জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দুই সরকারের দুই ভিন্ন অবস্থান by মমতাজ পাটোয়ারী
আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী
লীগ এবং বিএনপির দলীয় অবস্থান মোটেও এক রকম নয়, দুই দলের সরকারের ভূমিকা
কখনও এক রকম ছিল না বা নেই। নিকট অতীতের আয়নায় তাকিয়ে এই পার্থক্যের ছবিটা
ভাল করে দেখে নিতে পারি।
যারা রাজনীতি, লেখালেখি অথবা
টকশোতে বলাবলি করেন-তাদের বেশির ভাগই দুই দলের মধ্যেকার দৃশ্যমান ও সূক্ষ্ম
পার্থক্যগুলোকে যথাযথভাবে তুলে ধরেন না, প্রায়শই এক করে চালিয়ে দেয়ার
চেষ্টা করে থাকেন। ফলে অর্জনের সম্ভাব্য ধারাটি নস্যাতের প্রবণতার সঙ্গে
বিলীন হয়ে যায়, রাজনীতি নিয়ে জনমানসে তারতম্য নির্ধারণের সংস্কৃতি গড়ে উঠতে
পারে না, হোঁচট খায়।
যে বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য উপরের ভূমিকাটি সংক্ষেপে লিখেছি তা এখন একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে। এ মুহূর্তে দেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিদিনই শুনতে পাচ্ছি। তাদের বক্তব্য শুনে ধারণা হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান মহাজোট সরকার ব্যাপক কারচুপি করার মাধ্যমে ক্ষমতায় আবার ফিরে আসার জন্য সংবিধানে থাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দিয়েছে। মনে হচ্ছে যে, এর ফলে নির্বাচনের সময় সরকারের প্রশাসন এবং দলীয় লোকজন প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে নৌকা মার্কায় সিল দিয়ে ভোট জালিয়াতি করতে দাঁড়িয়ে থাকবে। সেভাবেই তারা নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসবেই। সরকার সে রকম পরিবেশই ভোট কেন্দ্রে তৈরি করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতায় থাকতে চায়। এ ধরনের ধারণা দেয়ার মাধ্যমে যেটি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, তা হলো সরকার অসীম শক্তিশালী, সরকার যা খুশি তা করতে পারে, গণমানুষের রায়ও ছিনিয়ে নিতে পারে। হ্যাঁ, এমনটি ঘটেছিল ১৯৮৬ ও ৮৮ সালে, আরও ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে, ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে। কিন্তু ওইভাবে নির্বাচনের চেষ্টা করে কি ওইসব সরকার শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় যেতে পেরেছিল, বা স্বস্তিতে থাকতে পেরেছিল? ইতিহাস বলেÑ না, মোটেও পারেনি। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এরশাদ সরকার মিডিয়া ক্যু করে ‘জয়লাভ’ করেছিল, ১৯৮৮ সালে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ সৃষ্টি করার নির্বাচন করেছিল, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একদলীয় নির্বাচন করেছিল বিএনপি সরকার, ২০০৭ সালে তেমন নির্বাচন করতে গিয়ে ৪ দলীয় জোট দেশে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, শেষ পর্যন্ত দেশে অনাকাক্সিক্ষত এক-এগারোর ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। এখন বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে সব আশঙ্কার কথা বলে বেড়াচ্ছে, তার দুটোরই সংঘটক অনুঘটক বা ‘সৃষ্টিকর্তা’ তারা। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তেমন জোরজবরদস্তি করতে গিয়ে তারাই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। সুতরাং জোরজবরদস্তির জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়ে কেউ ক্ষমতায় যেতে না পারার এমন নিদারুণ উদাহরণ থাকতে সেভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার কথা যারা ভাবেন তারা বোধ হয় জনগণের ওপর আস্থা রাখার রাজনীতি কখনও শেখেননি। জনগণের চাইতে কোন দল বা সরকার কখনও বড় বা শক্তিশালী নয়Ñএটি বুঝতে বিশ্বাস করতে বা শিখতে হবে। গণতন্ত্রে জনগণই ক্ষমতায় যাওয়া, থাকা এবং না-থাকার সব চাইতে বড় শক্তি। জনগণের ভোট কোন দলের বা সরকারের প্রশাসন দিয়ে জালিয়াতি করে নেয়া সম্ভব, সেভাবে নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভবÑতা যারা এমনটি ভাবতে পারেÑ তারা ইতিহাসের চরম সত্যকে উপলব্ধি করতে দারুণভাবে অক্ষম। কোন বুদ্ধিমান রাজনৈতিক দল হলে সে রকম কোন নির্বাচন করিয়ে কোন দল ক্ষমতায় থাকতে বা ফিরে আসতে চাইলে তেমনটি করতে দিয়ে সেই দলকে জনগণের মুখোমুখি হতে দিতে মোটেও দেরি করত না। তাতে সেই দলের অপরাজনীতি চিরদিনের জন্য জনগণের কাছে উন্মোচিত হয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত। সে ক্ষেত্রে জনরোষের মুখে সেই দল বা সরকার এমনিতেই পড়ে রাজনৈতিকভাবে নিঃশেষিত হতে পারে। সুতরাং বিএনপি আগামী নির্বাচন নিয়ে যেসব আশঙ্কার কথা বলছে-তা বাস্তবে ঘটে কিনা, আওয়ামী লীগ তেমন ভোট কারচুপির কোন নির্বাচন করতে চায় কিনা তা করতে দিলে বিএনপির পক্ষে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করা খুব সহজ হতো। একটি হচ্ছে, জনগণ স্বচ্ছভাবে ভোট না দিতে পারলে গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিতে পারত, দুই আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সাধ এবং স্বাদ চিরদিনের জন্য মুছে যেতে পারত। তবে বিএনপি কেন-তা করতে চাচ্ছে না-তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে নিকট অতীতে আওয়ামী লীগের দুই শাসনামলে জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতায় টিকে থাকার মতো ধর ধর মার মার প্রস্তুতি বা হাবভাব আওয়ামী লীগের মধ্যে অতীতে দেখা যায়নি বা এখনও দেখা যাচ্ছে নাÑযেমনটি বিএনপির দুই আমলে প্রকাশ্যেই দেখা গেছে। আসুন একটু নিকট ইতিহাসের পাতা উল্টাই, স্মরণ করি কেমন ছিল তখন, কেমন দেখা যাচ্ছে এখন সবকিছু মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি, একই সঙ্গে বুঝে নিতে পারি পার্থক্যটা আদতেই কতটা বড়, নাকি এক রকমই-অর্থাৎ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ যা আমাদের রাজনীতির কোন কোন ‘বিজ্ঞজন’ প্রায়ই আমাদের শোনান। আসলে এসব ‘বিজ্ঞজনের’ কথা শোনার পর মিলিয়ে দেখা, সত্যাসত্য যাচাই করে দেখা বড় বেশি জরুরী হয়ে পড়েছে। নচেৎ বড্ড ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বিএনপি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। তাদের ওই আমলে অনুষ্ঠিত সব উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের খতিয়ান হাতে নিলে দেখা যাবে যে বিএনপি সরকার এবং এর অনুগত প্রশাসন নগ্নভাবে নির্বাচনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছিল। বরিশাল বা মাগুরার উপনির্বাচন থেকেই শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারণা জন্ম লাভ করেছিল। মনে পড়ে কী প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি রউফ বা সাদেক সাহেবের কথা? বিএনপি তখন সরকারে থেকে উভয় নির্বাচন কমিশনকে কতটা মেরুদ-াহীন এবং বিতর্কিত করেছিলÑ সোজা বাংলায় পচিয়েছিল তা স্মরণ করে দেখা দরকার। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সরকার থেকে বিএনপির চাপ ও জেদ ছিল একশত ভাগ, অন্যদিকে মেরুদ-হীন সাদেক আলীর নির্বাচন কমিশন ছিল আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান মাত্র। ফলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যা কিছু কলঙ্ক পড়েছিল তার সিংহভাগের দায় কিন্তু নিতে হবে তৎকালীন বিএনপি সরকারকে, বাকিটা নির্বাচন কমিশনের। জনগণ তেমন নির্বাচনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল পর পরই। বিএনপিকে সংসদ ভেঙ্গে দিতে হয়েছিল, পদত্যাগও করতে হয়েছিল। এরপর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, আবু হেনার নির্বাচন কমিশন এবং বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকায় ১৯৯৬ সালের ১২ জুন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে সেই নির্বাচন ভ-ুল করতে মহল বিশেষের গোপন ষড়যন্ত্র এবং কারসাজি ছিল যা তখন বিচারপতি হাবিবুর রহমান প্রজ্ঞার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পেরেছিলেন বলে নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠিত হতে পেরেছিল।
১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। বিএনপি আবু হেনা সাহেবকে দুষলেন তাদের পরাজয়ের কারণ হিসেবে। তাঁকে নির্বাচন কমিশন হিসেবে কাজ করতেই তারা দেয়নি। নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি দেশে একটা গভীর সঙ্কট তৈরি করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ সাবেক আমলা এম সাঈদকে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব দিলেন ১৯৯৬-২০০১ সালে অনুষ্ঠিত বেশির ভাগ নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছিল। দু’একটি নির্বাচন নিয়ে কিছু সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে ২০০১ সালে কোন ধরনের নীলনকশার নির্বাচন করানোর কোন পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের ছিল-তেমন অভিযোগ একবারও শোনা যায়নি। নির্বাচন কমিশন কমিশনের মতো করে কাজ করেছে, সরকার সরকারের জায়গায় অবস্থান করে ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও আওয়ামী লীগ সরকারের কোন বিশেষ কোন পরিকল্পনা ছিল বলে শোনা যায়নি। বরং বিচারপতি লতিফুর রহমান পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা পদে আসীন হয়ে বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য আগে থেকেই বেশকিছু হোমওয়ার্ক করে রেখেছিলেন যা বোঝা গেল লতিফুর রহমানের দায়িত্বভার গ্রহণের পর পরই। ১৯৯১-৯৬ সালের বিএনপি শাসনামলের সঙ্গে ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমের তুলনা করা হলে যে উল্টো চিত্রটি ফুটে ওঠে তাতে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের কোন তুলনাই করা চলে না। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে আওয়ামী লীগ বিষয়গুলোকে খুবই উদারভাবে দেখেছিল, অপরদিকে বিএনপি খুবই রক্ষণশীল, আক্রমণাত্মক এবং অস্থিরচিত্তের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সেগুলোকে নিতে দেখা গেছে। বিএনপির মধ্য জনগণের ওপর অনাস্থার, নির্ভর না করার লক্ষণ প্রবলভাবে দেখা গেছে, অপরদিকে আওয়ামী লীগ সহজ, সরল এবং উদারভাবে জনগণের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিল।
এরপর আসুন একেবারে নিকট অতীতের সঙ্গে বর্তমান সময়ের তুলনামূলক আলোচনায়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ৪ দলীয় জোট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে। এমএ সাঈদের নির্বাচন কমিশনকে অনেকটাই ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখা হয়েছিল, ঢাকা-১০ আসনে সিল মারার কেমন উপনির্বাচন করা হয়েছি-তা সবারই মনে থাকার কথা। চট্টগ্রাম মেয়র নির্বাচনে কিভাবে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ভোট কারচুপি করার চেষ্টা করা হয়েছিল তা সবারই মনে থাকার কথা। সারাদেশেই যেসব স্থানীয় সরকার এবং উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলোতে নির্বাচন কমিশনকে কিভাবে অকার্যকর করে রাখা হয়েছিলÑতা একটু স্মরণ করতে অনুরোধ করব। অবশেষে নির্বাচন কমিশন গঠন করার সময় এলে কীভাবে বিরোধী দলের মতামত গ্রহণকে উপেক্ষা করে বিচারপতি আজিজ ও মাহফুজদের নির্বাচন কমিশনে একের পর এক আনিয়ে বসিয়ে দেয়া হলোÑ তা সবার মনে থাকার কথা। অথচ এই বিএনপিই ১৯৯৬-২০০১ সময়ের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন গঠনসহ নানা কার্যক্রমকে কীভাবে সমালোচনা করেছিল, বাধাগ্রস্ত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ২০০৫-০৬ সালে জোট সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনকে তারাই একটি ভাঁড়ের আড্ডাখানায় পরিণত করেছিল, সিইসি আজিজ ছিলেন প্রতিদিনের রসাত্মক আলোচিত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, মাহফুজ, জাকারিয়াদের কর্মকা- নিয়ে তখন মিডিয়াই ব্যাপকভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠে। বোঝাই যাচ্ছিল যে, ৪ দলীয় জোট নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে একটি সিল মারা বা অনুমোদন দেয়ার নির্বাচন করিয়ে নিতে সচিবসহ সবাইকে বিভিন্ন জায়গায় বেছে বেছ বসিয়েছে, এরা সবাই জনগণের ভোট দেয়া না দেয়ার কোন তোয়াক্কা করার চেষ্টাই করেননি, তারা সবাই যে জামায়াত-বিএনপির আস্থাভাজন বিশেষ ব্যক্তি, সেভাবেই তারা কাজ করছিলেন। একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারটিও যাতে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে সে কারণে প্রথমে বিচারপতি কেএম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করতে চেয়েছিল বিএনপি। জানি না, তিনি ওই দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারলে শেষ পর্যন্ত তিনি কতটা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের মতো এমন দাসানুদাস সার্ভিস দিতেন, তবে যেহেতু বিরোধী দল বিচারপতি হাসানকে নিয়ে অতিমাত্রায় আস্থাহীনতা প্রকাশ করেছিল, তাই বিএনপি ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে চরম প্রতিশোধ নেয়ার মস্ত বড় নজির স্থাপন করে। ২০০৬ সালের নবেম্বর-ডিসেম্বর এবং ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের সেই সময়কার দিনগুলোর কথা মনে করা যেতে পারে, অথবা পত্রিকার পাতাগুলো উল্টিয়ে দেখে নেয়া যেতে পারে। সেটি অবশ্য সবার জন্য বেশ কষ্টকর কাজ। রূপ প্রকাশন থেকে ২০০৮ সালে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার শিরোনামে আমার লেখা ১৫৬ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। কষ্ট করে যে কেউ নেড়েচেড়ে দেখলে তৎকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশনের জোরজবরদস্তি নির্বাচনের চেষ্টা এর বিরুদ্ধে মহাজোটসহ সকল মহলের প্রতিবাদ, বিদেশী দাতা সংস্থা, সরকারদের উদ্বেগের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তারপরও ২২ জানুয়ারির ভোটহীন নির্বাচনের দিকে নির্বাচন কমিশন ও ইয়াজউদ্দিনের যৌথভাবে মহড়া দিয়ে এগিয়ে যাওয়াটি নিয়ে একটু ভেবে দেখুন তো সেই সব দিন ও ঘটনার কথা। বাঙালী অবশ্যই খুব দ্রুত অনেক কিছু ভুলে যায় এমন বদনাম আছে। এখন ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের শুরুতে ২০০২-২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত দেশের নির্বাচন চিত্রের কোন কি মিল আছে? এখন কি আজিজ-মাহফুজ-জাকারিয়াদের মতো নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশে কারও হাসি, উদ্বেগ, ক্ষোভ, ঘৃণা আর হতাশার কোন ঘটনা ঘটিয়েছে নির্বাচন কমিশন কি কোন নীলনকশার নির্বাচন করা ও ফল তৈরির মতো কোন কাজে লিপ্ত আছে এমন কোন অভিযোগ আছে কিনা? ২০০৭ সাল থেকেই নির্বাচন কমিশনের চেহারা পরিবর্তিত হতে থাকে। নতুন নির্বাচন গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগ কোন ধরনের বাড়াবাড়িতে যায়নি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের গঠিত একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে একটি কমিশন তালিকা উপস্থাপন করেছে যা নিয়ে কোন মহলেরই বড় ধরনের কোন অভিযোগ নেই। তারপরও বিএনপি বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে যা বলার মতো নৈতিক অবস্থান তাদের আছে কিনা প্রশ্ন করা যেতে পারে।
অন্যদিকে ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত যে সব স্থানীয় সরকার এবং উপনির্বাচন দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনটিতেই নির্বাচন কমিশনকে নিষ্ক্রিয় দেখা যায়নি বরং বেশ সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে, কোথাও প্রশাসন বা সরকারী দল প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছেÑএমনটি একবারও শোনা যায়নি। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তেমন কোন চেষ্টা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের দৃঢ় অবস্থানের ফলে স্থানীয় পর্যায়ে কেউ কিছু করার সাহস পায়নি। নারায়ণগঞ্জে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলÑকিছু একটা হবে। শেষ পর্যন্ত কোথাও মাগুরা বা ঢাকা-১০ আসনের সামান্যতম উদাহরণও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেশ কিছু উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন, জনগণ যাদের পছন্দ করেছে তারাই নির্বাচিত হয়েছেÑএতে কোন বাধার সৃষ্টি হয়নি। সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত বেশ ক’টি জনসভায় অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলেছেন, আগামী নির্বাচনে জনগণ যদি তার দলকে ভোট দেয় তিনি সরকার গঠন করবেন, ভোট না দিলে তিনি বিরোধী দলে যাবেন, জনগণের রায় মাথা পেতে মেনে নেবেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনেও তিনি স্পষ্টভাবে একই কথা বলেছেন। তাঁর এ কথা থেকে যেটি বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না যে, নির্বাচনে কারচুপি করার কোন ইচ্ছে তার দল বা সরকারের নেই। সরকারে থাকা অবস্থায় ১৯৯৬-২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে দল, সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেছে। ২০০৯ সাল থেকে সেই ধারাকে আরও সুদৃঢ় করার প্রমাণ রেখে আসছে আওয়ামী লীগ সরকার। দেশে এ ধারাটি বিএনপি সরকারের আমলে অব্যাহত থাকলে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হতে পারত। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি এবং জোট সরকারের সময় দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলুষিত করার সর্বোত চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা এবং জনগণের রায়ের প্রতি আস্থা স্থাপনের অবস্থান স্পষ্ট করেছেÑএতে কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। আওয়ামী লীগের নীতিগত অবস্থানটি অব্যাহত রাখা এবং এই ধারায় বিএনপির আসা ও অবস্থান নেয়ার কোন বিকল্প নেই।
যে বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য উপরের ভূমিকাটি সংক্ষেপে লিখেছি তা এখন একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে। এ মুহূর্তে দেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিদিনই শুনতে পাচ্ছি। তাদের বক্তব্য শুনে ধারণা হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান মহাজোট সরকার ব্যাপক কারচুপি করার মাধ্যমে ক্ষমতায় আবার ফিরে আসার জন্য সংবিধানে থাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দিয়েছে। মনে হচ্ছে যে, এর ফলে নির্বাচনের সময় সরকারের প্রশাসন এবং দলীয় লোকজন প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে নৌকা মার্কায় সিল দিয়ে ভোট জালিয়াতি করতে দাঁড়িয়ে থাকবে। সেভাবেই তারা নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসবেই। সরকার সে রকম পরিবেশই ভোট কেন্দ্রে তৈরি করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতায় থাকতে চায়। এ ধরনের ধারণা দেয়ার মাধ্যমে যেটি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, তা হলো সরকার অসীম শক্তিশালী, সরকার যা খুশি তা করতে পারে, গণমানুষের রায়ও ছিনিয়ে নিতে পারে। হ্যাঁ, এমনটি ঘটেছিল ১৯৮৬ ও ৮৮ সালে, আরও ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে, ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে। কিন্তু ওইভাবে নির্বাচনের চেষ্টা করে কি ওইসব সরকার শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় যেতে পেরেছিল, বা স্বস্তিতে থাকতে পেরেছিল? ইতিহাস বলেÑ না, মোটেও পারেনি। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এরশাদ সরকার মিডিয়া ক্যু করে ‘জয়লাভ’ করেছিল, ১৯৮৮ সালে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ সৃষ্টি করার নির্বাচন করেছিল, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একদলীয় নির্বাচন করেছিল বিএনপি সরকার, ২০০৭ সালে তেমন নির্বাচন করতে গিয়ে ৪ দলীয় জোট দেশে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, শেষ পর্যন্ত দেশে অনাকাক্সিক্ষত এক-এগারোর ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। এখন বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে সব আশঙ্কার কথা বলে বেড়াচ্ছে, তার দুটোরই সংঘটক অনুঘটক বা ‘সৃষ্টিকর্তা’ তারা। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তেমন জোরজবরদস্তি করতে গিয়ে তারাই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। সুতরাং জোরজবরদস্তির জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়ে কেউ ক্ষমতায় যেতে না পারার এমন নিদারুণ উদাহরণ থাকতে সেভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার কথা যারা ভাবেন তারা বোধ হয় জনগণের ওপর আস্থা রাখার রাজনীতি কখনও শেখেননি। জনগণের চাইতে কোন দল বা সরকার কখনও বড় বা শক্তিশালী নয়Ñএটি বুঝতে বিশ্বাস করতে বা শিখতে হবে। গণতন্ত্রে জনগণই ক্ষমতায় যাওয়া, থাকা এবং না-থাকার সব চাইতে বড় শক্তি। জনগণের ভোট কোন দলের বা সরকারের প্রশাসন দিয়ে জালিয়াতি করে নেয়া সম্ভব, সেভাবে নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভবÑতা যারা এমনটি ভাবতে পারেÑ তারা ইতিহাসের চরম সত্যকে উপলব্ধি করতে দারুণভাবে অক্ষম। কোন বুদ্ধিমান রাজনৈতিক দল হলে সে রকম কোন নির্বাচন করিয়ে কোন দল ক্ষমতায় থাকতে বা ফিরে আসতে চাইলে তেমনটি করতে দিয়ে সেই দলকে জনগণের মুখোমুখি হতে দিতে মোটেও দেরি করত না। তাতে সেই দলের অপরাজনীতি চিরদিনের জন্য জনগণের কাছে উন্মোচিত হয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত। সে ক্ষেত্রে জনরোষের মুখে সেই দল বা সরকার এমনিতেই পড়ে রাজনৈতিকভাবে নিঃশেষিত হতে পারে। সুতরাং বিএনপি আগামী নির্বাচন নিয়ে যেসব আশঙ্কার কথা বলছে-তা বাস্তবে ঘটে কিনা, আওয়ামী লীগ তেমন ভোট কারচুপির কোন নির্বাচন করতে চায় কিনা তা করতে দিলে বিএনপির পক্ষে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করা খুব সহজ হতো। একটি হচ্ছে, জনগণ স্বচ্ছভাবে ভোট না দিতে পারলে গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিতে পারত, দুই আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সাধ এবং স্বাদ চিরদিনের জন্য মুছে যেতে পারত। তবে বিএনপি কেন-তা করতে চাচ্ছে না-তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে নিকট অতীতে আওয়ামী লীগের দুই শাসনামলে জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতায় টিকে থাকার মতো ধর ধর মার মার প্রস্তুতি বা হাবভাব আওয়ামী লীগের মধ্যে অতীতে দেখা যায়নি বা এখনও দেখা যাচ্ছে নাÑযেমনটি বিএনপির দুই আমলে প্রকাশ্যেই দেখা গেছে। আসুন একটু নিকট ইতিহাসের পাতা উল্টাই, স্মরণ করি কেমন ছিল তখন, কেমন দেখা যাচ্ছে এখন সবকিছু মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি, একই সঙ্গে বুঝে নিতে পারি পার্থক্যটা আদতেই কতটা বড়, নাকি এক রকমই-অর্থাৎ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ যা আমাদের রাজনীতির কোন কোন ‘বিজ্ঞজন’ প্রায়ই আমাদের শোনান। আসলে এসব ‘বিজ্ঞজনের’ কথা শোনার পর মিলিয়ে দেখা, সত্যাসত্য যাচাই করে দেখা বড় বেশি জরুরী হয়ে পড়েছে। নচেৎ বড্ড ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বিএনপি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। তাদের ওই আমলে অনুষ্ঠিত সব উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের খতিয়ান হাতে নিলে দেখা যাবে যে বিএনপি সরকার এবং এর অনুগত প্রশাসন নগ্নভাবে নির্বাচনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছিল। বরিশাল বা মাগুরার উপনির্বাচন থেকেই শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারণা জন্ম লাভ করেছিল। মনে পড়ে কী প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি রউফ বা সাদেক সাহেবের কথা? বিএনপি তখন সরকারে থেকে উভয় নির্বাচন কমিশনকে কতটা মেরুদ-াহীন এবং বিতর্কিত করেছিলÑ সোজা বাংলায় পচিয়েছিল তা স্মরণ করে দেখা দরকার। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সরকার থেকে বিএনপির চাপ ও জেদ ছিল একশত ভাগ, অন্যদিকে মেরুদ-হীন সাদেক আলীর নির্বাচন কমিশন ছিল আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান মাত্র। ফলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যা কিছু কলঙ্ক পড়েছিল তার সিংহভাগের দায় কিন্তু নিতে হবে তৎকালীন বিএনপি সরকারকে, বাকিটা নির্বাচন কমিশনের। জনগণ তেমন নির্বাচনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল পর পরই। বিএনপিকে সংসদ ভেঙ্গে দিতে হয়েছিল, পদত্যাগও করতে হয়েছিল। এরপর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, আবু হেনার নির্বাচন কমিশন এবং বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকায় ১৯৯৬ সালের ১২ জুন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে সেই নির্বাচন ভ-ুল করতে মহল বিশেষের গোপন ষড়যন্ত্র এবং কারসাজি ছিল যা তখন বিচারপতি হাবিবুর রহমান প্রজ্ঞার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পেরেছিলেন বলে নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠিত হতে পেরেছিল।
১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। বিএনপি আবু হেনা সাহেবকে দুষলেন তাদের পরাজয়ের কারণ হিসেবে। তাঁকে নির্বাচন কমিশন হিসেবে কাজ করতেই তারা দেয়নি। নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি দেশে একটা গভীর সঙ্কট তৈরি করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ সাবেক আমলা এম সাঈদকে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব দিলেন ১৯৯৬-২০০১ সালে অনুষ্ঠিত বেশির ভাগ নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছিল। দু’একটি নির্বাচন নিয়ে কিছু সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে ২০০১ সালে কোন ধরনের নীলনকশার নির্বাচন করানোর কোন পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের ছিল-তেমন অভিযোগ একবারও শোনা যায়নি। নির্বাচন কমিশন কমিশনের মতো করে কাজ করেছে, সরকার সরকারের জায়গায় অবস্থান করে ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও আওয়ামী লীগ সরকারের কোন বিশেষ কোন পরিকল্পনা ছিল বলে শোনা যায়নি। বরং বিচারপতি লতিফুর রহমান পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা পদে আসীন হয়ে বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য আগে থেকেই বেশকিছু হোমওয়ার্ক করে রেখেছিলেন যা বোঝা গেল লতিফুর রহমানের দায়িত্বভার গ্রহণের পর পরই। ১৯৯১-৯৬ সালের বিএনপি শাসনামলের সঙ্গে ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমের তুলনা করা হলে যে উল্টো চিত্রটি ফুটে ওঠে তাতে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের কোন তুলনাই করা চলে না। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে আওয়ামী লীগ বিষয়গুলোকে খুবই উদারভাবে দেখেছিল, অপরদিকে বিএনপি খুবই রক্ষণশীল, আক্রমণাত্মক এবং অস্থিরচিত্তের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সেগুলোকে নিতে দেখা গেছে। বিএনপির মধ্য জনগণের ওপর অনাস্থার, নির্ভর না করার লক্ষণ প্রবলভাবে দেখা গেছে, অপরদিকে আওয়ামী লীগ সহজ, সরল এবং উদারভাবে জনগণের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিল।
এরপর আসুন একেবারে নিকট অতীতের সঙ্গে বর্তমান সময়ের তুলনামূলক আলোচনায়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ৪ দলীয় জোট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে। এমএ সাঈদের নির্বাচন কমিশনকে অনেকটাই ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখা হয়েছিল, ঢাকা-১০ আসনে সিল মারার কেমন উপনির্বাচন করা হয়েছি-তা সবারই মনে থাকার কথা। চট্টগ্রাম মেয়র নির্বাচনে কিভাবে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ভোট কারচুপি করার চেষ্টা করা হয়েছিল তা সবারই মনে থাকার কথা। সারাদেশেই যেসব স্থানীয় সরকার এবং উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলোতে নির্বাচন কমিশনকে কিভাবে অকার্যকর করে রাখা হয়েছিলÑতা একটু স্মরণ করতে অনুরোধ করব। অবশেষে নির্বাচন কমিশন গঠন করার সময় এলে কীভাবে বিরোধী দলের মতামত গ্রহণকে উপেক্ষা করে বিচারপতি আজিজ ও মাহফুজদের নির্বাচন কমিশনে একের পর এক আনিয়ে বসিয়ে দেয়া হলোÑ তা সবার মনে থাকার কথা। অথচ এই বিএনপিই ১৯৯৬-২০০১ সময়ের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন গঠনসহ নানা কার্যক্রমকে কীভাবে সমালোচনা করেছিল, বাধাগ্রস্ত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ২০০৫-০৬ সালে জোট সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনকে তারাই একটি ভাঁড়ের আড্ডাখানায় পরিণত করেছিল, সিইসি আজিজ ছিলেন প্রতিদিনের রসাত্মক আলোচিত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, মাহফুজ, জাকারিয়াদের কর্মকা- নিয়ে তখন মিডিয়াই ব্যাপকভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠে। বোঝাই যাচ্ছিল যে, ৪ দলীয় জোট নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে একটি সিল মারা বা অনুমোদন দেয়ার নির্বাচন করিয়ে নিতে সচিবসহ সবাইকে বিভিন্ন জায়গায় বেছে বেছ বসিয়েছে, এরা সবাই জনগণের ভোট দেয়া না দেয়ার কোন তোয়াক্কা করার চেষ্টাই করেননি, তারা সবাই যে জামায়াত-বিএনপির আস্থাভাজন বিশেষ ব্যক্তি, সেভাবেই তারা কাজ করছিলেন। একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারটিও যাতে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে সে কারণে প্রথমে বিচারপতি কেএম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করতে চেয়েছিল বিএনপি। জানি না, তিনি ওই দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারলে শেষ পর্যন্ত তিনি কতটা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের মতো এমন দাসানুদাস সার্ভিস দিতেন, তবে যেহেতু বিরোধী দল বিচারপতি হাসানকে নিয়ে অতিমাত্রায় আস্থাহীনতা প্রকাশ করেছিল, তাই বিএনপি ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে চরম প্রতিশোধ নেয়ার মস্ত বড় নজির স্থাপন করে। ২০০৬ সালের নবেম্বর-ডিসেম্বর এবং ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের সেই সময়কার দিনগুলোর কথা মনে করা যেতে পারে, অথবা পত্রিকার পাতাগুলো উল্টিয়ে দেখে নেয়া যেতে পারে। সেটি অবশ্য সবার জন্য বেশ কষ্টকর কাজ। রূপ প্রকাশন থেকে ২০০৮ সালে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার শিরোনামে আমার লেখা ১৫৬ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। কষ্ট করে যে কেউ নেড়েচেড়ে দেখলে তৎকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশনের জোরজবরদস্তি নির্বাচনের চেষ্টা এর বিরুদ্ধে মহাজোটসহ সকল মহলের প্রতিবাদ, বিদেশী দাতা সংস্থা, সরকারদের উদ্বেগের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তারপরও ২২ জানুয়ারির ভোটহীন নির্বাচনের দিকে নির্বাচন কমিশন ও ইয়াজউদ্দিনের যৌথভাবে মহড়া দিয়ে এগিয়ে যাওয়াটি নিয়ে একটু ভেবে দেখুন তো সেই সব দিন ও ঘটনার কথা। বাঙালী অবশ্যই খুব দ্রুত অনেক কিছু ভুলে যায় এমন বদনাম আছে। এখন ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের শুরুতে ২০০২-২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত দেশের নির্বাচন চিত্রের কোন কি মিল আছে? এখন কি আজিজ-মাহফুজ-জাকারিয়াদের মতো নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশে কারও হাসি, উদ্বেগ, ক্ষোভ, ঘৃণা আর হতাশার কোন ঘটনা ঘটিয়েছে নির্বাচন কমিশন কি কোন নীলনকশার নির্বাচন করা ও ফল তৈরির মতো কোন কাজে লিপ্ত আছে এমন কোন অভিযোগ আছে কিনা? ২০০৭ সাল থেকেই নির্বাচন কমিশনের চেহারা পরিবর্তিত হতে থাকে। নতুন নির্বাচন গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগ কোন ধরনের বাড়াবাড়িতে যায়নি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের গঠিত একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে একটি কমিশন তালিকা উপস্থাপন করেছে যা নিয়ে কোন মহলেরই বড় ধরনের কোন অভিযোগ নেই। তারপরও বিএনপি বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে যা বলার মতো নৈতিক অবস্থান তাদের আছে কিনা প্রশ্ন করা যেতে পারে।
অন্যদিকে ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত যে সব স্থানীয় সরকার এবং উপনির্বাচন দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনটিতেই নির্বাচন কমিশনকে নিষ্ক্রিয় দেখা যায়নি বরং বেশ সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে, কোথাও প্রশাসন বা সরকারী দল প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছেÑএমনটি একবারও শোনা যায়নি। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তেমন কোন চেষ্টা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের দৃঢ় অবস্থানের ফলে স্থানীয় পর্যায়ে কেউ কিছু করার সাহস পায়নি। নারায়ণগঞ্জে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলÑকিছু একটা হবে। শেষ পর্যন্ত কোথাও মাগুরা বা ঢাকা-১০ আসনের সামান্যতম উদাহরণও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেশ কিছু উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন, জনগণ যাদের পছন্দ করেছে তারাই নির্বাচিত হয়েছেÑএতে কোন বাধার সৃষ্টি হয়নি। সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত বেশ ক’টি জনসভায় অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলেছেন, আগামী নির্বাচনে জনগণ যদি তার দলকে ভোট দেয় তিনি সরকার গঠন করবেন, ভোট না দিলে তিনি বিরোধী দলে যাবেন, জনগণের রায় মাথা পেতে মেনে নেবেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনেও তিনি স্পষ্টভাবে একই কথা বলেছেন। তাঁর এ কথা থেকে যেটি বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না যে, নির্বাচনে কারচুপি করার কোন ইচ্ছে তার দল বা সরকারের নেই। সরকারে থাকা অবস্থায় ১৯৯৬-২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে দল, সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেছে। ২০০৯ সাল থেকে সেই ধারাকে আরও সুদৃঢ় করার প্রমাণ রেখে আসছে আওয়ামী লীগ সরকার। দেশে এ ধারাটি বিএনপি সরকারের আমলে অব্যাহত থাকলে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হতে পারত। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি এবং জোট সরকারের সময় দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলুষিত করার সর্বোত চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা এবং জনগণের রায়ের প্রতি আস্থা স্থাপনের অবস্থান স্পষ্ট করেছেÑএতে কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। আওয়ামী লীগের নীতিগত অবস্থানটি অব্যাহত রাখা এবং এই ধারায় বিএনপির আসা ও অবস্থান নেয়ার কোন বিকল্প নেই।
No comments