স্মরণ-একজন সৃজনশীল ব্যাংকারের স্মরণে by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
২৪ জুন ২০১৩ সকাল সাড়ে ৮টায় না ফেরার দেশে
চলে গেলেন সৃজনশীল ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকার। যখন ব্যাংকিং পেশা ছিল
অবাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে এবং শিক্ষিত বাঙালিরাও যখন ব্যাংকিং পেশা গ্রহণে
আগ্রহী ছিলেন না,
এমনি এক সময়ে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের
দশকের মধ্যভাগে করাচির হাবিব ব্যাংক লিমিটেডে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে
যোগদান করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বাঙালি তরুণ
লুৎফর রহমান সরকার। অল্পকালের মধ্যেই তার আগমন জানিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাংকিং
অঙ্গনে। ষাটের দশকের মধ্য ভাগে গিয়ে হাবিব ব্যাংক ছেড়ে নবগঠিত
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে উচ্চপদে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর
মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এবং অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক
একত্রিত হয়ে রূপালী ব্যাংকের সঙ্গে মিলিত হলে জনাব সরকার রূপালী ব্যাংকের
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার নিযুক্ত হন। সত্তরের দশকের শেষার্ধে ১৯৭৬ সালে
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে তিনি অগ্রণী
ব্যাংকে যোগদান করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই সরকার তাকে পদোন্নতি দিয়ে সোনালী
ব্যাংকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিযুক্ত করে। তার পেশাগত আচরণে সরকার বিরক্ত
হয়। জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার তাকে পদচ্যুত করে কারাগারে প্রেরণ করে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে মূল্যায়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর
হিসেবে নিয়োগদান করে। গভর্নর হওয়ার আগে তিনি ব্যক্তি খাতের ইসলামী ব্যাংক
এবং প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রধান উপদেষ্টাও হয়েছিলেন তিনি। এই হলো সংক্ষেপে
তার কর্ম অঙ্গন।
পেশাজীবনের প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন সৃজনশীল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা পুনর্গঠনে তার অবদান ছিল যথেষ্ট। সদ্য স্বাধীন দেশে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ছিল না। ভারতের ব্যাংকিং প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা দেখে এসে দেশের জন্য একটি প্রশিক্ষণ রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিলাম আমরা কয়েকজন তরুণ ব্যাংকার। এদের মধ্যে লুৎফর রহমান সরকারও ছিলেন। রূপরেখা অনুযায়ী বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) প্রতিষ্ঠিত হলে আমিই প্রথম ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। লুৎফর রহমান সরকারও কয়েক মাস প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
দ্রুত সম্প্রসারণশীল ব্যাংক ব্যবস্থার জন্য প্রতিটি ব্যাংকে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ছিলাম আমি। টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ছিলেন আইএমএফ মনোনীত ড. এসএস কুলকার্নি। এ উদ্যোগে সাড়া দিয়ে প্রথমেই রূপালী ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছিলেন লূৎফর রহমান সরকার। জনতা ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছিলেন শামসুদ্দিন আহমেদ এবং অগ্রণী ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছিলেন খোন্দকার এ এ মাহতাব উদ্দিন।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশকালীন সময়ে ছাত্রদের স্বল্পকালীন কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখেছিলেন লুৎফর রহমান সরকার। চিন্তাটি তার মস্তিষ্কপ্রসূত। রূপরেখা প্রণয়ন করে ঊধৎহ যিরষব ুড়ঁ ষবধৎহ নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছিলাম আমি। এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম প্রচলন করা হয়েছিল।
ব্যাংকিং সেক্টরে সর্বপ্রথম অগ্রণী ব্যাংকে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা বিভাগ স্থাপন করেছিলেন জনাব সরকার। আমি নবগঠিত বিভাগের প্রথম পরিচালক ছিলাম। বছরে পাঁচ থেকে দশটি পর্যন্ত প্রায়োগিক গবেষণা সম্পাদন করা হতো। প্রতিটি গবেষণার টিম লিডার থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। টিমে দলভুক্ত থাকতেন ৪-৫ জন তরুণ মেধাবী ব্যাংকার। লুৎফর রহমান সরকারের সহায়তা ও সমর্থন ছাড়া এটি সম্ভব হতো না। তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে সোনালী ব্যাংকে চলে যাওয়ার পর গবেষণা প্রকল্পটি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং প্রায়োগিক গবেষণা এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়।
জনাব সরকার বাংলাদেশে প্রথম ইনল্যান্ড ট্রাভেলার চেক এবং উপহার চেক প্রবর্তন করেন। কম্পিউটার তথা প্রযুক্তি ব্যবহার সম্প্রসারণে তার অসামান্য অবদান ছিল। পল্লী অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণেও তিনি ছিলেন অগ্রপথিক।
সোনালী ব্যাংকে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য 'বিকল্প' প্রকল্প উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন শুরু করেন। এ প্রকল্পের আওতায় অনেক ডেন্টাল ক্লিনিক, চিকিৎসা কেন্দ্র, ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং ট্যাক্সি ক্যাব চালু করেছিল শিক্ষিত যুবকরা। শুধু সরকারি দলের ছাত্রদের এই ঋণ সুবিধা দিতে সম্মত না হওয়ায় তিনি রাজরোষে পতিত হন। জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার তাকে সামরিক আইনে 'শাস্তি' দিয়ে জেলে প্রেরণ করে। দীর্ঘদিন জেল খেটে বেরিয়ে আসার পর দেখা হলে তিনি বলেছিলেন, 'জেলে না গেলে একটি অধ্যায় অজানা থেকে যেত।' তিনি কয়েদিদের গল্পচ্ছলে জ্ঞানদান করতেন। সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'অনেক কয়েদিই আসলে ভালো মানুষ। কখনও ভুল করেছে, কখনও আবার সুবিচার পায়নি। কেউ আবার ভাড়া খাটছে অর্থাৎ জেল হয়েছে অন্যজনের, তার বদলে অর্থের বিনিময়ে জেল খাটছে আরেকজন!' এমন অনেক অভিজ্ঞতার কথা তিনি শুনিয়েছিলেন জেল থেকে বেরিয়ে।
লুৎফর রহমান সরকার শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিজ্ঞাপন দিয়ে কত লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশে সাহায্য করেছেন তার হিসাব নেই। এসব লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা যথেষ্টই হতো। কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তার সখ্যও ছিল উল্লেখ করার মতো। তিনি নিজেও একজন সাহিত্যিক ছিলেন। সম্ভবত 'সূর্যের সাত রং' তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। তার লেখা 'জীবন যখন যেমন' বইটিও সমাদৃত হয়েছিল। রম্য রচনায় তার মুন্সিয়ানা ফুটে উঠত। কৌতুকের মধ্য দিয়ে জীবনবোধ প্রকাশে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি ছড়াও লিখতেন। শিশুদের জন্য ছড়া এবং গল্প রচনায় তার বেশ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।
লুৎফর রহমান সরকার প্রশিক্ষণ ক্লাসে এবং মজলিসে গল্প শোনাতে পছন্দ করতেন। প্রতিটি গল্পেরই অন্তর্নিহিত অর্থ থাকত। 'এ্যসপস্ ফেবলস্' গ্রন্থে যেমন গল্পের পরে একটি নীতিবাক্য সংযোজিত থাকত, তার গল্প বলার ধারাটি অনেকটা সেরকম। দু'একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বর্তমান শিক্ষকদের বিদ্যার ঘাটতির কথা বলতে গিয়ে তিনি এই গল্পটি বলেছিলেন : ইন্সপেক্টর ক্লাসে ঢুকে ছাত্রদের প্রশ্ন করলেন, চীনের প্রাচীর কে ভেঙেছে? কেউ উত্তর দিচ্ছে না দেখে ইন্সপেক্টর একজন ছাত্রের দিকে ইশারা করে বললেন, তুমি বলো। ছেলেটি দাঁড়িয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, 'স্যার, আমি ভাঙিনি।' তারপর ইন্সপেক্টর ক্লাস টিচারের দিকে তাকালেন। ক্লাস টিচার বললেন, 'স্যার, ও খুব ভালো ছেলে, ও ভাঙতেই পারে না।'
আরেকদিন জনাব সরকার পেশাগত দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে মানবিকতার মানসিকতা গড়ে তোলার বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। স্বভাবসঞ্জাত কৌতুকবোধের প্রকাশ ঘটিয়ে 'ভালো মানুষ' হওয়ার বিষয়ে তিনি বলছিলেন : 'একটি পুত্রের জন্ম হলো ভালোভাবে। ভালোভাবেই বেড়ে উঠল সে। একটি ভালো স্কুলে ভর্তি হলো। ভালোভাবে পড়াশোনা করতে লাগল। পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু সে বোঝে না। বিপদে কারও পাশে দাঁড়ায় না। কাউকে সাহায্যও করে না। সান্ত্বনাও দেয় না। সে ভালোভাবে পাস করল। ভালো চাকরি পেল। ভালো বিয়ে করল। ভালোভাবে অবসর গ্রহণ করল। ভালোভাবে বৃদ্ধ হলো। তারপর একদিন ভালোভাবে মৃত্যুবরণ করল। সমাজে এমন ভালো মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকলে, ব্যক্তি ভালো থাকবে, সমাজ উপকৃত হবে না।'
না, তিনি তেমন ভালো মানুষ সাজেননি। তিনি মানুষের সঙ্গে থেকেছেন। মানুষকে নিয়ে বেঁচেছেন। মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তাই তার মৃত্যুতে আমরা একজন মানুষ হারিয়েছি। একজন স্বজন হারিয়েছি। করুণাময় সৃষ্টিকর্তা পরকালে তাকে শান্তিনিবাস দান করুন।
সাবেক ডেপুটি গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক
পেশাজীবনের প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন সৃজনশীল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা পুনর্গঠনে তার অবদান ছিল যথেষ্ট। সদ্য স্বাধীন দেশে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ছিল না। ভারতের ব্যাংকিং প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা দেখে এসে দেশের জন্য একটি প্রশিক্ষণ রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিলাম আমরা কয়েকজন তরুণ ব্যাংকার। এদের মধ্যে লুৎফর রহমান সরকারও ছিলেন। রূপরেখা অনুযায়ী বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) প্রতিষ্ঠিত হলে আমিই প্রথম ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। লুৎফর রহমান সরকারও কয়েক মাস প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
দ্রুত সম্প্রসারণশীল ব্যাংক ব্যবস্থার জন্য প্রতিটি ব্যাংকে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ছিলাম আমি। টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ছিলেন আইএমএফ মনোনীত ড. এসএস কুলকার্নি। এ উদ্যোগে সাড়া দিয়ে প্রথমেই রূপালী ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছিলেন লূৎফর রহমান সরকার। জনতা ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছিলেন শামসুদ্দিন আহমেদ এবং অগ্রণী ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছিলেন খোন্দকার এ এ মাহতাব উদ্দিন।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশকালীন সময়ে ছাত্রদের স্বল্পকালীন কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখেছিলেন লুৎফর রহমান সরকার। চিন্তাটি তার মস্তিষ্কপ্রসূত। রূপরেখা প্রণয়ন করে ঊধৎহ যিরষব ুড়ঁ ষবধৎহ নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছিলাম আমি। এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম প্রচলন করা হয়েছিল।
ব্যাংকিং সেক্টরে সর্বপ্রথম অগ্রণী ব্যাংকে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা বিভাগ স্থাপন করেছিলেন জনাব সরকার। আমি নবগঠিত বিভাগের প্রথম পরিচালক ছিলাম। বছরে পাঁচ থেকে দশটি পর্যন্ত প্রায়োগিক গবেষণা সম্পাদন করা হতো। প্রতিটি গবেষণার টিম লিডার থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। টিমে দলভুক্ত থাকতেন ৪-৫ জন তরুণ মেধাবী ব্যাংকার। লুৎফর রহমান সরকারের সহায়তা ও সমর্থন ছাড়া এটি সম্ভব হতো না। তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে সোনালী ব্যাংকে চলে যাওয়ার পর গবেষণা প্রকল্পটি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং প্রায়োগিক গবেষণা এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়।
জনাব সরকার বাংলাদেশে প্রথম ইনল্যান্ড ট্রাভেলার চেক এবং উপহার চেক প্রবর্তন করেন। কম্পিউটার তথা প্রযুক্তি ব্যবহার সম্প্রসারণে তার অসামান্য অবদান ছিল। পল্লী অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণেও তিনি ছিলেন অগ্রপথিক।
সোনালী ব্যাংকে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য 'বিকল্প' প্রকল্প উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন শুরু করেন। এ প্রকল্পের আওতায় অনেক ডেন্টাল ক্লিনিক, চিকিৎসা কেন্দ্র, ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং ট্যাক্সি ক্যাব চালু করেছিল শিক্ষিত যুবকরা। শুধু সরকারি দলের ছাত্রদের এই ঋণ সুবিধা দিতে সম্মত না হওয়ায় তিনি রাজরোষে পতিত হন। জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার তাকে সামরিক আইনে 'শাস্তি' দিয়ে জেলে প্রেরণ করে। দীর্ঘদিন জেল খেটে বেরিয়ে আসার পর দেখা হলে তিনি বলেছিলেন, 'জেলে না গেলে একটি অধ্যায় অজানা থেকে যেত।' তিনি কয়েদিদের গল্পচ্ছলে জ্ঞানদান করতেন। সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'অনেক কয়েদিই আসলে ভালো মানুষ। কখনও ভুল করেছে, কখনও আবার সুবিচার পায়নি। কেউ আবার ভাড়া খাটছে অর্থাৎ জেল হয়েছে অন্যজনের, তার বদলে অর্থের বিনিময়ে জেল খাটছে আরেকজন!' এমন অনেক অভিজ্ঞতার কথা তিনি শুনিয়েছিলেন জেল থেকে বেরিয়ে।
লুৎফর রহমান সরকার শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিজ্ঞাপন দিয়ে কত লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশে সাহায্য করেছেন তার হিসাব নেই। এসব লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা যথেষ্টই হতো। কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তার সখ্যও ছিল উল্লেখ করার মতো। তিনি নিজেও একজন সাহিত্যিক ছিলেন। সম্ভবত 'সূর্যের সাত রং' তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। তার লেখা 'জীবন যখন যেমন' বইটিও সমাদৃত হয়েছিল। রম্য রচনায় তার মুন্সিয়ানা ফুটে উঠত। কৌতুকের মধ্য দিয়ে জীবনবোধ প্রকাশে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি ছড়াও লিখতেন। শিশুদের জন্য ছড়া এবং গল্প রচনায় তার বেশ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।
লুৎফর রহমান সরকার প্রশিক্ষণ ক্লাসে এবং মজলিসে গল্প শোনাতে পছন্দ করতেন। প্রতিটি গল্পেরই অন্তর্নিহিত অর্থ থাকত। 'এ্যসপস্ ফেবলস্' গ্রন্থে যেমন গল্পের পরে একটি নীতিবাক্য সংযোজিত থাকত, তার গল্প বলার ধারাটি অনেকটা সেরকম। দু'একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বর্তমান শিক্ষকদের বিদ্যার ঘাটতির কথা বলতে গিয়ে তিনি এই গল্পটি বলেছিলেন : ইন্সপেক্টর ক্লাসে ঢুকে ছাত্রদের প্রশ্ন করলেন, চীনের প্রাচীর কে ভেঙেছে? কেউ উত্তর দিচ্ছে না দেখে ইন্সপেক্টর একজন ছাত্রের দিকে ইশারা করে বললেন, তুমি বলো। ছেলেটি দাঁড়িয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, 'স্যার, আমি ভাঙিনি।' তারপর ইন্সপেক্টর ক্লাস টিচারের দিকে তাকালেন। ক্লাস টিচার বললেন, 'স্যার, ও খুব ভালো ছেলে, ও ভাঙতেই পারে না।'
আরেকদিন জনাব সরকার পেশাগত দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে মানবিকতার মানসিকতা গড়ে তোলার বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। স্বভাবসঞ্জাত কৌতুকবোধের প্রকাশ ঘটিয়ে 'ভালো মানুষ' হওয়ার বিষয়ে তিনি বলছিলেন : 'একটি পুত্রের জন্ম হলো ভালোভাবে। ভালোভাবেই বেড়ে উঠল সে। একটি ভালো স্কুলে ভর্তি হলো। ভালোভাবে পড়াশোনা করতে লাগল। পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু সে বোঝে না। বিপদে কারও পাশে দাঁড়ায় না। কাউকে সাহায্যও করে না। সান্ত্বনাও দেয় না। সে ভালোভাবে পাস করল। ভালো চাকরি পেল। ভালো বিয়ে করল। ভালোভাবে অবসর গ্রহণ করল। ভালোভাবে বৃদ্ধ হলো। তারপর একদিন ভালোভাবে মৃত্যুবরণ করল। সমাজে এমন ভালো মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকলে, ব্যক্তি ভালো থাকবে, সমাজ উপকৃত হবে না।'
না, তিনি তেমন ভালো মানুষ সাজেননি। তিনি মানুষের সঙ্গে থেকেছেন। মানুষকে নিয়ে বেঁচেছেন। মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তাই তার মৃত্যুতে আমরা একজন মানুষ হারিয়েছি। একজন স্বজন হারিয়েছি। করুণাময় সৃষ্টিকর্তা পরকালে তাকে শান্তিনিবাস দান করুন।
সাবেক ডেপুটি গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক
No comments