পাকিস্তানে ভিক্ষাবৃত্তিতে মাফিয়া চক্র শিশুদের অপহরণ করে পঙ্গু করে দেয়া হয়

ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানেও গড়ে উঠেছে একটি মাফিয়া চক্র। এ চক্রটি হাজার হাজার শিশুকে জোর করে এ পেশায় নিয়োজিত করছে। এর মধ্য দিয়ে ওই শিশুরা সারা জীবনের জন্য দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকা পড়ছে। মুসলিম প্রধান দেশ পাকিস্তানে রয়েছে অনেক সূফী সাধকের মাজার।
সেখানে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ জিয়ারত করতে যায়। এ সময় তারা ভিক্ষুকদের হাতে অর্থ দান করেন। তাদের এই দানের সুযোগ নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যবসা গড়ে উঠেছে। অনলাইন বিবিসিতে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মোবিন আজহারের লেখা ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মাজারগুলো ভিক্ষুকদের প্রধান আকর্ষণের স্থান হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শিশু ভিক্ষুকদের জন্য তা আরও সুবিধাজনক। যারা মাজারে যান তারা মনে করেন গরিব লোকদের হাতে অর্থ দান করে মাজারে প্রার্থনা করলে তা কবুল হবে। রোশনি হেলপলাইন নামের দাতব্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী বলেছেন, এ জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে শিশুদের অপহরণ করে নিয়ে যায় ওই চক্রটি। তারপর তাদেরকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে বাধ্য করে। শুধু ২০১০ সালেই মাত্র করাচি থেকে ৩০০০ শিশু নিখোঁজ হয়েছে। এদের বেশির ভাগ শিশুকে পাকিস্তানের কোন না কোন মাজারের আশেপাশে রাখা হয়। দেখা যাবে তাদের কারো কারো মাথার চুল ফেলে দেয়া হয়েছে। কারো বা মাথায় বা শরীরে আঁকা হয়েছে উল্কি। এমনভাবে তা করা হয়েছে যাতে তার পিতামাতাও তাকে চিনতে না পারে। এ ব্যবসা এতটাই লোভনীয় যে, পুলিশও এতে তেমন হস্তক্ষেপ করে না। তারা শিশুদের কাছে জানতেও চায় না কিভাবে তারা মাজারে গিয়েছে। পাকিস্তানের কোন মাজারে কিছু সময় অপেক্ষা করলেই দেখা মেলে পঙ্গু ভিক্ষুকরা লোকজনের বেশি দৃষ্টি কাড়ে। তারা বেশি অর্থ সহায়তা পায়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই কোন শিশু যদি পঙ্গু না থাকে তাহলে তাকে পঙ্গু বানিয়ে দেয়া হয়। মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা এমন অনেক ঘটনা পেয়েছি যেখানে শিশুদের অঙ্গহানি করে দেয়া হয়েছে। তাদের চুল তুলে ফেলা হয়। একটি চোখ তুলে ফেলা হয়। এর কারণ, এই শিশুর প্রতি যাতে সহানুভূতি বেশি জন্মায়। বিনিময়ে সে বেশি অর্থ ভিক্ষা পায়। করাচির একটু বাইরের শহর হায়দরাবাদ। সেখানে তিন সন্তান, স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন ট্যাক্সিচালক মির মোহাম্মদ। তার বড় ছেলে মুমতাজ নিখোঁজ হয়ে গেছে সমপ্রতি। মির মোহাম্মদ বলেন, আমার সেই ছেলেটি চলাচলে অক্ষম। তার জন্য আমি সব চেষ্টাই করেছি। নিখোঁজ হওয়ার আগে সে হুইলচেয়ারে করে মাত্র বাড়ির বাইরে গিয়েছিল। তারপর থেকে তাকে আর আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ কেউ বলেন, তাকে জোর করে একটি রিকশায় তুলে নিতে দেখেছেন। তারা হতে পারে ভিক্ষাবৃত্তির মাফিয়া চক্র। মুমতাজের মতো শিশুরা এই চক্রের প্রধান আকর্ষণ। তাকে আমরা প্রায় সব মাজারে খুঁজেছি। কিন্তু পাই নি। আমরা তাকে ফিরে পেতে চাই। রোশনি হেল্পলাইনের কর্মীরা মুমতাজের ছবি টানিয়ে দিচ্ছেন মাজারে মাজারে। তাকে খুঁজে দিতে পুলিশকে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানে এত মাজার যে সেখানে নিখোঁজ কোন শিশুকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সুপরিচিত মাজারগুলোর মধ্যে একটি হলো গুজরাটের সূফী দোলি শাহ-এর মাজার। এখানে বেশি পর্যটক যান পাঞ্জাব থেকে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী। তারা ওই মাজারে যান সন্তান সম্ভবা হওয়ার আশায়। এ জন্য তাদের সামনে যেই আসে তারা তাকেই অর্থ দিয়ে খুশি করতে চান। বংশগতবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডা. কাশিম মেহদির মতে, পাকিস্তানে নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের ঘটনা বেশি। এর ফলে জেনেটিক বা বংশগত উর্বরা শক্তি সংক্রান্ত সমস্যা পাকিস্তানে বেশি। অতীতে তো বিকলাঙ্গ শিশুদের মাজারে দিয়ে দেয়াটাই একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এই ধারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে পরিত্যক্ত শিশুর সংখ্যা কমে গেছে। মেহেদি বলে, তা-ই বলে ভিক্ষা করা শিশুর সংখ্যা কমেনি। পরিত্যক্ত শিশুর তুলনায় এখন অপহরণ হওয়া শিশুর সংখ্যা বেশি। তিনি বলেন, যেসব মানুষ মাজারে যান তারা কোন কিছু জিজ্ঞাসা না করেই ভিক্ষুকদের হাতে অর্থ দিয়ে আসেন। তাদের দানের এই অর্থ কোথায় যাচ্ছে, কে পাচ্ছে, কিভাবে তা ব্যবহার হচ্ছে- এর কিছুই জানতে চান না তারা। রোশনি হেল্পলাইনের মোহাম্মদ আলী জনগণের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই সংস্কৃতি পাল্টাতে চান।

No comments

Powered by Blogger.