বিনিয়োগশূন্য প্রবৃদ্ধির ফাঁদে দেশ by শওকত হোসেন
বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগের হার প্রায় একই
জায়গায় স্থির হয়ে আছে। সরকারি ব্যয় বাড়ানোর কারণে গত দুই অর্থবছরে বিনিয়োগ
সামান্য বেড়েছে। তবে বিপজ্জনক দিকটি হচ্ছে, বেসরকারি বা ব্যক্তি খাতের
বিনিয়োগ কমে গেছে।
এবার প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই
প্রবৃদ্ধি বিনিয়োগ বাড়িয়ে হয়নি। বিনিয়োগ ছাড়াই প্রবৃদ্ধি অর্জন বাংলাদেশের
অর্থনীতিতে এখন আলোচনার নতুন বিষয়। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের যে
মাথাপিছু আয়, সে অনুযায়ী এ দেশে বিনিয়োগের হার হওয়া উচিত মোট দেশজ উৎপাদনের
৩১ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ দেশে বিনিয়োগের হার ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ বড়
ধরনের বিনিয়োগ ঘাটতির মধ্যে আছে দেশ। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে বিনিয়োগের
পরিমাণ ২৫ শতাংশের আশপাশে রয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক এই পরিস্থিতিকে বলছে
বিনিয়োগ-ফাঁদ। এ থেকে বের হতে পারছে না দেশ।
তবে অর্থনীতিবিদেরা একে বলছেন বিনিয়োগশূন্য প্রবৃদ্ধি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা উল্লেখ করে বলেন, এই সরকার যে তার প্রাক্কলন অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারল না, তার সবচেয়ে বড় কারণ ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকে সচল করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। এটার প্রথম দিকের বড় কারণ ছিল বিদ্যুৎ ও গ্যাস না পাওয়া। পরবর্তী সময়ে কারণ হয়েছে ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারের অব্যবস্থাপনা। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, সরকারের বিনিয়োগে বাড়ানোর জন্য যে সংস্কার দরকার ছিল, তা করতে না পারা। এর প্রকট প্রমাণ হচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি বা পিপিপি প্রতিশ্রুতির বিন্দুমাত্র বাস্তবায়ন সরকার করতে পারেনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এই গবেষক মনে করেন, এতে সরকারই রাজনৈতিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কারণ, প্রাক্কলন অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি হলো না বলে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার যে প্রতিশ্রুতি সরকারের ছিল, সেই রাস্তাটা এখন আরও দীর্ঘ হয়ে গেল।
বিনিয়োগের উল্টো যাত্রা: আরও এক দিক থেকেও বাংলাদেশের অনন্য রেকর্ড রয়েছে। সঞ্চয়-বিনিয়োগের সম্পর্ক নিয়ে অর্থনীতির তত্ত্ব বাংলাদেশে কাজ করছে না। সাধারণত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বড় সমস্যা হচ্ছে, এসব দেশে আয় কম বলে জাতীয় সঞ্চয় কম। তাই বিনিয়োগযোগ্য অর্থও কম। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটেছে উল্টোটা। এখানে জাতীয় সঞ্চয় বেশি, জাতীয় বিনিয়োগ কম। বর্তমানে এখানে জাতীয় সঞ্চয়ের হার ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মানে, বাংলাদেশে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ আছে, কিন্তু বিনিয়োগ করার জায়গা বা পরিবেশ নেই।
শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগের হার ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ, জাতীয় সঞ্চয় ২৪ শতাংশ। আবার ভারতে বিনিয়োগের হার ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ, সঞ্চয়ের হার ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বিনিয়োগ-সঞ্চয়ের সম্পর্কটা এ রকম। উল্টোটাই কেবল বাংলাদেশে।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে পুঁজির সঞ্চয়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখনো বাংলাদেশে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর মূল জায়গা হলো পুঁজির সঞ্চয়ন, এর মাধ্যমেই আগাতে হবে। কিন্তু দেশে এ কাজটি ঠিকমতো হচ্ছে না বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন।
বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে: সবচেয়ে দুরবস্থা বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। এই সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর এখন তা কমে হয়েছে ১৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগের হার এটাই সর্বনিম্ন। আর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে (২০০৬-০৭ অর্থবছর) এর চেয়ে কম বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছিল, ১৯ দশমিক ০২ শতাংশ।
বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালনিসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত সংকটের কারণে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। আবার রাজনৈতিক সহিংসতা, সংঘর্ষ, হরতাল—এসব কারণেও ধীরে চলো নীতি বজায় রাখছেন তাঁরা। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণও নিচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ শতাংশ। যদিও দ্বিগুণেরও বেশি ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ সরবরাহে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ।
আমদানি ঋণাত্মক: বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে আমদানি কমে যাওয়া। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের তুলনায় তা কমেছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। এর আগে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয়ে সর্বশেষ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০০১-০২ অর্থবছরে, সাড়ে ৮ শতাংশ।
উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন না বলেই যে আমদানি হ্রাস পেয়েছে, তার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে, ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণও কমেছে। মার্চ পর্যন্ত সময়ে পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হলেও নিষ্পত্তি কমে গেছে। সূত্রগুলো বলছে, মূলত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেই পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে, অন্য খাতে নয়। সবচেয়ে বেশি কমছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি। এ ক্ষেত্রে নতুন ঋণপত্র খোলাও কমে গেছে।
কর্মসংস্থানে ঘাটতি: বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) হিসাব দিয়ে বলছে, বর্তমান সরকারের সময়ে দেশে গড় বিনিয়োগের হার ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর এর আগের পাঁচ বছরে বিনিয়োগ হয়েছিল গড়ে ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ গড় বিনিয়োগ বেড়েছে অতি সামান্য। সংস্থাটির হিসাবে, এই সরকারের আমলে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বিনিয়োগ কম হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকও মনে করে, বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের তুলনায় বিনিয়োগে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের হার ২৪ শতাংশের আশপাশে থাকছে বলেই প্রবৃদ্ধিও ৬ শতাংশের আশপাশে আটকে আছে। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, পুঁজি ও উৎপাদনের অনুপাত ৪:১ হলে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিনিয়োগের হার হতে হবে ২৪ শতাংশ। কিন্তু ৭ শতাংশ করতে হলে বিনিয়োগ বাড়িয়ে ২৮ শতাংশ করা প্রয়োজন। কিন্তু এ কাজটিই হচ্ছে না।
বিনিয়োগ স্থবিরতার শিকার হয়েছে নতুন কর্মসংস্থান। বিনিয়োগ না বাড়লেও জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তাই শিল্প খাতে কর্মসংস্থানও তেমন বাড়েনি। এতে গত চারটি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করা যায়নি।
শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে শ্রমশক্তির পরিমাণ পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৪১ লাখ মানুষের কাজ আছে। এর অর্থ, মাত্র ২৬ লাখ মানুষ বেকার। তবে এই পরিসংখ্যানে কৌশল রয়েছে। কারণ, জরিপেই বলা আছে যে পরিবারের মধ্যে কাজ করেন কিন্তু কোনো মজুরি পান না, এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১১ লাখ। এ ছাড়া আছেন আরও এক কোটি ছয় লাখ দিনমজুর। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশে প্রকৃত পক্ষে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর এখন প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছেন। সুতরাং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে অর্থনীতির ওপর। আর এ জন্য নতুন বিনিয়োগের বিকল্প নেই। অথচ বিনিয়োগই বাড়ানো যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিনিয়োগশূন্য প্রবৃদ্ধির কারণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে প্রভাব পড়ার কথা ছিল, তা হয়নি। তবে যাঁরা শ্রমবাজারে ইতিমধ্যে প্রবেশ করেছেন, তাঁরা হয়তো উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু নতুন করে যাঁরা শ্রমবাজারে ঢুকতে চাইছেন, তাঁরা কার্যকরভাবে যুক্ত হতে বা বাজারে ঢুকতে পারলেন না। এ জন্য সমাজে আয়বৈষম্য বাড়বে।
তবে অর্থনীতিবিদেরা একে বলছেন বিনিয়োগশূন্য প্রবৃদ্ধি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা উল্লেখ করে বলেন, এই সরকার যে তার প্রাক্কলন অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারল না, তার সবচেয়ে বড় কারণ ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকে সচল করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। এটার প্রথম দিকের বড় কারণ ছিল বিদ্যুৎ ও গ্যাস না পাওয়া। পরবর্তী সময়ে কারণ হয়েছে ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারের অব্যবস্থাপনা। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, সরকারের বিনিয়োগে বাড়ানোর জন্য যে সংস্কার দরকার ছিল, তা করতে না পারা। এর প্রকট প্রমাণ হচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি বা পিপিপি প্রতিশ্রুতির বিন্দুমাত্র বাস্তবায়ন সরকার করতে পারেনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এই গবেষক মনে করেন, এতে সরকারই রাজনৈতিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কারণ, প্রাক্কলন অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি হলো না বলে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার যে প্রতিশ্রুতি সরকারের ছিল, সেই রাস্তাটা এখন আরও দীর্ঘ হয়ে গেল।
বিনিয়োগের উল্টো যাত্রা: আরও এক দিক থেকেও বাংলাদেশের অনন্য রেকর্ড রয়েছে। সঞ্চয়-বিনিয়োগের সম্পর্ক নিয়ে অর্থনীতির তত্ত্ব বাংলাদেশে কাজ করছে না। সাধারণত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বড় সমস্যা হচ্ছে, এসব দেশে আয় কম বলে জাতীয় সঞ্চয় কম। তাই বিনিয়োগযোগ্য অর্থও কম। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটেছে উল্টোটা। এখানে জাতীয় সঞ্চয় বেশি, জাতীয় বিনিয়োগ কম। বর্তমানে এখানে জাতীয় সঞ্চয়ের হার ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মানে, বাংলাদেশে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ আছে, কিন্তু বিনিয়োগ করার জায়গা বা পরিবেশ নেই।
শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগের হার ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ, জাতীয় সঞ্চয় ২৪ শতাংশ। আবার ভারতে বিনিয়োগের হার ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ, সঞ্চয়ের হার ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বিনিয়োগ-সঞ্চয়ের সম্পর্কটা এ রকম। উল্টোটাই কেবল বাংলাদেশে।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে পুঁজির সঞ্চয়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখনো বাংলাদেশে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর মূল জায়গা হলো পুঁজির সঞ্চয়ন, এর মাধ্যমেই আগাতে হবে। কিন্তু দেশে এ কাজটি ঠিকমতো হচ্ছে না বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন।
বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে: সবচেয়ে দুরবস্থা বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। এই সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর এখন তা কমে হয়েছে ১৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগের হার এটাই সর্বনিম্ন। আর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে (২০০৬-০৭ অর্থবছর) এর চেয়ে কম বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছিল, ১৯ দশমিক ০২ শতাংশ।
বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালনিসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত সংকটের কারণে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। আবার রাজনৈতিক সহিংসতা, সংঘর্ষ, হরতাল—এসব কারণেও ধীরে চলো নীতি বজায় রাখছেন তাঁরা। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণও নিচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ শতাংশ। যদিও দ্বিগুণেরও বেশি ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ সরবরাহে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ।
আমদানি ঋণাত্মক: বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে আমদানি কমে যাওয়া। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের তুলনায় তা কমেছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। এর আগে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয়ে সর্বশেষ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০০১-০২ অর্থবছরে, সাড়ে ৮ শতাংশ।
উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন না বলেই যে আমদানি হ্রাস পেয়েছে, তার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে, ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণও কমেছে। মার্চ পর্যন্ত সময়ে পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হলেও নিষ্পত্তি কমে গেছে। সূত্রগুলো বলছে, মূলত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেই পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে, অন্য খাতে নয়। সবচেয়ে বেশি কমছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি। এ ক্ষেত্রে নতুন ঋণপত্র খোলাও কমে গেছে।
কর্মসংস্থানে ঘাটতি: বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) হিসাব দিয়ে বলছে, বর্তমান সরকারের সময়ে দেশে গড় বিনিয়োগের হার ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর এর আগের পাঁচ বছরে বিনিয়োগ হয়েছিল গড়ে ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ গড় বিনিয়োগ বেড়েছে অতি সামান্য। সংস্থাটির হিসাবে, এই সরকারের আমলে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বিনিয়োগ কম হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকও মনে করে, বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের তুলনায় বিনিয়োগে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের হার ২৪ শতাংশের আশপাশে থাকছে বলেই প্রবৃদ্ধিও ৬ শতাংশের আশপাশে আটকে আছে। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, পুঁজি ও উৎপাদনের অনুপাত ৪:১ হলে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিনিয়োগের হার হতে হবে ২৪ শতাংশ। কিন্তু ৭ শতাংশ করতে হলে বিনিয়োগ বাড়িয়ে ২৮ শতাংশ করা প্রয়োজন। কিন্তু এ কাজটিই হচ্ছে না।
বিনিয়োগ স্থবিরতার শিকার হয়েছে নতুন কর্মসংস্থান। বিনিয়োগ না বাড়লেও জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তাই শিল্প খাতে কর্মসংস্থানও তেমন বাড়েনি। এতে গত চারটি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করা যায়নি।
শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে শ্রমশক্তির পরিমাণ পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৪১ লাখ মানুষের কাজ আছে। এর অর্থ, মাত্র ২৬ লাখ মানুষ বেকার। তবে এই পরিসংখ্যানে কৌশল রয়েছে। কারণ, জরিপেই বলা আছে যে পরিবারের মধ্যে কাজ করেন কিন্তু কোনো মজুরি পান না, এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১১ লাখ। এ ছাড়া আছেন আরও এক কোটি ছয় লাখ দিনমজুর। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশে প্রকৃত পক্ষে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর এখন প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছেন। সুতরাং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে অর্থনীতির ওপর। আর এ জন্য নতুন বিনিয়োগের বিকল্প নেই। অথচ বিনিয়োগই বাড়ানো যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিনিয়োগশূন্য প্রবৃদ্ধির কারণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে প্রভাব পড়ার কথা ছিল, তা হয়নি। তবে যাঁরা শ্রমবাজারে ইতিমধ্যে প্রবেশ করেছেন, তাঁরা হয়তো উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু নতুন করে যাঁরা শ্রমবাজারে ঢুকতে চাইছেন, তাঁরা কার্যকরভাবে যুক্ত হতে বা বাজারে ঢুকতে পারলেন না। এ জন্য সমাজে আয়বৈষম্য বাড়বে।
No comments