আমাদের ঢাকার সমস্যা by সারোয়ার জামীল
বাংলাদেশের পত্রিকা ও টেলিভিশন
চ্যানেলগুলো খুললে যে সমস্যাটা সবচেয়ে প্রকট হিসেবে দেখা যায় তা হলো ঢাকার
যানজট। এ সমস্যা সমাধানের জন্য পাতাল রেল, আকাশ রেল, কমিউটার রেল,
ফ্লাইওভার ইত্যাদির উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু এসবই জরাজীর্ণ
সমস্যার ওপর প্রলেপ মাত্র। যানজট সমস্যার সমাধান করতে প্রথমেই চাই
ঢাকাকেন্দ্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ। এটা করতে গেলে রাজনীতি,
প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও সমাজব্যবস্থাসহ আমাদের দেশের মূল
অবকাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন। বিকেন্দ্রীকরণের প্রথম ধাপ হলো সরকারি ও
স্বায়ত্তশাসিত অনেক প্রতিষ্ঠানকে ঢাকা থেকে সরিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে
স্থানান্তর করা।
ঢাকা দেশের রাজধানী, এখানে সরকারের নীতিনির্ধারণকারী সংস্থা ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার দফতর থাকার প্রয়োজন নেই। আমেরিকার স্টেটগুলোর রাজধানী ওই স্টেটের বড় শহরগুলোতে থাকে না। যেমন, নিউইয়র্ক স্টেটের রাজধানী নিউইয়র্ক শহরে নয়, ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানী লস অ্যাঞ্জেলেস নয়।
বিকেন্দ্রীকরণের যেসব পদক্ষেপ প্রথমে নেওয়া যেতে পারে :সামরিক বিভাগের বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানের কার্যালয় ছাড়া অন্য দফতরগুলোকে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। শুধু মন্ত্রণালয় ছাড়া সরকারের অন্যান্য বিভাগের সদর দফতর এবং মহাপরিচালকের দফতরগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। যেমন, নৌচলাচল বিভাগ নারায়ণগঞ্জ, রেলওয়ে চট্টগ্রাম, সড়ক বিভাগ ময়মনসিংহ কিংবা মানিকগঞ্জ, চা বিভাগ সিলেট, বনবিভাগ পার্বত্য চট্টগ্রাম বা খুলনায় ইত্যাদি। আবার অনেক সরকারি দফতর, যেমন_ শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা কৃষি বিভাগ যেখানে সাধারণ লোকের নিত্য আসা-যাওয়া করতে হয় সেগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে প্রতি জেলায় তাদের সদর দফতর বানিয়ে দিতে হবে, যাতে সরকারি অনুদান, চাকরির পদোন্নতি বা বদলির তদবিরের জন্য জনসাধারণ বা সরকারি কর্মচারীদের ঢাকা ছুটতে না হয়। বিকেন্দ্রীকরণের প্রথম সমস্যা নতুন স্থাপনার জন্য ব্যয়। কিন্তু ঢাকায় বর্তমানে সরকারি দফতরগুলো যেসব বাড়িঘরে আছে সেগুলোর অনেক সরকারি মালিকানায় আর বাকিগুলো ভাড়ায় নেওয়া বেসরকারি বাড়ি। সরকারি বাড়িগুলো বিক্রি করে এবং বেসরকারিগুলোর ভাড়ার চুক্তি শেষ করে ওই অর্থে নতুন শহরগুলোতে বাড়ি তৈরি ও ভাড়া করা সম্ভব। এতে ওইসব ছোট ছোট শহরও উন্নত হবে এবং শহরগুলোর অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে সরকারি কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের ঢাকার বাইরে যাওয়ার অনীহা। তাদের এই অনীহার প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়, ঢাকার বাইরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বাসস্থান এবং বিনোদনের অভাব। প্রশ্ন হলো, ঢাকার বাইরে এসব গড়ে উঠেনি কেন?
ঢাকার বাইরে না যাওয়ার এই প্রবণতা স্বাভাবিক। ২০-৩০ বছর আগেও সরকারি কর্মচারীরা স্ত্রী পরিজনকে কর্মস্থলে নিয়ে যেতেন। তাদের ছেলেমেয়েরা স্থানীয় স্কুলে পড়ালেখা করত। এর দুটি ভালো দিক ছিল_ প্রথমত, নিজেদের ছেলেমেয়েরা স্থানীয় স্কুলে পড়ত বলে সরকারি কর্মচারীরা স্কুলের পড়ালেখার মান নিয়ে খুব সচেতন থাকতেন। ফলে প্রত্যেক জেলায় অন্তত একটা ভালো স্কুল গড়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় ছেলেমেয়েরা বড় শহর থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারত।
ঢাকাকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা শুধু ঢাকার পরিবেশ, আবাসন, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে না, এটা সবার পারিবারিক জীবনেও একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। ঢাকার বাইরে পরিবার স্থানান্তর করতে অনাগ্রহী ব্যক্তিদের দুটি সংসার চালাতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পরিবারকে মফস্বলের বিশাল সরকারি বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় ছোট বাড়ি বা ফ্ল্যাটে থাকতে হয়।
ঢাকার জনসংখ্যার স্ফীতি ও আনুষঙ্গিক সমস্যার আরও একটি কারণ হলো পানি, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশন, যানবাহনের ব্যবস্থা না করে অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর তৈরি করা। যেখানে আগে একটা বাড়িতে দুটি পরিবার থাকত, এখন সেখানে কম করে হলেও ২০টি পরিবার থাকে।
ঢাকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক এবং সহনীয় করতে হলে আমাদের নীতিনির্ধারকদের জরুরি ভিত্তিতে কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, জেলা শহরগুলোর উন্নয়নে অর্থায়ন বাড়িয়ে সেখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র, যোগাযোগ ও বিনোদন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। এরপর বেশিরভাগ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অফিস ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করতে হবে। ঢাকার বাইরে বাড়িঘর বানানোর জন্য বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। এটাকে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হিসেবে নিয়ে অগ্রসর না হলে ঢাকার জনজীবনের এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই।
স ড. সারোয়ার জামীল :ব্রিটেন প্রবাসী
ঢাকা দেশের রাজধানী, এখানে সরকারের নীতিনির্ধারণকারী সংস্থা ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার দফতর থাকার প্রয়োজন নেই। আমেরিকার স্টেটগুলোর রাজধানী ওই স্টেটের বড় শহরগুলোতে থাকে না। যেমন, নিউইয়র্ক স্টেটের রাজধানী নিউইয়র্ক শহরে নয়, ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানী লস অ্যাঞ্জেলেস নয়।
বিকেন্দ্রীকরণের যেসব পদক্ষেপ প্রথমে নেওয়া যেতে পারে :সামরিক বিভাগের বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানের কার্যালয় ছাড়া অন্য দফতরগুলোকে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। শুধু মন্ত্রণালয় ছাড়া সরকারের অন্যান্য বিভাগের সদর দফতর এবং মহাপরিচালকের দফতরগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। যেমন, নৌচলাচল বিভাগ নারায়ণগঞ্জ, রেলওয়ে চট্টগ্রাম, সড়ক বিভাগ ময়মনসিংহ কিংবা মানিকগঞ্জ, চা বিভাগ সিলেট, বনবিভাগ পার্বত্য চট্টগ্রাম বা খুলনায় ইত্যাদি। আবার অনেক সরকারি দফতর, যেমন_ শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা কৃষি বিভাগ যেখানে সাধারণ লোকের নিত্য আসা-যাওয়া করতে হয় সেগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে প্রতি জেলায় তাদের সদর দফতর বানিয়ে দিতে হবে, যাতে সরকারি অনুদান, চাকরির পদোন্নতি বা বদলির তদবিরের জন্য জনসাধারণ বা সরকারি কর্মচারীদের ঢাকা ছুটতে না হয়। বিকেন্দ্রীকরণের প্রথম সমস্যা নতুন স্থাপনার জন্য ব্যয়। কিন্তু ঢাকায় বর্তমানে সরকারি দফতরগুলো যেসব বাড়িঘরে আছে সেগুলোর অনেক সরকারি মালিকানায় আর বাকিগুলো ভাড়ায় নেওয়া বেসরকারি বাড়ি। সরকারি বাড়িগুলো বিক্রি করে এবং বেসরকারিগুলোর ভাড়ার চুক্তি শেষ করে ওই অর্থে নতুন শহরগুলোতে বাড়ি তৈরি ও ভাড়া করা সম্ভব। এতে ওইসব ছোট ছোট শহরও উন্নত হবে এবং শহরগুলোর অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে সরকারি কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের ঢাকার বাইরে যাওয়ার অনীহা। তাদের এই অনীহার প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়, ঢাকার বাইরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বাসস্থান এবং বিনোদনের অভাব। প্রশ্ন হলো, ঢাকার বাইরে এসব গড়ে উঠেনি কেন?
ঢাকার বাইরে না যাওয়ার এই প্রবণতা স্বাভাবিক। ২০-৩০ বছর আগেও সরকারি কর্মচারীরা স্ত্রী পরিজনকে কর্মস্থলে নিয়ে যেতেন। তাদের ছেলেমেয়েরা স্থানীয় স্কুলে পড়ালেখা করত। এর দুটি ভালো দিক ছিল_ প্রথমত, নিজেদের ছেলেমেয়েরা স্থানীয় স্কুলে পড়ত বলে সরকারি কর্মচারীরা স্কুলের পড়ালেখার মান নিয়ে খুব সচেতন থাকতেন। ফলে প্রত্যেক জেলায় অন্তত একটা ভালো স্কুল গড়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় ছেলেমেয়েরা বড় শহর থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারত।
ঢাকাকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা শুধু ঢাকার পরিবেশ, আবাসন, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে না, এটা সবার পারিবারিক জীবনেও একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। ঢাকার বাইরে পরিবার স্থানান্তর করতে অনাগ্রহী ব্যক্তিদের দুটি সংসার চালাতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পরিবারকে মফস্বলের বিশাল সরকারি বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় ছোট বাড়ি বা ফ্ল্যাটে থাকতে হয়।
ঢাকার জনসংখ্যার স্ফীতি ও আনুষঙ্গিক সমস্যার আরও একটি কারণ হলো পানি, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশন, যানবাহনের ব্যবস্থা না করে অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর তৈরি করা। যেখানে আগে একটা বাড়িতে দুটি পরিবার থাকত, এখন সেখানে কম করে হলেও ২০টি পরিবার থাকে।
ঢাকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক এবং সহনীয় করতে হলে আমাদের নীতিনির্ধারকদের জরুরি ভিত্তিতে কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, জেলা শহরগুলোর উন্নয়নে অর্থায়ন বাড়িয়ে সেখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র, যোগাযোগ ও বিনোদন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। এরপর বেশিরভাগ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অফিস ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করতে হবে। ঢাকার বাইরে বাড়িঘর বানানোর জন্য বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। এটাকে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হিসেবে নিয়ে অগ্রসর না হলে ঢাকার জনজীবনের এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই।
স ড. সারোয়ার জামীল :ব্রিটেন প্রবাসী
No comments