নতুনের জন্য জায়গা ছাড়ুন by আবু এন এম ওয়াহিদ
প্রায় চার যুগ আগে যখন স্কুলে পড়তাম তখন কোনো এক বোশেখের রাতে ভীষণ শিলাবৃষ্টি আর ঝড়-তুফান হয়েছিল। বিজলি-চমক, আকাশের কড়কড় শব্দ আর বাতাসের শোঁ শোঁ ধ্বনিতে বাড়িশুদ্ধ সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে একরুমে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। অবশেষে ঝড় থামলে পরে ঘুমোতে গিয়েছিলাম।
অল্প বয়স তাই বুঝতে পারিনি, কিন্তু সে রাতে আমার ঘুমের ঘাটতি হয়েছিল বেশ ভালোই। সকালে উঠে দেখি প্রকৃতি একেবারে সাফ্সফা হয়ে ঝকঝক তকতক করছে। ঝড়ঝঞ্ঝার প্রসব-বেদনা থেকে জন্ম নিয়েছে এক রোদ ঝলমল ফকফকা দিন। কিন্তু চারদিকে এলোপাতাড়ি পড়ে থাকা গাছের ছিঁড়ে-পড়া তাজা সবুজ পাতা, ভাঙা ডাল আর একাধিক উপড়ানো গাছ জানান দিচ্ছিল গত রাতের বিভীষিকার কথা। এর মধ্যেও সবচেয়ে মজা পেয়েছিলাম ঝড়ে আক্রান্ত জবুথবু হয়ে যাওয়া এক শালিককে মাটিতে হাঁটাহাঁটি করতে দেখে। ধরতে গিয়ে দেখি সে উড়তে পারে না। পাখিটিকে অনেক দিন ধরে রেখেছিলাম। পরে বেচারা শালিককে ছেড়ে দিয়েছিলাম না সে মরে গিয়েছিল তা মনে নেই।
যদ্দূর মনে পড়ে সেদিন স্কুলে যাইনি। পরদিন বন্ধু-বান্ধবসহ স্কুল থেকে ফেরার পথে চোখে পড়ল প্রতিবেশীর এক বিশাল শিমুল গাছ গোড়া উপড়ে পড়েছে তাদের পুকুরে। আমাদের মাথায় বুদ্ধি এলো গাছের কাণ্ড এবং শাখা-প্রশাখা বেয়ে আমরা তো সহজেই একদম পুকুরের মাঝখানে পানির ওপরে চলে যেতে পারি। যেই ভাবা সেই কাজ, বইখাতা মাটিতে রেখে ডালপালা ধরে ধরে চিত হয়ে পড়ে থাকা গাছের বুকের ওপর দিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলাম পুকুরের পানির ওপর। সেখানে গিয়ে গাছের ডাল ধরে অনেকক্ষণ লাফালাফি করেছিলাম, ডাল ভেঙেছিলাম, পাতা ছিঁড়েছিলাম। সে যেন ছিল এক ভীষণ মজার খেলা। স্কুল থেকে ফেরার পথে এ খেলা আমরা প্রায়ই খেলতাম। আমার ধারণা ছিল, দু-এক সপ্তার মধ্যেই গাছটি মরে যাবে, কিন্তু তা হয়নি। বরং মাস-দেড়েক পরে দেখি চিত হওয়া ডালপালাগুলো খাড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠছে এবং সারা গাছে অসংখ্য নতুন পাতা গজাচ্ছে। সেই বয়সে এর চেয়ে আর বেশি কিছু বুঝিনি, ভাবিওনি। এখন বুঝি, ঝড়ে পড়ে গেলেই সব শেষ হয় না, সব গাছ মরে যায় না। ইদানীং, ছোটবেলার ওই ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করে 'পড়ে গেলেই মরে যায় না' শিরোনামে আমি একটি কবিতাও লিখেছি।
মাত্র সেদিন বহু যুগ পর প্রবাস জীবনে ন্যাসভিলের মাটিতে নতুন করে উল্টো ধরনের আরেকটি উপলব্ধি হলো, 'মরে গেলেই পড়ে যায় না'। এবার ঘটনাটি আরেকটু খোলাসা করেই বলছি। দিনটি ছিল শুক্রবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরছি। আসার পথে দোকানে নেমে সামান্য একটু গ্রোসারি কেনাকাটা করে গাড়িতে উঠেছি। এমন সময় দোকানের পাশে লাগানো কতগুলো ছোট ছোট ম্যাপল গাছের দিকে হঠাৎ নজর পড়ল। দেখলাম একটি ভিন্ন চিত্র। ভিন্ন এ জন্য বলছি, কারণ সময়টি ছিল ফেব্রুয়ারি মাস। ন্যাসভিলে ভর শীতের মৌসুম। শীতকালে পাইন জাতীয় এভারগ্রিন ট্রি আর ঝোপঝাড় বা শ্রাবারি ছাড়া অন্য কোনো গাছেই পাতা থাকে না, থাকার কথাও নয়। কিন্তু ম্যাপল গাছগুলোয় ভর্তি পাতা। তবে একটিও সবুজ নয়, সব মরা শুকনো বাদামি রঙের পাতা। অন্তত তিন মাস আগে পাতাগুলো মরে গেছে, কিন্তু অন্যান্য গাছের মতো মাটিতে ঝরে পড়েনি। এমনকি ঝড়বৃষ্টিতেও খুব একটা পড়ে না। বুঝলাম ম্যাপলের পাতা 'মরে গেলেও ঝরে না'। গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবতে লাগলাম আল্লাহর সৃষ্টি-জগতে এমন আর কিছু কী আছে, যে মরে গেলেও পড়ে না, জনমের ও জীবনের বন্ধন ছিন্ন করে না, করতে পারে না। সেদিনকার এ উপলব্ধিটা ছিল আমার কাছে নতুন, কিন্তু দৃশ্যটা নতুন নয়। আমি আগেও দেখেছি, শীতকালে ম্যাপলের পাতা মরে গেলেও ঝরে পড়ে না।
বিষয়টি হল শীতের শেষে, সপ্রীংএর শুরুতে অর্থাত এপ্রিল-মে মাসে গাছে গাছে যখন কুঁড়ি আসে, নতুন পাতা গজায়, তখন ম্যাপল গাছ মরা পাতাকে আর ধরে রাখতে পারে না। ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়ই হোক, মরা পাতার সঙ্গে প্রাণের বন্ধন ছিন্ন করে, শুকনো পাতা সবই একসঙ্গে ঝরিয়ে দেয়। এভাবে নতুনকে আলিঙ্গন করে পুরনোকে বিসর্জন দিয়ে। এটা প্রকৃতির সর্বজনীন নিয়ম, প্রকৃতিরই বিধান। এটা যে শুধু গাছের জীবনে সত্যি, তা নয়। সব ব্যাপারেই খাটে। বস্তু জগতের ক্ষেত্রে যেমন পুরনো জামা ছিঁড়ে গেলে নতুন জামা গায়ে দিই। টুথপেস্টের টিউব শেষ হয়ে গেলে নতুন একটা কিনে আনি। মানব জীবনের প্রতিটি স্তরেও এটা সমানভাবে সত্য, এটা চিরকালীন সত্য। জরাজীর্ণ বৃদ্ধরা মরে যায়, নবজাত শিশুর জন্য স্থান ছেড়ে দেয়। ছাত্রাবস্থায় বছর শেষে পুরনোরা নতুনের জন্য শ্রেণীকক্ষ ছেড়ে দেন। চাকরি জীবনে পুরনোরা ক্রমাগত অবসরে যাচ্ছেন আর নতুনরা এসে যোগ দিচ্ছেন। সময় ও স্রোত যেমন কারো জন্য অপেক্ষা করে না, তেমনি এ নিয়মেরও কারো জন্য কোথাও কোনো ব্যত্যয় হয় না, ব্যতিক্রম হয় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ নিয়মের একটি আংশিক ব্যতিক্রম দেখা যায়। এখানে অবসর বলে কোনো বিষয় নেই। পুরনোরা অবসর নিয়ে নতুনদের জায়গা করে দেন না। তবে দেন যখন মরে যান, যখন আর কোনো উপায় থাকে না। এখানে আমি বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের একটি কথা বলতে চাই। বুঝলাম আপনারা অতি জনপ্রিয়, অভিজ্ঞ, সাহসী, বিচক্ষণ এবং শক্তিশালী। অবসর না হয় না-ই নিলেন, কিন্তু মৃত্যুকে তো আর এড়াতে পারবেন না। তাই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে নতুনের জন্য জায়গা করার চিন্তা করুন। নতুনদের তৈরি করুন, কৌশল শেখান, তাঁদের মনে সাহস জোগান, প্রশিক্ষণ দিন। সময়মতো আপনাদের শূন্য স্থান পূরণ করার জন্য প্রস্তুত রাখুন। পৃথিবী চলমান, সবকিছু পরিবর্তনশীল। সুষ্ঠু, সুন্দর ও বাধাবিঘ্নহীন ট্র্যানজিশন বা উত্তরণের জন্য আগে থেকেই তো দলকে তৈরি করে রাখা প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid2569@gmail.com
যদ্দূর মনে পড়ে সেদিন স্কুলে যাইনি। পরদিন বন্ধু-বান্ধবসহ স্কুল থেকে ফেরার পথে চোখে পড়ল প্রতিবেশীর এক বিশাল শিমুল গাছ গোড়া উপড়ে পড়েছে তাদের পুকুরে। আমাদের মাথায় বুদ্ধি এলো গাছের কাণ্ড এবং শাখা-প্রশাখা বেয়ে আমরা তো সহজেই একদম পুকুরের মাঝখানে পানির ওপরে চলে যেতে পারি। যেই ভাবা সেই কাজ, বইখাতা মাটিতে রেখে ডালপালা ধরে ধরে চিত হয়ে পড়ে থাকা গাছের বুকের ওপর দিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলাম পুকুরের পানির ওপর। সেখানে গিয়ে গাছের ডাল ধরে অনেকক্ষণ লাফালাফি করেছিলাম, ডাল ভেঙেছিলাম, পাতা ছিঁড়েছিলাম। সে যেন ছিল এক ভীষণ মজার খেলা। স্কুল থেকে ফেরার পথে এ খেলা আমরা প্রায়ই খেলতাম। আমার ধারণা ছিল, দু-এক সপ্তার মধ্যেই গাছটি মরে যাবে, কিন্তু তা হয়নি। বরং মাস-দেড়েক পরে দেখি চিত হওয়া ডালপালাগুলো খাড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠছে এবং সারা গাছে অসংখ্য নতুন পাতা গজাচ্ছে। সেই বয়সে এর চেয়ে আর বেশি কিছু বুঝিনি, ভাবিওনি। এখন বুঝি, ঝড়ে পড়ে গেলেই সব শেষ হয় না, সব গাছ মরে যায় না। ইদানীং, ছোটবেলার ওই ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করে 'পড়ে গেলেই মরে যায় না' শিরোনামে আমি একটি কবিতাও লিখেছি।
মাত্র সেদিন বহু যুগ পর প্রবাস জীবনে ন্যাসভিলের মাটিতে নতুন করে উল্টো ধরনের আরেকটি উপলব্ধি হলো, 'মরে গেলেই পড়ে যায় না'। এবার ঘটনাটি আরেকটু খোলাসা করেই বলছি। দিনটি ছিল শুক্রবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরছি। আসার পথে দোকানে নেমে সামান্য একটু গ্রোসারি কেনাকাটা করে গাড়িতে উঠেছি। এমন সময় দোকানের পাশে লাগানো কতগুলো ছোট ছোট ম্যাপল গাছের দিকে হঠাৎ নজর পড়ল। দেখলাম একটি ভিন্ন চিত্র। ভিন্ন এ জন্য বলছি, কারণ সময়টি ছিল ফেব্রুয়ারি মাস। ন্যাসভিলে ভর শীতের মৌসুম। শীতকালে পাইন জাতীয় এভারগ্রিন ট্রি আর ঝোপঝাড় বা শ্রাবারি ছাড়া অন্য কোনো গাছেই পাতা থাকে না, থাকার কথাও নয়। কিন্তু ম্যাপল গাছগুলোয় ভর্তি পাতা। তবে একটিও সবুজ নয়, সব মরা শুকনো বাদামি রঙের পাতা। অন্তত তিন মাস আগে পাতাগুলো মরে গেছে, কিন্তু অন্যান্য গাছের মতো মাটিতে ঝরে পড়েনি। এমনকি ঝড়বৃষ্টিতেও খুব একটা পড়ে না। বুঝলাম ম্যাপলের পাতা 'মরে গেলেও ঝরে না'। গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবতে লাগলাম আল্লাহর সৃষ্টি-জগতে এমন আর কিছু কী আছে, যে মরে গেলেও পড়ে না, জনমের ও জীবনের বন্ধন ছিন্ন করে না, করতে পারে না। সেদিনকার এ উপলব্ধিটা ছিল আমার কাছে নতুন, কিন্তু দৃশ্যটা নতুন নয়। আমি আগেও দেখেছি, শীতকালে ম্যাপলের পাতা মরে গেলেও ঝরে পড়ে না।
বিষয়টি হল শীতের শেষে, সপ্রীংএর শুরুতে অর্থাত এপ্রিল-মে মাসে গাছে গাছে যখন কুঁড়ি আসে, নতুন পাতা গজায়, তখন ম্যাপল গাছ মরা পাতাকে আর ধরে রাখতে পারে না। ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়ই হোক, মরা পাতার সঙ্গে প্রাণের বন্ধন ছিন্ন করে, শুকনো পাতা সবই একসঙ্গে ঝরিয়ে দেয়। এভাবে নতুনকে আলিঙ্গন করে পুরনোকে বিসর্জন দিয়ে। এটা প্রকৃতির সর্বজনীন নিয়ম, প্রকৃতিরই বিধান। এটা যে শুধু গাছের জীবনে সত্যি, তা নয়। সব ব্যাপারেই খাটে। বস্তু জগতের ক্ষেত্রে যেমন পুরনো জামা ছিঁড়ে গেলে নতুন জামা গায়ে দিই। টুথপেস্টের টিউব শেষ হয়ে গেলে নতুন একটা কিনে আনি। মানব জীবনের প্রতিটি স্তরেও এটা সমানভাবে সত্য, এটা চিরকালীন সত্য। জরাজীর্ণ বৃদ্ধরা মরে যায়, নবজাত শিশুর জন্য স্থান ছেড়ে দেয়। ছাত্রাবস্থায় বছর শেষে পুরনোরা নতুনের জন্য শ্রেণীকক্ষ ছেড়ে দেন। চাকরি জীবনে পুরনোরা ক্রমাগত অবসরে যাচ্ছেন আর নতুনরা এসে যোগ দিচ্ছেন। সময় ও স্রোত যেমন কারো জন্য অপেক্ষা করে না, তেমনি এ নিয়মেরও কারো জন্য কোথাও কোনো ব্যত্যয় হয় না, ব্যতিক্রম হয় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ নিয়মের একটি আংশিক ব্যতিক্রম দেখা যায়। এখানে অবসর বলে কোনো বিষয় নেই। পুরনোরা অবসর নিয়ে নতুনদের জায়গা করে দেন না। তবে দেন যখন মরে যান, যখন আর কোনো উপায় থাকে না। এখানে আমি বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের একটি কথা বলতে চাই। বুঝলাম আপনারা অতি জনপ্রিয়, অভিজ্ঞ, সাহসী, বিচক্ষণ এবং শক্তিশালী। অবসর না হয় না-ই নিলেন, কিন্তু মৃত্যুকে তো আর এড়াতে পারবেন না। তাই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে নতুনের জন্য জায়গা করার চিন্তা করুন। নতুনদের তৈরি করুন, কৌশল শেখান, তাঁদের মনে সাহস জোগান, প্রশিক্ষণ দিন। সময়মতো আপনাদের শূন্য স্থান পূরণ করার জন্য প্রস্তুত রাখুন। পৃথিবী চলমান, সবকিছু পরিবর্তনশীল। সুষ্ঠু, সুন্দর ও বাধাবিঘ্নহীন ট্র্যানজিশন বা উত্তরণের জন্য আগে থেকেই তো দলকে তৈরি করে রাখা প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid2569@gmail.com
No comments