অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন মানবাধিকার যখন অগ্নিদগ্ধ, নিষ্পেষিত... by শেখ হাফিজুর রহমান

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের সূত্র ধরে যখন মানবাধিকার বিষয়ে লেখাটি শুরু করেছি, সাভারে ভবনধসের ঘটনায় ওই সময় পর্যন্ত নিহত শ্রমিকের সংখ্যা এক হাজার ১২৭ জন।
কয়েক মাস আগে, অর্থাৎ ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ১১১ জন পোশাকশ্রমিক। তাজরীন ফ্যাশনসের কর্মকর্তারা দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকদের সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য মূল ফটক খুলে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। শ্রমিকের জীবনের চেয়ে মূল্যবান হয়ে উঠেছিল কারখানার যন্ত্রপাতি। ওগুলো চুরি হওয়ার ভয়ে নাকি কর্মকর্তারা মূল ফটক খুলে দিতে অস্বীকৃতি জানান। এই হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের মানবাধিকার, যেখানে শ্রমিকের জীবনের চেয়ে যন্ত্রপাতি বেশি মূল্যবান! ওদিকে সাভারে ভবনে ফাটল দেখে শ্রমিকেরা কাজে যোগদান করতে চাননি। জোর করে তাঁদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করা হলো, আর লোভের আগুনে পুড়ে খাঁক হয়ে গেল শত শত শ্রমিকের জীবন।

২.
গত ২৩ মে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার বাংলাদেশবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে যে গত বছর বিনা বিচারে ৩০ জন খুন হয়েছেন এবং গুম হয়েছেন ১০ জন। ‘ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ বা গুমের কথা আমরা আগে শুনিনি। বাংলাদেশের মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিবেদনে গুমের ঘটনার উল্লেখ এবারই প্রথম। তবে নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে এটি বাংলাদেশের জন্য ভালো সংবাদ নয়। গুমের ঘটনা ঘটতে শুরু করার পর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, গুমের ঘটনা যখন বেড়ে যাচ্ছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা তখন কমে যাচ্ছে। এর ভেতরে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন।
মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিবেদনে আমরা যখন দেখি যে এক বছরে গুম হয়েছেন ১০ জন, আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ৩০, তখন সেটি আমাদের বেদনার্ত করে। কিন্তু যাঁরা খুন বা গুম হয়েছেন, তাঁরা তালিকাবদ্ধ সন্ত্রাসী কি না, অনেকগুলো খুনের মামলার আসামি বা বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো গোষ্ঠীর অস্ত্রের জোগানদাতা কি না, সে ব্যাপারে আমরা সবিস্তারে কিছুই জানতে পারি না। সে জন্য মানবাধিকারের বাইরেও এ ঘটনাগুলোর বৃহত্তর কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলাজনিত ফলাফল আছে কি না, সে বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের ঘটনা আমাদের ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতাকেই স্পষ্ট করে তোলে। কেননা, বিচারব্যবস্থা সব অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে না বলেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পথ প্রশস্ত হয়। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোভাবেই তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

৩.
অ্যামনেস্টি গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। একদিকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এ ধরনের সহিংসতা, সংকট ও অচলাবস্থা নজিরবিহীন। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাব্যবস্থা, পেশাগত কর্মকাণ্ড হুমকির মুখে। রাস্তায় বেরোলে কে কখন আক্রমণের শিকার হবে, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ভবনধসে কে কখন অপূরণীয় ক্ষতির মধ্যে পড়বে, কেউ তা জানে না। এর চেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর কী হতে পারে? এ রকম অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা প্রয়োজন। এতে করে বিদ্যমান অসহনীয় অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি পাব। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিগুলো পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারবে না।

৪.
অ্যামনেস্টি তার প্রতিবেদনে নারী এবং মেয়েশিশুদের ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুক দিতে না পারায় হত্যা, ধর্মীয় বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সালিসের মাধ্যমে দোররা মারা, পারিবারিক ও যৌন সহিংসতার কথা উল্লেখ করেছে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, কয়েক মাস আগে নারী ধর্ষণের ঘটনা কী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। নিত্যদিনকার রাজনৈতিক সহিংসতা ও লাশের স্তূপের নিচে নারীর সম্ভ্রমহানির ওই ভয়াবহ ঘটনাগুলো চাপা পড়ে গেছে। তবু দুটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হবে। মনে পড়ছে টাঙ্গাইলের ১৪ বছরের মেয়েটির কথা। মেয়েটি এমন পাশবিকতার শিকার হয়েছিল যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় চিকিৎসারত অবস্থায় সে কোনো পুরুষ দেখলে চিৎকার করে উঠছিল! মনে পড়ছে রাজবাড়ীর ছয় বছরের সেই বালিকার কথা, যাকে রইসউদ্দিন নামের এক পাষণ্ড প্রথমে ধর্ষণ করে, পরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে তাকে হত্যা করে। ছয় বছরের অবোধ বালিকা। তবু তাকে সেই পাশবিকতার শিকার হতে হলো।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াগুলোর দুর্বল হয়ে পড়া, মূল্যবোধের অবক্ষয়, অশ্লীল ও পর্নো ছবির প্রভাব, মেয়েদের প্রতি স্থূল ও ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ার ফলে মেয়েরা আজ অসম্মানিত ও নিরাপত্তাহীন। বিশেষ করে প্রান্তিক মেয়েদের অবস্থা খুব নাজুক। সমাজকাঠামোর গভীরে যে পুরুষালি আস্ফাালন রয়েছে, নারীকে পীড়ন করার এবং অধীন করে রাখার যে হিংস্র ও পশ্চাৎপদ মনোবৃত্তি অধিকাংশ পুরুষ ধারণ করে, তার ফলে নারীর ওপর সহিংসতা দিন দিন বেড়ে চলেছে।

৫.
গত বছরের সেপ্টেম্বরের একটি ঘটনা মানবাধিকার পরিস্থিতিকে নতুন মাত্রা (নেতিবাচক অর্থে!) দিয়েছে, বাংলাদেশের ৪৩ বছরের ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে সেটি উঠে এসেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা হামলার শিকার হন। চট্টগ্রামের পটিয়া ও কক্সবাজারের রামুতে ২০টি বৌদ্ধমন্দির ও আশ্রম, একটি হিন্দুমন্দির, বহু বাড়িঘর ও দোকান আক্রান্ত ও ভস্মীভূত হয়। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করতে চাই যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায় ঘোষণার পর জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী ও তাঁদের সহযোগীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের জীবন, সম্পত্তি ও মন্দিরের ওপর হামলা চালান।
লালন তাঁর গানে বলেছিলেন, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে?’ লালনের কোনো জাত নেই, লালন মানুষ। নজরুল লিখেছিলেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন/ কাণ্ডারী বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র! মুক্তিযুদ্ধের পর ৪৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও আমরা এখনো মানুষ হতে পারিনি। আমরা এখনো হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান। রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্থিক, পেশাগত—এমনতর নানা পরিচয় ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা আমাদের খণ্ডিত করে রেখেছে। বাংলাদেশ সংবিধানের মুখবন্ধ, জাতিসংঘ সনদ এবং সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় মানবাধিকার নিয়ে যত সুন্দর সুন্দর কথাই লেখা থাকুক না কেন, যত দিন আমরা লালন আর নজরুলের মতো সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে না পারব, তত দিন মানবাধিকার অগ্নিদগ্ধ হবে, সংখ্যালঘু ও নারী নিষ্পেষিত হবে, লোভের আগুনে মাটিচাপা পড়বেন শত শত শ্রমিক।
শেখ হাফিজুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক।
hrkarzon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.