ডেটলাইন ১২ মার্চ-মহাসমাবেশ বন্ধ করতে পুলিশকে আওয়ামী লীগের আহবান by পারভেজ খান ও পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য
১২ মার্চ বিরোধী দলের ঢাকা চলো কর্মসূচি নিয়ে উদ্বিগ্ন পুলিশ প্রশাসন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল আলম হানিফ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মৌখিকভাবে তাঁর আশঙ্কা ব্যক্ত করে এ কর্মসূচি বন্ধ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন।
একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রীর আশঙ্কা এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনও তাদের নানাভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, হানিফের আহ্বান, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাওয়া নাশকতার আশঙ্কা আর ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের উৎকণ্ঠা সামনে রেখে দফায় দফায় বৈঠক করছেন পুলিশ ও গোয়েন্দারা। আর তাই কোনো ঝুঁকি না নিয়ে এই আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে ১২ তারিখে এবং এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কর্মসূচি বাতিল করার ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। তবে এখন পর্যন্ত এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। প্রয়োজনই বলে দেবে, কী করতে হবে। তাঁরা এখন পর্যন্ত যেকোনো নাশকতার আশঙ্কাকে কঠোরভাবে মোকাবিলার সিদ্ধান্তেই বহাল রয়েছেন এবং এর জন্য পুলিশ প্রস্তুত বলে তিনি জানান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, সরকার যদি এ কর্মসূচি বাতিলের কোনো চেষ্টা করে তবে সেটা হবে তাদের বড় ধরনের একটা ভুল। কারণ তাদের প্রস্তুতি শতভাগ সম্পন্ন। এর পরও যদি সরকার তাদের এজেন্সি দিয়ে কোনো কিছু করতে যায়, সেটা সরকারের জন্যই বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও মহানগর কমিটির আহ্বায়ক সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা জানান, ১২ মার্চের কর্মসূচি সামনে রেখে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। তিনি মনে করেন না সরকার এই পর্যায়ে এসে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, সরকারদলীয় কেউ তাঁদের কাছে এখন পর্যন্ত লিখিত কোনো আবেদন জানাননি। তবে মৌখিকভাবে অনেকেই এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। অনেকের সঙ্গে বৈঠকে, আবার কারো কারো সঙ্গে টেলিফোনেও এ ব্যাপারে তাঁদের কথা হয়েছে। অনেকে বলেছেন, কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা এনে তা বাতিল করার জন্য। আবার অনেকে বলেছেন, সেটা না করে যেকোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি শক্ত হাতে দমন করার জন্য। তবে অধিকাংশই বিরোধী দলের কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পক্ষে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তাদের নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল করছে। এসব প্রতিবেদনে নাশকতার আশঙ্কার তথ্য ক্রমেই জোরালো হচ্ছে বলে জানা গেছে। আর এই তথ্যের ভিত্তিতে নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থাকে নানা কৌশলে সাজানো হচ্ছে। একই সঙ্গে সন্দেহভাজনদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার কোনো প্রকার ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। আর এই আশঙ্কার মাত্রা যদি আরো বেড়ে যায় তবে সে ক্ষেত্রে কর্মসূচির ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তেও কোনো নতুন ঘোষণা আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে শুধু বিএনপির ঢাকা চলো কর্মসূচিই নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের ১১ তারিখে রাজধানীতে মানববন্ধন ও ১৪ মার্চের জনসভা নিয়েও একই রকম সিদ্ধান্তের ঘোষণা আসতে পারে।
উল্লেখ্য, এর আগে ২৯ জানুয়ারি রাজধানীতে বিএনপির গণমিছিলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে পুলিশ। পরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট তাদের কর্মসূচি একদিন পিছিয়ে ৩০ জানুয়ারি পালন করে। অবশ্য ওই দিন বিএনপির গণমিছিল শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়। এবারও বিএনপির পক্ষ থেকে কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবেই পালন করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বিরোধী দলের মহাসমাবেশে জঙ্গি হামলা ও নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রায় সব মহল থেকেই।
এদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১২ মার্চ রাজধানীতে ভাঙচুর, গোলাগুলি, নৈরাজ্য এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড হতে পারে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন সরকারের হাতে পৌঁছেছে। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও এরই মধ্যে ১২ মার্চের কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া শুধু ক্ষমতাসীন দল নয়, বিএনপির পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সমাবেশে আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে নাশকতা সৃষ্টির আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, সরকার মহাসমাবেশে নাশকতা সৃষ্টি করে এর দায়-দায়িত্ব বিএনপির ওপর চাপাবে।
সব কিছু মিলিয়ে এই দুই দলের কর্মসূচির ব্যাপারে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে দু-এক দিনের মধ্যেই সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার ঐতিহাসিক সাতই মার্চ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত গণশোভাযাত্রার উদ্বোধনকালে সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, মার্চ মুক্তিযুদ্ধের মাস, স্বাধীনতার মাস। এ মাসকেই খালেদা জিয়া বেছে নিয়েছেন স্বাধীনতার শত্রুদের খুশি করতে। কিন্তু মার্চে রাজাকারদের ঠাঁই বাংলার মাটিতে হবে না। অন্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও বিভিন্ন সমাবেশে প্রায় প্রতিদিন নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। শুধু তাই নয়, আইন প্রতিমন্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা রাজধানীতে ভিড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া গত মন্ত্রিসভার বৈঠকেও মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীকে ১২ মার্চে নাশকতার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী যাতে কোনো নাশকতামূলক ঘটনা ঘটতে না পারে সে জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশনা দিয়েছেন। ওই বৈঠকের পরপরই নিজের মন্ত্রণালয়ে আইন প্রতিমন্ত্রী, মাহবুব-উল-আলম হানিফ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এ ব্যাপারে মাহবুব-উল-আলম হানিফ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ করতে চাইলে আপত্তি ছিল না। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতাদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, তাঁরা ওই দিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করবেন। সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করছে বিএনপি- এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে জেনেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপির এ কর্মসূচি বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে।
হানিফ কালের কণ্ঠকে আরো বলেন, নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এ ব্যাপারে তারা সঠিক সিদ্ধান্তই নেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে বিএনপিকেও তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
No comments