আগামী নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের অবসান হোক by মেজর (অব.) সুধীর সাহা
বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের আগে এ দেশের মানুষ বেশ অনেকটা অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা বদলের পালাটি সুন্দরভাবে হয়ে ওঠে না। নির্বাচনের আগে শুরু হয়ে যায় নানা রকম অশুভ তৎপরতা।
ক্ষমতায় বসা দলটি ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টায় মেতে ওঠে এবং গণতান্ত্রিক রাস্তায় অনিশ্চয়তার আঁচ লক্ষ করে অগণতান্ত্রিক উপায়ে টিকে থাকার পথ খুঁজে। অন্যদিকে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যেকোনো পথে ক্ষমতার আস্বাদ লাভে মরিয়া হয়ে ওঠে। ভোটের মাধ্যমেই হোক অথবা অন্য কোনো রাস্তায়ই হোক, ক্ষমতায় তাদের যেতেই হবে- এমন এক অশান্ত প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। মূলত এ অশান্ত প্রতিযোগিতা গত কয়েকটি নির্বাচন ধরে সীমাবদ্ধ আছে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে। এ দুটি দল ক্ষমতায় আসার পর দলবাজিতে মেতে ওঠে। সরকারি সব স্তরে তাদের নিজেদের দলের লোকদের খুঁজে বেড়ায় এবং বড় বড় পদ দিয়ে খুশি রাখে। পেশাজীবী সংগঠন ও অফিসগুলোতেও সরকার নিজ দলের লোক দিয়ে ভরে ফেলে। অন্য দলের বিশ্বাসী লোকদের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখে। এই দলবাজির খেলা থেকে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় সংগঠন কোনোটাই বাদ থাকে না। ফলে রাষ্ট্রের সর্বত্র সরকারদলীয় লোকজন দিয়ে ভরা থাকে। বিএনপির রাজত্বকালেও আমরা ঠিক এমনটাই দেখেছি এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ শাসনামলেও তাই দেখছি। দলীয়করণের এ মহাপ্লাবনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় কাঠামো বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে দলীয়করণের কারণে। সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হলো আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে দলীয় পেশাজীবী হিসেবে চিহ্নিত অনেক যোগ্য ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও সরকারি ও রাষ্ট্রীয় পদগুলোতে এ দল দুটি কেন যেন সেসব যোগ্য দলীয় লোক নিয়োগ না দিয়ে বরং তাদের চাটুকারিতায় পটীয়সী কিছু অযোগ্য দলীয় লোকদের বড় বড় পজিশনে নিয়োগ দিয়ে বসে। তাই সর্বত্র দেখা যায় অযোগ্য নেতৃত্ব। আর তাই তো হওয়া স্বাভাবিক। সরকার তো বিবেচনা করে তার দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, যোগ্যতা সেখানে গৌণ হয়ে পড়ে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই দলীয়করণ বিষয়টি আবার নতুন করে জাতীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় আরেকবার। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যাঁরা সরকারের দলীয় লোক হিসেবে সরকারের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই জানেন, এ সরকার সামনে ক্ষমতায় না যেতে পারলে তাঁদের কপালে দুঃখ আছে। তাই প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা চিন্তা করে তাঁরা সমষ্টিগতভাবে বর্তমান সরকারকেই আবার ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করেন। এ চেষ্টাতে তাঁদের যত নিচেই নামতে হয়, তাঁরা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেন না। কেননা বিষয়টি তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে মিশে আছে। আরেক দল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যাঁরা সরকারের সুনজরে নেই এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আছেন তাঁরা ঠিক নির্বাচনের আগে মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং যেমন করেই হোক সরকার বদলের সংগ্রামে নিজেদের ব্যাপৃত করে ফেলেন। এই দুই দল সরকারি লোকজন যাঁরা রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী তাঁরা এক অঘোষিত রাজনৈতিক সাংঘর্ষিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ঢুকে পড়েন। নানা অজুহাতে তাঁরা সরকারি দল এবং বিরোধী দলকে সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন। নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রেও এসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষপাতিত্বের বিষয়টি খুঁজে পাওয়া যায়। বড় দুই দল এমনভাবে শুধু রাজনৈতিক মাঠেই নয় বরং সমাজের সব স্তরেই বিভাজনের পথ পরিষ্কার করে রেখেছে। এ বিভাজন আমাদের সোনার দেশটিকে কুরে কুরে খাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তাই জনগণের এক অংশের কাছে জাতীয় নির্বাচন এক রকম প্রহসনের মতো মনে হয়। কেননা সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত যেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরপেক্ষতা, সেখানে আমাদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এই দুই শিবিরে বিভক্ত। তাই তাঁরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছেন না।
আর মাত্র এক বছর বাকি আছে সামনের জাতীয় নির্বাচনের। বরাবরের মতো এ নির্বাচনের জন্যও দুই দলের অজুহাত দাঁড় হয়ে আছে। একদল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে অনড় এবং অন্য দল অনির্বাচিত সরকার ব্যবস্থায় না ফেরার শক্ত অবস্থানে অনড়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন চায় না। সরকার কোনো অবস্থাতেই অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নেবে না। তাদের পক্ষে অজুহাত হিসেবে এসেছে বর্তমান সংবিধানের বিধানটি। হাইকোর্টের রায়ের জোরে এবং সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান পরিবর্তন করে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে রেখেছে আগেই। এখন তাদের দাবি, নির্বাচিত সরকার এবং বিরোধী দলের সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে কে থাকবেন তা-ও স্পষ্ট করেছে মহাজোট সরকার। অর্থাৎ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই থাকবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য অনেকবারই বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে এমনও বলেছেন। অর্থাৎ বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, সরকার চাচ্ছে হয় অন্তর্বর্তী সরকার অথবা বর্তমান সরকার এই দুয়ের যেকোনো একটির অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে।
অন্যদিকে বিএনপির নির্বাচনী অবস্থান বরাবরের মতোই উল্টো পথে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হলে তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। শুধু সেটুকুই নয়, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া কোনো নির্বাচন তারা হতে দেবে না। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে ইতিমধ্যে বিএনপি বেশ কয়েকবার হরতাল করেছে।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে। মহাজোটের ছোট ছোট দল যা-ই ভাবুক ও বুঝুক, আওয়ামী লীগ এবং বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা যা ভাববেন ও মনস্থ করবেন- সেটাই হবে মহাজোটের সিদ্ধান্ত। এখানে এরশাদের জাতীয় পার্টি ও অন্য ছোট দলগুলো তাঁর কথাই শেষ পর্যন্ত মেনে নেবে, তা সবাই জানে। অন্যদিকে ১৮ দলীয় জোটের মূল ক্ষমতা কিন্তু বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়ার হাতে। বিষয়টিকে যদি আরো সীমাবদ্ধ আঙ্গিকে দেখি, তাহলে সামনের নির্বাচনে প্রধান ইস্যু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বনাম দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার এবং আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা বনাম বিএনপির খালেদা জিয়া। এই মহান দুই নেত্রী আজ রাজনৈতিক মুখোমুখি। তাঁরা মুখোমুখি অবস্থায়ই সব সময় ছিলেন। কিন্তু এবারের বিষয়টি একটু ভিন্ন। কেননা সামনের নির্বাচনটি শুধু তাঁদের দুজন কিংবা তাঁদের দুই দলেরই ব্যাপার নয়; বরং বিষয়টি সারা দেশের। তাই আমরা উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত ও শঙ্কিত। খুব সংক্ষিপ্তভাবে যদি এ দুজনের দুটি দাবির দিকে তাকাই তাহলে দেখব, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থার জন্য আমাদের সংবিধান কি এখন প্রস্তুত? সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকবে। যদি এমনটাই হয় তবে সেখানে নির্বাচন হতে হবে বর্তমান সরকারের অধীনেই। অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা হতে হলে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। সংসদ ভাঙার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে কি আবার সংবিধানের পরিবর্তন প্রয়োজন পড়ছে না?
বিএনপি ক্ষমতায় এলেই তাঁরা মামলায় পড়বেন, নির্যাতিত হবেন এমন ভয় থেকেই তাঁরা বিএনপিকে ঠেকাতে মাঠে নামবেন। আবার অন্যদিকে গত চার বছর কষ্টে আছেন যাঁরা, ব্যক্তিস্বার্থের কথা চিন্তা করে তাঁরাও মরিয়া হয়ে উঠবেন কিভাবে এ সরকারের পতন ঘটানো যায় সেই কাজে।
বড় দুই দলের দুই নেত্রীই সম্ভবত এ সত্যটি ঠিক উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যদি তাঁরা তা বুঝতেন, তবে এটুকু বুঝতেন যে তাঁদের কথাবার্তায় এবং কাজকর্মে প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আভাস পাওয়া যাচ্ছে এবং এর ফলে সামনের দিনগুলোতে সংঘাতের পদধ্বনি পেয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দেশের সাধারণ জনগণ ভীত হয়ে পড়েছে। তাঁদের অন্তত এটুকু বোঝা উচিত, তাঁরা দুজন শুধু ব্যক্তিমানুষই নন, তাঁরা একজন প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যজন বিরোধীদলীয় নেতা। সংবিধান অনুযায়ী তাঁরা এ দেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। সুতরাং তাঁরা এমন কোনো কাজ করতে পারেন না যে কাজে দেশের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। শান্তিপূর্ণ অবস্থায় ক্ষমতার পালাবদলের স্বার্থে তাঁদের দুজনকে যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। সেখানে দুজন দুজনের প্রতি অশোভন বক্তব্য পেশের অথবা পাশাপাশি দেখা হলেও কথা না বলার অধিকার কিন্তু তাঁদের নেই। কেননা ব্যক্তিবিশেষের থেকেও তাঁদের সাংবিধানিক পরিচয়টি রাষ্ট্রের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। যেখানে জড়িয়ে আছে সারা দেশের ভাগ্য, সেই নির্বাচন নিয়ে খেয়ালের বশে তাঁরা দুজন যা কিছু করবেন বা বলবেন, এমন অরাজনৈতিক স্বাধীনতা কিন্তু তাঁরা ভোগ করেন না। এ সত্যটুকু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁরা যদি বুঝতে পারেন, তবে এ দেশের, এ রাষ্ট্রের এবং তাঁদের উভয়ের মঙ্গল নিহিত আছে। জনপ্রিয়তার দোহাই দিচ্ছেন দুজনই। দুজনই দাবি করছেন তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে সামনের নির্বাচনে। তবে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণে অথবা দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা গ্রহণে অথবা বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁদের এত 'না' কেন? জনগণের ওপর তাদের কি ভরসা নেই? তাই যদি থাকে, তবে পদ্ধতির ওপর নয় বরং আগামী নির্বাচনের ফলাফলের ভার তাঁরা ছেড়ে দিতে পারেন জনগণের ওপরই।
উভয় দলকেই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশের মিডিয়া কিন্তু এখন আর আগের জায়গায় নেই। এখন মিডিয়া অনেক শক্তিশালী এবং অনুসন্ধানী। মিডিয়াকে ফাঁকি দিয়ে নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে পাস করার স্বপ্ন কিন্তু এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজ এবং দেশের সাধারণ জনগণ কেউ কিন্তু আজ আর আগের জায়গায় নেই। সবাই এখন সোচ্চার এবং আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন। যেনতেনভাবে লোক-দেখানো নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব সমাজের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া কিন্তু আজকের দিনে প্রায় অসম্ভব। এ সত্যগুলো যদি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সত্যিই বুঝতে পারে, তবে আগামী নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? তবে কি তারা জনগণকে ভয় পায়? তবে কি তারা জনগণের ভোট নয় বরং অন্য পথে ক্ষমতা চায়? তাদের এমন অবস্থানের কারণে ভয় হচ্ছে আগামী নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে হবে তো? সঠিক প্রার্থী নির্বাচনে এ দেশের ভোটাররা স্বাধীনভাবে সুযোগটি পাবে তো?
লেখক : কলামিস্ট
আর মাত্র এক বছর বাকি আছে সামনের জাতীয় নির্বাচনের। বরাবরের মতো এ নির্বাচনের জন্যও দুই দলের অজুহাত দাঁড় হয়ে আছে। একদল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে অনড় এবং অন্য দল অনির্বাচিত সরকার ব্যবস্থায় না ফেরার শক্ত অবস্থানে অনড়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন চায় না। সরকার কোনো অবস্থাতেই অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নেবে না। তাদের পক্ষে অজুহাত হিসেবে এসেছে বর্তমান সংবিধানের বিধানটি। হাইকোর্টের রায়ের জোরে এবং সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান পরিবর্তন করে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে রেখেছে আগেই। এখন তাদের দাবি, নির্বাচিত সরকার এবং বিরোধী দলের সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে কে থাকবেন তা-ও স্পষ্ট করেছে মহাজোট সরকার। অর্থাৎ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই থাকবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য অনেকবারই বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে এমনও বলেছেন। অর্থাৎ বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, সরকার চাচ্ছে হয় অন্তর্বর্তী সরকার অথবা বর্তমান সরকার এই দুয়ের যেকোনো একটির অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে।
অন্যদিকে বিএনপির নির্বাচনী অবস্থান বরাবরের মতোই উল্টো পথে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হলে তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। শুধু সেটুকুই নয়, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া কোনো নির্বাচন তারা হতে দেবে না। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে ইতিমধ্যে বিএনপি বেশ কয়েকবার হরতাল করেছে।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে। মহাজোটের ছোট ছোট দল যা-ই ভাবুক ও বুঝুক, আওয়ামী লীগ এবং বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা যা ভাববেন ও মনস্থ করবেন- সেটাই হবে মহাজোটের সিদ্ধান্ত। এখানে এরশাদের জাতীয় পার্টি ও অন্য ছোট দলগুলো তাঁর কথাই শেষ পর্যন্ত মেনে নেবে, তা সবাই জানে। অন্যদিকে ১৮ দলীয় জোটের মূল ক্ষমতা কিন্তু বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়ার হাতে। বিষয়টিকে যদি আরো সীমাবদ্ধ আঙ্গিকে দেখি, তাহলে সামনের নির্বাচনে প্রধান ইস্যু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বনাম দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার এবং আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা বনাম বিএনপির খালেদা জিয়া। এই মহান দুই নেত্রী আজ রাজনৈতিক মুখোমুখি। তাঁরা মুখোমুখি অবস্থায়ই সব সময় ছিলেন। কিন্তু এবারের বিষয়টি একটু ভিন্ন। কেননা সামনের নির্বাচনটি শুধু তাঁদের দুজন কিংবা তাঁদের দুই দলেরই ব্যাপার নয়; বরং বিষয়টি সারা দেশের। তাই আমরা উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত ও শঙ্কিত। খুব সংক্ষিপ্তভাবে যদি এ দুজনের দুটি দাবির দিকে তাকাই তাহলে দেখব, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থার জন্য আমাদের সংবিধান কি এখন প্রস্তুত? সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকবে। যদি এমনটাই হয় তবে সেখানে নির্বাচন হতে হবে বর্তমান সরকারের অধীনেই। অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা হতে হলে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। সংসদ ভাঙার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে কি আবার সংবিধানের পরিবর্তন প্রয়োজন পড়ছে না?
বিএনপি ক্ষমতায় এলেই তাঁরা মামলায় পড়বেন, নির্যাতিত হবেন এমন ভয় থেকেই তাঁরা বিএনপিকে ঠেকাতে মাঠে নামবেন। আবার অন্যদিকে গত চার বছর কষ্টে আছেন যাঁরা, ব্যক্তিস্বার্থের কথা চিন্তা করে তাঁরাও মরিয়া হয়ে উঠবেন কিভাবে এ সরকারের পতন ঘটানো যায় সেই কাজে।
বড় দুই দলের দুই নেত্রীই সম্ভবত এ সত্যটি ঠিক উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যদি তাঁরা তা বুঝতেন, তবে এটুকু বুঝতেন যে তাঁদের কথাবার্তায় এবং কাজকর্মে প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আভাস পাওয়া যাচ্ছে এবং এর ফলে সামনের দিনগুলোতে সংঘাতের পদধ্বনি পেয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দেশের সাধারণ জনগণ ভীত হয়ে পড়েছে। তাঁদের অন্তত এটুকু বোঝা উচিত, তাঁরা দুজন শুধু ব্যক্তিমানুষই নন, তাঁরা একজন প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যজন বিরোধীদলীয় নেতা। সংবিধান অনুযায়ী তাঁরা এ দেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। সুতরাং তাঁরা এমন কোনো কাজ করতে পারেন না যে কাজে দেশের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। শান্তিপূর্ণ অবস্থায় ক্ষমতার পালাবদলের স্বার্থে তাঁদের দুজনকে যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। সেখানে দুজন দুজনের প্রতি অশোভন বক্তব্য পেশের অথবা পাশাপাশি দেখা হলেও কথা না বলার অধিকার কিন্তু তাঁদের নেই। কেননা ব্যক্তিবিশেষের থেকেও তাঁদের সাংবিধানিক পরিচয়টি রাষ্ট্রের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। যেখানে জড়িয়ে আছে সারা দেশের ভাগ্য, সেই নির্বাচন নিয়ে খেয়ালের বশে তাঁরা দুজন যা কিছু করবেন বা বলবেন, এমন অরাজনৈতিক স্বাধীনতা কিন্তু তাঁরা ভোগ করেন না। এ সত্যটুকু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁরা যদি বুঝতে পারেন, তবে এ দেশের, এ রাষ্ট্রের এবং তাঁদের উভয়ের মঙ্গল নিহিত আছে। জনপ্রিয়তার দোহাই দিচ্ছেন দুজনই। দুজনই দাবি করছেন তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে সামনের নির্বাচনে। তবে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণে অথবা দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা গ্রহণে অথবা বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁদের এত 'না' কেন? জনগণের ওপর তাদের কি ভরসা নেই? তাই যদি থাকে, তবে পদ্ধতির ওপর নয় বরং আগামী নির্বাচনের ফলাফলের ভার তাঁরা ছেড়ে দিতে পারেন জনগণের ওপরই।
উভয় দলকেই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশের মিডিয়া কিন্তু এখন আর আগের জায়গায় নেই। এখন মিডিয়া অনেক শক্তিশালী এবং অনুসন্ধানী। মিডিয়াকে ফাঁকি দিয়ে নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে পাস করার স্বপ্ন কিন্তু এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজ এবং দেশের সাধারণ জনগণ কেউ কিন্তু আজ আর আগের জায়গায় নেই। সবাই এখন সোচ্চার এবং আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন। যেনতেনভাবে লোক-দেখানো নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব সমাজের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া কিন্তু আজকের দিনে প্রায় অসম্ভব। এ সত্যগুলো যদি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সত্যিই বুঝতে পারে, তবে আগামী নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? তবে কি তারা জনগণকে ভয় পায়? তবে কি তারা জনগণের ভোট নয় বরং অন্য পথে ক্ষমতা চায়? তাদের এমন অবস্থানের কারণে ভয় হচ্ছে আগামী নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে হবে তো? সঠিক প্রার্থী নির্বাচনে এ দেশের ভোটাররা স্বাধীনভাবে সুযোগটি পাবে তো?
লেখক : কলামিস্ট
No comments