আমাদের চলচ্চিত্র by আতাউর রহমান
আমরা গান ছাড়া সিনেমা ভাবতে পারি না। এই উপমহাদেশের যে কোনো ভাষার সিনেমায় হিন্দি ও বাংলা গানের সুর মূর্ছনায় আমরা বহুকাল ধরে বিমোহিত হয়ে আসছি। নৃত্যের উপস্থিতিও এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে প্রায় অবশ্যম্ভাবী। বিদেশের, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রে ফর্মুলা হিসেবে গান-নাচ থাকে না।
গান-নাচের ছায়াছবি মিউজিক্যাল হিসেবে পরিচিত। যেমন—‘সাউন্ড অব মিউজিক’, ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’, ‘মাই ফেয়ার লেডি’, ‘কেরোজেল’-এর নাম আমরা জানি। মঞ্চ নাটকে আমরা গান ও নাচের উপস্থিতি বিদেশে তেমন একটা দেখি না। ওদের দেশে অপেরা অথবা মিউজিক্যাল ড্রামা মঞ্চে অভিনীত হয়ে থাকে। অপেরাতে কোনো সংলাপ থাকে না, ঘটনা প্রবাহ বিশেষ ভঙ্গিমায় গীত গানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়। মিউজিক্যালে গান ও সংলাপ দুই-ই থাকে। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের ‘ব্রডওয়ে’ মঞ্চে বা ইংল্যান্ডের লন্ডনের ‘ওয়েস্ট অ্যান্ড’ মঞ্চে অভিনীত বিভিন্ন মিউজিক্যাল বর্তমান বিশ্বে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তবে আমাদের নৃত্য নাট্য বা গীতি নাট্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের মিউজিক্যাল বা অপেরার তেমন কোনো মিল নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চণ্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা ইত্যাদি তার নিজস্ব ঘরানার নৃত্য ও গীতি নাট্য। চলচ্চিত্রের কথায় ফিরে আসি। এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে নায়ক, নায়িকা বা যে কোনো চরিত্রের গাওয়া একই গানের মধ্যে দৃশ্যপট (লোকেশন) যেমন বদলে যায়, তেমনি পোশাক বদলে যায়। এই কাজটিকে সিনেমার ভাষায় বলা হয় চলচ্চিত্রায়ন (পিকচারাইজেশন)। চলচ্চিত্রের মুড অথবা গায়ক-গায়িকার মুডের সঙ্গে সমতা রেখে লোকেশন ও পোশাক বদলে যাওয়ার কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। সত্যজিত্ রায়ের ইংরেজিতে লেখা একটি বই আছে, নাম ‘আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস’। এই বইতে ‘দোজ সংস’ (ওইসব গান) এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ আছে। সত্যজিত্ রায়কে প্রায়ই ভারতীয় তথা এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের গানের বাহুল্য সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। তিনি একটি সহজ ও গ্রহণযোগ্য উত্তর দিতেন। বলতেন, আমাদের দেশের মানুষ গান ভালোবাসে, অনেকে কেবল ভালো গানের জন্য সিনেমা দেখতে যায়। সত্যজিত্ রায়ের এহেন উক্তির সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ ঐকমত্য পোষণ করি। আমি এখনও আমারই বয়েসি বন্ধু-বান্ধবদের দূর অতীতের ফিল্মি গান গাইতে দেখি। দ্বিতীয় প্রশ্নটি রায় বাবুর জন্য কঠিনই ছিল। আমাদের দেশের মানুষ কি এমনই সঙ্গীতপ্রিয় যে, গান ছাড়া চলচ্চিত্র বাজারজাত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে? কারণ, এখন পর্যন্ত প্রমাণ মেলেনি যে জাতিগতভাবে উপমহাদেশীয়রা ইতালিয়ান, স্পেনিশ, এমনকি রাশিয়ান অথবা আমেরিকানদের চেয়েও সঙ্গীতপ্রিয় জাতি। এ ধরনের প্রশ্নের সামনে সত্যজিত্ রায় আমতা আমতা করে উত্তর দিতেন—ব্যাপারটা হলো একটা ছায়াছবি গানের জন্য বাজার পেয়ে গেল, তারপর আরেকজন সঙ্গীতবহুল আরেকটি ছায়াছবি বানাল, সেটিও চলল, তারপর আরেকটি, আরেকটি—এভাবে নাচে-গানে ভরপুর ছায়াছবি তৈরি হতে লাগল। সত্যজিত্ রায় পাঠকদের জানাচ্ছেন, শেষমেশ ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল, চলচ্চিত্র সঙ্গীতের রসসিক্ততার জীবাণুতে আক্রান্ত হতে লাগল। তৃতীয় উত্তর—যেটির কথা সত্যজিত্ ভেবেছিলেন, তাতে সত্যতার উপস্থিতি অনেক বেশি পাওয়া যায়। এই বিরাট উপমহাদেশের মানুষের কাছে একসময় চলচ্চিত্র প্রধান বিনোদনের উপকরণ ছিল। চলচ্চিত্রের দর্শকরা একের মধ্যে দশ দেখতে চাইত। হিরো, ভিলেন, কমেডিয়ান—সবাইকে একই ছায়াছবিতে যেমন দেখতে চাইত, তেমনি দেখতে চাইত নাচ ও গান। আবার হিরোইজিমের পরিচায়ক হিসেবে ‘ফাইটিং’ দেখতেও দর্শকরা পছন্দ করত। একটা কথা ভুললে চলবে না, পাশ্চাত্যের দর্শকদের জন্য কেবল সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য মিলনায়তন, নাট্যশালা, সম্মেলক সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য আলাদা হল, এমনকি স্থায়ী সার্কাস হলও আছে। আমাদের এই সুবিধাগুলো নেই। বর্তমানে শুধু নাট্যশালা আছে। আমাদের দেশের সিনেমার দর্শকরা বিনোদনের প্রয়োজনে সিনেমাতেই গানের ও নৃত্যের সমাহার দেখতে চায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মঞ্চ নাটক অথবা টিভি নাটকে আমরা জীবনের প্রতিফলন দেখতে চাই, চলচ্চিত্রে দেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ সেটা দেখতে চায় না। তাদের জীবনযাপন অতি কষ্টের। কর্মক্লান্ত দিনের পর তারা সিনেমা হলে অথবা ডিভিডি’তে বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র দেখতে চায় না। আমি নিশ্চিত, সত্যজিত্ রায়ের ‘অপু ট্রিলজি’ (পথের পাঁচালি, অপরাজিত ও অপুর সংসার) এখন যদি সিনেমা হলগুলোতে পুনরায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়, সমাজের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ তিনটি ছায়াছবিই দেখতে চাইবে। এমন ছায়াছবিই বারবার দেখা যায়। সমাজের শ্রমজীবী মানুষ এই রূঢ় বাস্তবতার ছবি দেখতে চাইবে না। ছায়াছবির নান্দনিক দিক বিচার-বিবেচনার কথা ছেড়ে দিলাম, ওসবের প্রশ্নই ওঠে না। কর্মজীবী মানুষ জীবনের সাধারণ রূঢ় বাস্তবের সংঘাতে বিক্ষত হয়ে বিনোদনের জন্য আবার বাস্তবধর্মী ছায়াছবি দেখতে চায় না। তারাই দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার জন্য একটা অলীক জগতে বসবাস করতে চায়। যে জগতে গান গাইতে গাইতে ও নাচতে নাচতে নায়ক-নায়িকার শাড়ি পাল্টে যায়, ডিসম-ডিসম ফাইটিং দৃশ্য আছে। আজকাল আবার মার্শাল আর্টের ব্যবহারও আমাদের চলচ্চিত্রে দেখা যায়। আমি মনে করি, সিনেমা ভিজুয়াল আর্ট (দৃশ্যমান ও চলমান শিল্প) হলেও গল্পবলা সিনেমার প্রধান উপাদান যা দর্শক-শ্রোতাকে বিপুলভাবে আকর্ষণ করে। আমি সিনেমার গান ও নৃত্যের উপস্থিতির বিরোধিতা করি না, আমি শুধু বলি, সিনেমা ভালো গল্প বলুক, যেমন আমাদের দেশেরই ‘রাজধানীর বুকে’ ‘সুতরাং’, ‘কাচের দেয়াল’ ইত্যাদি একসময় যেভাবে সফল হয়েছিল এবং পশ্চিম বঙ্গের উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত বাণিজ্যিক ছবিগুলো যেভাবে সফল হয়েছিল, ঠিক তেমনি। দর্শকের রুচির উন্নতি ঘটানোও চলচ্চিত্র নির্মাতার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
No comments