পশ্চিমবঙ্গ লিটিল ম্যাগাজিন মেলা- মোহর চট্টোপাধ্যায়
জমজমাট ঠা-ায় রবীন্দ্রসদন চত্বর ঝলমল করে উঠল। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি থেকে শুরম্ন হলো দ্বাদশ লিটিল ম্যাগাজিন মেলা। চলল ১২ জানুয়ারি পর্যনত্ম। মেলার উদ্যোক্তা পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।
মেলার উদ্বোধন হলো রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে বাঁধা অস্থায়ী মঞ্চে। উপস্থিত ছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবতর্ী, মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। পাঁচদিন ধরে শুধু কবিতার জন্য গমগম করল মেলা প্রাঙ্গণ। অসংখ্য যুবক-যুবতী, নানা বয়সের মানুষ দারম্নণ উন্মাদনা নিয়ে যোগ দিলেন। রবীন্দ্রসদন চত্বরে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য অস্থায়ী স্টল। বাংলা আকাদেমি সভাঘর, জীবনানন্দ সভাঘর এবং অস্থায়ী মুক্তমঞ্চে কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল সাহিত্য বিষয়ক আলোচনাচক্র। বাংলা সাহিত্যের কিংবদনত্মিরা যেমন কবিতা পড়লেন পাশাপাশি সদ্যতরম্নণ অথবা তরম্নণী যাঁরা নতুন কবিতা লিখছেন তাঁরাও পড়লেন। দর্শক-শ্রোতারা সবার লেখা শুনলেন সমান মনোযোগে। কলকাতার তারকাখচিত কবিরা যেমন এলেন, গ্রাম-মফস্বল থেকেও এলেন অসংখ্য কবি।মেলা চলাকালীন কবিতা পড়লেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবতর্ী। তাঁর কবিতা পাঠের ভঙ্গি এবং কবিতা শীতের সন্ধেবেলাকে উষ্ণ করে তুলল। সমসত্ম মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনল তিনি পড়ছেন 'অমলকানত্মি রোদ্দুর হ'তে চেয়েছিল।'
শীতের কুয়াশায় আগুন জ্বলে উঠল যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 'নীরা'কে নিয়ে লেখা একটি কবিতা পড়লেন। শ্রোতাদের অনুরোধে তিনি তারপর পড়লেন_ 'অরম্নন্ধতী সর্বস্ব আমার/ হাঁ করো, আ- আলজিভ চুমু খাও।' প্রবল হর্ষধ্বনিতে তখন যেন আতসবাজি জ্বলে উঠল শীতের রাতে।
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, কৃষ্ণ ধর, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, নবনীতা দেবসেন, কৃষ্ণা বসু, সুবোধ সরকার, মলিস্নকা সেনগুপ্ত, বীথি চট্টোপাধ্যায়, শ্যামলকানত্মি দাশ কবিতা পাঠ করলেন।
শ্রীজাত, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্দাক্রানত্মা সেন, মিতুল দত্ত, সেবনত্মী ঘোষ, পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়দের মতো কম বয়সীরাও বাদ গেলেন না।
বাংলা সাহিত্যের বিষয় এবং আঙ্গিকের বিভিন্ন ধারা নিয়ে চমৎকার আলোচনা হলো। ঠাকুরবাড়ির পত্রপত্রিকা নিয়ে আলোচনা হলো। জ্যোতির্ময় ঘোষ, প্রভাত কুমার দাস, অনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা বললেন বালক পত্রিকা, ভারতী পত্রিকার পরম্পরা নিয়ে।
লিটিল ম্যাগাজিনের নতুন শ্রেণি : বাণিজ্য-অবাণিজ্যের মধ্যপথে শীর্ষক আলোচনাচক্রটি এই সময়ের পৰে খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল। লিটিল ম্যাগাজিন কীভাবে বাণিজ্যের আওতায় চলে আসছে সেটা নিয়ে কথা বললেন জহর সেন মজুমদার, সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লিটিল ম্যাগাজিনের কবিরা।
আলোচনাচক্রগুলোর বৈশিষ্ট্য ছিল অনেক আলোচনার মধ্যে এই সময়ের প্রাসঙ্গিকতা। যেমন একটি আলোচনার বিষয় ছিল ইন্টারনেটে লিটিল ম্যাগাজিন। সেই আলোচনায় এটাই প্রমাণিত হলো বাংলা ভাষা এবং প্রযুক্তি এখন হাতে হাত মিলিয়ে বন্ধুর মতো এগিয়ে চলেছে।
কবিতা ছাড়াও এবারের মেলায় গল্প লেখকদের গল্প পাঠের আয়োজন করা হয়েছিল। স্বপ্নময় চক্রবতর্ী, আফসার আহমেদ, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গে নিজেদের ছোট গল্প পাঠ করলেন নবীন গল্প লেখকরা।
মেলায় অসংখ্য লিটিল ম্যাগাজিন বিক্রি হয়েছে। কৃত্তিবাস, বিভাব, অনুষ্টুপ, এৰণ, প্রতিৰণ, ভাষানগর, প্রথম আলো প্রভৃতি লিটিল ম্যাগাজিনের স্টলগুলো নবীন কবিতা লেখক ও পাঠকদের ভিড়ে ভরভরনত্ম ছিল।
কবিতা বা সাহিত্যকে ঘিরে এত উন্মাদনা হয়ত খুব কম জাতের মধ্যেই দেখা যায়। যে যুবকের পকেটে মাত্র দশ টাকা পড়ে আছে, সে হয়ত অনেকৰণ কিছু খায়নি সেও ঝপ করে কিনে ফেলছে কোন লিটিল ম্যাগাজিন। হয়ত তার কোন প্রিয় লেখকের লেখা সে ওই পত্রিকায় দেখেছে।
আবার অনেক সময় সাহিত্যে উৎসাহ দেখে সম্পাদকরা কোন গরিব পাঠকের কাছে পত্রিকার দাম নিচ্ছেন না_ এটাও ছিল মেলার অতি পরিচিত দৃশ্য। একটি মেয়ে বর্ধমান থেকে ট্রেনে চেপে এসেছে তার পছন্দের কিছু পত্রিকা সংগ্রহ করতে। সে টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়। তবু লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় প্রতিবছর এসে কপর্দকশূন্য হতে তার সমস্যা হয় না। এভাবেই সাহিত্যের প্রতি আবেগে-ভালবাসায় হই হই করে শেষ হলো দ্বাদশতম লিটিল ম্যাগাজিন মেলা।
No comments