সাদাকালো-হরতালে আগুন ও ভাঙচুর সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে by আহমদ রফিক
হরতাল মানে প্রতিবাদ। শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক অন্যায় বা ভুলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদ বরাবরই শান্তিপূর্ণ। পঞ্চাশের দশকে ছাত্র আন্দোলন, মিছিল-সমাবেশ তার নজির রেখেছে।
এমনকি বায়ান্নর গুলিবর্ষণের পরও লাগাতার হরতাল, মিছিল সহিংসতার পরিচয় দেয়নি- গাড়ি-বাস ও মানুষ পোড়ানো তো দূরের কথা।
ষাটের দশকের শেষদিকে আইয়ুব-মোনায়েমি দুঃশাসনে ব্যাপক গুলিবাজি আর পাখির মতো মানুষ মারার প্রতিবাদে জনতা সহিংস হয়ে ওঠে। তখনো তাদের লক্ষ্য ছিল নির্দিষ্ট। অন্যায়ের ধারকবাহকের বাড়ি-গাড়ি। কিন্তু নির্বিচার ভাঙচুর- যা পাই তাই ভাঙি, ন্যায়-অন্যায় হিসাব নেই, এমন তো ছিল না হরতাল, প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশের সংস্কৃতি। তখনকার যাঁরা এখনো সহিসালামতে আছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ওপরের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন।
এখন হরতালের নামে কী হচ্ছে- যত্রতত্র যা কিছু সামনে পড়ে সব ভেঙে চুরমার। শুধু ভাঙাই নয়, নির্বিচার আগুন। তাতে গাড়ি পুড়ুক, মানুষ মরুক ক্ষতি নেই। বিবেকবোধ, মূল্যবোধ- সব উধাও। কিছুদিন আগে হরতালের নামে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে ঘুমন্ত চালককে পুড়িয়ে মারতে মাস্তানদের এতটুকুও হাত কাঁপেনি। এ কোন হরতাল, এ কোন রাজনীতি? জনমানুষের নামে, জনস্বার্থে প্রতিবাদের নামে এসব সহিংসতা কতটা জনস্বার্থে আর কতটা রাজনৈতিক স্বার্থে সে প্রশ্ন স্বভাবতই আসে। আসে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে।
আবার তাই বলে সরকার সমর্থক পাণ্ডারা মাঠে নেমে হরতাল ঠেকানোর নামে নিরীহ বিশ্বজিৎদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারবে- এটাও মেনে নেওয়া যায় না। তবে হরতালের নামে সহিংসতা, গাড়ি ভাঙচুর, মানুষ হত্যা- এসব নৈরাজ্য, এসব আপরাধধর্মী মনস্তত্ত্ব মেনে নেওয়া যায় না। এ সব কিছুর দায় বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি হরতাল আহ্বানকারীদের হরতালের নামে সক্রিয় অশুভ শক্তির।
কবে থেকে শুরু হয়েছে এ ভাঙচুর সংস্কৃতি, হরতালের নামে আগুন জ্বালানোর অমানুষিক রীতিনীতি? যত দূর মনে পড়ে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে হরতাল উপলক্ষে বা বিনা হরতালে মিছিল-সমাবেশ উপলক্ষে গাড়ি ভাঙচুর, টায়ার জ্বালানো, নিরীহ পথচারীকে মারধরের নৈরাজ্য শুরু হয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন? তাই সব জায়েজ। এর চেয়ে অনেক বেশি স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট চরিত্রের মুসলিম লীগ শাসনের অন্যায়-অত্যাচার, জেল-জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, আন্দোলনে এ জাতীয় কাণ্ড ঘটেনি। না ঘটিয়েও সাফল্য মিলেছে। যেমন পঞ্চাশে, তেমনি আশির দশকের শেষেও।
কিন্তু সেই নৈরাজ্য রাজনীতির মস্তিষ্ক কোষে বাসা বেঁধেছে। দিন দিন তার মাত্রা বৃদ্ধি ঘটছে, তীব্রতা বাড়ছে, এই যা। একের পর এক বৈনাশিক কর্মকাণ্ড ঘটে চলেছে অথচ হরতাল আহ্বানকারী রাজনৈতিক শক্তি বা নেতৃত্বের তাতে কোনো মাথাব্যথা নেই। পুড়ে যাক বাস, পুড়ুক মানুষ, হরতালের নামে আতঙ্ক জাগুক- এটাই এখন বিরোধী দলের হরতালের ভাষা অথবা স্লোগান।
কিন্তু হরতালের নামে, প্রতিবাদের নামে সমাজবিরোধী নৈরাজ্য- তা যে দলেরই হোক সমর্থনযোগ্য নয়। রাজনীতির ধীমানদের বলি, এ সর্বনাশা প্রতিবাদের ধরন পাল্টান, মাস্তানির রাশ টেনে ধরুন। এ প্রতিবাদের ধারা জনগণ পছন্দ করে না, যে জনগণের নামে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড চলছে, তাতে যে তাদের সায় নেই সে কথা জানতে-বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জনগণের নামে জনগণকে হয়রানি বন্ধ হোক।
উদাহরণ টানতে এর আগে হতভাগ্য বাসচালককে পুড়িয়ে মারার কথা যদি নাও বলি, তবু দুই দিন আগে (৬ জানুয়ারি) জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে বিএনপির ডাকা হরতালে সংঘটিত সহিংসতার পক্ষে কী জবাব দেবে তারা? আমরা আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে অল্প সময়ের ব্যবধানে দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিরোধী। বিরোধী এ কারণে যে এই মূল্যবৃদ্ধি যুক্তিসংগত নয়। যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নির্দেশের বিরুদ্ধে সরকারসহ সবাই সোচ্চার, যেসব নির্দেশ প্রায়শ আমাদের আত্মস্বার্থবিরোধী, সেসব নির্দেশ মানার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি এবং যার বেশির ভাগই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় না, সেসবের দাম বাড়বে কোন যুক্তিতে। লক্ষ করুন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করেছে সরকারেরই গঠিত বিদ্যুৎ জ্বালানি সম্পদবিষয়ক সংসদীয় কমিটি।
তাই প্রতিবাদে হরতাল ডাকা অন্যায় কিছু নয়। তাই বলে হরতালের এক দিন আগে বিকেল থেকে গাড়ি জ্বালানো, গাড়ি ভাঙচুর, ককটেল ফাটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি কোন বিচারে, কোন নীতিতে সমর্থনযোগ্য? জাতীয় সম্পদ নষ্ট, ব্যক্তিগত সম্পদ নষ্টের অধিকার তো হরতালের নেই। তাও আবার হঠাৎ করে এক দিন আগে থেকে, কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই? এও তো এক ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। মানুষের দুর্দশা-দুর্ভোগ বাড়ানো তো হরতালের কাজ নয়।
এর আগে বিএনপির ঘোষণা ছিল, 'বাধা দিলে বাধবে লড়াই।' কিন্তু তাদের কর্মসূচি তো নির্বিবাদে চলেছে। তার পরও হরতাল? জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে হরতাল ছাড়া অন্য কোনো কর্মসূচি নেওয়া যেত। এই তো হরতাল হলো, হরতাল পার হলো, সরকার তার আগের অবস্থানে। হরতাল কি তাহলে সফল হয়েছে? তাই বলা, বিকল্প কর্মসূচির। তবু হরতাল যদি ডাকাই হলো, তখন তা শান্তিপূর্ণভাবে চালানোর দায়িত্বও নেতৃত্বের ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি।
এখন হরতাল মানেই আগুন জ্বালানো, হরতাল মানেই বোমাবাজি, হরতাল মানেই নির্বিচার গাড়ি ভাঙচুর, গাড়ি পোড়ানো। হরতাল তাই ভেবেচিন্তে, পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে দেওয়া উচিত। আবারও বলছি, হরতালকে জ্বালাওপোড়াও, মানুষ মারার বাইরে রাখার দায়িত্ব- অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ হরতালের দায়িত্ব অবশ্যই হরতাল আহ্বানকারী রাজনৈতিক নেতৃত্বের। কিন্তু সে নীতি কেউ মানে না। তাই রবিবারের হরতালের আগেই শুরু হয়ে গেল অতর্কিতে গাড়ি পোড়ানো। বাদ গেল না ওষুধবাহী গাড়িও। হরতালেও তো জীবনরক্ষার দায় বলে ওষুধের দোকান খোলা থাকে এবং প্রয়োজনেই থাকে- তবু জীবনরক্ষাকারী ওষুধ বহনকারী গাড়িই পোড়ানো হলো, তা-ও আবার হরতালের এক দিন আগে। শনিবার তো হরতালের আওতায় ছিল না। তাহলে কেন সেদিন গাড়ি পোড়ানো হলো? কী জবাব দেবেন হরতাল আহ্বায়ক নেতৃত্ব?
আমরা জানি, এর জবাব নেই। জবাব নেই, কেন ওই শনিবার বাসগুলোতে আগুন দেওয়া হলো? এই সম্পদ নষ্ট ও মানুষের জীবনের ওপর হুমকির দায় তো হরতাল আহ্বানকারী রাজনীতির। দায় নিরপরাধ মানুষের গাড়ি পোড়ানোর। যাদের জন্য হরতাল ডাকা তাদেরই গাড়ি পোড়ানো, তাদেরই ক্ষতি করা, তাদেরই জীবন বিপন্ন করা কী তারা সংগত কাজ বলে মেনে নেবে? এ জাতীয় হরতালের রাজনীতি কী সমর্থন পাবে সংশ্লিষ্ট মানুষজনের?
না, পাবে না। হয়তো তাই সহিংসতার দায় তাঁরা সরকারের ওপর চাপাতে চেষ্টা করেছেন, যা প্রায়শই বিরোধী পক্ষ থেকে করা হয়ে থাকে। কিন্তু তাতে মানুষ ভুলবে না। ভুলবে না কারণ, হরতালবিষয়ক সহিংসতার অভিজ্ঞতা মানুষের রয়েছে। তারা জানে, কিসে কী হয়। সম্ভবত এ অপরাধবোধের কারণে রবিবারের হরতাল ততটা সহিংসতম হয়নি। তবু কাগজে শিরোনাম- 'নিরুত্তাপ হরতালে গাড়িতে আগুন'। এসব কারণেই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দাবি, হরতালে নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখুন, হরতাল শান্তিপূর্ণ হোক। বন্ধ হোক গাড়ি পোড়ানো সংস্কৃতি। আর সে হিসেবেই হরতালের কর্মীদের পরিচালনা করা হোক। এটা সব দলমতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
হরতাল যে শান্তিপূর্ণ হয়েও কার্যকর হতে পারে, তার প্রমাণ রেখেছে ১৮ ডিসেম্বর সিপিবি-বাসদের ডাকা হরতাল। এ হরতালও ছিল সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চরিত্রের। এ হরতালে দোকানপাট বন্ধের জবরদস্তি ছিল না, ছিল না ভাঙচুর সংস্কৃতির প্রকাশ। কর্মীদের হাতে ছিল না মোটা বাঁশের লাঠি বা চাপাতি, পিস্তল। তবু হরতাল সফল হয়েছিল, প্রতিবাদী বার্তাও ঠিকই ছিল। ভাঙচুরহীন শান্তিপূর্ণ এ হরতালের প্রশংসা শুনেছি অনেকের মুখে, পড়েছি কাগজে।
তাই ভাঙচুর না করলে, গাড়ি-বাস না পোড়ালে প্রতিবাদ হবে না, হরতাল জমবে না- এমন ধারণা যে ভুল সে প্রমাণ মানুষ পেয়ে গেছে। মানুষ শান্তিপূর্ণ হরতালের পক্ষে। বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ মানেই ভাঙচুর বা 'জ্বালাওপোড়াও' নয়, গণতান্ত্রিক রাজনীতির এ সত্য সব দলকেই বুঝতে হবে। হোক তা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কিংবা জামায়াত অথবা জাতীয় পার্টি। অবশ্য জাতীয় পার্টির ক্বচিৎ ডাকা হরতালে এ জাতীয় আলামত অপেক্ষাকৃত কম দেখা যায়।
তাই দেশের প্রধান দুই দলের প্রতিই আমাদের আহ্বান, আমাদের অনুরোধ- হরতালে সহিংসতা বর্জনে দলীয় কর্মীদের কঠোর নির্দেশ দিন, শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনে তাদের উদ্বুদ্ধ করুন। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে হরতালে সংঘটিত সহিংসতা, রক্ত বা মৃত্যু হরতালের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে। অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ হরতালে সরকারপক্ষে পুলিশি হঠকারিতা ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা কমায়।
এ বাস্তবতা যে প্রধান দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব জানেন না তা নয়, তবু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রকাশে তাঁরা বড় একটা আগ্রহী নন। বিরোধিতা নীতিসম্মত, মানবিকবোধসমৃদ্ধ হলে ক্ষতি কি? গণতান্ত্রিক সংসদীয় রাজনীতিই যদি দলের আদর্শ হয়ে থাকে, তাহলে এর নিয়মনীতিগুলো পালন করতে হবে, মূল্যবোধ অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।
সে জন্যই আর নয় হরতালে বা বিক্ষোভে বা সমাবেশে সহিংসতা। প্রতিবাদ হোক সুস্থ, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন। আর নয় হত্যার রাজনীতি, নয় কোনো নিরীহ, নিরপরাধ পরিবারের সর্বনাশ। বিনা অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় যেন কোনো গাড়ি বা বাস মালিক। ইতিবাচক রাজনীতির সংস্কৃতি সচল হোক আর সে পথ ধরেই যেন চলে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলাম লেখক
ষাটের দশকের শেষদিকে আইয়ুব-মোনায়েমি দুঃশাসনে ব্যাপক গুলিবাজি আর পাখির মতো মানুষ মারার প্রতিবাদে জনতা সহিংস হয়ে ওঠে। তখনো তাদের লক্ষ্য ছিল নির্দিষ্ট। অন্যায়ের ধারকবাহকের বাড়ি-গাড়ি। কিন্তু নির্বিচার ভাঙচুর- যা পাই তাই ভাঙি, ন্যায়-অন্যায় হিসাব নেই, এমন তো ছিল না হরতাল, প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশের সংস্কৃতি। তখনকার যাঁরা এখনো সহিসালামতে আছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ওপরের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন।
এখন হরতালের নামে কী হচ্ছে- যত্রতত্র যা কিছু সামনে পড়ে সব ভেঙে চুরমার। শুধু ভাঙাই নয়, নির্বিচার আগুন। তাতে গাড়ি পুড়ুক, মানুষ মরুক ক্ষতি নেই। বিবেকবোধ, মূল্যবোধ- সব উধাও। কিছুদিন আগে হরতালের নামে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে ঘুমন্ত চালককে পুড়িয়ে মারতে মাস্তানদের এতটুকুও হাত কাঁপেনি। এ কোন হরতাল, এ কোন রাজনীতি? জনমানুষের নামে, জনস্বার্থে প্রতিবাদের নামে এসব সহিংসতা কতটা জনস্বার্থে আর কতটা রাজনৈতিক স্বার্থে সে প্রশ্ন স্বভাবতই আসে। আসে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে।
আবার তাই বলে সরকার সমর্থক পাণ্ডারা মাঠে নেমে হরতাল ঠেকানোর নামে নিরীহ বিশ্বজিৎদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারবে- এটাও মেনে নেওয়া যায় না। তবে হরতালের নামে সহিংসতা, গাড়ি ভাঙচুর, মানুষ হত্যা- এসব নৈরাজ্য, এসব আপরাধধর্মী মনস্তত্ত্ব মেনে নেওয়া যায় না। এ সব কিছুর দায় বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি হরতাল আহ্বানকারীদের হরতালের নামে সক্রিয় অশুভ শক্তির।
কবে থেকে শুরু হয়েছে এ ভাঙচুর সংস্কৃতি, হরতালের নামে আগুন জ্বালানোর অমানুষিক রীতিনীতি? যত দূর মনে পড়ে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে হরতাল উপলক্ষে বা বিনা হরতালে মিছিল-সমাবেশ উপলক্ষে গাড়ি ভাঙচুর, টায়ার জ্বালানো, নিরীহ পথচারীকে মারধরের নৈরাজ্য শুরু হয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন? তাই সব জায়েজ। এর চেয়ে অনেক বেশি স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট চরিত্রের মুসলিম লীগ শাসনের অন্যায়-অত্যাচার, জেল-জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, আন্দোলনে এ জাতীয় কাণ্ড ঘটেনি। না ঘটিয়েও সাফল্য মিলেছে। যেমন পঞ্চাশে, তেমনি আশির দশকের শেষেও।
কিন্তু সেই নৈরাজ্য রাজনীতির মস্তিষ্ক কোষে বাসা বেঁধেছে। দিন দিন তার মাত্রা বৃদ্ধি ঘটছে, তীব্রতা বাড়ছে, এই যা। একের পর এক বৈনাশিক কর্মকাণ্ড ঘটে চলেছে অথচ হরতাল আহ্বানকারী রাজনৈতিক শক্তি বা নেতৃত্বের তাতে কোনো মাথাব্যথা নেই। পুড়ে যাক বাস, পুড়ুক মানুষ, হরতালের নামে আতঙ্ক জাগুক- এটাই এখন বিরোধী দলের হরতালের ভাষা অথবা স্লোগান।
কিন্তু হরতালের নামে, প্রতিবাদের নামে সমাজবিরোধী নৈরাজ্য- তা যে দলেরই হোক সমর্থনযোগ্য নয়। রাজনীতির ধীমানদের বলি, এ সর্বনাশা প্রতিবাদের ধরন পাল্টান, মাস্তানির রাশ টেনে ধরুন। এ প্রতিবাদের ধারা জনগণ পছন্দ করে না, যে জনগণের নামে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড চলছে, তাতে যে তাদের সায় নেই সে কথা জানতে-বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জনগণের নামে জনগণকে হয়রানি বন্ধ হোক।
উদাহরণ টানতে এর আগে হতভাগ্য বাসচালককে পুড়িয়ে মারার কথা যদি নাও বলি, তবু দুই দিন আগে (৬ জানুয়ারি) জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে বিএনপির ডাকা হরতালে সংঘটিত সহিংসতার পক্ষে কী জবাব দেবে তারা? আমরা আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে অল্প সময়ের ব্যবধানে দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিরোধী। বিরোধী এ কারণে যে এই মূল্যবৃদ্ধি যুক্তিসংগত নয়। যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নির্দেশের বিরুদ্ধে সরকারসহ সবাই সোচ্চার, যেসব নির্দেশ প্রায়শ আমাদের আত্মস্বার্থবিরোধী, সেসব নির্দেশ মানার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি এবং যার বেশির ভাগই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় না, সেসবের দাম বাড়বে কোন যুক্তিতে। লক্ষ করুন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করেছে সরকারেরই গঠিত বিদ্যুৎ জ্বালানি সম্পদবিষয়ক সংসদীয় কমিটি।
তাই প্রতিবাদে হরতাল ডাকা অন্যায় কিছু নয়। তাই বলে হরতালের এক দিন আগে বিকেল থেকে গাড়ি জ্বালানো, গাড়ি ভাঙচুর, ককটেল ফাটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি কোন বিচারে, কোন নীতিতে সমর্থনযোগ্য? জাতীয় সম্পদ নষ্ট, ব্যক্তিগত সম্পদ নষ্টের অধিকার তো হরতালের নেই। তাও আবার হঠাৎ করে এক দিন আগে থেকে, কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই? এও তো এক ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। মানুষের দুর্দশা-দুর্ভোগ বাড়ানো তো হরতালের কাজ নয়।
এর আগে বিএনপির ঘোষণা ছিল, 'বাধা দিলে বাধবে লড়াই।' কিন্তু তাদের কর্মসূচি তো নির্বিবাদে চলেছে। তার পরও হরতাল? জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে হরতাল ছাড়া অন্য কোনো কর্মসূচি নেওয়া যেত। এই তো হরতাল হলো, হরতাল পার হলো, সরকার তার আগের অবস্থানে। হরতাল কি তাহলে সফল হয়েছে? তাই বলা, বিকল্প কর্মসূচির। তবু হরতাল যদি ডাকাই হলো, তখন তা শান্তিপূর্ণভাবে চালানোর দায়িত্বও নেতৃত্বের ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি।
এখন হরতাল মানেই আগুন জ্বালানো, হরতাল মানেই বোমাবাজি, হরতাল মানেই নির্বিচার গাড়ি ভাঙচুর, গাড়ি পোড়ানো। হরতাল তাই ভেবেচিন্তে, পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে দেওয়া উচিত। আবারও বলছি, হরতালকে জ্বালাওপোড়াও, মানুষ মারার বাইরে রাখার দায়িত্ব- অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ হরতালের দায়িত্ব অবশ্যই হরতাল আহ্বানকারী রাজনৈতিক নেতৃত্বের। কিন্তু সে নীতি কেউ মানে না। তাই রবিবারের হরতালের আগেই শুরু হয়ে গেল অতর্কিতে গাড়ি পোড়ানো। বাদ গেল না ওষুধবাহী গাড়িও। হরতালেও তো জীবনরক্ষার দায় বলে ওষুধের দোকান খোলা থাকে এবং প্রয়োজনেই থাকে- তবু জীবনরক্ষাকারী ওষুধ বহনকারী গাড়িই পোড়ানো হলো, তা-ও আবার হরতালের এক দিন আগে। শনিবার তো হরতালের আওতায় ছিল না। তাহলে কেন সেদিন গাড়ি পোড়ানো হলো? কী জবাব দেবেন হরতাল আহ্বায়ক নেতৃত্ব?
আমরা জানি, এর জবাব নেই। জবাব নেই, কেন ওই শনিবার বাসগুলোতে আগুন দেওয়া হলো? এই সম্পদ নষ্ট ও মানুষের জীবনের ওপর হুমকির দায় তো হরতাল আহ্বানকারী রাজনীতির। দায় নিরপরাধ মানুষের গাড়ি পোড়ানোর। যাদের জন্য হরতাল ডাকা তাদেরই গাড়ি পোড়ানো, তাদেরই ক্ষতি করা, তাদেরই জীবন বিপন্ন করা কী তারা সংগত কাজ বলে মেনে নেবে? এ জাতীয় হরতালের রাজনীতি কী সমর্থন পাবে সংশ্লিষ্ট মানুষজনের?
না, পাবে না। হয়তো তাই সহিংসতার দায় তাঁরা সরকারের ওপর চাপাতে চেষ্টা করেছেন, যা প্রায়শই বিরোধী পক্ষ থেকে করা হয়ে থাকে। কিন্তু তাতে মানুষ ভুলবে না। ভুলবে না কারণ, হরতালবিষয়ক সহিংসতার অভিজ্ঞতা মানুষের রয়েছে। তারা জানে, কিসে কী হয়। সম্ভবত এ অপরাধবোধের কারণে রবিবারের হরতাল ততটা সহিংসতম হয়নি। তবু কাগজে শিরোনাম- 'নিরুত্তাপ হরতালে গাড়িতে আগুন'। এসব কারণেই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দাবি, হরতালে নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখুন, হরতাল শান্তিপূর্ণ হোক। বন্ধ হোক গাড়ি পোড়ানো সংস্কৃতি। আর সে হিসেবেই হরতালের কর্মীদের পরিচালনা করা হোক। এটা সব দলমতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
হরতাল যে শান্তিপূর্ণ হয়েও কার্যকর হতে পারে, তার প্রমাণ রেখেছে ১৮ ডিসেম্বর সিপিবি-বাসদের ডাকা হরতাল। এ হরতালও ছিল সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চরিত্রের। এ হরতালে দোকানপাট বন্ধের জবরদস্তি ছিল না, ছিল না ভাঙচুর সংস্কৃতির প্রকাশ। কর্মীদের হাতে ছিল না মোটা বাঁশের লাঠি বা চাপাতি, পিস্তল। তবু হরতাল সফল হয়েছিল, প্রতিবাদী বার্তাও ঠিকই ছিল। ভাঙচুরহীন শান্তিপূর্ণ এ হরতালের প্রশংসা শুনেছি অনেকের মুখে, পড়েছি কাগজে।
তাই ভাঙচুর না করলে, গাড়ি-বাস না পোড়ালে প্রতিবাদ হবে না, হরতাল জমবে না- এমন ধারণা যে ভুল সে প্রমাণ মানুষ পেয়ে গেছে। মানুষ শান্তিপূর্ণ হরতালের পক্ষে। বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ মানেই ভাঙচুর বা 'জ্বালাওপোড়াও' নয়, গণতান্ত্রিক রাজনীতির এ সত্য সব দলকেই বুঝতে হবে। হোক তা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কিংবা জামায়াত অথবা জাতীয় পার্টি। অবশ্য জাতীয় পার্টির ক্বচিৎ ডাকা হরতালে এ জাতীয় আলামত অপেক্ষাকৃত কম দেখা যায়।
তাই দেশের প্রধান দুই দলের প্রতিই আমাদের আহ্বান, আমাদের অনুরোধ- হরতালে সহিংসতা বর্জনে দলীয় কর্মীদের কঠোর নির্দেশ দিন, শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনে তাদের উদ্বুদ্ধ করুন। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে হরতালে সংঘটিত সহিংসতা, রক্ত বা মৃত্যু হরতালের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে। অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ হরতালে সরকারপক্ষে পুলিশি হঠকারিতা ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা কমায়।
এ বাস্তবতা যে প্রধান দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব জানেন না তা নয়, তবু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রকাশে তাঁরা বড় একটা আগ্রহী নন। বিরোধিতা নীতিসম্মত, মানবিকবোধসমৃদ্ধ হলে ক্ষতি কি? গণতান্ত্রিক সংসদীয় রাজনীতিই যদি দলের আদর্শ হয়ে থাকে, তাহলে এর নিয়মনীতিগুলো পালন করতে হবে, মূল্যবোধ অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।
সে জন্যই আর নয় হরতালে বা বিক্ষোভে বা সমাবেশে সহিংসতা। প্রতিবাদ হোক সুস্থ, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন। আর নয় হত্যার রাজনীতি, নয় কোনো নিরীহ, নিরপরাধ পরিবারের সর্বনাশ। বিনা অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় যেন কোনো গাড়ি বা বাস মালিক। ইতিবাচক রাজনীতির সংস্কৃতি সচল হোক আর সে পথ ধরেই যেন চলে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলাম লেখক
No comments