সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-গণতন্ত্রই রক্ষাকবচ by অজয় রায়

প্রবন্ধটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে খুশি হব। সাধারণভাবে আমার মতো সামান্য লোকের লেখা তার দৃষ্টিতে না পড়ারই কথা। তার পিএ ইচ্ছা করলে লেখাটি তার দৃষ্টিতে আনলেও আনতে পারেন।
দুঃখজনক এবং কৌতুককর হলেও আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা কিছু প্রবচন বা প্রবাদ সৃৃষ্টি করেছেন, যেগুলো মনে হয় কালজয়ী হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটি উল্লেখ করি, পাঠকরা যদি ভুলে গিয়ে থাকেন তাদের মনে করিয়ে দেওয়ার মানসে :
'আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে' (বিএনপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আলতাফ হোসেনের কালজয়ী উক্তি)।
তার আরও একটি স্মরণীয় উচ্চারণ আছে :২০০১ সালে দক্ষিণবঙ্গে বিএনপি-শিবির-জামায়াত দুর্বৃত্তরা যখন সংখ্যালঘু সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালায় সে সময় রামশীলে অনেক নিঃসহায় হিন্দু পরিবার আশপাশের জেলাগুলো থেকে আশ্রয় নেয়। তাদের দেখতে গিয়ে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, 'এই তথাকথিত নির্যাতিত হিন্দুদের দেখতে উল্কার মতো ছুটে গিয়েছিলাম, কিন্তু কোনো মানুষ দেখতে পাইনি।' রসিকজন মন্তব্য করেছিলেন, 'উল্কার বেগে গেলে তো না দেখারই কথা!'
বিএনপির আর একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, জনাব বাবরের একটি উচ্চারণ প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে : 'উই আর লুকিং ফর শত্রুজ' (ডব ধৎব ষড়ড়শরহম ভড়ৎ ্তুংযধঃৎঁং্থ র.ব. বহবসরবং)
কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, আন্দোলনের একজন পোড়খাওয়া নেত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। সে সময় তিনি জনসাধারণকে উদ্দেশ করে একটি সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, যা একটি কালজয়ী কৌতুকপূর্ণ প্রবাদে পরিণত হয়েছে। তার সাবধানবাণীটি ছিল : 'ঈদে বাড়ি গেলে ঘরে তালা লাগিয়ে যাবেন।' রসিকজনের সহাস্য মন্তব্য, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগে জনগণ কি বাড়ির দরজা হাঁ করে খোলা রেখে যেতেন? সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার অনেক অনেক আগে বাংলাদেশে সম্রাট অশোকের বা বাগদাদের সুলতান খলিফা হারুন অর রশীদের রাজত্বকাল ছিল। চোর, ছেঁচড়, দস্যু, ডাকাতরা তখন দস্যু রত্নাকরের মতো ঋষি এবং কবি বাল্মীকিতে উন্নীত হয়েছিলেন।
আমাদের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, যিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য, যার প্রতি আমার ব্যক্তিগত স্নেহসিক্ত শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে এবং তার মেধা ও ধীশক্তির ওপর আমার বিপুল আস্থা রয়েছে। কিন্তু তার মতো মানুষও যখন উক্তি করেন :
সাভারের রানা প্লাজা ভবনের 'ফাটল ধরা দেয়াল ও গেট ধরে নাড়াচাড়া করাতেই (বিএনপি কর্মীরা) ভবন ধসে পড়েছে'_ তখন তার ওপর আস্থার জায়গাটি নড়বড়ে হয়ে যায়, আর বলতে ইচ্ছে করে 'ঞযড়ঁ ঃড়ড় ইৎঁঃঁং!'
এর কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে ১৯ মে (২০১৩) ঘোষণা দিলেন যে আগামী এক মাস সারাদেশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ। ঘোষণাটির যৌক্তিকতা বা অযৌক্তিকতার প্রশ্ন না তুলেও আমার বিনীত প্রশ্ন, মাননীয় মন্ত্রী ঘোষণাটি আপনার মুখ থেকে আসতে হবে কেন। পুলিশের কাজ আপনাকে করতে হবে কেন?
তবে প্রসঙ্গত বলি, দেশের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায়নি যে আমার গণতান্ত্রিক অধিকার আপনি বা সরকার হরণ করবেন, তা আপনি পারেন না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে বলেই আমি মনে করি। কিছু দুর্বৃত্ত এবং জামায়াত-শিবির-হেফাজতের সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে বটে। এদের দমন করতে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবই যথেষ্ট। কাজেই আমার গণতন্ত্র হরণকারী নিষেধাজ্ঞাটি অনতিবিলম্বে তুলে নিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা ঠিক হবে না।
কিন্তু আমার আজকের বিষয় ভিন্ন। কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি ইসলাম-পছন্দ পত্রিকার পক্ষ থেকে ৮০ জন ব্লগারের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দফতরে প্রেরণ করে কোনো প্রমাণ ছাড়াই ঢালাও অভিযোগ তুলে যে তারা ধর্মদ্রোহী, ইসলাম ও পয়গম্বরের কুৎসা রটনাকারী। দুঃখের বিষয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটি গ্রহণ করেছে, এন্টারটেইন করেছে এবং উৎসাহ প্রদান করে তদন্তের জন্য একজন অতিরিক্ত(?) সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আর ওই সচিব একটি ই-মেইলের ঠিকানা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য পাঠাতে (যাদের জানা আছে)। এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, কারণ এর সুযোগ স্বার্থান্বেষী মহল গ্রহণ করতে পারে। সত্য-মিথ্যা বানোয়াট তথ্য দিয়ে সমগ্র বিষয়টিকে জটিল করে তোলা হবে। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আমার নিবেদন, ওই ই-মেইলটি এখনই অকার্যকর করার আদেশ দিন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে।
শুধু ইসলাম বা তার নবীদের সম্পর্কে নয়, যে কোনো ধর্ম বা তার প্রেরিত পুরুষ বা অবতার নিয়ে কটূক্তি, কটূক্তিকারীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইনে শাস্তির ব্যবস্থা আছে, যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য, যে বিজ্ঞজন বা আলেমরা এ অভিযোগ করেছেন তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তালিকা না পাঠিয়ে এই তথাকথিত নাস্তিক ও ইসলামদ্রোহী ধর্মবিরোধী ব্লগারদের বিরুদ্ধে প্রমাণসহ মামলা দায়ের করছেন না কেন? আদালতের দুয়ার তো খোলাই আছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখে আদালত রায় দেবেন ওরা দোষী বা নির্দোষ। এ নিয়ে আলেমদের একটি অংশের উচিত নয় ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারের চেষ্টা করা। এ প্রক্রিয়ায় আর যা-ই করা যাক, ইসলামের সেবা বা হেফাজত করা যায় না। কোরআনে কোনো দল বা কিছু আলেমকে ইসলামের হেফাজত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আল্লাহতালা স্বয়ং এই শান্তির ধর্মের প্রতিপালক, পৃষ্ঠপোষক এবং রক্ষাকারী। জামায়াত-শিবির বা হেফাজতে ইসলামের মতো কট্টর সাম্প্র্রদায়িক সংগঠনকে ইসলামের হেফাজত করার দায়িত্ব আল্লাহতালা দেননি।
উগ্র ইসলামপন্থি দলগুলোর 'ব্লগারদের' ওপর আক্রোশের কারণ বুঝি_ তারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে, সেক্যুলারিজমে ও উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বাসী, মুক্তমনা ও সবার ওপরে এরা মানবতাবাদী। নিজের আনন্দেই তারা লেখালেখি করে, তাদের ভাবনাচিন্তাও একান্ত ব্যক্তিগত, নিজেদের মাঝে মিথস্ক্রিয়া করলেও সমাজের সঙ্গে কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। এ নিয়ে তারা হৈচৈও করে না। কিন্তু তাদের এই আদর্শই জামায়াত-শিবির ও হেফাজতে ইসলাম গংয়ের গাত্রদাহের কারণ। অথচ ইসলামে, যে ইসলামকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই। যেমন ইসলাম বলে :
তোমরা মিথ্যা বলা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে (সূরা হজ, আয়াত ৩০)
ইসলাম অর্থ শান্তি। ইসলাম অর্থ স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ (সূরা বাকারা, আয়াত ১১২)
নিশ্চয় আল্লাহ বিদ্রোহ থেকে তোমাদের বারণ করেছেন (সূরা নাহ্ল, আয়াত ৯০)
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন : 'আমার উম্মতের মতবিরোধ রহমতের কারণ হবে' (আল হাদিস)
'লা ইকরাহা ফিদ্বীন' অর্থাৎ ধর্মের বিষয়ে কোনোরূপ বলপ্রয়োগ নেই (সূরা বাকারা, আয়াত ২৫৬)
অথচ পাঠক লক্ষ্য করুন, জামায়াত-শিবির-হেফাজতিরা কোন ধরনের ইসলামকে ধারণ ও মান্য করে ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের নিশ্চয় জানা আছে, আসিফ মহীউদ্দীন নামে এক ব্লগারকে ইসলামপছন্দ দুর্বৃত্তরা গত ১৪ জানুয়ারি নির্মমভাবে আঘাত করে হত্যার উদ্দেশ্যে। ভাগ্যগুণে আসিফ বেঁচে যান। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাতকারীরা গ্রেফতার হয়েছে কি-না এবং হয়ে থাকলে তাদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে কি-না আমার জানা নেই। কিন্তু আমার জানা আছে যে, পুলিশ আহত আসিফকে গ্রেফতার করে এই বলে যে, সে একজন ইসলামবিরোধী ব্লগার। সে এখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি। কিছুদিন থেকে সে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন। একই সঙ্গে ব্লগার মশিউর রহমান বিপ্লব, রাসেল পারভেজ ও সুব্রত শুভকে পুলিশ একই অভিযোগে গ্রেফতার করে। শুভ খবর হচ্ছে, তারা জামিনে মুক্তি পেয়েছে।
সুধী পঠিক, আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, একজন ব্লগার রাজীবকে দুর্বৃত্তরা কিছুদিন আগে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই দুর্বৃত্তদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে কি-না আমার জানা নেই। কেন আমরা ব্লগারদের প্রতি নির্মম আচরণ করছি বলতে পারেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়?
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনাকে বিবেকবান ও জনদরদি বুদ্ধিজীবী বলেই জেনে আসছি। আপনি কি মনে করেন না সমাজে প্রভাবহীন এই নির্দোষ (রহহড়পবহঃ) ব্লগারদের নিয়ে সরকার একটু বেশি মাত্রায় স্পর্শকাতরতার পরিচয় দিচ্ছে?
আমার সবিনয় কিন্তু জোরালো আবেদন, বিচারাধীন বা গ্রেফতারের জন্য পুলিশ খুঁজছে এমন ব্লগারদের মুক্তি দিন, মামলা তুলে নিন। মুক্তি দিন আসিফ মহীউদ্দীনকে। আর জেলে দিন রাজীব হত্যাকারীকে। শাহবাগ মঞ্চের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত তরুণ সমাজ, সেক্যুলার ও উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার নব প্রজন্মের সৈনিকরা দু'হাত তুুলে অভিনন্দন জানাবে, আবেগে আপনাকে জড়িয়ে ধরবে, আপনাকে ধন্য ধন্য করবে। সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

ড. অজয় রায় :শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.