মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর এবং খালেদা জিয়ার অবস্থান by আহমদ আশিকুল হামিদ
বাংলাদেশ সফরে আগত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
রাজনীতিবিষয়ক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি আর শেরমেনও যথারীতি হরতাল ও
সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য রেখে গেছেন। সোচ্চার হয়েছেন।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারি সংলাপে অংশ নেয়ার জন্য ২৬ মে ঢাকায় পা
রেখেই তাকে হরতালের মুখে পড়তে হয়েছিল।
সে কারণে নিজের
বিরক্তি, ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেননি তিনি। এই প্রতিক্রিয়া
থেকে প্রথমে তিনি বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে
পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছেন। বলেছেন, হরতালের কারণে ‘শিডিউল
বিপর্যয়’! ঘটেছে বলেই তাকে বৈঠকটি বাতিল করতে হয়েছে। পরদিন ২৭ মে অনুষ্ঠিত
এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের মনোভাব আরও স্পষ্ট করেছেন মিজ শেরমেন।
হরতালসহ রাজনৈতিক সহিংসতার তীব্র বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র ও
অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই সহিংসতার বৃত্ত থেকে
বেরিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সঙ্কট যে রয়েছে সে সত্যও স্বীকার করেছেন
তিনি। বলেছেন, অন্যসব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের জনগণকেই সঙ্কট
উত্তরণের পথ খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু সহিংসতার পথে নয়, সব দলের অংশগ্রহণে
অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে হবে।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের কল্যাণ এবং দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চান বলেই মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহিংসতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার এবং গণতন্ত্রসম্মত পন্থায় সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পরামর্শ দিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে কথাও উঠেছে তার এ পরামর্শ এবং প্রাসঙ্গিক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। কথা ওঠার প্রধান কারণ হলো, তিনি শুধু একতরফাভাবে সহিংসতার কথাই বলেছেন, এর পেছনে সক্রিয় কারণ তথা ক্ষমতাসীনদের উস্কানি ও কর্মকাণ্ডের দিকগুলো সম্পূর্ণ রূপে এড়িয়ে গেছেন। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের রাজনীতিবিষয়ক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি, সেহেতু ধরে নেয়া যায়, সহিংসতার প্রকৃত কারণ সম্পর্কেও বিস্তারিতই জানা রয়েছে তার। বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল পালনের আহ্বান যে মাঝে-মধ্যেই জানানো হয় এবং হরতাল যে পালিতও হয় সে কথাটাও তিনি নিশ্চয়ই জানেন। তা সত্ত্বেও একদিকে তিনি ‘শিডিউল বিপর্যয়ের’ অজুহাত দেখিয়ে দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে সরকারের জন্য প্লাস পয়েন্ট যোগাড় করে দিয়েছেন, অন্যদিকে সহিংসতার অভিযোগও এমনভাবেই হাজির করেছেন, যা শুনে মনে হতে পারে যেন সহিংস কর্মকাণ্ড শুধু বিরোধী দলগুলোই চালাচ্ছে— যেন সহিংসতার পেছনে সরকারের কোনো ভূমিকাই নেই! অন্যদিকে সত্য তথা বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু মিজ ওয়েন্ডিকে সমর্থন করে না। কারণ, যে কোনো পর্যালোচনায় পরিষ্কার হয়ে যাবে, দায়ভার বিরোধী দলের ওপর চাপানো হলেও সহিংসতার পেছনে প্রধান ভূমিকা আসলে সরকারই পালন করে চলেছে। বিরামহীন উস্কানিও সরকারের পক্ষ থেকেই আসছে। সেটাও আবার ক্ষমতায় আসার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই। হত্যার পাশাপাশি নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনও তো সরকারই চালাচ্ছে।
সরকারের উস্কানিমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের তালিকাও ছোটখাটো নয়, অনেক দীর্ঘ। পুরোটা বয়ান করতে গেলে হিমশিম খেতে হবে, মিজ ওয়েন্ডির পক্ষেও পড়ে শেষ করা সম্ভব হবে না। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের কথাই বলা যাক। মার্কিন মন্ত্রী অন্যসব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কি এমন কোনো রাষ্ট্রের উদাহরণ দিতে পারবেন যেখানে সংবিধানের নির্দেশনা লংঘন করে কোনো সরকার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে? উদাহরণ দেয়ার জন্য সরকারের আরও অনেক সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের কথাও উল্লেখ করা যায়। এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুগ্রহ করে ঘোষণা দিয়ে জানান দিলেও প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলগুলো তো সরকারের প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই বাধাহীনভাবে সভা-সমাবেশ করতে পারছে না। সেটা রাজধানীতেই হোক কিংবা হোক দেশের প্রত্যন্ত কোনো এলাকায়, সরকার ১৪৪ ধারা প্রয়োগ করে এবং পুলিশকে দিয়ে লাঠিপেটা করিয়ে সভা-সমাবেশ পণ্ড করে দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিরোধী দলের ওপর। ঝাঁপিয়ে পড়াটাও আবার যেমন-তেমন নয়। পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে ক্যাডাররা এমনভাবেই গুলি চালাচ্ছে যে, কোনটি কোন বাহিনীর বন্দুক থেকে বেরিয়ে এসে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ নারী-পুরুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তা বোঝার উপায় থাকছে না। একযোগে দেশজুড়ে চলছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করার অভিযান। অফিসে বা হোটেল-রেস্তোরাঁয় বা মাঠে-ময়দানে দূরে থাকুক, বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা এমনকি নিজেদের বাসাবাড়িতেও কোনো বৈঠক করতে পারছেন না। দলীয় অফিসে যাওয়াও বহুদিন আগেই বন্ধ করেছে সরকার। এ ব্যাপারে সবচেয়ে নিষ্ঠুর আচরণ করা হচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে। সরকারের পুলিশ ২০১০ সালেই জামায়াতের অফিসে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় অফিসে শুধু নয়, জেলা-উপজেলার অফিসগুলোতেও। একই আচরণ করা হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গেও। বিএনপির অফিসেও নেতাকর্মীরা এখন বুক ফুলিয়ে যাতায়াত করতে পারছেন না। যখন তখন গ্রেফতার করা হচ্ছে তাদের। মাত্র কিছুদিন আগে পুলিশ নিজেরাই বিস্ফোরক রেখে সব দোষ চাপিয়েছে বিএনপির ওপর। যে পুলিশ অফিসার এই মহাকম্মটুকু করেছেন তাকে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানেই সিঙ্গাপুরে সপরিবারে হাওয়া খেতে পাঠিয়েছিল সরকার।
এভাবেই সারাদেশে বিরোধী দলগুলোর ওপর সরকার নিষ্ঠুর দমনের অভিযান চালাচ্ছে। কোনো কারণে মিছিল-সমাবেশের উদ্যোগ নেয়া হলেও নেতাকর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে র্যাব ও পুলিশ। আজকাল তারা আর আগের মতো লাঠিচার্জ করে বা টিয়ার গ্যাস ছুড়ে বসে থাকছে না—প্রকৃতপক্ষে সেগুলোর ব্যবহারই করছে না। তারা শুরুই করছে গুলি ও গ্রেনেড দিয়ে। ফলে মারাও যাচ্ছেন অসংখ্য নেতাকর্মী। ক’দিন আগে, গত ৫-৬ মে গভীর রাতের অভিযানে দেড়-দুই-আড়াই না তিন হাজার নিরীহ হেফাজতীর মৃত্যু ঘটেছে তার সঠিক হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। ওদিকে যে সঙ্কট থেকে উত্তরণের কথা মিজ ওয়েন্ডি বলেছেন তার পেছনেও তো ক্ষমতাসীনরাই উস্কানিদাতার ভূমিকা রেখেছেন। তারা যদি স্বৈরাচারী কায়দায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল না করতেন তাহলে হয়তো এখনকার মতো কোনো সঙ্কটেরই সৃষ্টি হতো না। মার্কিন মন্ত্রী নিশ্চয়ই স্ব্বীকার করবেন, যে সরকার বিরোধী দলের দাবি বা প্রস্তাব বিবেচনা পর্যন্ত করতে রাজি হয় না সে সরকারের আমলে সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার কথাও কল্পনা করা যায় না। বর্তমান বাংলাদেশও সে অবস্থার মধ্যেই পড়েছে।
হরতাল প্রসঙ্গে মিজ ওয়েন্ডি যেভাবে মুখ বাঁকিয়েছেন এবং কঠোর মন্তব্য করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কিছু তথ্য স্মরণ না করিয়ে দিয়ে পারা যায় না। এটা আরও বেশি দরকার এজন্য যে, প্রকাশিত বিভিন্ন খবরেই শুধু বলা হয়নি, রাজধানীর কূটনৈতিক অঞ্চলে যাতায়াত ও কূটনীতিকদের সঙ্গে মেলামেশা করেন এমন সাংবাদিকরাও জানিয়েছেন, বিএনপিকে নাকি মার্কিন মন্ত্রীর সফরের সময় হরতাল ডাকতে নিষেধ করা হয়েছিল। যারা নিষেধ করেছিলেন তারা নাকি এ কথাও আগাম জানিয়ে রেখেছিলেন যে, বিএনপি যদি হরতাল ডাকে তাহলে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ওয়েন্ডি শেরম্যানের নির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল করা হবে। বাস্তবেও সেটাই ঘটেছে। নিষেধ করার বিষয়টিকে বিএনপি তার মানসম্মানের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে জেদে পরিণত করেছিল কিনা সে প্রশ্নে না গিয়েও বলা দরকার, মার্কিন মন্ত্রী বিএনপিকে একহাত দেখিয়ে ছেড়েছেন বটে! আমরা জানি না, বিএনপির পক্ষ থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সফরকালে পালিত হরতাল এবং খালেদা জিয়া যে ওই হরতালের কারণে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছিলেন এসব তথ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের জানানো হয়েছে কিনা। এটা তো মাত্র সেদিনের, গত মার্চ মাসের ঘটনা। পাঠকদেরও মনে থাকার কথা, প্রণব মুখার্জি গত ৪ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর এটাই ছিল তার প্রথম কোনো বিদেশ সফর। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং কাদের সিদ্দিকী ও ইনু-মেননসহ আরও অনেকের সঙ্গেই দেখা ও কথা হয়েছে তার। নড়াইলে শ্বশুরবাড়িতে গেছেন, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহের দীঘিতে নৌকায় বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভোগ করেছেন তিনি। খাওয়া-দাওয়াও কম করেননি। কিন্তু এতকিছুর পরও প্রণব মুখার্জিকে নাকি ফিরতি পথে বিমানে যথেষ্ট ‘ক্ষুব্ধ’ দেখেছেন ভারতের সাংবাদিকরা। কথাটা ভারতীয় পত্রপত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশেও প্রকাশিত হয়েছিল। ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণও জানানো হয়েছিল। কারণ ছিল একটাই—বেগম খালেদা জিয়া তার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেননি এবং পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করেছিলেন। প্রণব মুখার্জির প্রতিক্রিয়া জানার আগেই এ ব্যাপারে জানান দিয়েছিলেন এদেশের ক্ষমতাসীনরা। প্রণব মুখার্জির সফরকালেই তারা এমন এক প্রচারণা চালিয়েছিলেন যেন ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত্ না করে খালেদা জিয়া বিরাট কোনো ‘অপরাধ’ করে ফেলেছেন! এটা নাকি ‘অশোভন’ হয়েছে এবং খালেদা জিয়া নাকি ‘কূটনৈতিক সৌজন্য’ লঙ্ঘন করেছেন! পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি থেকে আওয়ামী লীগের লন্ডন প্রবাসী সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পর্যন্ত অনেকেই নিন্দা-সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছিলেন।
অন্যদিকে সত্য কিন্তু মোটেও তেমন ছিল না। কারণ, এই সাক্ষাতের নির্ধারিত তারিখ ছিল ৪ মার্চ। সেদিন এবং তার আগেরদিন আগেই হরতাল ডেকেছিল জামায়াতে ইসলামী। ১৮ দলীয় জোটের প্রধান নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে জামায়াতের ডাকা হরতাল ভঙ্গ করা এবং হরতালে মধ্যে গাড়িতে চড়ে সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে বসা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া গণহত্যাসহ সরকারের ফ্যাসিস্ট কর্মকাণ্ডের কারণে তার নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নও ছিল। এজন্যই খালেদা জিয়া অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। এতেই নাকি সরকারের ‘মহাভারত’ অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল! ওদিকে ভারতীয়রাও যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার লিখেছিল, প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করার মাধ্যমে খালেদা জিয়া নাকি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ব্যাপারে ‘সুদূরপ্রসারী বার্তা’ দিয়েছেন! রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্ধৃতি দিয়ে আনন্দবাজার আরও জানিয়েছে, খবরটি জানার পর প্রণব মুখার্জির মুখের হাসি নাকি কিছুক্ষণের জন্য ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছিল!
ক্ষমতাসীনরা ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত্ না করার বিষয়টিকে নিয়ে এভাবে নোংরা রাজনীতি করলেও দেশপ্রেমিকরা কিন্তু খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তকে সঠিক ও জাতীয় নেত্রীসুলভ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তারা মনে করেন, সরকার আসলে প্রণব মুখার্জিকেও নিজেদের দাবার ঘুঁটি বানিয়েছেন। নাহলে এবং ভারতের রাষ্ট্রপতিকে সম্মান দেখানোর সত্যিই সদিচ্ছা থাকলে সরকার অবশ্যই জামায়াত-শিবিরের গণতন্ত্রসম্মত প্রতিবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঠিক ওই দিনগুলোতেই এতটা ভয়ঙ্করভাবে মারমুখী হয়ে উঠত না। তার সফরের প্রাক্কালে ডজনে-ডজনে লাশও ফেলত না। ক্ষমতাসীনরা ঠিকই জানতেন, আন্দোলনকারীদের লাশের ওপর দিয়ে খালেদা জিয়া অন্তত প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে যাবেন না। তেমন অবস্থায় তারা সহজেই খালেদা জিয়াকে ভারতবিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে এবং নতুন পর্যায়ে ভারতের সমর্থন আদায় করতে পারবেন। মূলত অমন এক কুটিল কৌশল নিয়েই এগিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। তাছাড়া এমন এক অশান্ত পরিস্থিতির মধ্যে প্রণব মুখার্জিরও বাংলাদেশে আসা উচিত হয়নি। তিনি চাইলে সরকার অবশ্যই গণহত্যা বন্ধ করত। কিন্তু সেটা তিনি করেননি বরং ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে গণহত্যাসহ সরকারের নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের প্রতিই পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়ে গেছেন। এজন্যই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে ভারতপন্থীদের মতো উচ্ছ্বাস দেখানোর কোনো উপাদানই তখন ছিল না। তিনিও তাই বিগলিত ও কৃতার্থ হওয়ার পথে পা বাড়াননি।
বৃহত্ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি—তাও ‘প্রথম বাঙালি’ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে যিনি এতটা কঠোর অবস্থান নিতে পারেন, সেই নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গুরুত্ব নিশ্চয়ই খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া মিজ ওয়েন্ডিও বেছে বেছে এমন এক সময়ে ঢাকায় এসেছিলেন যার মাত্র ক’দিন আগেই সরকার হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছিল। সুতরাং প্রণব মুখার্জির বেলায় যেমন বলা হয়েছে তেমনটা মার্কিন মন্ত্রীর বেলায়ও বলা যেতে পারে। তিনি তথা মার্কিন সরকার চাইলে আওয়ামী লীগ সরকার অবশ্যই তার সফরের প্রাক্কালে অন্তত গণহত্যা চালানোর সাহস পেত না। দেড় থেকে তিন হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানকেও প্রাণ হারাতে হতো না। কিন্তু সে ব্যবস্থা তিনিও করেননি, মার্কিন সরকারও এ ব্যাপারে প্রশ্নসাপেক্ষ ভূমিকা রেখেছে। বলা হচ্ছে, গণহত্যাসহ সরকারের নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের শিকার যারা হয়েছেন তাদের মুখে দাড়ি আর মাথায় টুপি ছিল বলে মিজ ওয়েন্ডিরা নাকি উল্টো খুশিই হয়েছেন! কথিত ইসলামী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ায় তারা নাকি সাবাশিও দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারকে। অর্থাত্ তারাও উল্টো সরকারের গণহত্যা ও দমন-নির্যাতনের প্রতিই সমর্থন জানিয়ে গেছেন! বলা বাহুল্য, অমন যাদের নীতি-কৌশল ও উদ্দেশ্য তাদের প্রধান প্রতিনিধি ওয়েন্ডি শেরমেনের সঙ্গে বৈঠক করতে হয়নি বলে বেগম খালেদা জিয়ার মানসম্মানই বরং বেঁচে গেছে।
সবশেষে আবারও হরতাল প্রসঙ্গে কিছু তথ্যের উল্লেখ করা দরকার—যে হরতালের কারণে মার্কিন উপমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঢাকঢোল পিটিয়ে বৈঠক বাতিল করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চার দলীয় জোট সরকারের প্রথম ১৭ মাসেই শেখ হাসিনা ১৬টি হরতাল করেছিলেন। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের প্রথম ১৭ মাসে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো কোনো হরতাল করেনি। সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার ১৮ মাস পর প্রথম হরতাল করেছিল তারা ২০১০ সালের ২৭ জুন। দ্বিতীয়বার হরতাল ডাকা হয়েছিল ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর। শুধু তা-ই নয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিরোধী দল সব মিলিয়ে হরতাল করেছিল ৫৯ দিন। অন্যদিকে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জোট সরকারের পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ হরতাল করেছে ১৭৩ দিন। বিএনপি যেখানে ১৮ মাস পর প্রথম হরতাল করেছে, আওয়ামী লীগ সেখানে চার দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার মাত্র ৫২ দিনের মাথায় ২০০১ সালের ২ ডিসেম্বরই হরতাল করেছিল। এজন্যই বলা হচ্ছে, ওয়েন্ডি শেরমেন সম্ভবত আওয়ামী লীগ সরকারের হরতাল বিরোধী প্রচারণায় বিশ্বাস স্থাপন করে তাদেরই দেয়া ঢোলের বাড়িতে নৃত্য করে গেছেন।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের কল্যাণ এবং দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চান বলেই মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহিংসতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার এবং গণতন্ত্রসম্মত পন্থায় সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পরামর্শ দিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে কথাও উঠেছে তার এ পরামর্শ এবং প্রাসঙ্গিক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। কথা ওঠার প্রধান কারণ হলো, তিনি শুধু একতরফাভাবে সহিংসতার কথাই বলেছেন, এর পেছনে সক্রিয় কারণ তথা ক্ষমতাসীনদের উস্কানি ও কর্মকাণ্ডের দিকগুলো সম্পূর্ণ রূপে এড়িয়ে গেছেন। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের রাজনীতিবিষয়ক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি, সেহেতু ধরে নেয়া যায়, সহিংসতার প্রকৃত কারণ সম্পর্কেও বিস্তারিতই জানা রয়েছে তার। বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল পালনের আহ্বান যে মাঝে-মধ্যেই জানানো হয় এবং হরতাল যে পালিতও হয় সে কথাটাও তিনি নিশ্চয়ই জানেন। তা সত্ত্বেও একদিকে তিনি ‘শিডিউল বিপর্যয়ের’ অজুহাত দেখিয়ে দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে সরকারের জন্য প্লাস পয়েন্ট যোগাড় করে দিয়েছেন, অন্যদিকে সহিংসতার অভিযোগও এমনভাবেই হাজির করেছেন, যা শুনে মনে হতে পারে যেন সহিংস কর্মকাণ্ড শুধু বিরোধী দলগুলোই চালাচ্ছে— যেন সহিংসতার পেছনে সরকারের কোনো ভূমিকাই নেই! অন্যদিকে সত্য তথা বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু মিজ ওয়েন্ডিকে সমর্থন করে না। কারণ, যে কোনো পর্যালোচনায় পরিষ্কার হয়ে যাবে, দায়ভার বিরোধী দলের ওপর চাপানো হলেও সহিংসতার পেছনে প্রধান ভূমিকা আসলে সরকারই পালন করে চলেছে। বিরামহীন উস্কানিও সরকারের পক্ষ থেকেই আসছে। সেটাও আবার ক্ষমতায় আসার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই। হত্যার পাশাপাশি নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনও তো সরকারই চালাচ্ছে।
সরকারের উস্কানিমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের তালিকাও ছোটখাটো নয়, অনেক দীর্ঘ। পুরোটা বয়ান করতে গেলে হিমশিম খেতে হবে, মিজ ওয়েন্ডির পক্ষেও পড়ে শেষ করা সম্ভব হবে না। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের কথাই বলা যাক। মার্কিন মন্ত্রী অন্যসব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কি এমন কোনো রাষ্ট্রের উদাহরণ দিতে পারবেন যেখানে সংবিধানের নির্দেশনা লংঘন করে কোনো সরকার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে? উদাহরণ দেয়ার জন্য সরকারের আরও অনেক সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের কথাও উল্লেখ করা যায়। এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুগ্রহ করে ঘোষণা দিয়ে জানান দিলেও প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলগুলো তো সরকারের প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই বাধাহীনভাবে সভা-সমাবেশ করতে পারছে না। সেটা রাজধানীতেই হোক কিংবা হোক দেশের প্রত্যন্ত কোনো এলাকায়, সরকার ১৪৪ ধারা প্রয়োগ করে এবং পুলিশকে দিয়ে লাঠিপেটা করিয়ে সভা-সমাবেশ পণ্ড করে দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিরোধী দলের ওপর। ঝাঁপিয়ে পড়াটাও আবার যেমন-তেমন নয়। পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে ক্যাডাররা এমনভাবেই গুলি চালাচ্ছে যে, কোনটি কোন বাহিনীর বন্দুক থেকে বেরিয়ে এসে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ নারী-পুরুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তা বোঝার উপায় থাকছে না। একযোগে দেশজুড়ে চলছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করার অভিযান। অফিসে বা হোটেল-রেস্তোরাঁয় বা মাঠে-ময়দানে দূরে থাকুক, বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা এমনকি নিজেদের বাসাবাড়িতেও কোনো বৈঠক করতে পারছেন না। দলীয় অফিসে যাওয়াও বহুদিন আগেই বন্ধ করেছে সরকার। এ ব্যাপারে সবচেয়ে নিষ্ঠুর আচরণ করা হচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে। সরকারের পুলিশ ২০১০ সালেই জামায়াতের অফিসে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় অফিসে শুধু নয়, জেলা-উপজেলার অফিসগুলোতেও। একই আচরণ করা হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গেও। বিএনপির অফিসেও নেতাকর্মীরা এখন বুক ফুলিয়ে যাতায়াত করতে পারছেন না। যখন তখন গ্রেফতার করা হচ্ছে তাদের। মাত্র কিছুদিন আগে পুলিশ নিজেরাই বিস্ফোরক রেখে সব দোষ চাপিয়েছে বিএনপির ওপর। যে পুলিশ অফিসার এই মহাকম্মটুকু করেছেন তাকে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানেই সিঙ্গাপুরে সপরিবারে হাওয়া খেতে পাঠিয়েছিল সরকার।
এভাবেই সারাদেশে বিরোধী দলগুলোর ওপর সরকার নিষ্ঠুর দমনের অভিযান চালাচ্ছে। কোনো কারণে মিছিল-সমাবেশের উদ্যোগ নেয়া হলেও নেতাকর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে র্যাব ও পুলিশ। আজকাল তারা আর আগের মতো লাঠিচার্জ করে বা টিয়ার গ্যাস ছুড়ে বসে থাকছে না—প্রকৃতপক্ষে সেগুলোর ব্যবহারই করছে না। তারা শুরুই করছে গুলি ও গ্রেনেড দিয়ে। ফলে মারাও যাচ্ছেন অসংখ্য নেতাকর্মী। ক’দিন আগে, গত ৫-৬ মে গভীর রাতের অভিযানে দেড়-দুই-আড়াই না তিন হাজার নিরীহ হেফাজতীর মৃত্যু ঘটেছে তার সঠিক হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। ওদিকে যে সঙ্কট থেকে উত্তরণের কথা মিজ ওয়েন্ডি বলেছেন তার পেছনেও তো ক্ষমতাসীনরাই উস্কানিদাতার ভূমিকা রেখেছেন। তারা যদি স্বৈরাচারী কায়দায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল না করতেন তাহলে হয়তো এখনকার মতো কোনো সঙ্কটেরই সৃষ্টি হতো না। মার্কিন মন্ত্রী নিশ্চয়ই স্ব্বীকার করবেন, যে সরকার বিরোধী দলের দাবি বা প্রস্তাব বিবেচনা পর্যন্ত করতে রাজি হয় না সে সরকারের আমলে সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার কথাও কল্পনা করা যায় না। বর্তমান বাংলাদেশও সে অবস্থার মধ্যেই পড়েছে।
হরতাল প্রসঙ্গে মিজ ওয়েন্ডি যেভাবে মুখ বাঁকিয়েছেন এবং কঠোর মন্তব্য করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কিছু তথ্য স্মরণ না করিয়ে দিয়ে পারা যায় না। এটা আরও বেশি দরকার এজন্য যে, প্রকাশিত বিভিন্ন খবরেই শুধু বলা হয়নি, রাজধানীর কূটনৈতিক অঞ্চলে যাতায়াত ও কূটনীতিকদের সঙ্গে মেলামেশা করেন এমন সাংবাদিকরাও জানিয়েছেন, বিএনপিকে নাকি মার্কিন মন্ত্রীর সফরের সময় হরতাল ডাকতে নিষেধ করা হয়েছিল। যারা নিষেধ করেছিলেন তারা নাকি এ কথাও আগাম জানিয়ে রেখেছিলেন যে, বিএনপি যদি হরতাল ডাকে তাহলে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ওয়েন্ডি শেরম্যানের নির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল করা হবে। বাস্তবেও সেটাই ঘটেছে। নিষেধ করার বিষয়টিকে বিএনপি তার মানসম্মানের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে জেদে পরিণত করেছিল কিনা সে প্রশ্নে না গিয়েও বলা দরকার, মার্কিন মন্ত্রী বিএনপিকে একহাত দেখিয়ে ছেড়েছেন বটে! আমরা জানি না, বিএনপির পক্ষ থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সফরকালে পালিত হরতাল এবং খালেদা জিয়া যে ওই হরতালের কারণে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছিলেন এসব তথ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের জানানো হয়েছে কিনা। এটা তো মাত্র সেদিনের, গত মার্চ মাসের ঘটনা। পাঠকদেরও মনে থাকার কথা, প্রণব মুখার্জি গত ৪ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর এটাই ছিল তার প্রথম কোনো বিদেশ সফর। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং কাদের সিদ্দিকী ও ইনু-মেননসহ আরও অনেকের সঙ্গেই দেখা ও কথা হয়েছে তার। নড়াইলে শ্বশুরবাড়িতে গেছেন, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহের দীঘিতে নৌকায় বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভোগ করেছেন তিনি। খাওয়া-দাওয়াও কম করেননি। কিন্তু এতকিছুর পরও প্রণব মুখার্জিকে নাকি ফিরতি পথে বিমানে যথেষ্ট ‘ক্ষুব্ধ’ দেখেছেন ভারতের সাংবাদিকরা। কথাটা ভারতীয় পত্রপত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশেও প্রকাশিত হয়েছিল। ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণও জানানো হয়েছিল। কারণ ছিল একটাই—বেগম খালেদা জিয়া তার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেননি এবং পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করেছিলেন। প্রণব মুখার্জির প্রতিক্রিয়া জানার আগেই এ ব্যাপারে জানান দিয়েছিলেন এদেশের ক্ষমতাসীনরা। প্রণব মুখার্জির সফরকালেই তারা এমন এক প্রচারণা চালিয়েছিলেন যেন ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত্ না করে খালেদা জিয়া বিরাট কোনো ‘অপরাধ’ করে ফেলেছেন! এটা নাকি ‘অশোভন’ হয়েছে এবং খালেদা জিয়া নাকি ‘কূটনৈতিক সৌজন্য’ লঙ্ঘন করেছেন! পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি থেকে আওয়ামী লীগের লন্ডন প্রবাসী সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পর্যন্ত অনেকেই নিন্দা-সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছিলেন।
অন্যদিকে সত্য কিন্তু মোটেও তেমন ছিল না। কারণ, এই সাক্ষাতের নির্ধারিত তারিখ ছিল ৪ মার্চ। সেদিন এবং তার আগেরদিন আগেই হরতাল ডেকেছিল জামায়াতে ইসলামী। ১৮ দলীয় জোটের প্রধান নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে জামায়াতের ডাকা হরতাল ভঙ্গ করা এবং হরতালে মধ্যে গাড়িতে চড়ে সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে বসা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া গণহত্যাসহ সরকারের ফ্যাসিস্ট কর্মকাণ্ডের কারণে তার নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নও ছিল। এজন্যই খালেদা জিয়া অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। এতেই নাকি সরকারের ‘মহাভারত’ অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল! ওদিকে ভারতীয়রাও যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার লিখেছিল, প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করার মাধ্যমে খালেদা জিয়া নাকি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ব্যাপারে ‘সুদূরপ্রসারী বার্তা’ দিয়েছেন! রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্ধৃতি দিয়ে আনন্দবাজার আরও জানিয়েছে, খবরটি জানার পর প্রণব মুখার্জির মুখের হাসি নাকি কিছুক্ষণের জন্য ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছিল!
ক্ষমতাসীনরা ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত্ না করার বিষয়টিকে নিয়ে এভাবে নোংরা রাজনীতি করলেও দেশপ্রেমিকরা কিন্তু খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তকে সঠিক ও জাতীয় নেত্রীসুলভ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তারা মনে করেন, সরকার আসলে প্রণব মুখার্জিকেও নিজেদের দাবার ঘুঁটি বানিয়েছেন। নাহলে এবং ভারতের রাষ্ট্রপতিকে সম্মান দেখানোর সত্যিই সদিচ্ছা থাকলে সরকার অবশ্যই জামায়াত-শিবিরের গণতন্ত্রসম্মত প্রতিবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঠিক ওই দিনগুলোতেই এতটা ভয়ঙ্করভাবে মারমুখী হয়ে উঠত না। তার সফরের প্রাক্কালে ডজনে-ডজনে লাশও ফেলত না। ক্ষমতাসীনরা ঠিকই জানতেন, আন্দোলনকারীদের লাশের ওপর দিয়ে খালেদা জিয়া অন্তত প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে যাবেন না। তেমন অবস্থায় তারা সহজেই খালেদা জিয়াকে ভারতবিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে এবং নতুন পর্যায়ে ভারতের সমর্থন আদায় করতে পারবেন। মূলত অমন এক কুটিল কৌশল নিয়েই এগিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। তাছাড়া এমন এক অশান্ত পরিস্থিতির মধ্যে প্রণব মুখার্জিরও বাংলাদেশে আসা উচিত হয়নি। তিনি চাইলে সরকার অবশ্যই গণহত্যা বন্ধ করত। কিন্তু সেটা তিনি করেননি বরং ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে গণহত্যাসহ সরকারের নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের প্রতিই পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়ে গেছেন। এজন্যই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে ভারতপন্থীদের মতো উচ্ছ্বাস দেখানোর কোনো উপাদানই তখন ছিল না। তিনিও তাই বিগলিত ও কৃতার্থ হওয়ার পথে পা বাড়াননি।
বৃহত্ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি—তাও ‘প্রথম বাঙালি’ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে যিনি এতটা কঠোর অবস্থান নিতে পারেন, সেই নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গুরুত্ব নিশ্চয়ই খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া মিজ ওয়েন্ডিও বেছে বেছে এমন এক সময়ে ঢাকায় এসেছিলেন যার মাত্র ক’দিন আগেই সরকার হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছিল। সুতরাং প্রণব মুখার্জির বেলায় যেমন বলা হয়েছে তেমনটা মার্কিন মন্ত্রীর বেলায়ও বলা যেতে পারে। তিনি তথা মার্কিন সরকার চাইলে আওয়ামী লীগ সরকার অবশ্যই তার সফরের প্রাক্কালে অন্তত গণহত্যা চালানোর সাহস পেত না। দেড় থেকে তিন হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানকেও প্রাণ হারাতে হতো না। কিন্তু সে ব্যবস্থা তিনিও করেননি, মার্কিন সরকারও এ ব্যাপারে প্রশ্নসাপেক্ষ ভূমিকা রেখেছে। বলা হচ্ছে, গণহত্যাসহ সরকারের নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের শিকার যারা হয়েছেন তাদের মুখে দাড়ি আর মাথায় টুপি ছিল বলে মিজ ওয়েন্ডিরা নাকি উল্টো খুশিই হয়েছেন! কথিত ইসলামী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ায় তারা নাকি সাবাশিও দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারকে। অর্থাত্ তারাও উল্টো সরকারের গণহত্যা ও দমন-নির্যাতনের প্রতিই সমর্থন জানিয়ে গেছেন! বলা বাহুল্য, অমন যাদের নীতি-কৌশল ও উদ্দেশ্য তাদের প্রধান প্রতিনিধি ওয়েন্ডি শেরমেনের সঙ্গে বৈঠক করতে হয়নি বলে বেগম খালেদা জিয়ার মানসম্মানই বরং বেঁচে গেছে।
সবশেষে আবারও হরতাল প্রসঙ্গে কিছু তথ্যের উল্লেখ করা দরকার—যে হরতালের কারণে মার্কিন উপমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঢাকঢোল পিটিয়ে বৈঠক বাতিল করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চার দলীয় জোট সরকারের প্রথম ১৭ মাসেই শেখ হাসিনা ১৬টি হরতাল করেছিলেন। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের প্রথম ১৭ মাসে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো কোনো হরতাল করেনি। সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার ১৮ মাস পর প্রথম হরতাল করেছিল তারা ২০১০ সালের ২৭ জুন। দ্বিতীয়বার হরতাল ডাকা হয়েছিল ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর। শুধু তা-ই নয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিরোধী দল সব মিলিয়ে হরতাল করেছিল ৫৯ দিন। অন্যদিকে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জোট সরকারের পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ হরতাল করেছে ১৭৩ দিন। বিএনপি যেখানে ১৮ মাস পর প্রথম হরতাল করেছে, আওয়ামী লীগ সেখানে চার দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার মাত্র ৫২ দিনের মাথায় ২০০১ সালের ২ ডিসেম্বরই হরতাল করেছিল। এজন্যই বলা হচ্ছে, ওয়েন্ডি শেরমেন সম্ভবত আওয়ামী লীগ সরকারের হরতাল বিরোধী প্রচারণায় বিশ্বাস স্থাপন করে তাদেরই দেয়া ঢোলের বাড়িতে নৃত্য করে গেছেন।
No comments