ঐক্য দরকার সঙ্কট থেকে মুক্তির জন্য by মাহমুদ রেজা চৌধুরী
লেখাটি শুরু করতে চেয়েছিলাম—ব্লগার রাজীবের নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে। যেকোনো
হত্যা, সেটা যখনই বিনা বিচারে কোনো আবেগের বশবর্তী হয়ে করা হয় অপরাধের
সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া বা কোনো অন্যায় যখনই একতরফা তথাকথিত বিচারের নামে
প্রতিষ্ঠা হয়, সেটাই অন্যায় ও অমানবিক।
শাহবাগ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন রাজীব নামের এক তরুণ। তাকে যে বা যারাই যেভাবে
হত্যা করেছে, সেটাও এক অর্থে নৃশংস। নৃশংস কোনো ঘটনাকেই কোনো ধর্ম, মানবতা
বা ন্যায়—এসবের কোনো কিছু দিয়েই প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তাই রাজীব হত্যার
সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের নেপথ্যে ও সম্মুখে যারাই ছিল, তাদের সাজা হওয়া
দরকার। রাজীবের মৃত্যুর পর তার নামে যেসব ইসলামধর্মবিদ্বেষী এবং প্রায় দেড়
বিলিয়নের অধিক মুসলমান জাতির প্রিয় নবী করিম (সা.)-এর নামে যেসব কথা
পত্রপত্রিকায়, ফেসবুকে এসেছে, এরও সঠিক তদন্ত দরকার। এই তদন্ত এবং সঠিক
তথ্য এই কারণে জরুরি নয় যে, রাজীবের হত্যাকাণ্ডকে ‘জাস্টিফাই’ করা হবে।
রাজীব যদি তেমন কিছু লিখেও থাকেন, সেটার বিচারও রাজীব বেঁচে থাকতে হলে সেটা
জাস্টিফাইড হতে পারত। কিন্তু বিনা বিচারে কোনো মানুষকে, সে যেই হোক, হত্যা
করা সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে এবং এটা মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক বড় অপরাধ। এই
ধরনের অপরাধকে ঘৃণা জানাই। তবু রাজীবের নামে প্রচারিত কথা বা বক্তব্যগুলো
রাজীবেরই লেখা কি না, জানা প্রয়োজন আমাদের ভবিষ্যত্ শত্রু-মিত্র চিহ্নিত
করার জন্য। রাজীবের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে
উন্মাদনা ও ধর্মের নামে অনৈতিকতা-বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধির জন্য যদি কোনো দল বা
গোষ্ঠীকে, দায়ী করা হয় তবে তাকে বেনিফিট অব ডাউট দেব কীভাবে? এই রকমের
অসংখ্য হত্যা ও খুনের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা সম্ভব, আমাদের দেশের অধিকাংশ
নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের তৈরি রাজনৈতিক শত্রুতা, ক্ষমতার
প্রভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠশ্রেণীর কারও কারও ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে অন্য কোনো
শত্রুতা বা প্রতিহিংসাও জড়িত। জড়িত রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী ভূমিকা। অন্যায়,
অবিচার, কোন্দল ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতি তীব্রভাবে। এর সঙ্গে আছে আমাদের
সামাজিক ক্রম নিম্নগামী মানবিক মূল্যবোধ। লক্ষণীয় যে রাজীব হত্যার পরপরই
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছুটে গেলেন রাজীব পরিবারের কাছে। তিনি বললেন, তিনি এই
হত্যার সঙ্গে জড়িত জামায়াতিদের প্রয়োজনে নিষিদ্ধ করতে যা যা করার, সেটা
করবেন। খুবই ভালো কথা। রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে
কোনো নৃশংসতাকে মেনে নেয়া বা সহ্য করবারও কথা না। সাধারণ মানুষের তাই
সাধারণ জিজ্ঞাসা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি তো কোনো দলের প্রধানমন্ত্রী
হিসেবে শপথ গ্রহণ করেননি। রাষ্ট্রের যেখানে অনেক দল ও মতও রয়েছে, আমাদের
সবারই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি। দেশের সফলতা, ব্যর্থতা, আশা-হতাশা—এই
সবকিছুর আপনার শাসনামলে যা কিছু ঘটবে, তার একটা ইতিবাচক এবং নেতিবাচক ইমেজ
ব্যক্তিগতভাবে আপনারও। তাই প্রশ্ন, দেশবাসী তো এর কয়েক মাস আগে ছাত্রলীগের
কিছু উন্মাদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত নির্দোষ পথচারী বিশ্বজিতের হত্যাকণ্ডের
পর বিশ্বজিতের পরিবারের কাছে ছুটে গিয়ে আপনাকে তার হত্যাকারীদের ব্যাপারে
কোনো কঠোর কথা বলতে শোনেনি। এবং বলেনওনি যে আপনি বিশ্বজিতের হত্যাকারী দলকে
নিষিদ্ধ করবেন। এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তাহলে আপনিই বলুন, আমরা কীভাবে
আপনি দলের চেয়েও দেশকে অগ্রাধিকার দেন বলে ভাবতে পারি? বরং আপনার মনোনীত
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিলেন এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ছাত্রলীগের কেউ নাকি
জড়িত নেই। কী প্রমাণ বা ইনফরমেশন নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কথা বলেছিলেন,
সেটা আপনার জ্ঞানে থাকলেও দেশবাসীর জ্ঞানে নেই।
আলোচনার ‘স্পটলাইট’ থেকে একটু সরে গিয়েছি। এবার ফিরে আসি। দেশে সর্বত্রই এখন কমবেশি উত্তেজনা, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও মোটা দাগে যাকে বলা যায় বিভাজন বিরাজ করছে। কারও মতে, দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ এত দিনে স্পষ্ট হলো। লন্ডন থেকে এই কথা লিখেছেন প্রখ্যাত কলামিস্ট ও সাংবাদিক আবদুল গফ্ফার চৌধুরী। তবে এ কথিত রাজনৈতিক মেরুকরণ সমাজ ও রাষ্ট্রের সাধারণ কোটি কোটি মানুষের পক্ষে না বিপক্ষে, সময় অবশ্যই তা বলে দেবে। প্রখ্যাত সমাজচিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার বলেছেন, দেশে নির্মূলের রাজনীতি চলছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নতুন সাংগঠনিক রূপ পাচ্ছে। আমাদের সময়ের অন্যতম চৌকস ও মেধাবী ছাত্র এখন সমাজচিন্তাবিদ সলিমুল্লাহ খান বলছেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষম পরিণতি নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন, ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এ বাংলাদেশের রাজনীতি। এসব কথা আমরা এখন প্রতিদিন দেশের দৈনিক পত্রিকা খুললেই পাই। শ্রদ্ধেয় প্রবীণ কলামিস্ট ও সাংবাদিক এবিএম মূসা, প্রখ্যাত আইনবিশেষজ্ঞ ব্যরিস্টার রফিক-উল-হক, সমাজগবেষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, সমাজগবেষক বদরুদ্দিন উমর, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজচিন্তাবিদ ড. পিয়াস করিম, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ ড. আকবর আলি খান, নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মোহাম্মদ, রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট মাহমুদুর রহমান মান্না—তাদের প্রত্যেকের কথায় সুস্পষ্ট যে দেশ ভালো নেই। দেশের বর্তমান ক্রান্তিকালকে উল্লিখিত ব্যক্তিরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েও দেখছেন। তাদের মধ্যে কেউ চরম হতাশার কথাও বলছেন, কেউ বা সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য এই সঙ্কটকে অনিবার্যভাবে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। কেউ একে চলমান সঙ্কটে, দলের দলীয় ফয়দা লুটের কথাও বলছেন। সংক্ষেপে দেশের মানুষ ভালো নেই। ভবিষ্যত্ কী হতে পারে, দেশের ভবিষ্যত্ কী—এটাও একটি প্রশ্ন। এটা শুধু আবেগের প্রশ্ন নয়। অনেক অরাজকতার হিসাব-নিকাশের প্রশ্ন। কঠিন বাস্তবতার প্রশ্ন। উত্পাদন, বাণিজ্য ও দেশের আর্থিক উন্নতির প্রশ্ন। উত্পাদন সম্পর্কেরও প্রশ্ন। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা যথার্থই বলেছেন, দেশ আজ কোন পথে যাচ্ছে, সেটা বড় প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন—জনগণের ভাগ্য আজ কোন পথে, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের ভবিষ্যত কী? আমাদের স্বাধীনতার চার কাল অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। দুঃখের বিষয়, রাজনৈতিকভাবে আমাদের জাতীয় ঐক্য ‘এখনও বিভেদের ঊর্ধ্বে’ যেতে পারেনি। দুর্ভাগ্য আমাদের, জাতীয় দাবি হয়ে গেছে দলীয় ইস্যু, জাতীয় নেতারাও হয়ে পড়েছেন আমাদের হাতে এবং আমাদের দলীয় চিন্তার সংকীর্ণতায় বন্দি। এরই ভয়ঙ্কর পরিণতি হচ্ছে, দেশের চলমান সঙ্কট ও আগ্রাসী শ্রেণীসংঘাতের একটি কারণ।
আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে রাজনীতির সূচনা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বহু আগের। তাই এ বিষয়টাকে অনেকটা দূরে রেখেই দেশকে বিভক্ত না করে একতা বজায় রেখে সামনের দিকে পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন আমাদের প্রয়াত অনেক নেতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও। তবু আমরা আজ এতগুলো যুগের পর এই বিষয়টাকে কেন্দ্র করে এতটা আগ্রাসী, উচ্ছৃঙ্খল, আবেগতাড়িত, একরোখা, জেদি, সর্বোপরি বিভক্ত হলাম কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা পেয়ে যাব সময়ের ইতিহাসে। অনেকের কাছে উদীয়মান, মননশীল অধ্যাপক বলে পরিচিত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার গ্রন্থ আমার একাত্তর-এ। (প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে) লিখছেন, ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে তার কথোপকথনের উদ্ধৃতি দিয়ে, ‘তাঁর সঙ্গে সেদিন দুটো বিষয়ে কথা হয়েছিলো। একটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রসঙ্গ ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসরদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়। তিনি বলেছিলেন, চেষ্টার ত্রুটি হবে না, তবে কাজটা সহজ হবে না। আমি জানতে চাই, কেন? তিনি বলেন, যুদ্ধবন্দি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাউকে বিচার করা সম্ভবপর হবে বলে তিনি মনে করেন না। আমি আবার জানতে চাই, কেন? তিনি বলেন, মার্কিনীদের চাপ আছে। তারা পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে, ভারতকে চাপ দিচ্ছে যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দিয়ে উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলতে। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধবন্দিদের বিচারে সোভিয়েট ইউনিয়ন ইচ্ছুক নয়, এমন কি ভারতও উত্সাহী নয়। এই অবস্থায় কার জোরে আপনি বিচার করবেন? আর মূল অপরাধীদের বিচার না করতে পারলে তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের বিচারের প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যেতে বাধ্য।’ (গ্রন্থ : আমার একাত্তর পৃষ্ঠা-১৮৩) লেখক, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আজকের প্রজন্মের জানা না থাকলেও চুয়াত্তরে আমরা যারা তরুণ ছিলাম, তাদের নিশ্চয়ই জানা আছে ঐতিহাসিক দিল্লি চুক্তির কথা। যার সিগনেটরি ছিলেন তত্কালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের শরণ সিং এবং পাকিস্তানের আজিজ আহমেদ। যে চুক্তির সম্ভবত ১৩ বা ১৫ প্যারাগ্রাফে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়ার কথা উল্লেখ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সেই ক্ষমার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে মাফ করে দিয়ে বাংলাদেশ দেখিয়ে দিল, বাঙালি জানে, কীভাবে মাফ করতে হয়। বঙ্গবন্ধুও চেয়েছিলেন, মানুষ অতীত ভুলে যাক এবং নতুন করে বন্ধুত্ব শুরু করুক। আজকের যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায়বিচার-প্রক্রিয়ায় ইতিহাসের এসব অধ্যায়কেও দ্ব্যার্থহীনভাবে উপেক্ষা করলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে তা প্রশ্নবিদ্ধ করতেই পারে। বিতর্কিত করতেই পারে। এটাই গণতন্ত্র, এটাই স্বাভাবিক। এই প্রশ্ন থেকে মুক্ত হয়ে আজকে কেন, শত বছর পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জাতির ন্যায্য দাবি এবং অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, যদি এই বিষয় নিয়ে কেউ বা সরকারও বাড়াবাড়ি না করে বা না করতো। দলীয়করণ বা বিষয়ের রাজনীতিকরণ না হতো অথবা না করা হয়। আমাদের বাড়াবাড়ি, আবেগ ও প্রতিহিংসার কারণেও বলা যায়, ইতিহাসের আরেক নির্মম ও নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। পারলেন না দেশের মানুষকে একে অন্যের বন্ধু বানাতে, ব্যর্থ হলেন রাজনীতিতে, ‘গণতন্ত্র’ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে। এরপর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ, প্রতিরোধ এসবের রাষ্ট্রীয়করণ এবং দলীয় মেরুকরণের বিকাশ ঘটে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে শুরুতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নামের একটি সংগঠন এবং এর অন্যতম উদ্যোক্তা প্রয়াত জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর আরেক মেরুকরণের পথে ধাবিত হয় তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক নামের কিছু ব্যক্তি, যাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। এই মেরুকরণের নেতৃত্ব দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিকগোষ্ঠী নামের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং বাম নামের কয়েকজন জনগণ বিচ্ছিন্ন তথাকথিত চেতনার মানুষ।
এরপর ক্ষমতার রাজনীতির পট পরিবর্তনে ক্ষমতায় এলো আরেকবার বর্তমান আওয়ামী লীগ। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী মেনিফেস্টোর অন্যতম ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। জনগণও সম্মতি জানাল। কিন্তু এই বিচার নিয়ে যখন নোংরা রাজনীতি শুরু করল মূলত সরকার এবং তাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্কের রাজনৈতিক কিছু, সাম্প্রদায়িক পণ্ডিত ব্যক্তি তখন দেশ এই ব্যাপারে বিভক্ত হয়ে যান আমাদের অনেকের অজান্তে, অলক্ষ্যে। এই বিভক্তির বহিঃপ্রকাশ বলি বা বিদ্রোহের প্রকাশ যাই বলি না কেন, ঘটল যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে কিছু তরুণের সম্মিলিত প্রতিবাদ ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই’ দাবির মধ্য দিয়ে। সরকারও তাত্ক্ষণিকভাবে তরুণদের এই প্রতিবাদকে তাদের আসন্ন নির্বাচনের অন্যতম শক্তিশালী ‘আইকন’ মনে করে শাহবাগের তরুণদের দলীয় কোঠায় রাখতে চেষ্টা করেন। পুরো বিষয়টাকে তখন দেশের অধিকাংশ মিডিয়াও আবেগতাড়িত হয়ে অতি প্রচারের মাধ্যমে দেশের ভেতর অনেকটা মতান্তরে প্যারালাল সরকারের অবস্থা সৃষ্টি করল। এতে সংঘাত, সংঘর্ষ আগ্রাসী আক্রমণ বেড়ে চলল। রাজনীতির অস্তিত্বের মাঠে টিকে থাকতে জামায়াত ও বিএনপি মরিয়া হয়ে ওঠে। তখন কেউ দেশে অরাজকতা রোধের নামে আবার কেউ ধর্ম গেল ধর্ম গেলর নামে সহিংস আন্দোলনে জড়িয়ে যায়। দেশে অরাজকতা বিশৃঙ্খলা, বিভাজন, বিভক্তি, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক সংঘাত বৃদ্ধি পায়। সাধারণ জনগণ এর থেকে মুক্তি চায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌম অস্তিত্বের স্বার্থে। কোনো দল নয়, শ্রেণীগোষ্ঠীও নয়, কেবল শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনরত তরুণ সমাজও নয়। এই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে শর্তহীন সর্বদলীয় ডায়ালগ বা আলোচনার বিকল্প নেই। গণতন্ত্রকে রক্ষা করতেও সর্বদলীয় আলোচনা সঙ্কট নিরসনের পথ দেখালেও দেখাতে পারে। এই আলোচনায় দল, ইগো, পরসমালোচনাকে নয়, অগ্রাধিকারে রাখতে হবে দেশের সার্বিক কল্যাণকে উদার হৃদয়ে। পরিহার করতে হবে নেতিবাচক দলীয় ও ব্যক্তিগত কুরুচিকর লেভেলিংয়ের মনোবৃত্তিকেও। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, অভিযোগের প্রমাণ ছাড়া জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তি, নেতা নেতৃত্বকেও রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধের শত্রু, দেশদ্রোহী ইত্যাদি ধরনের গালাগালিকে ঐকমত্য সৃষ্টির আলোচনায় পরিহার করতে হবে। প্রবাসেও একই সঙ্গে আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে চর্চায় রাখতে হবে আমাদের দলীয় রাজনীতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার সংস্কৃতিতে। কারণ, নিজের দেশের সত্যিকার কল্যাণে স্বদেশে ও প্রবাসেও আমাদের সব রকমের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে নিজেদের রাগ-অনুরাগ ও বিবেক-বুদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই সভ্যতা। সার্বিক শোষণমুক্তি এই পথেই অগ্রসর হতে পারে।
কোনো ধরনেরই সাম্প্রদায়িক সংঘাত, দাঙ্গা, ফ্যাসাদ যেমন জনসমর্থন পেতে পারে না, একইভাবে কোনো ধরনের রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা, নেতিবাচক বা নির্মূলের সংস্কৃতিও দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে না। বিশেষ করে জাতীয় স্বার্থ ও ইস্যুতে আমাদের কেবল আবেগ নয়, যুক্তিমিশ্রিত আবেগকেই গুরুত্ব দিতে হবে। যুক্তি ও আবেগ এই উভয়ের মানবিক এবং বৈজ্ঞানিক চর্চাকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের কল্যাণের কথা ভাবলে যেকোনো যুদ্ধ, সংঘাত বা মেরুকরণের শুভ পরিণাম দেশের সাধারণ মানুষকে শোষণমুক্ত করতে সহায়ক হয়। দেশে এখন চলমান এক সন্ত্রাস, অরাজকতা, ও সাম্প্রদায়িক আগ্রাসী আন্দোলনে জড়িত পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে দেশের কিছু মানুষ। একে আরও ধূমায়িত ও কুয়াশা থেকে মুক্তি দিতে পারে দেশের সরকার, প্রধান বিরোধী দল এবং দল ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে দেশের গুণীসমাজ। বিভক্ত হয়ে নয়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে। এই কাজে তারা যত বেশি বিভক্ত থাকবেন বা হবেন, দেশে বিভাজনটা ততই বাড়বে। প্রবাসে এই বিষয়ে ঐক্যের ব্যাপারেও একই সত্য বাস্তব। এটা ১৯৭০ বা ’৭১ নয়। এখানে আমাদের শত্রু আমরা নিজেরা হয়ে গেলে, বিভক্তিতে জাতি টিকে থাকা কঠিন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রয়াত আব্রাহাম লিঙ্কনও একই কথা বহুবার বলেছেন যে, বিভক্ত জাতি কখনও তাদের কল্যাণে ভূমিকা রাখে না। জাতিকে ক্ষুদ্র চিন্তা ও নেতিবাচক স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকার কথা প্রয়াত মার্কিন মহান নেতা মার্টিন লুথার কিং দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা এবং আধুনিক সিঙ্কাপুরের মহান রূপকার লি কুয়ান ইউও বলেছেন বহুবার। এসব ইতিহাসকেও আমরা যেন ভুলে না যাই। পরিশেষে একজন সব ধর্মে শ্রদ্ধাশীল ও ইসলামধর্মে বিশ্বাসী হিসেবে বলব, আমার প্রতিবেশী সে যে ধর্ম, গোত্র, ভাষা, গোষ্ঠী বা বিশ্বাসেরই হন না কেন, তার জীবন ও সম্পদের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের বাইরে আমারও। এমনকি কোনো জীবজন্তুকেও অকারণে আঘাত বা কষ্ট দেয়ার কোনো অধিকার নেই আমার। পাশাপাশি যেকোনো ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক বা সামাজিক অপরাধ সেটা আমি বা যে-ই করি না, তারও বিচার এই ধরাতেই শেষ বলে বিশ্বাস করি না। আমরা পৃথিবীতে যে যত বড় বা ছোট অপরাধ করব, এর বিচার এখানে এটা হোক বা না হোক, এর পরের জগত্ ও জীবনে সুনির্দিষ্টভাবেই তা হবে। বিচারক হবেন স্বয়ং এই বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ। আমরা যদি এই ধরাতেই কেউ কাউকে তার অপরাধের জন্য এক বিন্দু পরিমাণ কম সাজা দিই, যারও যেমন হিসাব বা জবাব দিতে হবেই, তেমনি কাউকে এক বিন্দু পরিমাণ বেশি সাজা দিলে এরও জবাব দিতে হবে, বিশেষ করে এর বিচারক ও রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ককে। কিছু মাথা নয়, তবে সব মাথা মিলে সত্ উদ্দেশ্য থাকলে, রাষ্ট্রের কল্যাণ ত্বরান্বিত হতে পারে। তবে এর কোনো কিছুতেই কেবল দুনিয়ার রায়ে আমরা উল্লাসিত বা হতাশ—কোনোটাই যেন না হই। নিজের স্বাধীন বুদ্ধি ও বিবেককে যেন বন্ধক না দিই। এই বিশ্বাসটা জরুরি, যারা আমরা আল্লাহর তাকওয়ায় (ভয়ে) বিশ্বাস রাখি। সব ধর্মের গ্রন্থ ও আদর্শেও তাই ‘ক্ষমা’ই মানুষের মহান ও মানবিক ধর্ম বলেও বলা হয়েছে। এই ক্ষমার আদর্শ থেকে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিভক্ত করা অন্যায়। ক্ষমাও চাইতে হবে। একেও উপেক্ষা করার অবকাশ নেই।
আমরা যে যে ধর্মেই বিশ্বাস করি না তাতে অটল থেকেই যেন আমরা জাত, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে একে অন্যের কল্যাণে আসতে পারি। ব্যক্তিগত, দলীয়, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে আমরা যে যত বেশি শক্তিশালী, পরাক্রমশালী, ক্ষমতাবান, ঐশ্বর্যবান, সম্পদশালী, শাসক, শোষিত বা জ্ঞানী, পণ্ডিত, কবি, সাহিত্যিক, শ্রমিক, নেতা যে যা-ই হই না কেন, এই ধরাতে আমাদের সবকিছু যেমন ক্ষণিকের, ক্ষণস্থায়ী, তেমনি এই পৃথিবীটাও ক্ষণস্থায়ী। মুহূর্তের নিশ্চয়তা নেই এখানে যেই জীবন নামের অস্তিত্বের, তার কোনো কিছুর জন্য আমাদের লোভ, লালসা, স্বার্থপরতা, দুর্বলতা, উগ্রতা, হিংসা, প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধের চেয়ে উত্তম হলো ক্ষমা ও ত্যাগ, নির্লোভ, মহানুভবতা, একতা, ঐক্য, সহনশীলতা, পরমতে সহিষ্ণুতার বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক মন ও মননশীলতার বৈজ্ঞানিক চর্চা। এর বিপরীত ঘটলে সামগ্রিকভাবে আমাদের দ্বন্দ্ব ও এর আগ্রাসী শ্রেণীসংঘাত আমাদের টোটাল মানবিক অবক্ষয় এবং এর আর্থসামাজিক শোষণমুক্তির বিপক্ষেই ক্রিয়াশীল থাকবে বেশি। সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবে, লিখতে হবে পড়ে, বুঝতে হবে প্রজ্ঞার আলোকে। ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে— শোষণমুক্তি এই পথে। আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধ এটাই ছিল, এটাই থাকবে, আগ্রাসী শ্রেণীসংঘাতে শোষণমুক্তি হবে না।
লেখক : রাজনীতিবিশ্লেষক ও কলামিস্ট
আলোচনার ‘স্পটলাইট’ থেকে একটু সরে গিয়েছি। এবার ফিরে আসি। দেশে সর্বত্রই এখন কমবেশি উত্তেজনা, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও মোটা দাগে যাকে বলা যায় বিভাজন বিরাজ করছে। কারও মতে, দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ এত দিনে স্পষ্ট হলো। লন্ডন থেকে এই কথা লিখেছেন প্রখ্যাত কলামিস্ট ও সাংবাদিক আবদুল গফ্ফার চৌধুরী। তবে এ কথিত রাজনৈতিক মেরুকরণ সমাজ ও রাষ্ট্রের সাধারণ কোটি কোটি মানুষের পক্ষে না বিপক্ষে, সময় অবশ্যই তা বলে দেবে। প্রখ্যাত সমাজচিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার বলেছেন, দেশে নির্মূলের রাজনীতি চলছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নতুন সাংগঠনিক রূপ পাচ্ছে। আমাদের সময়ের অন্যতম চৌকস ও মেধাবী ছাত্র এখন সমাজচিন্তাবিদ সলিমুল্লাহ খান বলছেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষম পরিণতি নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন, ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এ বাংলাদেশের রাজনীতি। এসব কথা আমরা এখন প্রতিদিন দেশের দৈনিক পত্রিকা খুললেই পাই। শ্রদ্ধেয় প্রবীণ কলামিস্ট ও সাংবাদিক এবিএম মূসা, প্রখ্যাত আইনবিশেষজ্ঞ ব্যরিস্টার রফিক-উল-হক, সমাজগবেষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, সমাজগবেষক বদরুদ্দিন উমর, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজচিন্তাবিদ ড. পিয়াস করিম, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ ড. আকবর আলি খান, নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মোহাম্মদ, রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট মাহমুদুর রহমান মান্না—তাদের প্রত্যেকের কথায় সুস্পষ্ট যে দেশ ভালো নেই। দেশের বর্তমান ক্রান্তিকালকে উল্লিখিত ব্যক্তিরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েও দেখছেন। তাদের মধ্যে কেউ চরম হতাশার কথাও বলছেন, কেউ বা সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য এই সঙ্কটকে অনিবার্যভাবে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। কেউ একে চলমান সঙ্কটে, দলের দলীয় ফয়দা লুটের কথাও বলছেন। সংক্ষেপে দেশের মানুষ ভালো নেই। ভবিষ্যত্ কী হতে পারে, দেশের ভবিষ্যত্ কী—এটাও একটি প্রশ্ন। এটা শুধু আবেগের প্রশ্ন নয়। অনেক অরাজকতার হিসাব-নিকাশের প্রশ্ন। কঠিন বাস্তবতার প্রশ্ন। উত্পাদন, বাণিজ্য ও দেশের আর্থিক উন্নতির প্রশ্ন। উত্পাদন সম্পর্কেরও প্রশ্ন। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা যথার্থই বলেছেন, দেশ আজ কোন পথে যাচ্ছে, সেটা বড় প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন—জনগণের ভাগ্য আজ কোন পথে, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের ভবিষ্যত কী? আমাদের স্বাধীনতার চার কাল অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। দুঃখের বিষয়, রাজনৈতিকভাবে আমাদের জাতীয় ঐক্য ‘এখনও বিভেদের ঊর্ধ্বে’ যেতে পারেনি। দুর্ভাগ্য আমাদের, জাতীয় দাবি হয়ে গেছে দলীয় ইস্যু, জাতীয় নেতারাও হয়ে পড়েছেন আমাদের হাতে এবং আমাদের দলীয় চিন্তার সংকীর্ণতায় বন্দি। এরই ভয়ঙ্কর পরিণতি হচ্ছে, দেশের চলমান সঙ্কট ও আগ্রাসী শ্রেণীসংঘাতের একটি কারণ।
আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে রাজনীতির সূচনা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বহু আগের। তাই এ বিষয়টাকে অনেকটা দূরে রেখেই দেশকে বিভক্ত না করে একতা বজায় রেখে সামনের দিকে পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন আমাদের প্রয়াত অনেক নেতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও। তবু আমরা আজ এতগুলো যুগের পর এই বিষয়টাকে কেন্দ্র করে এতটা আগ্রাসী, উচ্ছৃঙ্খল, আবেগতাড়িত, একরোখা, জেদি, সর্বোপরি বিভক্ত হলাম কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা পেয়ে যাব সময়ের ইতিহাসে। অনেকের কাছে উদীয়মান, মননশীল অধ্যাপক বলে পরিচিত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার গ্রন্থ আমার একাত্তর-এ। (প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে) লিখছেন, ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে তার কথোপকথনের উদ্ধৃতি দিয়ে, ‘তাঁর সঙ্গে সেদিন দুটো বিষয়ে কথা হয়েছিলো। একটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রসঙ্গ ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসরদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়। তিনি বলেছিলেন, চেষ্টার ত্রুটি হবে না, তবে কাজটা সহজ হবে না। আমি জানতে চাই, কেন? তিনি বলেন, যুদ্ধবন্দি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাউকে বিচার করা সম্ভবপর হবে বলে তিনি মনে করেন না। আমি আবার জানতে চাই, কেন? তিনি বলেন, মার্কিনীদের চাপ আছে। তারা পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে, ভারতকে চাপ দিচ্ছে যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দিয়ে উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলতে। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধবন্দিদের বিচারে সোভিয়েট ইউনিয়ন ইচ্ছুক নয়, এমন কি ভারতও উত্সাহী নয়। এই অবস্থায় কার জোরে আপনি বিচার করবেন? আর মূল অপরাধীদের বিচার না করতে পারলে তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের বিচারের প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যেতে বাধ্য।’ (গ্রন্থ : আমার একাত্তর পৃষ্ঠা-১৮৩) লেখক, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আজকের প্রজন্মের জানা না থাকলেও চুয়াত্তরে আমরা যারা তরুণ ছিলাম, তাদের নিশ্চয়ই জানা আছে ঐতিহাসিক দিল্লি চুক্তির কথা। যার সিগনেটরি ছিলেন তত্কালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের শরণ সিং এবং পাকিস্তানের আজিজ আহমেদ। যে চুক্তির সম্ভবত ১৩ বা ১৫ প্যারাগ্রাফে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়ার কথা উল্লেখ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সেই ক্ষমার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে মাফ করে দিয়ে বাংলাদেশ দেখিয়ে দিল, বাঙালি জানে, কীভাবে মাফ করতে হয়। বঙ্গবন্ধুও চেয়েছিলেন, মানুষ অতীত ভুলে যাক এবং নতুন করে বন্ধুত্ব শুরু করুক। আজকের যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায়বিচার-প্রক্রিয়ায় ইতিহাসের এসব অধ্যায়কেও দ্ব্যার্থহীনভাবে উপেক্ষা করলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে তা প্রশ্নবিদ্ধ করতেই পারে। বিতর্কিত করতেই পারে। এটাই গণতন্ত্র, এটাই স্বাভাবিক। এই প্রশ্ন থেকে মুক্ত হয়ে আজকে কেন, শত বছর পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জাতির ন্যায্য দাবি এবং অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, যদি এই বিষয় নিয়ে কেউ বা সরকারও বাড়াবাড়ি না করে বা না করতো। দলীয়করণ বা বিষয়ের রাজনীতিকরণ না হতো অথবা না করা হয়। আমাদের বাড়াবাড়ি, আবেগ ও প্রতিহিংসার কারণেও বলা যায়, ইতিহাসের আরেক নির্মম ও নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। পারলেন না দেশের মানুষকে একে অন্যের বন্ধু বানাতে, ব্যর্থ হলেন রাজনীতিতে, ‘গণতন্ত্র’ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে। এরপর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ, প্রতিরোধ এসবের রাষ্ট্রীয়করণ এবং দলীয় মেরুকরণের বিকাশ ঘটে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে শুরুতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নামের একটি সংগঠন এবং এর অন্যতম উদ্যোক্তা প্রয়াত জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর আরেক মেরুকরণের পথে ধাবিত হয় তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক নামের কিছু ব্যক্তি, যাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। এই মেরুকরণের নেতৃত্ব দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিকগোষ্ঠী নামের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং বাম নামের কয়েকজন জনগণ বিচ্ছিন্ন তথাকথিত চেতনার মানুষ।
এরপর ক্ষমতার রাজনীতির পট পরিবর্তনে ক্ষমতায় এলো আরেকবার বর্তমান আওয়ামী লীগ। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী মেনিফেস্টোর অন্যতম ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। জনগণও সম্মতি জানাল। কিন্তু এই বিচার নিয়ে যখন নোংরা রাজনীতি শুরু করল মূলত সরকার এবং তাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্কের রাজনৈতিক কিছু, সাম্প্রদায়িক পণ্ডিত ব্যক্তি তখন দেশ এই ব্যাপারে বিভক্ত হয়ে যান আমাদের অনেকের অজান্তে, অলক্ষ্যে। এই বিভক্তির বহিঃপ্রকাশ বলি বা বিদ্রোহের প্রকাশ যাই বলি না কেন, ঘটল যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে কিছু তরুণের সম্মিলিত প্রতিবাদ ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই’ দাবির মধ্য দিয়ে। সরকারও তাত্ক্ষণিকভাবে তরুণদের এই প্রতিবাদকে তাদের আসন্ন নির্বাচনের অন্যতম শক্তিশালী ‘আইকন’ মনে করে শাহবাগের তরুণদের দলীয় কোঠায় রাখতে চেষ্টা করেন। পুরো বিষয়টাকে তখন দেশের অধিকাংশ মিডিয়াও আবেগতাড়িত হয়ে অতি প্রচারের মাধ্যমে দেশের ভেতর অনেকটা মতান্তরে প্যারালাল সরকারের অবস্থা সৃষ্টি করল। এতে সংঘাত, সংঘর্ষ আগ্রাসী আক্রমণ বেড়ে চলল। রাজনীতির অস্তিত্বের মাঠে টিকে থাকতে জামায়াত ও বিএনপি মরিয়া হয়ে ওঠে। তখন কেউ দেশে অরাজকতা রোধের নামে আবার কেউ ধর্ম গেল ধর্ম গেলর নামে সহিংস আন্দোলনে জড়িয়ে যায়। দেশে অরাজকতা বিশৃঙ্খলা, বিভাজন, বিভক্তি, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক সংঘাত বৃদ্ধি পায়। সাধারণ জনগণ এর থেকে মুক্তি চায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌম অস্তিত্বের স্বার্থে। কোনো দল নয়, শ্রেণীগোষ্ঠীও নয়, কেবল শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনরত তরুণ সমাজও নয়। এই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে শর্তহীন সর্বদলীয় ডায়ালগ বা আলোচনার বিকল্প নেই। গণতন্ত্রকে রক্ষা করতেও সর্বদলীয় আলোচনা সঙ্কট নিরসনের পথ দেখালেও দেখাতে পারে। এই আলোচনায় দল, ইগো, পরসমালোচনাকে নয়, অগ্রাধিকারে রাখতে হবে দেশের সার্বিক কল্যাণকে উদার হৃদয়ে। পরিহার করতে হবে নেতিবাচক দলীয় ও ব্যক্তিগত কুরুচিকর লেভেলিংয়ের মনোবৃত্তিকেও। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, অভিযোগের প্রমাণ ছাড়া জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তি, নেতা নেতৃত্বকেও রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধের শত্রু, দেশদ্রোহী ইত্যাদি ধরনের গালাগালিকে ঐকমত্য সৃষ্টির আলোচনায় পরিহার করতে হবে। প্রবাসেও একই সঙ্গে আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে চর্চায় রাখতে হবে আমাদের দলীয় রাজনীতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার সংস্কৃতিতে। কারণ, নিজের দেশের সত্যিকার কল্যাণে স্বদেশে ও প্রবাসেও আমাদের সব রকমের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে নিজেদের রাগ-অনুরাগ ও বিবেক-বুদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই সভ্যতা। সার্বিক শোষণমুক্তি এই পথেই অগ্রসর হতে পারে।
কোনো ধরনেরই সাম্প্রদায়িক সংঘাত, দাঙ্গা, ফ্যাসাদ যেমন জনসমর্থন পেতে পারে না, একইভাবে কোনো ধরনের রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা, নেতিবাচক বা নির্মূলের সংস্কৃতিও দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে না। বিশেষ করে জাতীয় স্বার্থ ও ইস্যুতে আমাদের কেবল আবেগ নয়, যুক্তিমিশ্রিত আবেগকেই গুরুত্ব দিতে হবে। যুক্তি ও আবেগ এই উভয়ের মানবিক এবং বৈজ্ঞানিক চর্চাকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের কল্যাণের কথা ভাবলে যেকোনো যুদ্ধ, সংঘাত বা মেরুকরণের শুভ পরিণাম দেশের সাধারণ মানুষকে শোষণমুক্ত করতে সহায়ক হয়। দেশে এখন চলমান এক সন্ত্রাস, অরাজকতা, ও সাম্প্রদায়িক আগ্রাসী আন্দোলনে জড়িত পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে দেশের কিছু মানুষ। একে আরও ধূমায়িত ও কুয়াশা থেকে মুক্তি দিতে পারে দেশের সরকার, প্রধান বিরোধী দল এবং দল ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে দেশের গুণীসমাজ। বিভক্ত হয়ে নয়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে। এই কাজে তারা যত বেশি বিভক্ত থাকবেন বা হবেন, দেশে বিভাজনটা ততই বাড়বে। প্রবাসে এই বিষয়ে ঐক্যের ব্যাপারেও একই সত্য বাস্তব। এটা ১৯৭০ বা ’৭১ নয়। এখানে আমাদের শত্রু আমরা নিজেরা হয়ে গেলে, বিভক্তিতে জাতি টিকে থাকা কঠিন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রয়াত আব্রাহাম লিঙ্কনও একই কথা বহুবার বলেছেন যে, বিভক্ত জাতি কখনও তাদের কল্যাণে ভূমিকা রাখে না। জাতিকে ক্ষুদ্র চিন্তা ও নেতিবাচক স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকার কথা প্রয়াত মার্কিন মহান নেতা মার্টিন লুথার কিং দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা এবং আধুনিক সিঙ্কাপুরের মহান রূপকার লি কুয়ান ইউও বলেছেন বহুবার। এসব ইতিহাসকেও আমরা যেন ভুলে না যাই। পরিশেষে একজন সব ধর্মে শ্রদ্ধাশীল ও ইসলামধর্মে বিশ্বাসী হিসেবে বলব, আমার প্রতিবেশী সে যে ধর্ম, গোত্র, ভাষা, গোষ্ঠী বা বিশ্বাসেরই হন না কেন, তার জীবন ও সম্পদের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের বাইরে আমারও। এমনকি কোনো জীবজন্তুকেও অকারণে আঘাত বা কষ্ট দেয়ার কোনো অধিকার নেই আমার। পাশাপাশি যেকোনো ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক বা সামাজিক অপরাধ সেটা আমি বা যে-ই করি না, তারও বিচার এই ধরাতেই শেষ বলে বিশ্বাস করি না। আমরা পৃথিবীতে যে যত বড় বা ছোট অপরাধ করব, এর বিচার এখানে এটা হোক বা না হোক, এর পরের জগত্ ও জীবনে সুনির্দিষ্টভাবেই তা হবে। বিচারক হবেন স্বয়ং এই বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ। আমরা যদি এই ধরাতেই কেউ কাউকে তার অপরাধের জন্য এক বিন্দু পরিমাণ কম সাজা দিই, যারও যেমন হিসাব বা জবাব দিতে হবেই, তেমনি কাউকে এক বিন্দু পরিমাণ বেশি সাজা দিলে এরও জবাব দিতে হবে, বিশেষ করে এর বিচারক ও রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ককে। কিছু মাথা নয়, তবে সব মাথা মিলে সত্ উদ্দেশ্য থাকলে, রাষ্ট্রের কল্যাণ ত্বরান্বিত হতে পারে। তবে এর কোনো কিছুতেই কেবল দুনিয়ার রায়ে আমরা উল্লাসিত বা হতাশ—কোনোটাই যেন না হই। নিজের স্বাধীন বুদ্ধি ও বিবেককে যেন বন্ধক না দিই। এই বিশ্বাসটা জরুরি, যারা আমরা আল্লাহর তাকওয়ায় (ভয়ে) বিশ্বাস রাখি। সব ধর্মের গ্রন্থ ও আদর্শেও তাই ‘ক্ষমা’ই মানুষের মহান ও মানবিক ধর্ম বলেও বলা হয়েছে। এই ক্ষমার আদর্শ থেকে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিভক্ত করা অন্যায়। ক্ষমাও চাইতে হবে। একেও উপেক্ষা করার অবকাশ নেই।
আমরা যে যে ধর্মেই বিশ্বাস করি না তাতে অটল থেকেই যেন আমরা জাত, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে একে অন্যের কল্যাণে আসতে পারি। ব্যক্তিগত, দলীয়, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে আমরা যে যত বেশি শক্তিশালী, পরাক্রমশালী, ক্ষমতাবান, ঐশ্বর্যবান, সম্পদশালী, শাসক, শোষিত বা জ্ঞানী, পণ্ডিত, কবি, সাহিত্যিক, শ্রমিক, নেতা যে যা-ই হই না কেন, এই ধরাতে আমাদের সবকিছু যেমন ক্ষণিকের, ক্ষণস্থায়ী, তেমনি এই পৃথিবীটাও ক্ষণস্থায়ী। মুহূর্তের নিশ্চয়তা নেই এখানে যেই জীবন নামের অস্তিত্বের, তার কোনো কিছুর জন্য আমাদের লোভ, লালসা, স্বার্থপরতা, দুর্বলতা, উগ্রতা, হিংসা, প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধের চেয়ে উত্তম হলো ক্ষমা ও ত্যাগ, নির্লোভ, মহানুভবতা, একতা, ঐক্য, সহনশীলতা, পরমতে সহিষ্ণুতার বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক মন ও মননশীলতার বৈজ্ঞানিক চর্চা। এর বিপরীত ঘটলে সামগ্রিকভাবে আমাদের দ্বন্দ্ব ও এর আগ্রাসী শ্রেণীসংঘাত আমাদের টোটাল মানবিক অবক্ষয় এবং এর আর্থসামাজিক শোষণমুক্তির বিপক্ষেই ক্রিয়াশীল থাকবে বেশি। সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবে, লিখতে হবে পড়ে, বুঝতে হবে প্রজ্ঞার আলোকে। ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে— শোষণমুক্তি এই পথে। আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধ এটাই ছিল, এটাই থাকবে, আগ্রাসী শ্রেণীসংঘাতে শোষণমুক্তি হবে না।
লেখক : রাজনীতিবিশ্লেষক ও কলামিস্ট
No comments