কথার প্যাঁচে ঝামেলা পাকাচ্ছে সরকার by শাহ আহমদ রেজা


কথা রাখতে না পারলে অতি বুদ্ধিমানরা নাকি মানুষের মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। মানুষকে এমন ঝামেলার মধ্যে ফেলেন, তারা যাতে তালগোল হারিয়ে ফেলে এবং অঙ্গীকারের কথা ভুলে যায়। রাজনীতিতে এটা অনেক পুরনো এবং বহুবার ব্যবহৃত একটি কৌশল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও সম্ভবত সে কৌশল নিয়েই এগুতে চাচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা এমন কিছু বিষয় নিয়েই মাতামাতি করছেন যেগুলোর ব্যাপারে জনগণের আগ্রহ রয়েছে বলে জানা যায় না। তারা সেই সঙ্গে আগ বাড়িয়ে ঝগড়া বাধানোরও তাল খুঁজছেন, প্রতিপক্ষকে আচমকা খোঁচা দিয়ে বসছেন।

প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর কথা উল্লেখ করা যাক। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর বসিলায় শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলে বসেছেন, চারদলীয় জোটই নাকি ‘ষড়যন্ত্র’ করে ১/১১ ঘটিয়েছিল! এ এক সম্পূর্ণ নতুন এবং আজব তথ্যই বটে! কারণ, এতদিন জানা গেছে এবং একথা প্রমাণিতও হয়েছে, উদ্দিন সাহেবদের অসাংবিধানিক সরকারকে আওয়ামী লীগ ও তার সঙ্গী-সাথীরাই এনেছিল। ১/১১-কে অনিবার্য করার আসল কারণও লুকিয়ে রাখা যায়নি। চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা জনগণের স্বার্থে অবদান রাখতে পারেননি। এজন্য তিনি জনগণের আস্থা ও সমর্থন অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। নিজেদের এবং ‘বন্ধুরাষ্ট্রের’ গোয়েন্দা সংস্থার জরিপেও দেখা গিয়েছিল, আওয়ামী লীগ অন্তত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। মূলত এই হতাশা থেকেই শুরু হয়েছিল লগি-বৈঠার তাণ্ডব, যা শেষ পর্যন্ত ১/১১-কে অনিবার্য করেছিল। এটা যে সপরিকল্পিত এক আয়োজন ছিল সে ব্যাপারে স্বয়ং শেখ হাসিনাই বহুবার জানান দিয়েছেন। বলেছেন, ওই সরকারকে তারাই এনেছেন।
প্রধানমন্ত্রী যা-ই ভাবুন না কেন, সময় পেরিয়ে গেলেও জনগণ লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথা ভুলে যায়নি। কারণ, নির্বাচনে অংশ নেয়ার সামান্য ইচ্ছা থাকলেও আওয়ামী লীগের তখন নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে নেমে পড়ার কথা। অন্যদিকে প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার পাশাপাশি দাবির পর দাবি তুলে দলটি এবং তার সঙ্গী-সাথীরা শুধু ঝামেলা বাড়িয়েছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক দিনগুলোতে এমন কোনো বড় দাবির কথা বলা যাবে না যা পূরণ করা হয়নি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব উদ্যোগকেই তারা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ব্যর্থ করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সেই সঙ্গে বঙ্গভবন অবরোধ করার এবং বঙ্গভবনের ‘অক্সিজেন’ বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়েছিল। দলটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল গৃহযুদ্ধেরও ভয় দেখিয়েছিলেন। সব মিলিয়েই আওয়ামী জোটের উদ্যোগে পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক করে তোলা হয়েছিল। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য হলে আর যা-ই হোক তারা নিশ্চয়ই মানুষ মারার মতো নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড চালাতেন না। ঝামেলাও পাকাতেন না।
এসবই প্রতিষ্ঠিত এবং প্রমাণিত হয়েছে। ঠিক কার সঙ্গে কোন্ জেনারেলের ‘ডিল’ হয়েছিল, কোন্ গোয়েন্দা সংস্থার ডিজি ঠিক কার জন্য নিজেই খাবার নিয়ে গেছেন এবং কাকে টাঙ্গাইলের শাড়ি উপহার দিয়েছেন—এ ধরনের অনেক গোপন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। কোন্ গোয়েন্দা সংস্থার ডিজির সঙ্গে ঠিক কোন্ দলের নীতিনির্ধারক হিসেবে বিশেষ দু’চারজন সাবেক আমলা দিনের পর দিন ধরে বৈঠক করেছেন এবং পুরস্কার হিসেবে কারা ঠিক কার উপদেষ্টার পদ পেয়েছেন—এসবও তো এখন সবারই জানা। সুতরাং এতদিন পর ১/১১ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর হাজির করা নতুন তথ্যে কিছু যায়-আসে না।
কথাটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হঠাত্ এমন একটি গুরুতর মন্তব্য করায় তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সে প্রশ্নের উত্তর হিসেবেই শুরুতে ঝামেলা পাকানোর কৌশল সম্পর্কে বলতে হয়েছে। এখানে অন্য একটি তথ্যও স্মরণ করা দরকার। তথ্যটি হলো, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা সমপ্রতি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ১/১১-এর প্রধান খলনায়ক এবং সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদকে গ্রেফতার করার দাবি তুলেছেন। এটুকুই সব নয়। নেতারা ১/১১-এর অন্য সব কুশীলবের পাশাপাশি মইন উ’র সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগ নেতাদেরও গ্রেফতার ও বিচার দাবি করেছেন। এই দাবিকে আড়ালে ঠেলে দেয়ার উদ্দেশ্যেই প্রধানমন্ত্রী হঠাত্ তার বিচিত্র তথ্যটি হাজির করেছেন কি-না, তা নিয়েও ভাবছেন অনেকে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে প্রাধান্যে এসেছে সরকারের কৌশলের দিকটি। কারণ, আগেও বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীনরা এমন কিছু বিষয় নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন, যেগুলোর ব্যাপারে জনগণের কোনো আগ্রহ আছে বলে জানা যায় না।
সংবিধান সংশোধন করা এরকম একটি প্রধান বিষয়। দেখা যাচ্ছে, সরকার হঠাত্ পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ও সংবিধান সংশোধন করে দেশকে আবারও ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অজুহাত হিসেবে সরকার হাইকোর্টের একটি রায়কে টেনে এনেছে। পুরনো ঢাকার মুন সিনেমা হলের মালিকানা সংক্রান্ত মামলার সূত্র ধরে ২০০৬ সালের ২৯ আগস্ট দেয়া এক রায়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল। জোট সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার সে আপিল প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিলে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী লিভ টু আপিল করে। আদালত দল দুটিকে মামলার পক্ষভুক্ত করে নিয়েছে। আগামী ১৮ জানুয়ারি লিভ টু আপিলের শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে গত ৩ জানুয়ারি সরকার জোট সরকারের আপিলটি প্রত্যাহার করে নেয়ায় হাইকোর্টের ২০০৬ সালের রায়টি আবার বহাল হয়েছে। এদিকে সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও একবার খোলামেলা বক্তব্য রেখেছেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। ৪ জানুয়ারি তিনি বলেছেন, রায়টি বাস্তবায়িত হলে সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত হবে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল বাতিল হয়ে যাবে। আইনমন্ত্রী অবশ্য জনগণকে আশ্বস্তও করতে চেয়েছেন। বলেছেন, সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ থাকবে, ইসলামও থাকবে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে। অন্যদিকে তথ্যাভিজ্ঞ মহল কিন্তু মনে করেন, হাইকোর্টের রায় অনুসারে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বহাল থাকার কথা নয়। তাছাড়া পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে সংবিধানে অন্য অনেক মৌলিক বিষয়েও পরিবর্তন ঘটবে।
বলা দরকার, এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। বিভিন্ন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কিছু ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় ছাড়া বর্তমান সংবিধানকে ‘সম্পূর্ণরূপে’ ১৯৭২-এর অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া হবে। এখন বোঝা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী ‘স্পর্শকাতর’ বলতে প্রধানত ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ও রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। মন্ত্রীরাও বিভিন্ন সময়ে সরকারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করেছেন। যেমন সর্বশেষ উপলক্ষে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল করার সুযোগ থাকবে না এবং ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হবে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার আড়ালে সরকার আসলে ইসলাম এবং মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী অবস্থানকেই সংহত করতে চাচ্ছে। এর কারণ সম্পর্কে সম্ভবত কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকায় ভারতসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাংলাদেশে যথেচ্ছভাবে তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারছে না। এজন্যই ১/১১-এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়নের চেষ্টা চালানো হয়েছিল—যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলোকে উত্খাত করা। কিন্তু হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও একথা প্রমাণ করা যায়নি যে, বাংলাদেশের কোনো জাতীয়তাবাদী বা ইসলামী দল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে। বিপরীতভাবে বরং একথাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক দলকে তত্পরতা চালানোর সুযোগ না দেয়ার সিদ্ধান্তই ছিল অগণতান্ত্রিক। অন্যদিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ইচ্ছা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের উদ্দেশ্য থেকে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদও একই কারণে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ মুহূর্তে মন্ত্রীরা যে ‘বিসমিল্লাহ’ থাকবে বলে আশ্বাস দিচ্ছেন, তার পেছনেও রয়েছে একই কারণ। সেটা ৯০ ভাগ নাগরিক মুসলমানের প্রতি সম্মান দেখানো।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে এমন কিছু বিষয় যেগুলোর মীমাংসা না করে সংবিধান সংশোধন করার চেষ্টা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যেতে চাইলে আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রথমেই ঘোষণা দিয়ে স্বীকার করতে হবে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেও ১৯৭২ সালের সংবিধানও ‘অক্ষত’ ছিল না। বরং মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সংবিধানকে চার-চারবার ‘কাটাছেঁড়া’ করা হয়েছিল এবং ‘কাটাছেঁড়া’র কাজটুকু করা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের আমলেই। তিনি দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রবর্তন করেছিলেন এবং এই আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ করে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছিলেন। তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ভারতের হাতে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ি তুলে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি রয়েছে চতুর্থ সংশোধনী—যার মাধ্যমে দেশে বাকশালের একদলীয় শাসন চাপানো হয়েছিল। সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিল। ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে চাইলে চতুর্থ সংশোধনী ও বাকশালী ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারকে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে। স্বীকার করতে হবে, শেখ মুজিবের সময়েই বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছিল। সমাজতন্ত্র সম্পর্কেও সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখতে হবে। অন্যদিকে আইনমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দিয়ে তারা সংবিধানের এখানে কিছু আর ওখানে কিছু পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন। সব মিলিয়ে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিকে ঝামেলায় ফেলা।
এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের অন্য সবাইও কম-বেশি জানান দিয়ে চলেছেন। যেমন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে সম্প্রতি হঠাত্ ইসলামের পেছনে লেগে পড়তে দেখা গেছে। ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম করায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ২৬ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বের কোথাও নাকি ধর্মভিত্তিক কোনো রাষ্ট্র নেই! কোনো দেশে নাকি রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু নেই! কথাটার মধ্য দিয়ে আইন প্রতিমন্ত্রীর জ্ঞানের ‘বহর’ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। কারণ, বাংলাদেশ ছাড়াও এত বেশি দেশে ইসলাম রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রয়েছে যে, নাম ও সংখ্যা শুনলে আইন প্রতিমন্ত্রীকে লজ্জায় পড়তে হবে। সৌদি আরব, বাহরাইন, ব্রুনেই, মিসর, ইরান, ইরাক, জর্ডান, ওমান, মালয়েশিয়া, তিউনিশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন, আলজিরিয়া, লিবিয়া, মরক্কো—কত দেশের নাম শুনতে চান আইন প্রতিমন্ত্রী? শুধু ইসলামের কথাই বা বলা কেন? বিশ্বে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মও রয়েছে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে। যেমন নেপাল একটি হিন্দুরাষ্ট্র। ইসরাইল ইহুদি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রধর্ম রোমান ক্যাথলিক—এমন দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, স্লোভাকিয়া, কোস্টারিকা, এল সালভেদর, মাল্টা প্রভৃতি। সবার ওপর রয়েছে ভ্যাটিকান সিটি। ডেনমার্ক, নরওয়ের মতো কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রধর্ম লুথেরান চার্চ। ব্রিটেনের রাষ্ট্রধর্ম প্রোটেস্ট্যান্টিজম—খ্রিস্টান ধর্ম। ভুটান, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রধর্ম বৌদ্ধ। অন্যদিকে আইন প্রতিমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন যেন একমাত্র বাংলাদেশেই রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে!
অন্য দু’-চারজন মন্ত্রীও ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছেন। যেমন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী তার উপস্থিতিতে কোনো অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে দেন না। ঘোষণা দিয়ে তেলাওয়াত বন্ধ করান। ওদিকে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ধারাবাহিকভাবে লেগে আছেন মুসলমানদের মসজিদ ও মাদরাসার বিরুদ্ধে। কিছুদিন আগেও তিনি বলেছেন, দেশের কওমী মাদরাসাগুলো নাকি জঙ্গিদের ‘প্রজনন কেন্দ্রে’ পরিণত হয়েছে এবং মসজিদের ইমামরা নাকি কেবল বেহেশতে যাওয়ার শিক্ষা দেন! বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তারও নাকি মাদরাসাকে কেন্দ্র করেই ঘটেছে! এমন অবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আইনমন্ত্রী বলেছেন, বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২-এর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে নস্যাত্ করায় এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার ফলেই নাকি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে!
এভাবেই ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন ক্ষমতাসীনরা। জনে জনে উদাহরণ দেয়ার পরিবর্তে লক্ষ্য করলে দেখা দেখা যাবে, উদ্দেশ্য তাদের একটিই—১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া, ধর্মের নামে শোরগোল তুলে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা এবং নিজেদের জন্য নয়া বাকশালী যুগের সূচনা করা। এ লক্ষ্য নিয়েই ক্ষেত্র প্রস্তুত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। সে চেষ্টা তারা চালাতেই পারেন। কিন্তু আপত্তি উঠেছে কথায় কথায় অসত্য বলায়, ভুল ব্যাখ্যা দেয়ায় এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল হিসেবে বিচিত্র ধরনের তথ্য হাজির করায়।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.