দাহকালের কথা আবু সায়েদ by মাহমুদুজ্জামান বাবু
১৮-দলীয় জোটের ডাকা বুধবারের হরতালের দুই
দিন আগে রাজধানীর তোপখানা রোডে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের গানের দলের সঙ্গে
মহড়া শেষ করে প্রেসক্লাবের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।
রাত
সাড়ে ১০টা বেজে গেছে ততক্ষণে। পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় এত রাতে ফিরে
যাওয়ার সবচেয়ে সহজ বাহন রিকশা। অন্যান্য দিন প্রেসক্লাবের সামনের জায়গাটায়
অনেক রিকশা যাত্রীর আশায় দাঁড়িয়ে থাকে। আজ সেখানে শূন্যতা। অনেকক্ষণ পর
পুরানা পল্টনের দিক থেকে একটা খালি রিকশা আসতে দেখে হাত তুলে দাঁড় করালাম।
ততক্ষণে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি ভাড়া যা চাইবে তা-ই দেব। ফেরা দরকার
তাড়াতাড়ি। একদিকে শূন্য পাকস্থলীর চাপ, অন্যদিকে ঠিক রাত ১১টায় বাসার
কলাপসিবল গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার স্নায়বিক পীড়ন। এই রিকশাটি কোনোভাবেই হারানো
চলবে না। আমি তাঁর গায়ে হাত রাখি। যথাসম্ভব কোমল স্বরে বলি, ‘যাবেন?’
রিকশাওয়ালা জানতে চান কোথায় যাব আমি। বলি, পান্থপথ। স্কয়ার হাসপাতালের
সামনে। রাজাবাজার পর্যন্ত বলি না। পাছে এত রাতে গলির ভেতরে না ঢুকতে চেয়ে
এতটুকুও বাতিল করে দেন। রাজি হন তিনি।
রিকশায় উঠতে যাব, তখনই ঘামে ভেজা মানুষটি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘ভাড়া কইলেন না?’ আমি বলি, ‘সমস্যা নাই। আপনি চালান।’ কিন্তু তাঁর পা রিকশার প্যাডলে চাপ দেয় না। চালকের আসনে বসেই নিজের মাথাটি ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকান তিনি। ইতিমধ্যে আমি উঠে বসেছি যাত্রীর আসনে। আমি বলি, ‘আপনিই বলেন কত নেবেন?’
‘স্কয়ার হাসপাতালের সামনেই নামবেন তো?’
আমি মরিয়া হয়ে বলি, ‘হ্যাঁ, ওখানেই নামব, ঠিক ওখানেই।’
এবার তিনি বলেন, ‘৫০ টাকা দিবেন।’
আমি বিস্মিত হই। নতুন এসেছে ঢাকায়? অথবা অল্প দিন হলো রিকশা চালাচ্ছে কি? নিকট অতীতে এই দূরত্ব আমি কোনো দিন ৭০ টাকার নিচে অতিক্রম করিনি। দরদাম করলে, রিকশার সংখ্যা বেশি আর যাত্রীর সংখ্যা কম থাকলে অথবা হরতালের রাত হলে ৬০ টাকা হলো রিকশাচালকদের নির্ধারিত ন্যায্য ভাড়া। আমি তাঁকে সে কথা জানালে তিনি প্রবলবেগে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়েন। বলেন, ‘না না, ভাড়া ৫০ টাকা। আমি ৬০ টাকা নিমু ক্যান?’ আমি বলি, ‘ভাইরে, আমি আপনারে ৬০ টাকা দেব। আপনার অসুবিধা কী?’ উত্তর আসে না। পোড়া চেহারার মানুষটির বসে থাকার ভঙ্গিতে একধরনের গোঁ-ধরা ভাব দেখে হাল ছাড়ি। বলি, ‘আচ্ছা আপনাকে ৫০ টাকাই দেব।’ এবার রিকশাটা চলতে শুরু করে।
রিকশা কদম ফোয়ারা পেরোয়। ডান দিকে মোড় নিলে হাতের বাঁয়ে হাইকোর্টের সাদা দালান পেছনে সরে যেতে থাকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পার হই। রমনা পার্ক সবুজ মায়া নিয়ে রাতকে জড়িয়ে আছে। পার হই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শিশুপার্ক, শাহবাগ, হাতিরপুল বাজার হয়ে বসুন্ধরা শপিং মল পার হয়ে স্কয়ার হাসপাতালের সামনে এসে যখন রিকশাটি থামল, তখন তাঁর সারা শরীর ঘামে জবজবে, বুকটা উঠছে-নামছে।
আমি বলি, ‘আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব, রিকশাটা সাইড করবেন?’ তিনি চালকের আসন থেকে নেমে রিকশার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ান।
‘নাম কী আপনার?’
পুরোনো ময়লা একটা গামছায় মুখ-ঘাড় মুছতে মুছতে বলেন, ‘আবু সায়েদ।’
‘বাড়ি?’
‘বাড়ি নাই।’
‘নাই মানে?’
‘ছিল। এখন নাই। নদী ভাইঙ্গা নিছে।’
‘কোথায় ছিল?’
‘ভোলা।’
‘ভোলার কোথায়?’
‘চর মনপুরা।’
পরিবারের কথা জানতে চাইলে আবু সায়েদ পশ্চিম দিক বরাবর অনির্দিষ্ট আঙুল তুলে বলেন, স্ত্রী ও দুই বাচ্চাসহ থাকেন মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ। স্ত্রী বুয়ার কাজ করে অন্যের বাসায়। ঝুপড়ি বস্তিতে একজন বয়স্ক নারী আছেন। তাঁর কাছে অনেকেই বাচ্চা রেখে কাজে যায়। দুই বাচ্চার জন্য আবু সায়েদ সেই নারীকে মাস শেষে ৪০০ টাকা দেন। দুই বাসায় কাজ করে স্ত্রীর আয় হয় মাসে তিন হাজার টাকা। আবু সায়েদের নিজের আয় জানতে চাইলে বলেন, ‘জানি না।’ আমি তাঁকে ১০০ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিই। তাঁকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। বুকপকেট থেকে টাকা বের করে আবু সায়েদ আমাকে গুনে গুনে পাঁচটা ১০ টাকার নোট ফিরিয়ে দিয়ে রিকশা চালাতে চালাতে সামনের দিকে মিলিয়ে যান। একধরনের পরাজয়বোধ নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। কেন এই পরাজিতের অনুভূতি?
সন্দেহ নেই, আবু সায়েদ ব্যতিক্রমী চরিত্র। যে পেশায় তিনি আছেন, সেখানে এই মূল্যবোধ দুষ্প্রাপ্য। যে সময় ও সমাজে আমাদের বসবাস, তা কোনোভাবেই আমাদের ঔদার্য শেখায় না। আমরা অন্যকে ঠকাতে চাই, মিথ্যা বলি, অধিকাংশ সময়ই ব্যক্তিস্বার্থকে তুচ্ছ করতে পারি না। আমাদের বড় বড় রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিরা নির্বাচনের মনোনয়ন চেয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন এবং নির্বাচিত হলে সেই টাকা বহুগুণ বেশি ফেরত নিয়ে আসেন। আমাদের শিল্প-কলকারখানার মালিকেরা শ্রমিকের মেহনতে মুনাফা অর্জন করেন বিপুল, কিন্তু শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরিটুকুও দিতে চান না। আমাদের চেতনায় মধ্যযুগীয় কূপমণ্ডূক ধারণা অন্ধবিশ্বাস নিয়ে শিকড় ছড়ায় প্রতিদিন। অথচ আমাদের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আপসমুখী, শাসকদের অনুগামী এবং বেশির ভাগ সময়ই রুদ্ধবাক। যে কৃষক এই বিশ্ব মহামন্দার কালেও শস্যের বাম্পার ফলন ফলান এ দেশে, আমাদের মুখের প্রতিদিনের আহার জোটান এবং নিজে পান না উৎপাদন খরচ আর অন্যদিকে তৈরি পোশাকশিল্প খাতে যে পোশাককর্মী তাঁর অভূতপূর্ব দক্ষতা ও সস্তা শ্রম দিয়ে প্রতিবছর আনেন ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার, বিনিময়ে ভবনধসে, আগুনে পুড়ে অথবা বেঁচে থেকে ন্যূনতম মজুরির জন্য বিক্ষোভ করে প্রতিদিন জীবন্মৃত হতে থাকেন, সেই সব বাস্তবতার প্রতিফলন আমাদের সাহিত্যে, সংগীতে, শিল্পকলায়, রাজনীতিতে, বাজেটনীতিতে কই? রবীন্দ্র দিবস হয়, নজরুল দিবস হয়, বসন্ত উৎসব হয়, পয়লা বৈশাখ হয়, বিজয় দিবস হয়, একুশে ফেব্রুয়ারি হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় আলপনা আঁকার উৎসব হয়, মনুষ্যত্বের উৎসব হয় না কেন?
আবু সায়েদ, আমাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য ক্ষমা করবেন। আমরা আপাদমস্তক নিষ্কর্মা।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che24c@yahoo.com
রিকশায় উঠতে যাব, তখনই ঘামে ভেজা মানুষটি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘ভাড়া কইলেন না?’ আমি বলি, ‘সমস্যা নাই। আপনি চালান।’ কিন্তু তাঁর পা রিকশার প্যাডলে চাপ দেয় না। চালকের আসনে বসেই নিজের মাথাটি ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকান তিনি। ইতিমধ্যে আমি উঠে বসেছি যাত্রীর আসনে। আমি বলি, ‘আপনিই বলেন কত নেবেন?’
‘স্কয়ার হাসপাতালের সামনেই নামবেন তো?’
আমি মরিয়া হয়ে বলি, ‘হ্যাঁ, ওখানেই নামব, ঠিক ওখানেই।’
এবার তিনি বলেন, ‘৫০ টাকা দিবেন।’
আমি বিস্মিত হই। নতুন এসেছে ঢাকায়? অথবা অল্প দিন হলো রিকশা চালাচ্ছে কি? নিকট অতীতে এই দূরত্ব আমি কোনো দিন ৭০ টাকার নিচে অতিক্রম করিনি। দরদাম করলে, রিকশার সংখ্যা বেশি আর যাত্রীর সংখ্যা কম থাকলে অথবা হরতালের রাত হলে ৬০ টাকা হলো রিকশাচালকদের নির্ধারিত ন্যায্য ভাড়া। আমি তাঁকে সে কথা জানালে তিনি প্রবলবেগে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়েন। বলেন, ‘না না, ভাড়া ৫০ টাকা। আমি ৬০ টাকা নিমু ক্যান?’ আমি বলি, ‘ভাইরে, আমি আপনারে ৬০ টাকা দেব। আপনার অসুবিধা কী?’ উত্তর আসে না। পোড়া চেহারার মানুষটির বসে থাকার ভঙ্গিতে একধরনের গোঁ-ধরা ভাব দেখে হাল ছাড়ি। বলি, ‘আচ্ছা আপনাকে ৫০ টাকাই দেব।’ এবার রিকশাটা চলতে শুরু করে।
রিকশা কদম ফোয়ারা পেরোয়। ডান দিকে মোড় নিলে হাতের বাঁয়ে হাইকোর্টের সাদা দালান পেছনে সরে যেতে থাকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পার হই। রমনা পার্ক সবুজ মায়া নিয়ে রাতকে জড়িয়ে আছে। পার হই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শিশুপার্ক, শাহবাগ, হাতিরপুল বাজার হয়ে বসুন্ধরা শপিং মল পার হয়ে স্কয়ার হাসপাতালের সামনে এসে যখন রিকশাটি থামল, তখন তাঁর সারা শরীর ঘামে জবজবে, বুকটা উঠছে-নামছে।
আমি বলি, ‘আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব, রিকশাটা সাইড করবেন?’ তিনি চালকের আসন থেকে নেমে রিকশার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ান।
‘নাম কী আপনার?’
পুরোনো ময়লা একটা গামছায় মুখ-ঘাড় মুছতে মুছতে বলেন, ‘আবু সায়েদ।’
‘বাড়ি?’
‘বাড়ি নাই।’
‘নাই মানে?’
‘ছিল। এখন নাই। নদী ভাইঙ্গা নিছে।’
‘কোথায় ছিল?’
‘ভোলা।’
‘ভোলার কোথায়?’
‘চর মনপুরা।’
পরিবারের কথা জানতে চাইলে আবু সায়েদ পশ্চিম দিক বরাবর অনির্দিষ্ট আঙুল তুলে বলেন, স্ত্রী ও দুই বাচ্চাসহ থাকেন মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ। স্ত্রী বুয়ার কাজ করে অন্যের বাসায়। ঝুপড়ি বস্তিতে একজন বয়স্ক নারী আছেন। তাঁর কাছে অনেকেই বাচ্চা রেখে কাজে যায়। দুই বাচ্চার জন্য আবু সায়েদ সেই নারীকে মাস শেষে ৪০০ টাকা দেন। দুই বাসায় কাজ করে স্ত্রীর আয় হয় মাসে তিন হাজার টাকা। আবু সায়েদের নিজের আয় জানতে চাইলে বলেন, ‘জানি না।’ আমি তাঁকে ১০০ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিই। তাঁকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। বুকপকেট থেকে টাকা বের করে আবু সায়েদ আমাকে গুনে গুনে পাঁচটা ১০ টাকার নোট ফিরিয়ে দিয়ে রিকশা চালাতে চালাতে সামনের দিকে মিলিয়ে যান। একধরনের পরাজয়বোধ নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। কেন এই পরাজিতের অনুভূতি?
সন্দেহ নেই, আবু সায়েদ ব্যতিক্রমী চরিত্র। যে পেশায় তিনি আছেন, সেখানে এই মূল্যবোধ দুষ্প্রাপ্য। যে সময় ও সমাজে আমাদের বসবাস, তা কোনোভাবেই আমাদের ঔদার্য শেখায় না। আমরা অন্যকে ঠকাতে চাই, মিথ্যা বলি, অধিকাংশ সময়ই ব্যক্তিস্বার্থকে তুচ্ছ করতে পারি না। আমাদের বড় বড় রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিরা নির্বাচনের মনোনয়ন চেয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন এবং নির্বাচিত হলে সেই টাকা বহুগুণ বেশি ফেরত নিয়ে আসেন। আমাদের শিল্প-কলকারখানার মালিকেরা শ্রমিকের মেহনতে মুনাফা অর্জন করেন বিপুল, কিন্তু শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরিটুকুও দিতে চান না। আমাদের চেতনায় মধ্যযুগীয় কূপমণ্ডূক ধারণা অন্ধবিশ্বাস নিয়ে শিকড় ছড়ায় প্রতিদিন। অথচ আমাদের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আপসমুখী, শাসকদের অনুগামী এবং বেশির ভাগ সময়ই রুদ্ধবাক। যে কৃষক এই বিশ্ব মহামন্দার কালেও শস্যের বাম্পার ফলন ফলান এ দেশে, আমাদের মুখের প্রতিদিনের আহার জোটান এবং নিজে পান না উৎপাদন খরচ আর অন্যদিকে তৈরি পোশাকশিল্প খাতে যে পোশাককর্মী তাঁর অভূতপূর্ব দক্ষতা ও সস্তা শ্রম দিয়ে প্রতিবছর আনেন ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার, বিনিময়ে ভবনধসে, আগুনে পুড়ে অথবা বেঁচে থেকে ন্যূনতম মজুরির জন্য বিক্ষোভ করে প্রতিদিন জীবন্মৃত হতে থাকেন, সেই সব বাস্তবতার প্রতিফলন আমাদের সাহিত্যে, সংগীতে, শিল্পকলায়, রাজনীতিতে, বাজেটনীতিতে কই? রবীন্দ্র দিবস হয়, নজরুল দিবস হয়, বসন্ত উৎসব হয়, পয়লা বৈশাখ হয়, বিজয় দিবস হয়, একুশে ফেব্রুয়ারি হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় আলপনা আঁকার উৎসব হয়, মনুষ্যত্বের উৎসব হয় না কেন?
আবু সায়েদ, আমাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য ক্ষমা করবেন। আমরা আপাদমস্তক নিষ্কর্মা।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che24c@yahoo.com
No comments