এ সময়ে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময় বঙ্গোপসাগরে পতিত মিঠা পানির নদীগুলোর মোহনায় ব্যাপকহারে ইলিশ ধরা পড়ে। দীর্ঘদিন ইলিশের আকালের পর এবার বর্ষার শুরুতে সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। কিন্তু সিগন্যালের কারণে অনেক মাছধরার নৌযান সাগরে যাত্রার সাহস পাচ্ছে না। তার পরও স্বল্পপাল্লায় কিছু নৌযান ফিশিং শুরু করেছে। অন্যদিকে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কর্ণফুলী নৌ চ্যানেলে অলস বসে আছে বহু লাইটার জাহাজ। বহির্নোঙ্গরেও স্রোতের কারণে লাইটার জাহাজগুলো মাদার ভেসেল থেকে পণ্য লাইটারিং করতে পারছে না। ফলে প্রভাব পড়েছে নিয়মিত লাইটারিং কাজে। নদী মোহনা ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় চট্টগ্রাম থেকে অভ্যন্তরীণ নৌরুটেও লাইটার জাহাজ চলাচল বন্ধ।
দীর্ঘ প্রায় পনেরো দিন খরায় দুরবস্থার পর বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেড়েছে চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকায়। খরার কারণে বিভিন্ন পুকুর এবং জমি শুকিয়ে যাওয়ায় এবার মৎস্য চাষে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। এখন তা কেটেছে। দু’দিন ধরে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। বৃষ্টির চেয়েও দুর্ভোগের কারণ ছিল জোয়ারের সময় নগরীতে জলাবদ্ধতা। কর্ণফুলী নদীর পানি জোয়ারের সময় উপচে পড়ে সংযুক্ত খালগুলোতে। এতে চাক্তাই, রাজাখালী, খাতুনগঞ্জ, চকবাজার, ডিসি রোড, চান্দগাঁও, মোহরা, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, হালিশহর, ডবলমুরিং, পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাগুলো দু‘তিন ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। এতে যানবাহন চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়। অবশ্য জোয়ার কেটে যাওয়ার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। লঘুচাপের প্রভাব ও মৌসুমী বায়ুর প্রবাহ সক্রিয় হয়ে ওঠায় বৃষ্টিপাতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে।
No comments