টাইগার স্যার by মোস্তাক চৌধুরী
: সীমান্ত, চল মাঠে গিয়ে খেলি।
: নারে এখনি ইংরেজির স্যার আসবে।
: মতিয়র স্যার তো! দূর কিছু বলবে না।
: নারে এখনি ইংরেজির স্যার আসবে।
: মতিয়র স্যার তো! দূর কিছু বলবে না।
: তুই বোধ হয় খুব সাহস নিয়ে স্কুলে এসেছিস।
: এই দেখ পকেটে বল নিয়ে এসেছি।
: সর্বনাশ! কী করেছিস তুই, টাইগার স্যার যদি বুঝতে পারে আর রক্ষা নেই তোর।
সীমান্ত মথুরাপুর পাবলিক হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। স্কুলটা অনেক সুন্দর। অনেক বড় মাঠ। মাঠে গিয়ে খেলতে ইচ্ছে করছে সীমান্তের, কিন্তু পারছে না টাইগার স্যারের জন্য। টাইগার স্যার হচ্ছে স্কুলের সবচেয়ে রাগী স্যার। ভীষণ রাগী বলেই নাম হয়েছে টাইগার। স্যারের আসল নাম রমেশ চন্দ্র বর্মণ ‘টাইগার স্যার’ নামের আড়ালেই চলে গেছে।
: চল না সীমান্ত, প্লিজ। স্কুল ছুটির পর তোকে অনেক পেয়ারা পেড়ে দেব।
: সত্যিই তো?
: সত্যিই-ই-ই। তপু জানে তার বন্ধুটিকে কীভাবে বশ করতে হয়। দুজনেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল মাঠে। কিন্তু মাঠে এসে সীমান্তের চোখ কপালে ঠেকেছে। অনেকেই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে মাঠে খেলছে। বড় ক্লাসের ভাইয়ারাও! কী মজা! আহা স্কুলটা যদি এমন হতো। বড়রা নারকেলগাছে হেলান দিয়ে গল্প করছে। কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ খেলছে।
: মিস করলি তো?
: এত জোরে মারলে ধরা যায়? মাঠের মাঝখানে চলে গেছে তো।
: যা নিয়ে আয় এখন। তুই মিস করেছিস তোকেই আনতে হবে।
বল আনতে গিয়ে পাখিগুলোকে দেখছিল সীমান্ত। সব সময় দল বেঁধে থাকে কেন ওরা? কিন্তু এই ভাবনাকে ছাপিয়ে গেল একজনের কথা, বারান্দায় টাইগার স্যার। কথাটা কানে পৌঁছামাত্রই থমকে গেল সীমান্ত। পড়ি কি মরি সবাই দৌড়ে নিজ নিজ ক্লাসে ঢুকছে। আশপাশে তপুও নেই। ক্লাসের দিকে দৌড়াতে গিয়েই নিজের নামের হুংকার (সী..মা..ন্ত) কানে এসে পৌঁছাল। নারকেলগাছে একটা কাক বসে এতক্ষণ কা..কা..কা.. করছিল, সেও চুপ। মাঠের এক কোণে বাঁধা সাদা গরুটা এতক্ষণ ঘাস খাচ্ছিল, এখন ঘাস খাওয়া বাদ দিয়ে সীমান্তের দিকে তাকিয়ে আছে। কাপড়ের কেডস পরা একজোড়া পা সীমান্তের সামনে এসে দাঁড়াল। কেডস জোড়া খুব চেনা, তবে কি...মাথা তুলতেই টাইগার স্যারের রাগী মুখ। উহ! কী ভয়ংকর লাগছে। স্যার কি জানে রেগে গেলে কী ভয়ংকর হয় দেখতে।
: কী করছিলি মাঠে?
: স্যার, পানি, না বাদাম...।
: চুপ কর মিথ্যার রাজা। হাতে কী?
: কিছু না স্যার।
: উহ! আবার মিথ্যা কথা। দুই হাত সামনে নিয়ে আয়।
: এই বলটা আমার না স্যার, তপুর।
: তোর হাতে কেন?
: ও আমাকে দিয়েছিল খেলতে।
: উহ! আর পারি না তোদের নিয়ে, বাহাদুর...। ডাক পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেত হাতে বাহাদুর হাজির স্যারের পেছনে। স্যারের হাতে সদ্য কিনে আনা বেত, রোদের স্পর্শে চকচক করছে। না ভুল হলো, সীমান্তকে দেখে দাঁত বের করে হাঁসছে। বেতের এই ঠাট্টা সহ্য হয় না সীমান্তের।
: কান ধর। কথাটা কানে আসামাত্র দুই হাতে কান ধরে সীমান্ত।
: আমার সঙ্গে বল আর কখনো ক্লাসের সময় খেলব না, মিথ্যার রাজা হওয়ার চেষ্টাও করব না। ক্লাসে যা। ফের যদি কখনো দেখি...।
কিছুক্ষণ পরই মতিয়র স্যার ক্লাস নিতে আসেন। চুপ করে বসে থাকতে দেখে স্যার জিজ্ঞেস করেন, কী রে কী হয়েছে তোর? কোনো উত্তর নেই সীমান্তের। রাগে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না সীমান্তের। অথচ মতিয়র স্যারকে কাছে পেলে সীমান্ত বকবক করতে থাকে। কত প্রশ্ন স্যারের কাছে। শেষে বিরক্ত হয়ে স্যার ধমক দিয়ে বলেন, আবার কথা বললে ক্লাস থেকে বের করে দেব। তবুও সীমান্ত থামে না, কারণ সে জানে স্যার তাকে অনেক আদর করেন। কিন্তু এখন স্যারের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। স্যার কতবার জিজ্ঞেস করল। শেষ পর্যন্ত তপুই সব খুলে বলল স্যারকে। তপুটা যেন কেমন, সারাক্ষণ মনে হয় অন্যের ব্যাপারে কথা বলার জন্য মুখ হাঁ করে বসে থাকে। সীমান্তকে কাছে ডেকে মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে দিল স্যার। এমন আদুরে স্পর্শে স্যারকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। স্বাভাবিক হয়ে যখন নিজের জায়গায় গিয়ে বসল সীমান্ত, কী লজ্জা! মাথা তোলাই দায়।
: তোদের আমরা খুব শাসন করি, না? স্যারের কথা শুনে মাথা তোলে সীমান্ত। খুব শাসন করি! কী কারণে করি, কখনো ভেবেছিস তোরা?
কী কঠিন কঠিন কথা। এই রাতের বেলাও কথাগুলো সীমান্তের মাথার ভেতর এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ স্কুলে গিয়েই মনে মনে টাইগার স্যারকে খুঁজছে সীমান্ত। বাহাদুর ভাইয়ের কাছে জেনেছে স্যারের অসুখ হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল সীমান্তের। জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে রইল। জানালার বাইরে অনেকখানি জায়গাজুড়ে বাঁশঝাড়, সেদিকে দৃষ্টি সীমান্তের। বাঁশঝাড়ের মাথায় আকাশ কালো হয়ে আছে। সীমান্ত জানে আকাশ কালো হয় মেঘেদের কারণে। নীল আকাশে মেঘ যখন জমাট বাঁধে তখন দেখতে কালো হয়, বৃষ্টি নামে। দাদু বলে, ওটা আকাশের কান্না। দাদু যেন কী! আকাশ কি মানুষের মতো যে কাঁদবে? প্রশ্নটা নিজেকে করেই চমকে উঠল। যেন কোনো কিছু মনে পড়ে গেল। সত্যিই কিছু তো মিল রয়েছে, দুঃখ জমে কান্না হয় আর মেঘ জমে বৃষ্টি। ক্লাসরুমের কোলাহলকে ছড়িয়ে যায় সীমান্তের ভাবনা। ঠিক করে আর কখনো স্যারদের ওপর রাগ করবে না। সীমান্তের এই ভাবনাও পাথরে রূপ নেয়। আজ বিকেলেই স্কুল ছুটির পর টাইগার স্যারকে দেখতে যাবে সীমান্ত।
: এই দেখ পকেটে বল নিয়ে এসেছি।
: সর্বনাশ! কী করেছিস তুই, টাইগার স্যার যদি বুঝতে পারে আর রক্ষা নেই তোর।
সীমান্ত মথুরাপুর পাবলিক হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। স্কুলটা অনেক সুন্দর। অনেক বড় মাঠ। মাঠে গিয়ে খেলতে ইচ্ছে করছে সীমান্তের, কিন্তু পারছে না টাইগার স্যারের জন্য। টাইগার স্যার হচ্ছে স্কুলের সবচেয়ে রাগী স্যার। ভীষণ রাগী বলেই নাম হয়েছে টাইগার। স্যারের আসল নাম রমেশ চন্দ্র বর্মণ ‘টাইগার স্যার’ নামের আড়ালেই চলে গেছে।
: চল না সীমান্ত, প্লিজ। স্কুল ছুটির পর তোকে অনেক পেয়ারা পেড়ে দেব।
: সত্যিই তো?
: সত্যিই-ই-ই। তপু জানে তার বন্ধুটিকে কীভাবে বশ করতে হয়। দুজনেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল মাঠে। কিন্তু মাঠে এসে সীমান্তের চোখ কপালে ঠেকেছে। অনেকেই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে মাঠে খেলছে। বড় ক্লাসের ভাইয়ারাও! কী মজা! আহা স্কুলটা যদি এমন হতো। বড়রা নারকেলগাছে হেলান দিয়ে গল্প করছে। কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ খেলছে।
: মিস করলি তো?
: এত জোরে মারলে ধরা যায়? মাঠের মাঝখানে চলে গেছে তো।
: যা নিয়ে আয় এখন। তুই মিস করেছিস তোকেই আনতে হবে।
বল আনতে গিয়ে পাখিগুলোকে দেখছিল সীমান্ত। সব সময় দল বেঁধে থাকে কেন ওরা? কিন্তু এই ভাবনাকে ছাপিয়ে গেল একজনের কথা, বারান্দায় টাইগার স্যার। কথাটা কানে পৌঁছামাত্রই থমকে গেল সীমান্ত। পড়ি কি মরি সবাই দৌড়ে নিজ নিজ ক্লাসে ঢুকছে। আশপাশে তপুও নেই। ক্লাসের দিকে দৌড়াতে গিয়েই নিজের নামের হুংকার (সী..মা..ন্ত) কানে এসে পৌঁছাল। নারকেলগাছে একটা কাক বসে এতক্ষণ কা..কা..কা.. করছিল, সেও চুপ। মাঠের এক কোণে বাঁধা সাদা গরুটা এতক্ষণ ঘাস খাচ্ছিল, এখন ঘাস খাওয়া বাদ দিয়ে সীমান্তের দিকে তাকিয়ে আছে। কাপড়ের কেডস পরা একজোড়া পা সীমান্তের সামনে এসে দাঁড়াল। কেডস জোড়া খুব চেনা, তবে কি...মাথা তুলতেই টাইগার স্যারের রাগী মুখ। উহ! কী ভয়ংকর লাগছে। স্যার কি জানে রেগে গেলে কী ভয়ংকর হয় দেখতে।
: কী করছিলি মাঠে?
: স্যার, পানি, না বাদাম...।
: চুপ কর মিথ্যার রাজা। হাতে কী?
: কিছু না স্যার।
: উহ! আবার মিথ্যা কথা। দুই হাত সামনে নিয়ে আয়।
: এই বলটা আমার না স্যার, তপুর।
: তোর হাতে কেন?
: ও আমাকে দিয়েছিল খেলতে।
: উহ! আর পারি না তোদের নিয়ে, বাহাদুর...। ডাক পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেত হাতে বাহাদুর হাজির স্যারের পেছনে। স্যারের হাতে সদ্য কিনে আনা বেত, রোদের স্পর্শে চকচক করছে। না ভুল হলো, সীমান্তকে দেখে দাঁত বের করে হাঁসছে। বেতের এই ঠাট্টা সহ্য হয় না সীমান্তের।
: কান ধর। কথাটা কানে আসামাত্র দুই হাতে কান ধরে সীমান্ত।
: আমার সঙ্গে বল আর কখনো ক্লাসের সময় খেলব না, মিথ্যার রাজা হওয়ার চেষ্টাও করব না। ক্লাসে যা। ফের যদি কখনো দেখি...।
কিছুক্ষণ পরই মতিয়র স্যার ক্লাস নিতে আসেন। চুপ করে বসে থাকতে দেখে স্যার জিজ্ঞেস করেন, কী রে কী হয়েছে তোর? কোনো উত্তর নেই সীমান্তের। রাগে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না সীমান্তের। অথচ মতিয়র স্যারকে কাছে পেলে সীমান্ত বকবক করতে থাকে। কত প্রশ্ন স্যারের কাছে। শেষে বিরক্ত হয়ে স্যার ধমক দিয়ে বলেন, আবার কথা বললে ক্লাস থেকে বের করে দেব। তবুও সীমান্ত থামে না, কারণ সে জানে স্যার তাকে অনেক আদর করেন। কিন্তু এখন স্যারের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। স্যার কতবার জিজ্ঞেস করল। শেষ পর্যন্ত তপুই সব খুলে বলল স্যারকে। তপুটা যেন কেমন, সারাক্ষণ মনে হয় অন্যের ব্যাপারে কথা বলার জন্য মুখ হাঁ করে বসে থাকে। সীমান্তকে কাছে ডেকে মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে দিল স্যার। এমন আদুরে স্পর্শে স্যারকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। স্বাভাবিক হয়ে যখন নিজের জায়গায় গিয়ে বসল সীমান্ত, কী লজ্জা! মাথা তোলাই দায়।
: তোদের আমরা খুব শাসন করি, না? স্যারের কথা শুনে মাথা তোলে সীমান্ত। খুব শাসন করি! কী কারণে করি, কখনো ভেবেছিস তোরা?
কী কঠিন কঠিন কথা। এই রাতের বেলাও কথাগুলো সীমান্তের মাথার ভেতর এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ স্কুলে গিয়েই মনে মনে টাইগার স্যারকে খুঁজছে সীমান্ত। বাহাদুর ভাইয়ের কাছে জেনেছে স্যারের অসুখ হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল সীমান্তের। জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে রইল। জানালার বাইরে অনেকখানি জায়গাজুড়ে বাঁশঝাড়, সেদিকে দৃষ্টি সীমান্তের। বাঁশঝাড়ের মাথায় আকাশ কালো হয়ে আছে। সীমান্ত জানে আকাশ কালো হয় মেঘেদের কারণে। নীল আকাশে মেঘ যখন জমাট বাঁধে তখন দেখতে কালো হয়, বৃষ্টি নামে। দাদু বলে, ওটা আকাশের কান্না। দাদু যেন কী! আকাশ কি মানুষের মতো যে কাঁদবে? প্রশ্নটা নিজেকে করেই চমকে উঠল। যেন কোনো কিছু মনে পড়ে গেল। সত্যিই কিছু তো মিল রয়েছে, দুঃখ জমে কান্না হয় আর মেঘ জমে বৃষ্টি। ক্লাসরুমের কোলাহলকে ছড়িয়ে যায় সীমান্তের ভাবনা। ঠিক করে আর কখনো স্যারদের ওপর রাগ করবে না। সীমান্তের এই ভাবনাও পাথরে রূপ নেয়। আজ বিকেলেই স্কুল ছুটির পর টাইগার স্যারকে দেখতে যাবে সীমান্ত।
No comments