কে এফ রুস্তামজির চোখে ১৯৭১-শুরুতেই রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব by সোহরাব হাসান

কে এফ (খসরু ফারামুজ) রুস্তামজি। ১৯৭১ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের মহাপরিচালক ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নয়াদিল্লির উইজডম ট্রি প্রকাশিত রুস্তামজির আত্মজীবনীমূলক বই দ্য ব্রিটিশ দ্য বেনডিট অ্যান্ড দ্য বর্ডার মেন অবলম্বনে এ লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।


দ্বিতীয় পর্ব
দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে আসার পর তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক সরকার গঠন করা। সরকার গঠন না করলে বিদেশের কাছে সহায়তা চাওয়া পাওয়া যাবে না। এ জন্য আওয়ামী লীগ নেতাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? এ ব্যাপারেও রুস্তামজি ও বিএসএফের কর্মকর্তারা তাঁকে সহায়তা করেন। তাঁরা যোগাযোগ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্নেল এম এ জি ওসমানী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এইচ এম কামরুজ্জামানের সঙ্গে। এরপর তাজউদ্দীন আহমদ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রূপরেখা নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের প্রবাসী সরকারের ঘোষণা আসে। পরদিন তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণে প্রথম যে বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন তা হলো: ‘আমরা এখন যুদ্ধে আছি। লাখো লাখো মানবসন্তানের লাশের স্তূপের নিচে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে।’
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শপথ নেন। তাজউদ্দীন আহমদই প্রথম স্থানটিকে মুজিবনগর হিসেবে উল্লেখ করেন, যে কারণে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিতে গিয়ে রুস্তামজি লিখেছেন, ‘ভারতের সীমান্তসংলগ্ন ত্রিকোনাকার একটা জায়গা পাওয়া গেল। সুন্দর একটা গ্রাম। জায়গাটির সঙ্গেই আমবাগান। বৈদ্যনাথতলা। সদ্য ভূমিষ্ঠ একটি জাতির সরকার গঠনের প্রথম অনুষ্ঠানটি কোনো সুসজ্জিত আলোকিত ভবনে অনুষ্ঠিত হলো না। এর মেঝে গালিচায় মোড়া ছিল না, মাথার ওপর কোনো ঝাড় লণ্ঠনের আলো জ্বলেনি। কিন্তু এ অনুষ্ঠানে মাথার ওপর চাঁদোয়া হয়েছিল আকাশ, শোভা বাড়িয়েছিল সবুজ গাছপালা। কয়েক দশক পর বা শত বছর পর বাংলাদেশের মানুষ যখন পেছন ফিরে দেখবে কীভাবে অভ্যুদয় ঘটেছিল এক নতুন রাষ্ট্রের, কী বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে—তখন একটা বিষয় নিয়ে তারা নিশ্চয় গর্ববোধ করবে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে জাতিরাষ্ট্রটির উদ্ভব হয়েছিল, তাকে প্রকৃতি তার সবটুকু প্রাচুর্য উপহার দিয়েছিল। আর যে আনুষ্ঠানিকতাটুকু ছিল, তা শুধু পবিত্রই ছিল না, ছিল অত্যন্ত সাহসী এক উদ্যোগ।’
এরপর রুস্তামজি ও তাঁর বিএসএফ সব রকমের সহায়তা দেয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। এগিয়ে আসে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়সহ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সব রাজ্যের মানুষ। কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে সহায়তা করেছেন, কেউ শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছেন, আবার কেউ ছিলেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে।
পশ্চিমবঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রুস্তামজি লিখেছেন, ‘২২ এপ্রিল গোলক মজুমদারকে নিয়ে সড়কপথে পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে যেতে দেখলাম পশ্চিমবঙ্গের বিপুলসংখ্যক মানুষ “জয়বাংলা” বলে উল্লাস করছে। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তারাও আবেগে জড়িয়ে পড়েছে। সংবাদপত্রগুলো বাংলাদেশকে সমর্থন জোগাচ্ছে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী) প্রতিক্রিয়া ছিল বিপরীত। তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চীনকে অখুশি করতে চায়নি। শরণার্থী সমস্যাটিকে সামনে রেখে সিপিআইএম কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করছে।’
সেদিন বাঙালির মনোবল ছিল দৃঢ় আর সাহস ছিল দুর্জয়। রুস্তামজির ভাষায়, ‘সীমান্ত পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যে উদ্দীপনা দেখলাম, তা অবিশ্বাস্য। তারা জানে, সুসজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করার মতো অস্ত্র তাদের হাতে নেই। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনা তাদের মধ্যে এমন মানবেতর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যা মুক্তি ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রজ্বলিত করে রেখেছে। তারা মনে করছে, ‘শেষ পর্যন্ত জয় হবেই।’
মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বনগাঁওয়ে আমরা প্রথমে থামলাম। যশোরের স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক আমার সঙ্গে দেখা করে উদ্বেগাকুল কণ্ঠে জানতে চাইলেন, “ভারত কী করছে? কেন তারা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। সেনাবাহিনীর হাতে আমরা নির্বিচারে খুন হচ্ছি, এখন আমাদের মুক্তির সংগ্রামে ভারতই ভরসা। আপনার সরকারকে বলুন, আমাদের সাহায্য করুক।”’
প্রত্যুত্তরে রুস্তামজি তাঁর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও যোগ করলেন, ‘আমরা দেখতে পেলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব সেনানিবাসে বাঙালি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকে নিহত হয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশিসংখ্যক বাঙালি সেনা বিদ্রোহ করেছে, তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে এবং পাকিস্তানি সেনাদের নাজেহাল করেছে। সবখানেই বাঙালি সেনাসদস্য ও ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’
এরপর রুস্তামজি তুরায় একটি বিএসএফ ক্যাম্পে পাকিস্তানের পাঠান সেনাদের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের বিবরণ দেন। বাঙালিদের আক্রমণের মুখে এই সেনারা বিএসএফ ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সেখানে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ চোখ বেঁধে তাদের রুস্তামজির সামনে হাজির করলে তিনি চোখ খুলে দিতে বলেন। এরপর পাঠানদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলে তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। তারা মুখে কিছু না বললেও চোখের ভাষায় ছিল কৃতজ্ঞতা।
আগরতলায় বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে রুস্তামজি লিখেছেন, ‘বিএসএফ মেসে বাংলাদেশের নবনিযুক্ত সেনাবাহিনীর প্রধান এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে দেখা করি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিএসএফের ব্রিগেডিয়ার পান্ডে (ব্রিটিশ আমলে দেরাদুনে ওসমানীর সহপাঠী)। সেখানে একটি সেনাছাউনিকে মেসে উন্নীত করে বিদ্রোহী বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁদের মধ্যে ওসমানী ছাড়াও ছিলেন জিয়াউর রহমান, কে এম সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, মীর শওকত আলী ও নুরুজ্জামান।
ওসমানী রুস্তামজিকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আমরা এখানে-সেখানে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প করেছি, যাদের মধ্যে সেনাসদস্য, ইপিআরের সদস্য ও উদ্দীপ্ত তরুণেরা রয়েছে। আপনি কি তাদের দেখাশোনা করবেন না?’ জবাবে পান্ডে বললেন, ‘আমরা তাদের সমর্থন করব এবং নিজেদের ছেলেদের মতোই তাদের দেখাশোনা করব।’ এরপর ওসমানী পান্ডের হাতে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত।’
রুস্তামজি লিখেছেন, ‘এরপর পরিকল্পনামাফিক সব সীমান্তেই মুক্তিবাহিনী ও বিএসএফ একযোগে কাজ করে একটি ইতিহাস সৃষ্টি করে। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে নিখাদ সমঝোতা। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে পান্ডের অবদান ছিল বিরাট।’
রুস্তামজি তাঁর স্মৃতিকথায় কেবল বাঙালির বীরত্বের প্রশংসা করেননি। তাদের দুর্বলতার সমালোচনাও করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক কমান্ডের মধ্যে যে বিরোধ ছিল, তা প্রকাশ্য। বিভিন্নজনের বই ও স্মৃতিকথায় তা উঠে এসেছে। কিন্তু রুস্তামজির পর্যবেক্ষণ ছিল আরও গভীর। তিনি লিখেছেন, ‘সংগ্রামের শুরুতে মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি ছিল। একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে অধিকাংশ বাঙালি সেনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের যোগাযোগ ছিল না। এর অন্যতম কারণ, সেনাবাহিনী রাজনীতিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের অপছন্দ করত, তেমনি রাজনীতিকেরাও সামরিক বাহিনীকে অপছন্দ করতেন। রাজনীতিক বা সিভিল প্রশাসনের যেকোনো নির্দেশনাকে তাঁরা সানন্দে গ্রহণ করতেন না। গড়পড়তা বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা মনে করতেন, রাজনীতিকেরা সুবিধাবাদী এবং পরিস্থিতি নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করবেন। বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা এ-ও মনে করতেন, তাঁরা যেহেতু পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে এসেছেন, সেহেতু লড়াই করা ছাড়া তাঁদের বিকল্প নেই। কিন্তু রাজনীতিকেরা ভবিষ্যতে দর-কষাকষির জন্য এটি থামিয়েও দিতে পারেন।’
বাংলাদেশ সেনাসদর থেকে যেসব আদেশ-নির্দেশ দেওয়া হতো, সেনা কমান্ডাররা কতিপয় ক্ষেত্রে তা অগ্রাহ্য করতেন। তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় নিজেদের সর্বেসর্বা ভাবতেন। কঠোর নিয়মানুবর্তী কর্নেল ওসমানী এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বোঝা হয়ে দাঁড়ান।
পান্ডের চিঠির বরাত দিয়ে রুস্তামজি লিখেছেন, ‘মুক্তিবাহিনীর কমান্ডাররা আমার অফিসে এসে রাজনৈতিক নেতা ও সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করতে বললেন। ঠিক হলো, খালেদ মোশাররফ সেনা কর্মকর্তাদের এবং ওসমানী রাজনীতিকদের মুখপাত্র হবেন। খালেদ মোশাররফ অভিযান চালনায় কমান্ডারদের সমস্যাগুলো তুলে ধরলেন এবং রাজনীতিকদের কাছে সমাধান চাইলেন। এই পরিস্থিতি বৈঠককে উত্তপ্ত করে তোলে এবং রাজনীতিকেরা উচ্চস্বরে কমান্ডারদের নিন্দামন্দ করতে থাকেন। ওসমানী উত্তেজিত হলেন এবং বললেন, ‘সেনা কর্মকর্তারা ক্ষমতার জন্য ক্ষুধার্ত।’ তিনি এ-ও বললেন, যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রতি তাঁদের আস্থা নেই, সেহেতু তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন।
এরপর রুস্তামজি ওসমানীকে বাইরে নিয়ে আসেন এবং সংগ্রামের শুরুতেই সংকট তৈরি না করার জন্য অনুরোধ করেন। ওসমানী তাঁর অনুরোধ রক্ষা করলেও বিরোধের অবসান ঘটাতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সেনা কমান্ডারদের যেমন বিরোধ ছিল, তেমনি বিরোধ ছিল নিজেদের মধ্যে। আমরা যার রেশ লক্ষ করি স্বাধীনতার পরেও। (চলবে)

 সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.