সাদাকালো-আত্মহননের বদলে রুখে দাঁড়াতে হবে by আহমদ রফিক
ঘটনাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ঘটছে। সংবাদপত্রে
ঘটনার বিবরণ পড়ে পাঠকমাত্রই উদ্বিগ্ন। ভাবনা কী হলো সমাজের, যে একের পর এক
ঘটনা নির্বিবাদে ঘটছে আর আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে আমরা সভ্য মানুষ পদবাচ্য
নই। ঘটনা আর কিছু নয়, নানামাত্রিক নারী নির্যাতন।
তার
মধ্যে যৌন নির্যাতনই সর্বাধিক। তার পরই রয়েছে যৌতুকের দায়ে গৃহবধূ
নির্যাতন এবং হত্যা। শেষোক্ত বিষয় নিয়ে শতবর্ষেরও আগে রবীন্দ্রনাথ
যৌতুকপ্রথার মতো সাধারণ বিষয় নিয়ে একটি অসাধারণ গল্প লিখেছিলেন, নাম
'দেনাপাওনা'। শাশুড়ির নির্মম অত্যাচারে পুত্রবধূর মৃত্যুর পর পুত্রকে তার
মা জানাচ্ছেন:
এর চেয়েও নিষ্ঠুরভাবে বধূ হত্যার ঘটনা যে হারে কাগজে প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে এমন সিদ্ধান্তই সঠিক হবে যে শতবর্ষ-উত্তর আধুনিকতা আমাদের মনুষ্যত্ববোধের কোনো শিক্ষাই দিতে পারেনি। পেরেছে জীবিকা ও অর্থ উপার্জনের শিক্ষা দিতে। সমাজের একটি অংশ সম্পর্কে কথাগুলো খুব খাটে। এদের সংখ্যা যতটা গ্রামে, তার চেয়ে কম নয় গঞ্জ বা শহরে কিংবা বৃহত্তর রাজধানী নামক মহানগরে। অথচ দেশে আইন আছে, বিচারব্যবস্থা আছে, শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, তবু এসব ঘটনা নিয়মিত ঘটে চলছে।
কিন্তু সংখ্যায় এর চেয়ে অনেক বেশি ঘটছে যৌন নির্যাতন- গৃহবধূ, তরুণী, কিশোরী, এমনকি শিশুও এ বর্বরতার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। পাঁচ বছরের শিশু- ভাবতে পারা যায়; যৌন নির্যাতনের শিকার, পরিণামে প্রায়ই মৃত্যু! এ তো মৃত্যু নয়, হত্যা। কথাটা আগেও বলেছি, এবারও বলি- সংবাদপত্র ঘটনার প্রাথমিক বিবরণ ছেপেই খালাস। ঘটনার 'ফলোআপ' বড় একটা দেখা যায় না। মানুষ জানতে পারে না, অপরাধীর কী শাস্তি হলো। আদৌ হলো কি না, নাকি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেকসুর খালাস।
যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই হবে, আইনে যদি তেমন ব্যবস্থাই থাকবে, তাহলে এসব বর্বরতার এত পুনরাবৃত্তি ঘটত না। আজকের (২৪ জুন, ২০১৩) একটি দৈনিকের শিরোনাম : 'রাগ ক্ষোভ অভিমানে আত্মহনন'- 'সলঙ্গার সুমি খাতুন ও বরগুনার সাবনুর'। খবরে প্রকাশ, 'সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার এক প্রত্যন্ত পল্লীতে ধর্ষণের শিকার এক হতদরিদ্র কিশোরী লোকলজ্জায় আত্মহননের পথ বেছে নিল। তাঁতশ্রমিক মা-বাবার অনুপস্থিতিতে সম্ভ্রম হারানোর পর শনিবার দুপুরে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।'
সম্প্রতি এ ধরনের আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের সমাজ এখনো এতটা অনাধুনিক যে সব লজ্জা লাঞ্ছিতার, অন্যায় যে করে তার নয়। স্বভাবতই সচেতনতার অভাবে লাঞ্ছিতা রুখে দাঁড়ানোর বদলে আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে অপরাধীকে আরো অন্যায়ের পথ ধরতে সাহায্য করে। আরো চমৎকার যে সমাজ প্রায়ই লাঞ্ছিতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, যেন অপরাধ তার। যদি লাঞ্ছিতা দরিদ্র পরিবারের, অন্যদিকে অপরাধী সচ্ছল পরিবারের হয় তাহলে তো কথাই নেই- সমাজ তখন সচ্ছলের পক্ষে।
একই ধরনের ঘটনা বরগুনার সাবনুরের ক্ষেত্রেও। মাদ্রাসার ছাত্রী (অষ্টম শ্রেণীর) সাবনুর এলাকার বখাটে, নেশাখোর ইমরানের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। গত কয়েক মাসের দৈনিক পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। যেন এটা সমাজের স্বাভাবিক চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজ যে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তার প্রমাণ মিলবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত কয়েকটি ঘটনার উল্লেখে। সব ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশ পায় না নানা কারণে। যেমন লোকলজ্জার ভয়ে, লোক জানাজানিতে ভবিষ্যৎ জীবন নষ্ট হওয়ার ভয়ে, সমাজে পারিবারিক সম্ভ্রম নষ্ট হওয়ার আশাঙ্কা ইত্যাদি কারণে। কখনো দেখা যায়, 'ধর্ষণের মামলা করায়' উল্টো 'ছাত্রীর পরিবার সমাজচ্যুত' এ ঘটনা সোনারগাঁয়।
তবু সাংবাদিকের অনুসন্ধানী কর্তব্যের দায়ে কিছু ঘটনা প্রকাশ পায়। পায় ক্ষুব্ধ অভিভাবকের অভিযোগের কারণে। তাই দেখা যায়, খবরে প্রকাশ: 'কুমিল্লায় স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণ, দুই যুবক গ্রেপ্তার', 'রায়পুরে ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মাদ্রাসায় যেতে পারছে না।' অবস্থা এমনই। এর কারণ অপরাধী রাজনৈতিক দলের (যুবদলের) প্রতাপশালী স্থানীয় নেতা।
অন্য আরেকটি খবরে প্রকাশ : 'ধর্মান্তর ও ধর্ষণের শিকার মেধাবী স্কুলছাত্রী- দুই মাস পর উদ্ধার'। গাজীপুর (টঙ্গীর) এ মেধাবী 'এ-প্লাস' পাওয়া ছাত্রীর কপালে এমন দুর্ভোগও লেখা ছিল? এবং প্রশাসনেরও দুই মাস লেগে গেল তাকে উদ্ধার করতে? এ বর্বরতা ঘটানো 'অপহরণকারীদের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ'- খবরে এমনটাই সাংবাদিকের প্রতিবেদনে প্রকাশ।
এখানেই শেষ নয়, আরেকটি অবিশ্বাস্য ঘটনা : 'খিলগাঁওয়ের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ/আসামির পক্ষ নিয়েছে পুলিশ।' সংবাদে প্রকাশ- স্কুলে যাওয়ার পথে এক ছাত্রীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে খুনের আসামি ও রাজধানীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর ছেলে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। কিন্তু ঘটনার ১৩ দিন পরও একমাত্র আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
দূরগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী নারায়ণগঞ্জই বা বাদ যাবে কেন? 'দুই কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ'। 'ফতুল্লায় গত রবিবার রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে তুলে নিয়ে এক কিশোরীকে গণধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে। ওই কিশোরী পোশাক কারখানায় কাজ করে। অন্যদিকে জেলার আড়াইহাজারে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আরেক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।'
আমাদের প্রশ্ন, সমাজটা কী এতই পচে গেছে যে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে উপস্থিত এত লোকের মধ্য দিয়ে কিশোরীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা কিভাবে ঘটতে পারে? আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনার শিরোনাম : 'শিবচরে গৃহবধূকে ধর্ষণ করে ভিডিও চিত্র প্রচার।' অবশ্য এ ক্ষেত্রে 'ধর্ষক গ্রেপ্তার'।
এর পরও আমরা দেখছি এ বিষয়ে একাধিক খবর যা বিশ্বাস করতে বড় কষ্ট হয়। যেমন 'রংপুরে সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা। লাশ পুঁতে রাখা হয় মেঝেতে'। 'ধর্ষণ চেষ্টার শিকার ছাত্রীকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত!' এ ঘটনা সাতক্ষীরার। 'ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আপত্তিকর ভিডিওচিত্র এলাকায় ছড়িয়েছে দুই বখাটে যুবক।'
আরো কিছু খবর। বোধহয় আর না উল্লেখ করাই ভালো। কারণ পাঠকের জন্য এই 'ধর্ষণ বিচিত্রা' অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। যেমন 'আশুলিয়ায় শিশু ধর্ষণের শিকার, যুবক গ্রেপ্তার'। কিশোরগঞ্জে 'ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে গৃহবধূর বাড়িতে আগুন'। গফরগাঁওয়ে 'ধর্ষকের বিচার চেয়ে থানায় মামলা ঠুকলেন তরুণী'। সাভারে 'পোশাকশ্রমিক ধর্ষণের শিকার'। 'মংলায় তরুণীকে পাঁচ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ'। দেখা যাচ্ছে, পোশাককর্মীরাই ধর্ষণের সহজ শিকার।
গত কয়েক মাসের বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে কেটে রাখা খবরের ফাইলে আরো অনেক অনুরূপ ঘটনার বিবরণ রয়েছে। এসব ঘটনার উল্লেখের উদ্দেশ্য পাঠকদের বলতে যে যৌন নির্যাতন নামক ব্যাধি বাংলাদেশে মনে হয় মহামারির আকার ধারণ করেছে। এ সামাজিক ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ আশু দরকার। আর লক্ষণীয় যে এ ব্যাধি সুদূর রংপুর থেকে কক্সবাজার, খুলনা-সাতক্ষীরা থেকে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর-আশুলিয়া থেকে রাজধানী ঢাকার মতো কোনো এলাকা এ ব্যাধি থেকে মুক্ত নয়। আমরা এতদাবস্থায় অন্ধ হয়ে প্রলয় দেখতে থাকব?
কী এর প্রতিকার। সমাজকে ব্যাধিমুক্ত করার? এর আগেও আমরা লিখেছি, এ জন্য দরকার অপরাধীর কঠোর শাস্তির বিধান এবং সে বিধানের সুপ্রয়োগ। কিন্তু লাঞ্ছিতাদের আত্মহননের কাফেলা সত্ত্বেও জরুরি হিসেবে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর যেটা দরকার সে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হলো সমাজ সংস্কার ও সমাজকে তার দায়দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা। এ দায়িত্ব সবার।
কিন্তু এ বিষয়ে কোনো দিকেই আমাদের কোনো প্রকার আন্তরিক প্রয়াস দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি একুশ শতকের আধুনিক বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের পাপ চলতেই থাকবে? আধুনিক চেতনা সেদিকে ফিরে তাকাবে না, তাকাবার দায় অনুভব করবে না? তার চেয়েও বড় কথা লাঞ্ছিতাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, যাতে ওরা হীনম্মন্যতায় না ভুগে আত্মহননের বদলে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা পায়, তেমন বলিষ্ঠ মানসিকতা অর্জন করে। আত্মহনন সমস্যার সমাধান নয়। এ সত্য অনুধাবন সমাজে নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর এ বিষয়ে সক্রিয় হওয়া জরুরি।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
এর চেয়েও নিষ্ঠুরভাবে বধূ হত্যার ঘটনা যে হারে কাগজে প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে এমন সিদ্ধান্তই সঠিক হবে যে শতবর্ষ-উত্তর আধুনিকতা আমাদের মনুষ্যত্ববোধের কোনো শিক্ষাই দিতে পারেনি। পেরেছে জীবিকা ও অর্থ উপার্জনের শিক্ষা দিতে। সমাজের একটি অংশ সম্পর্কে কথাগুলো খুব খাটে। এদের সংখ্যা যতটা গ্রামে, তার চেয়ে কম নয় গঞ্জ বা শহরে কিংবা বৃহত্তর রাজধানী নামক মহানগরে। অথচ দেশে আইন আছে, বিচারব্যবস্থা আছে, শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, তবু এসব ঘটনা নিয়মিত ঘটে চলছে।
কিন্তু সংখ্যায় এর চেয়ে অনেক বেশি ঘটছে যৌন নির্যাতন- গৃহবধূ, তরুণী, কিশোরী, এমনকি শিশুও এ বর্বরতার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। পাঁচ বছরের শিশু- ভাবতে পারা যায়; যৌন নির্যাতনের শিকার, পরিণামে প্রায়ই মৃত্যু! এ তো মৃত্যু নয়, হত্যা। কথাটা আগেও বলেছি, এবারও বলি- সংবাদপত্র ঘটনার প্রাথমিক বিবরণ ছেপেই খালাস। ঘটনার 'ফলোআপ' বড় একটা দেখা যায় না। মানুষ জানতে পারে না, অপরাধীর কী শাস্তি হলো। আদৌ হলো কি না, নাকি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেকসুর খালাস।
যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই হবে, আইনে যদি তেমন ব্যবস্থাই থাকবে, তাহলে এসব বর্বরতার এত পুনরাবৃত্তি ঘটত না। আজকের (২৪ জুন, ২০১৩) একটি দৈনিকের শিরোনাম : 'রাগ ক্ষোভ অভিমানে আত্মহনন'- 'সলঙ্গার সুমি খাতুন ও বরগুনার সাবনুর'। খবরে প্রকাশ, 'সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার এক প্রত্যন্ত পল্লীতে ধর্ষণের শিকার এক হতদরিদ্র কিশোরী লোকলজ্জায় আত্মহননের পথ বেছে নিল। তাঁতশ্রমিক মা-বাবার অনুপস্থিতিতে সম্ভ্রম হারানোর পর শনিবার দুপুরে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।'
সম্প্রতি এ ধরনের আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের সমাজ এখনো এতটা অনাধুনিক যে সব লজ্জা লাঞ্ছিতার, অন্যায় যে করে তার নয়। স্বভাবতই সচেতনতার অভাবে লাঞ্ছিতা রুখে দাঁড়ানোর বদলে আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে অপরাধীকে আরো অন্যায়ের পথ ধরতে সাহায্য করে। আরো চমৎকার যে সমাজ প্রায়ই লাঞ্ছিতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, যেন অপরাধ তার। যদি লাঞ্ছিতা দরিদ্র পরিবারের, অন্যদিকে অপরাধী সচ্ছল পরিবারের হয় তাহলে তো কথাই নেই- সমাজ তখন সচ্ছলের পক্ষে।
একই ধরনের ঘটনা বরগুনার সাবনুরের ক্ষেত্রেও। মাদ্রাসার ছাত্রী (অষ্টম শ্রেণীর) সাবনুর এলাকার বখাটে, নেশাখোর ইমরানের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। গত কয়েক মাসের দৈনিক পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। যেন এটা সমাজের স্বাভাবিক চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজ যে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তার প্রমাণ মিলবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত কয়েকটি ঘটনার উল্লেখে। সব ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশ পায় না নানা কারণে। যেমন লোকলজ্জার ভয়ে, লোক জানাজানিতে ভবিষ্যৎ জীবন নষ্ট হওয়ার ভয়ে, সমাজে পারিবারিক সম্ভ্রম নষ্ট হওয়ার আশাঙ্কা ইত্যাদি কারণে। কখনো দেখা যায়, 'ধর্ষণের মামলা করায়' উল্টো 'ছাত্রীর পরিবার সমাজচ্যুত' এ ঘটনা সোনারগাঁয়।
তবু সাংবাদিকের অনুসন্ধানী কর্তব্যের দায়ে কিছু ঘটনা প্রকাশ পায়। পায় ক্ষুব্ধ অভিভাবকের অভিযোগের কারণে। তাই দেখা যায়, খবরে প্রকাশ: 'কুমিল্লায় স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণ, দুই যুবক গ্রেপ্তার', 'রায়পুরে ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মাদ্রাসায় যেতে পারছে না।' অবস্থা এমনই। এর কারণ অপরাধী রাজনৈতিক দলের (যুবদলের) প্রতাপশালী স্থানীয় নেতা।
অন্য আরেকটি খবরে প্রকাশ : 'ধর্মান্তর ও ধর্ষণের শিকার মেধাবী স্কুলছাত্রী- দুই মাস পর উদ্ধার'। গাজীপুর (টঙ্গীর) এ মেধাবী 'এ-প্লাস' পাওয়া ছাত্রীর কপালে এমন দুর্ভোগও লেখা ছিল? এবং প্রশাসনেরও দুই মাস লেগে গেল তাকে উদ্ধার করতে? এ বর্বরতা ঘটানো 'অপহরণকারীদের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ'- খবরে এমনটাই সাংবাদিকের প্রতিবেদনে প্রকাশ।
এখানেই শেষ নয়, আরেকটি অবিশ্বাস্য ঘটনা : 'খিলগাঁওয়ের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ/আসামির পক্ষ নিয়েছে পুলিশ।' সংবাদে প্রকাশ- স্কুলে যাওয়ার পথে এক ছাত্রীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে খুনের আসামি ও রাজধানীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর ছেলে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। কিন্তু ঘটনার ১৩ দিন পরও একমাত্র আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
দূরগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী নারায়ণগঞ্জই বা বাদ যাবে কেন? 'দুই কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ'। 'ফতুল্লায় গত রবিবার রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে তুলে নিয়ে এক কিশোরীকে গণধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে। ওই কিশোরী পোশাক কারখানায় কাজ করে। অন্যদিকে জেলার আড়াইহাজারে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আরেক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।'
আমাদের প্রশ্ন, সমাজটা কী এতই পচে গেছে যে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে উপস্থিত এত লোকের মধ্য দিয়ে কিশোরীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা কিভাবে ঘটতে পারে? আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনার শিরোনাম : 'শিবচরে গৃহবধূকে ধর্ষণ করে ভিডিও চিত্র প্রচার।' অবশ্য এ ক্ষেত্রে 'ধর্ষক গ্রেপ্তার'।
এর পরও আমরা দেখছি এ বিষয়ে একাধিক খবর যা বিশ্বাস করতে বড় কষ্ট হয়। যেমন 'রংপুরে সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা। লাশ পুঁতে রাখা হয় মেঝেতে'। 'ধর্ষণ চেষ্টার শিকার ছাত্রীকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত!' এ ঘটনা সাতক্ষীরার। 'ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আপত্তিকর ভিডিওচিত্র এলাকায় ছড়িয়েছে দুই বখাটে যুবক।'
আরো কিছু খবর। বোধহয় আর না উল্লেখ করাই ভালো। কারণ পাঠকের জন্য এই 'ধর্ষণ বিচিত্রা' অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। যেমন 'আশুলিয়ায় শিশু ধর্ষণের শিকার, যুবক গ্রেপ্তার'। কিশোরগঞ্জে 'ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে গৃহবধূর বাড়িতে আগুন'। গফরগাঁওয়ে 'ধর্ষকের বিচার চেয়ে থানায় মামলা ঠুকলেন তরুণী'। সাভারে 'পোশাকশ্রমিক ধর্ষণের শিকার'। 'মংলায় তরুণীকে পাঁচ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ'। দেখা যাচ্ছে, পোশাককর্মীরাই ধর্ষণের সহজ শিকার।
গত কয়েক মাসের বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে কেটে রাখা খবরের ফাইলে আরো অনেক অনুরূপ ঘটনার বিবরণ রয়েছে। এসব ঘটনার উল্লেখের উদ্দেশ্য পাঠকদের বলতে যে যৌন নির্যাতন নামক ব্যাধি বাংলাদেশে মনে হয় মহামারির আকার ধারণ করেছে। এ সামাজিক ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ আশু দরকার। আর লক্ষণীয় যে এ ব্যাধি সুদূর রংপুর থেকে কক্সবাজার, খুলনা-সাতক্ষীরা থেকে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর-আশুলিয়া থেকে রাজধানী ঢাকার মতো কোনো এলাকা এ ব্যাধি থেকে মুক্ত নয়। আমরা এতদাবস্থায় অন্ধ হয়ে প্রলয় দেখতে থাকব?
কী এর প্রতিকার। সমাজকে ব্যাধিমুক্ত করার? এর আগেও আমরা লিখেছি, এ জন্য দরকার অপরাধীর কঠোর শাস্তির বিধান এবং সে বিধানের সুপ্রয়োগ। কিন্তু লাঞ্ছিতাদের আত্মহননের কাফেলা সত্ত্বেও জরুরি হিসেবে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর যেটা দরকার সে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হলো সমাজ সংস্কার ও সমাজকে তার দায়দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা। এ দায়িত্ব সবার।
কিন্তু এ বিষয়ে কোনো দিকেই আমাদের কোনো প্রকার আন্তরিক প্রয়াস দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি একুশ শতকের আধুনিক বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের পাপ চলতেই থাকবে? আধুনিক চেতনা সেদিকে ফিরে তাকাবে না, তাকাবার দায় অনুভব করবে না? তার চেয়েও বড় কথা লাঞ্ছিতাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, যাতে ওরা হীনম্মন্যতায় না ভুগে আত্মহননের বদলে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা পায়, তেমন বলিষ্ঠ মানসিকতা অর্জন করে। আত্মহনন সমস্যার সমাধান নয়। এ সত্য অনুধাবন সমাজে নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর এ বিষয়ে সক্রিয় হওয়া জরুরি।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
No comments