কিছু বলতে চাই by ড. মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন
বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, অবাধ তথ্যপ্রবাহের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের জন্যে অপরিহার্য শর্ত। প্রতিটি দেশের প্রশাসনিক কাঠামোকে মজবুত করার জন্য সরকারের সমালোচনার সুযোগ অত্যাবশ্যক। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ যদি অ্যামফিথিয়েটারের (অসঢ়যরঃযবধঃত্ব) মল্লভূমির কায়দায় প্রতিপক্ষকে মুষ্ঠাঘাতে কুপোকাত করতে চায় সেক্ষেত্রে গণতন্ত্র থাকে না।
বহু প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। অথচ আমরা বিগত আটত্রিশ বছরের শাসন ব্যবস্থায় অব্যাহত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা টিকাতে পারিনি। স্বাধীনতার পর মাত্র চার বছরের মধ্যে এদেশে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়। ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করার অর্থই হচ্ছে নিরাপদভাবে উত্তেজনা উপশমের এবং গঠনমূলক তত্পরতার ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিরোধী পক্ষের মতামত প্রকাশের সুযোগ জনমনের উত্তেজনা প্রশমনে কেবল সেফটি ভাল্বের কাজই করে না, জাতীয় স্বার্থসংরক্ষণে জনগণকে সতর্ক রাখে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন চক্রান্তের মাধ্যমে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করে। সেকালে রাজতন্ত্র বা নবাবতন্ত্রের কারণেই গণসচেতনতা ছিল না। নতুবা মুষ্টিমেয় ইংরেজ বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করা মোটেও কঠিন কাজ ছিল না। রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে সবল ও মজবুত করার জন্যই আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিস্তার।
ব্রিটিশ ভারতে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। এ রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠায় প্রথম সারির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত জনৈক অ্যালান অকেটাভিয়ান হিউস। ইংরেজ শাসকদের স্মৃতিতে তখনও ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের ভয়াবহতা ভাস্বর। ইংরেজ শাসকবর্গ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের মতো সশস্ত্র সংগ্রামের পথ এড়িয়ে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আন্দোলনের পথকে উন্মুক্ত রাখার জন্য ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিল। অবশ্য শাসকবর্গের স্বার্থেই বিশাল ভারতের জনগোষ্ঠীকে পর্যায়ক্রমে নিয়মতান্ত্রিক পথে পরিচালনার লক্ষ্যে ব্রিটিশ তাদের নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক ধারার চোরাপথে টেনে এনেছিল। তবুও সেটা ছিল সশস্ত্র সংঘাত এড়ানোর একটা কৌশল মাত্র।
বর্তমান বিশ্বে সার্বভৌম-স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক ধারার প্রতিষ্ঠা ঘটছে ভিন্ন আঙ্গিকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বর্তমান বিশ্বে জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য জনগণের নিকট নির্বাচনী ইস্তেহারের ভিত্তিতেই সরকার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের কাছে বহুবিধ ওয়াদা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এজন্য বর্তমান সরকারের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্র বহুগুণে প্রসারিত।
সম্প্রতি সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ও বর্তমানে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে যেভাবে হেনস্তা করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে এটা জনমনে সরকারের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। প্রতিটি অভিযোগকে মোকাবিলা করার জন্য আইনি প্রক্রিয়ার পথ উন্মুক্ত। কিন্তু কোনো অভিযোগ বা খবরকে কেন্দ্র করে একটা গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মানবাধিকারবিরোধী হামলা হুমকির ঘটনাকে মেনে নেয়া যায় না। এরই মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। ভৌগোলিক সীমানায় দেশ ছোট হলেও আমাদের জনসংখ্যার বিচারে জাতি বড়। এখানে শিক্ষায় ও জ্ঞানে অনেক খ্যাতিমান লোক রয়েছেন। সমাজে তাদের চিন্তাধারার একটা প্রতিফলন থাকতেই হবে। সুতরাং আলোচনায়, আচরণে কে কতটুকু সংযম অসংযম দেখাল তারও একটা পরিসংখ্যান থাকবে। এভাবেই জনমত গড়ে ওঠে।
আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক একজন প্রকৌশলী হয়েও ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি মানবিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। এগুলো সম্পর্কে তাঁর পাণ্ডিত্য আছে বললে অত্যুক্তি হবে না। কোনো জ্ঞানদীপ্ত সাহসী ব্যক্তিকে অনিয়তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দমানোর প্রচেষ্টা কারো জন্যে সুফল বয়ে আনবে না। প্রসঙ্গত এখানে এষধফ ঝঃড়হব উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য—“ঞযব ঢ়ত্ড়ঢ়বত্ ভঁহপঃরড়হ ড়ভ ঃযব মড়াবত্হসবহঃ রং ঃড় সধশব রঃ বধংু ভড়ত্ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ঃড় ফড় মড়ড়ফ, ধহফ ফরভভরপঁষঃ ভড়ত্ ঃযবস ঃড় ফড় বারষ." এজন্য ব্যক্তি যেই হোন না কেন তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ বা অন্য কোনো ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ এলে অগ্নিশর্মা হওয়ার অবকাশ নেই। ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে একজন জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে নতজানু করা সম্ভব। কিন্তু সহজাত সৃজনী ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিভাকে এভাবে নিষ্প্রভ করার প্রয়াস কোনো শুভ ফল আনবে না। ক্ষমতার দাপট দেখানো কোনো ভালো সরকারের কাজ নয়। জনগণের অভাব-অনটনের অবসান ও জনকল্যাণে আত্ম নিয়োগই প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত। সর্বশেষ ইঁত্শব-এর উক্তিটি এখানে উল্লেখ করছি— ''Government is a contrivance of human wisdom to provide for human wants.''
No comments